গল্প-কবিতা

সেলিনা হোসেনের গল্প ‘যুদ্ধ জয়’

সেলিনা হোসেন

হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বারান্দার শেষ মাথায় নিয়ে আসে মাসুদ। এখন ভরদুপুর, চারদিক নিঝুম। রান্নাঘরে বাবুর্চিদের সাড়াশব্দও নেই। এখানকার বাকি সবাই ঘুমুচ্ছে। ওর ঘুম কম, রাতে এবং দিনে। বারান্দার এই কোণা থেকে অনবরত ছুটে চলা মানুষ এবং যানবাহন দেখে ও। দেখতে ভালো লাগে, আপাতত এটাই ওর প্রিয় দৃশ্য। যুদ্ধেও সময়ে ছিল অন্য রকম, বুলেটবিদ্ধ শুত্রুর লাশ ছিল ও প্রিয়। এখন সেসব কিছু ভাবতে ভালো লাগে না। ওর খুব ইচ্ছে সেই সোনালি সময়টা বুকের কৌটোয় খুব যত্ন করে রেখে দিতে, কিন্তু পাওে না, কখনো অুনযোগ করে, নিজেদের অন্ধকারময় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ন, বিরক্ত হয়ে ওঠে, তখন ও চুপচাপ থাকে। অন্যমনস্ক হবার ভান করে, এক সময়ে নিঃশব্দে সরে আসে। নইলে চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নিজের ওপর আক্রোশ বাড়ে। মনে পড়ে বাবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, মা-র ব্যথিত বিষণ্ন চাউনি।
কাজের ছেলে মন্টু এসে পাশে দাঁড়ায়, ঘুমাইবেন না স্যার? নারে ঘুম আসে না।
আপনে এক্কেবারে কম ঘুমান।
মাসুদ কথা বলে না। মন্টু বেশ চটপটে, হাসিখুশি ছেলে। সবার সঙ্গেই ওর খাতির। মন্টুর অহঙ্কার, ও যাদের সঙ্গে কাজ করে তারা সবাই যুদ্ধ করেছিল। মাসুদ নিজেও শুনেছে মন্টু অনেকের কাছে এদের গল্প করতে ভালবাসে। আগ বাড়িয়ে অনেক বেশি গল্প করে, যার মধ্যে অনেকটাই ওর বানানো। ওকে নিষেধ করলে শোনে না। এখন ওরা সবাই এটা মেনে নিয়েছে, মন্টুর আনন্দটুকু নষ্ট করতে চায় না।
মন্টু আমার কোনো চিঠি আসেনি?
অহনো পিয়ন আহে নাই।
আর আসা-না -আসা-
আপনের চিঠি অ্যাতো কম আহে ক্যান স্যার?
আমার বাবা আমার উপর খুব রেগে আছে। সেজন্য লেখে না।
ক্যান রাগ ক্যান?
দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, এখন পঙ্গু হয়ে রইলাম, কি লাভ হল? সেজন্য বাবার খুব রাগ।
কন কি স্যার?
মন্টুর বিস্মিত কণ্ঠে মাসুদের ক্লান্তি আসে। হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে থামে। মাসখানেক পরই ও হাঁটতে পারবে। এই হুইল চেয়ারটা একদম অসহ্য। মন্টু পানি এনে দিলে এক চুমুকে খেয়ে শেষ করে। এতক্ষণ বুকটা কেমন শুকনো লাগছিল।
বিকেল নামতে শুরু করেছে। এক-দু’য়ে জেগে উঠেছে বাকিরা। মাসুদের পাশে এসে থামে শুকুরের হুইল চেয়ার। শুকুর হাত বাড়িয়ে ওর কাঁদে হাত রাখে। ম্লান হাসি ঠোঁটের কোণে।
কেমন আছ?
ভালো।
মাসুদ ঘাড় কাত করে। শুকুরের জন্য ওর বুকের ভেতর একটা স্থায়ী কষ্ট আছে। শুকুর কাছে এলে সেটা আরো দ্বিগুণ হয়।
আজ এমন চুপচাপ যে?
