হুমায়ুন কবির হিমু’র উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’এর শেষ পর্ব
জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।
পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হচ্ছে । আজ রইল উপন্যাসের শেষ পর্ব
এই রিকশা শাহাবাগ যাবে?
রিকশাওয়ালা রাজি হলো। জাকিয়া রিকশা ভাড়া ঠিক না করেই রিকশায় উঠে বসল। আজ জাকিয়ার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের দিন। আজ জাকিয়ার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ জাকিয়া তার মনের গহিনে আনিসের জন্য লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা আনিসের কাছে প্রকাশ করবে। তাই আজ তার কাছে যে যা-ই চাইবে, তা-ই তাকে দিয়ে দেয়া হবে। আজকের দিনে জাকিয়া কারো মনে কোনো কষ্ট দিবে না। তাই জাকিয়া ভাড়া ঠিক না করেই রিকশায় উঠে বসল। মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগের রিকশা ভাড়া সর্বোচ্চ ষাট টাকা হতে পারে। কিন্তু রিকশাওয়ালা যদি আজ জাকিয়ার কাছে পাঁচশ’ টাকাও ভাড়া চায় তাতেও জাকিয়ার আপত্তি নেই। কারণ জাকিয়া আজ তার ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য আনিসের কাছে যাচ্ছে। গতকালই জাকিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আনিসের জন্য তার মনের গহিনে যে স্থান তৈরি হয়েছে, আনিসের জন্য যে তার মনে ভয়াবহ রকমের ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে, তা যদি আর কিছুদিন জাকিয়া তার মনের মাঝে লুকিয়ে রাখে তাহলে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। তাছাড়া জাকিয়া কয়েক দিন থেকে আনিসকে নিয়ে একটু চিন্তিত। আনিস কয়েক দিন থেকে কেয়াকেও পড়াতে আসছে না। কেয়ার কাছে জাকিয়া শুনেছিল যে আনিস বরিশালে তার বন্ধুর বিয়েতে গেছে। তাই পড়াতে আসতে পারছে না। কিন্তু সেটার বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। গতকাল ছিল শুক্রবার। গতকাল আনিসের পড়াতে আসার কথা ছিল। জাকিয়া অনেক আশা নিয়ে আনিসের জন্য অপেক্ষা করেছে। দুপুরে জাকিয়া ঠিকমতো খেতেও পারেনি। খাবার টেবিলে বসে জাকিয়া চুপচাপ শুধু ভাতের প্লেট নাড়াচাড়া করেছে। কিন্তু ভাত মুখে তুলেনি। ফরহাদ সাহেব তার মেয়ের এই অবস্থা দেখে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছে, কি রে মা, তুই তো কিছু খাচ্ছিস না! শুধু ভাতের প্লেট নাড়াচাড়া করছিস। তোর কি কিছু হয়েছে জাকিয়া?
না তো বাবা! তেমন কিছু না। এমনিতেই একটা বিষয়ে চিন্তা করছিলাম।
আমাকে কি বলা যায় রে মা?