ভালো লাগছে না কিছু।
মাসুদ চেয়ার ঘুরিয়ে শুকুরের মুখোমুখি হয়।
আমরা যুদ্ধ করেছিলাম কেন শুকুর?
নিজেকে এসব প্রশ্ন করতে নেই মাসুদ।
তুমি নির্বিকার থাকতে পারো, আমি পারি না। আমার খুব কষ্ট হয়, তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
ডাক্তার তোমাকের উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে।
এই পঙ্গু, বিষণ্ন , জরাজীর্ণ জীবনটার জন্য কি যুদ্ধ করেছিলাম?
মাসুদের কণ্ঠ খাদে নেমে যায়। মন্টু ওদের চা-বিস্কুট এনে দেয়। পুরো বিস্কুট মুখে পুরে লম্বা টানে চুমুক দেয় শুকুর। মাসুদ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। চা কেমন তেতো লাগে। শুকুরের পিঠের একটা অংশ উচুঁ হয়ে আছে। ওখানে একটা বুলেট আছে, আজো বের করা হয়নি। সিলেটের কমলগঞ্জ থানায় শুকুর চার নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয় শেলের আঘাতে। তারিখটা ছিল তেরই নভেম্বর। শুকুরের কিছু মনে নেই। জ্ঞান হবার পর জেনেছে শরীরের নিচের অংশে কোনো অনুভূতি নেই, একদম অচল। একটুও কান্না পায়নি শুকুরের, বুকে তখনো অনেক স্বপ্ন ছিল। এখনো খুব সহজে মচকায় না, অথচ নিজের অজান্তে হয় ওে পেশাব-পায়খানা। আজ সাত বছর শুকুর ব্লাডারে পেশাব করে। মাসুদের চা খাওয়া হয় না, ঠান্ডা হয়ে গেছে। বিস্কুট বিস্বাদ, মন্টুর হাতে কাপ তুলে দেয়।

মাসুদ চেয়ার নিয়ে ঘরে আসে, বিছানার কাছে থামে, কী করবে বুঝতে পারে না। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। শুকুর অন্যদের সঙ্গে কথা বলছে, ওর জোরালো কণ্ঠ মাসুদের কানে ভেসে আসে। ওরা দশজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা এই বাড়িতে থাকে, যুদ্ধের পর ওদের জন্য এই ব্যবস্থা হয়েছে, চিকিৎসা এবং থাকা-খাওয়া। ওদের জন্য কি আরো কিছু করা যেত না? মাসুদের মনে হয় এই বাড়িটার ওপর অনবরত শুকনো পাতা ঝরে, আস্তে আস্তে এটা তলিয়ে যাবে, কোনো দিন কেউ আর ওদের কথা মনে রাখবে না। এই সাত বছরে ওর বাবার উদ্বিগ্নতা অনেক কমে এসেছে, এখন বছরে একবার দেখতেও আসে না, কুষ্টিয়া থেকে আসতে অনেক খরচ। চিঠি লেখাও কমে এসেছে। ও কার কাছে মনের কথা বলবে? মসুদ কাল রাতের অর্ধেক –পড়া উপণ্যাসটা পড়ার চেষ্টা করে, পারে না। বুকে কি একটু ব্যথা হচ্ছে, নাকি মন খারাপ? যুদ্ধে ওর হার্টেও একটা ভালব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গত সাত বছর ও হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাটিয়েছে। এবছরই বিদেশ থেকে ফিরেছে, অপারেশন করে ওর হার্টে বসানো হয়েছে কৃত্রিম ভালব । বুকে কানে পাতলে এই ভালবের জোরালো ধুকধুক আওয়াজ শোনা যায়। স্বাধীনতার মতো এই শব্দটুকু ওর বাড়তি লাভ। মাসুদ হো-হো হেসে ওঠে । তোফাজ্জল পাশের বিছানা থেকে হৈ চৈ করে ওঠে।
কী হল হাসছ কেন?
একটা কথা মনে হল।
বল না শুনি।
তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।
বলই না, যদি মন ভালো হয়। সন্ধ্যা থেকে খুব খারাপ লাগছে।
মাসুদ তোফাজ্জলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাঙা চোয়াল, উচুঁ দাঁত, ধবধবে গায়ের রঙ, তোফাজ্জল দুর্দান্ত যোদ্ধা ছিল। ভয় কাকে বলে জানত না। ওরা সাত ভাই যুদ্ধ করেছে, একজন শহীদ হয়েছে, বাকি পাঁচজন চাকরি, করছে, কোনোমতে দিন ঠেলে চলা আর কি। মাঝে মাঝে তোফাজ্জলকে দেখতে আসে। চুপ করে আছ কেন মাসুদ?
বলার কিছু নেই। কেবলই মনে হয় দেশের জন্য যুদ্ধ মানে কি এমন নিদারুণ নির্বাসন।
মাসুদ, কাউকে ভালবাসতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে।
ঠিক বলেছ, আমারও।
মাসুদের চোখ উজ্জ্বল হয়।
কিন্তু কে আমাদের ভালবাসবে?
দেশে কি এমন কোনো নারী নেই?
কে জানে।
দু’জনে আবার চুপ করে যায়। অকস্মাৎ সমস্ত শব্দ উধাও। ধূসর শীতার্ত সময় হামা দিয়ে এগিয়ে আসছে, ওরা সেই গহ্বরের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
হা- হা করে হেসে ওঠে তোফাজ্জল।
শালা আমি একটা বেকুব, আমার তো শালা দু’টো পা নেই। আমি কি দিবাস্বপ্ন দেখছি মাসুদ?
না।
মাসুদ চিৎকার করে ওঠে।
আমরা ভালবাসা চাই, ঘর চাই, সন্তান চাই।
হা-হা করে হাসে তোফাজ্জল। সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ঘরে। মাসুদের চিৎকার পৌঁছে যায় ওদের সকলের কানে। কান পেতে শোনে শুকুর, সিরাজুল, মুফাখখার, বাদল আরো অনেকে। সেই সঙ্গে শোনে তোফাজ্জলের ঠা-ঠা হাসি। হাসি আর থামে না। সবার চোখের কোণ ভিজে ওঠে। এক সময়ে তোফাজ্জলের হাসি থেমে যায়।
তোমার এখনো সময় আছে মাসুদ, আর কদিন পর হাঁটতে পারবে। তোমাকে দেখলে মনে হয় না যে বুকের একটা ভালব নষ্ট হয়ে গেছে। চমৎকার স্বাস্থ্য তোমার। তুমি কারো ভালবাসা পেতে পারো। কিন্তু এভাবে থাকতে থাকতে আমি একদিন পাগল হয়ে যাব।
তুমি থামো তোফাজ্জল।
থেমেই তো আছি, জ্বলে ওঠার শক্তি কি আর আছে?
তোফাজ্জলের বুকভরা নিঃশ্বাস বাকিরা শুনতে পায়। ঘরের আবহাওয়া থমথমে। মাসুদ চেয়ার ছেড়ে বিছানায় ওঠে। চিৎপাত শুয়ে ঘরের ছাদ দেখে, সাদা এবং শূন্য। ডাক্তার তার রিপোর্টে বলেছে, ও কোনো কাজ করার উপযুক্ত নয়। বেশি ছুটোছুটি নিষেধ। কিন্তু আমাকে কাজ করতে হবে, আমি এত সহজে জীবনকে ছেড়ে দেবো না। আরো দেখব, অনেক দেখব। আমি তো জানতাম স্বাধীনতা একটা দাঁতাল শুয়োর। কেড়ে নেয় জীবনের বাকি দিনগুলোর আলো- বাতাস, রোদ-বৃষ্টি। তবু আমি তার জন্য লড়েছি এবং জিতেছি। আমি পরাজিত হতে চাইনা।
ও বিছানায় উঠে বসে। উত্তেজিত হলে বুক কেমন চেপে আসে। মনে হয় নিঃশ্বাসের পথে কোথায় কী যেন আটকে আছে। পায়ে মশা কামড়াচ্ছে। বাড়িটা স্যাঁতসেঁতে বলে মশা বেশি। মন্টু চিৎকার করে গান করছে, শুনতে ভালোই লাগে। এতোগুলো পঙ্গু ও অথর্ব লোকের মধ্যে ও আশ্চর্য সজীব, প্রফুল্ল। ওর বাবা, মা কবে মরেছিল, কী হয়েছিল জানে না। এর ওর আশ্রয়ে থেকে বড় হয়েছে, কিন্তু তাতেও দমেনি, সেসব নিয়ে ও ভাবেও না। ভালবাসার জন্য ওর কোনো ব্যাকুলতা নেই। অথচ এত বয়সেও মা-ও কথা ভাবলে মাসুদের বুক কেমন খালি হয়ে যায়। ও হঠাৎ চিৎকার করে ওকে ডাকে।
মন্টু ! মন্টু!
জ্বি।
ও দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।
এক গ্লাস পানি।
মাসুদ একটু থমকে থেমে বলে। ও কি আসলে পানি চাইছিল, না অন্য কিছু। কী করবে বুঝতে পারে না, কী করা যায়, কী করা দরকার। ও তোফাজ্জলকে দেখে। বালিশে মুখ চেপে শুয়ে আছে তোফাজ্জল, নির্ভীক, দুর্ধর্ষ সাহসী- কেউ ওকে পিছু হটতে দেখেনি।
তোফাজ্জল বলত, বুলেট কখনো পিঠে নেব না, নিলে এই কলজেয়।
স্যার পানি?
থাক, খাব না।
ক্যান?
তুই আমাকে কড়া করে চা খাওয়া।
আজিজ চাচা রানতাছে চুলা খালি নাই।
চুপ, এক্ষুনি নিয়ে আয়। নইলে সব ভেঙে ফেলব।
মাসুদের অসহিষ্ণু কণ্ঠের ধমকে মন্টু চলে যায়। ওর জেদ বাগে। ইদানীং ওদের দিকে তেমন খেয়াল রাখা হচ্ছে না। এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধটাও পাওয়া যায় না। কত যে কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঘেন্না ধরে গেল। সাত বছরেই ওদের গায়ে শ্যাওলা পড়ে নোনা ধরে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও মন্টু চা নিয়ে আসে না। মাসুদের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। বুঝতে পারে বাবুর্চি সময়ের বাইরে ওকে এক কাপ চা দিতে রাজি নয়।
মন্টু! মন্টু!
মাসুদের অস্বাভাবিক চিৎকারে হকচকিয়ে যায় ঘরের সবাই।
জ্বি স্যার।
তোকে চা দিতে বললাম না?
মন্টু কিছু বলার আগেই মাসুদ খাট থেকে লাফিয়ে নেমে ওর চুলের মুঠি ধরে। কথা বললে কথা শোনা হয় না, বেয়াদব। আজ তোকে মেরেই ফেলব।
মন্টুকে দমাদম কয়েক ঘা লাগায়
বাবুর্চিকেও আজ খুন করব।
মাসুদ মন্টুকে ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে পড়ে যায়। বুকে অসম্ভব ব্যথা। কিছু একটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, কিন্তু পায় না। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়।
কয়দিন ওকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে ও জানে না। জ্ঞান ফেরার পরে দেখল নার্স মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। ডাক্তার মিনুকে বলে দিয়েছে মাসুদের একটু বিশেষ যত্ন নিতে।
কেমন লাগছে?
খুব ভালো।
চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
ও নিশ্চিত-নির্ভাবনায় চোখ বোজেঁ, যেন শরীরের কোথাও অসুখ নেই। বুকের ভেতরের যন্ত্রগুলো সবই তো ঠিক আছে, অথচ ওর কোনো যন্ত্রনা নেই। ঘুরেফিরে মনে হয় মিনু একদম নার্সের মতো নয়, কোথায় যেন শ্রী আছে, যা শুধু গৃহের নিরিবিলি সুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। যত্তোসব, নিজের ওপর রাগ হয়। এইসব আবেগে হৃদয় প্লাবিত হয়ে গেলে মেজাজ খিচে ওঠে, শরীর ঝিম ধরে থাকে। মিনু কাছে এলে কিছুটা সময় ভালো লাগে, নইলে হাসপাতালের দিনগুলো ক্লান্তিকর, নোনাধরা। মাসুদ জানালার ফাঁকে নারকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে নীল আকাশ দেখে, ধূসর হয়ে আসে দৃষ্টি।
কাউকে ভালবাসার মতো কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুদ্ধে চলে গেছে। ভালবাসার আগে যুদ্ধ, যুদ্ধের পরে ভালবাসা। নিয়মের ব্যতিক্রম হয় বলেই তো এমন বুকভরা তৃষ্ণা, কেবলই নোনাজল, তৃপ্তি হয় না। ভালবাসার আগে যুদ্ধ হলে এবং য্দ্ধু মাশুল উঠিয়ে নিলে ভালবাসার আর মুখ ফেরায় না। মাসুদের বুকের ভেতর দুপদাপ, একটা বাড়তি শব্দ সব সময়ে ওকে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ও উঠে এসে বারান্দায় রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়ায়। রাস্তায় মানুষ দেখতে দেখতে ছোটবেলার ঘরগেরস্থির কথা মনে পড়ে, যেখানে মা ছিল, ধান ছিল, চুলোয় আগুন ছিল। এখন আমি নারী চাই, ধান চাই, আগুন চাই। বুকে ব্যথা বাড়ে। ও আবারও বেডে ফিরে আসে।
মিনু কাছে এসে দাঁড়ায়।
ঘুমুচ্ছেন না যে?
ঘুম আসে না।
এমন করলে শরীর খারাপ করবে।
যুদ্ধে যেদিন আহত হয়েছি তারপর থেকে ডাক্তারের উপদেশ শুনতে এই এতটা বছর পেরিয়ে এলাম্ এখন তেতো লাগে। প্লিজ অন্য কথা বলুন, অন্য কিছু।
মিনু বিব্রত হয়ে যায়। মাসুদের ব্যাকুল দৃষ্টি উপেক্ষা করেই বলে, আমি তো এসবই শিখেছি।
এগুলো তো জীবিকার কথা, আপনার নিজের কিছু কথা নেই, একদম ব্যক্তিগত?
আপনি ঘুমুবার চেষ্টা করুন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
মাসুদ মুখ ফিরিয়ে নেয়। রক্তের গোঁয়ার্তুমি থামাতে কষ্ট হয়। মিনু মন্টু হলে হয়তো দমাদম কয়েকটা লাগিয়ে দিত। ইদানীং এমনই হচ্ছে।
মাস দুয়েক গড়িয়ে গেছে। মিনু এখন অনেক সহজ। কখনো হাসি-তামাশা করে। রাতের ডিউটি থাকলে বিছানার কাছে এসে বসে, কপালে হাত রেখে ঘুমুতে বলে । মাসুদের বুক ভরে যায়, একটু অনু রকম লাগে। তখন তোফাজ্জলের কথা মনে করে চোখের কোণ চিকচিকিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে মিনুর হাত ধরতে। পারে না। অনেক পরে বলে, ডাক্তার আমাকে কবে ছুটি দেবে?
বোধ হয় দিন সাতেক পরে।
কাল হয় না।
কেন? যদি আবার অসুখ বাড়ে।
আর যদি কখনো অসুস্থ হই তা হলে নিজে নিজেই মরব। কোনো ডাক্তার না, হাসপাতালা না, কারো কাছেই সাহায্যের জন্য হাত বাড়াব না।
গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বললে মিনু চমকে ওঠে, কণ্ঠ একটু অন্য রকম, ভারী, যুদ্ধে যাবার সংকল্প মতোই দৃঢ়প্রত্যয়ী।
আমি জানি আমি বেশিদিন বাঁচব না। সাতাশ বছর বয়স এদেশের জন্য অনেক। বাপ-মা’র সুখের ঘরগেরস্থি দেখেছি, যুদ্ধ দেখেছি, স্বাধীনতা দেখেছি, স্বাধীনতার পর এই সাত বছর দেখলাম, এখন আমার না-বাঁচলে চলে। আর দেখার কিইবা আছে?
মাসুদের বিষণ্ন হাসি মিনুকে চাবুক মারে, রাগে বিদ্রুপাত্মক চাবুক। ও মাসুদের চোখের দিকে চাইতে পারে না। কেবলই মনে হয়, এক জীবনে মাসুদ অনেক দেখেছে। ওর কিছুই দেখা হয়নি। পঁচিশ বছর এমনিই কেটে গেল। মাসুদের দিকে হাত বাড়ালে হয় না?
আমি আর ঐ খোঁয়াড়ে ফিরে যাব না। কাজ করব, মানুষের ভিড়ে মিশে যাব। মুক্তিযোদ্ধা নামের বিশেষ চিহ্ন নিয়ে আর বাঁচতে চাই না। এখন ঐ খোঁয়াড় থেকে পালানোই আমার জন্য জরুরি।
মিনু কথা বলতে পারে না। এত গভীর, ভারী অথচ বুক-নিংড়ানো কথা ও কখনো শোনেনি। কেমন এক শূন্যতা বুকের কোঠাবাড়িতে হা-হা করে। গলার কাছ কষ্ট আটকে থাকে। মাসুদ বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। বড় ইচ্ছে করে মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে চোখে চোখ রাখতে। একটু আগেও কেমন বিষণ্ন উদাস কণ্ঠ ছিল মাসুদের, যেন নদীর ওপার থেকে ডাকছে। ভাবতে কষ্ট হয় যে, এই ছেলে দেশের স্বাধীনতার জন্য ঘর থেকে পালিয়েছিল। ও চুলে হাত রেখে গভীর স্বরে ডাকে, ঘুমিয়েছ?
মাসুদ মাথা ওঠায়। মিনুর কণ্ঠ বুকের বাড়তি শব্দ দু’টো থামিয়ে দিতে চায়।
ঘুম এলে তো বেঁচে যেতাম।
আহ তুমি এমন করে কথা বল যে বুক তোলপাড় করে ওঠে।
না, থাক, ভালো লাগছে না।
ও আবার বালিশে মুখ গোঁজে। ভয় হয়, এত কাছ থেকে মিনু যদি আবার পালিয়ে যায়। আশ্চর্য শীতল হয়ে গেছে অনুভূতি। বড় প্রাপ্তির আশায় সাময়িক সুখটুকু তুলে রাখতে চায়। বুকে কেমন ব্যথা হচ্ছে। মিনুকে বলা যাবে না। এখন শুয়ে থাকাটাই জরুরি। মিনু ওর কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করে, মাসুদ কিছু বলে না। ওর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মিনুর বার বার মনে হয় বুকের ভালব নষ্ট হয়ে গেলেও এখনো জ্বলে ওঠার মতো সাহস ওর আছে। ও যে কয় দিন বাঁচবে মাথা উঁচু করেই বাঁচবে। এমন একজন মানুষই তো ও খুঁজছিল। মাসুদ যে কয়দিন বাঁচুক, ঝুঁকিটা ও নেবেই। কেউ ওকে কোনো দিন ভালবাসার কথা বলেনি, ওর নিজেরও সুযোগ হয়নি। আজ নিজ থেকেই মাসুদের কাছে যেচে দাঁড়াবে। মিনু নির্ভার হয়ে কাজ চলে যায়।

আগামীকাল মাসুদের ছুটি হবে। গত তিন-চার দিন মিনুর আগ্রহকেও জোর করে উপেক্ষা করেছে, একটি কথাও বলেনি। ও চায় না মিনু শুধু ওর জীবনে এক রক্তক্ষয়ী স্মৃতি হোক, কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক। তার চাইতে মিনু সময় নিক, বুঝে দেখুক। যুদ্ধ করা ছেলেরা এত তাড়াতাড়ি আবেগকে প্রশ্রয় দেয় না। মাসুদ সারা দিন খাটে শুয়ে থাকে। কেবলই যুদ্ধের কথা মনে হয়। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ-সেও তো এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা! ভালবাসাকেও যুদ্ধের মতো জয় করতে হয় এই বোধে আক্রান্ত হয়ে আছে আজ কয় দিন। তবু মুখ খোলে না। কেবলই মিনুর যন্ত্রণা দেখে। সকালে ও আসেনি। আজ ওর নাইট ডিউটি।
বিকেলের নার্সের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেবার পর মিনু একটুক্ষণের জন্য বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
তুমি আমাকে কিছু বললে না যে?
মাসুদ চোখে চোখ রেখে হাসে।
কী বলব?
ওর দু’চোখে স্থিত প্রশান্তি। আবেগ প্রকাশের ভাষা নেই।
কিছু বলবে না ? এই যে তোমাকে তুমি করে বলেছি।
মাসুদ চুপ করে থাকে। মিনু আরো কাছে আসুক, আকাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে। মিনুর চোখের পাতা কাঁপে। মাসুদ ওকে দেখছে না, মুখ নিচু, মাথা ভর্তি চুল কপালে লুটোয়।
ঠিক আছে কিছু বলতে হবে না।
মিনু ক্ষুণ্ন হয়ে টেবিলে ফিরে যায়। ইনজেকশনের সিরিজ নাড়াচাড়া করে, এখন অনেক কাজ। সাদা পোশাক-পরা ব্যস্ত মিনুর পিছু পিছু মাসুদের দৃষ্টি ফেরে, ও এখন মাসুদের ঠিক আকাঙ্খিত ভূখন্ড-স্বাধীন এবং শ্যামল সবুজ।
দশটার পর ওয়ার্ডের বাতি বন্ধ করে দিয়ে মিনু যখন মাসুদের বেডের কাছে এসে দাঁড়ায়, ও কপালের ওপর হাত রেখে শুয়েছিল, চোখ ঢাকা।
টেবিলে খাবার পড়ে আছে। মিনু কপাল থেকে হাত সরায়।
খাওনি যে?
ইচ্ছে হচ্ছিল না।
মিনু কথা না বলে প্লেটে ভাত মাখিয়ে মাসুদের মুখের কাছে ধরে। ও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়।
দেখছ কী? আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
না।
হ্যাঁ, এখন থেকে আমি রোজ তোমাকে খাইয়ে দেবো।
আমি কাল চলে যাচ্ছি।
তাতে কী? তবু আমি তোমাকে খাইয়ে দেবো।
কেমন করে?
আমাদের ঘরে বসে।
এতোক্ষণে মাসুদ ওর হাত চেপে ধরে।
সত্যি মিনু আমাদের ঘর হবে?
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
বিশ্বাস করতে ভয় হয়।
তোমার সাহস আছে তুমি সব যুদ্ধেই জিতে যাও। তোমাকে আামার ভীষণ হিংসে হয় মাসুদ।
মাসুদ মিনুর কথা শোনো না, মনে হয় প্রচন্ড গোলাগুলির পর বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসা শত্রুুমুক্ত মানুষ এখন ও, কামালপুর সীমান্ত দিয়ে স্বাধীন দেশে ঢুকছে।
মিনু ওর মুখে ভাতের গ্রাস তুলে দেয়।

Related Articles

Back to top button