কেন বলা যাবে না বাবা, অবশ্যই বলা যাবে। অফিসের একটা বিষয়। তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। এই কথা বলে জাকিয়া কয়েকটি গ্রাস মুখে তুলে বলে, খেতে ইচ্ছে করছে না বাবা, আমি উঠলাম মা। তোমরা খাও, আমার একটা জরুরি ফোন করতে হবে।
এই কথা বলে জাকিয়া খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে তার রুমে চলে গেল। সুকৌশলে জাকিয়া আনিসের বিষয়টি এড়িয়ে গেল। কিন্তু কেয়া সব বুঝতে পেরেছে। আনিস স্যার কয়েক দিন থেকে পড়াতে না আসার কারণে জাকিয়া আপা যে টেনশন করছে, কেয়া জাকিয়ার চোখে-মুখে তা দেখতে পেয়েছে।
জাকিয়ার মা শামীমা, জাকিয়াকে খুব তীক্ষè চোখে দেখেছে। কিছু বলেনি। শামীমা কেয়াকে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে যে জাকিয়ার কিছু হয়েছে কি না। কেয়া কিছু জানে কি না। কিন্তু কেয়া সরাসরি বলেছে সে এমন কিছু জানে না। এই ব্যাপারে কেয়াকে আর কোনো প্রশ্ন শামীমা করেনি।
খাওয়া শেষ করে কেয়া জাকিয়ার রুমে যেয়ে জাকিয়াকে ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। কোনো নড়াচড়া না করে স্থিরভাবে জানালার রড ধরে জাকিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের বাতাসে শুধুমাত্র জাকিয়ার চুল উড়ছে। জাকিয়াকে দেখে একটা মূর্তি মতো মনে হচ্ছে।
কেয়া জাকিয়ার পিছনে যেয়ে ডাকল, এই আপা, তোর কী হয়েছে? ঠিক মতো খেলিও না। তুই কি কোনো কারণে আপসেট আপা?
জাকিয়া তার ছোট বোন কেয়ার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে যেমন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। কেয়া যে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কিছু প্রশ্ন করেছে জাকিয়া মনে হয় তা শুনতে পায়নি।
কেয়া এবার একটু জোরে জাকিয়াকে বলল, এই আপা, তুই কি আমার কথা শুনতে পারছিস না?
এবার জাকিয়া জানালা থেকে ঘুরে কেয়াকে দেখতে পেয়ে চোখের জল মুছার চেষ্টা করল।
কেয়া অবাক হয়ে বলল, আপা! তুই কি কাঁদছিলি নাকি? কী হয়েছে তোর? তুই কাঁদছিস কেন?
জাকিয়া কেয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি আর পারছি না রে কেয়া। আমি আর চেপে রাখতে পারছি না। আনিসকে আমি আমার মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি রে। আমি নিজের সাথে নিজে অনেক যুদ্ধ করেছি। আমি চেষ্টা করেছি বহুবার আমার অবস্থান থেকে ফিরে আসতে। কিন্তু আমি আনিসের অনেক কাছে চলে গেছি। সেখান থেকে আমার আর ফেরার রাস্তা নেই। আমার সমস্ত অন্তর জুড়ে আনিস রয়েছে। আনিসকে আমি কোনোভাবেই মন থেকে সরাতে পারছি না। আনিসকে ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয় রে কেয়া। তুই তো কিছুটা হলেও জানিস। আমি কয়েক দিন থেকে অনেক টেনশনে আছি। আজ কয়েক দিন থেকে আনিস তোকে পড়াতে আসছে না। তুই আনিসের যে নাম্বারটা আমাকে দিয়েছিলি, গতকাল আমি সেটাতে ট্রাই করেছিলাম। কিন্তু বন্ধ পেয়েছি। আনিসের কিছু হয়নি তো কেয়া! আমি খুব টেনশন ফিল করছি।
আপা, তুমি তোমার ভালোবাসার কথা স্যারকে বলে দাও। আমার ধারণা স্যারও হয়তো মনে মনে তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তোমার মতো স্যার হয়তো দ্বিধায় আছে। স্যার কয়েক দিন থেকে আসছে না সেটা নিয়ে তো আমিও টেনশনে আছি। আমার সামনে পরীক্ষা, স্যার সেটা ভালো করেই জানে। এই অবস্থায় স্যার কেন আসছে না বুঝতে পারছি না। স্যারের মনে হয় কিছু একটা হয়েছে। আপা, একটা কাজ করো, আমার কাছে আনিস স্যারের মেসের ঠিকানা আছে। তুমি স্যারের খোঁজ নেয়ার জন্য যাও। আর এই সুযোগে তুমি তোমার মনের কথাটাও স্যারকে বলে দিও। কি যাবে নাকি?
আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
অবশ্যই ঠিক হবে। একটা কাজ করো, চলো আমিও তোমার সাথে যাই।
তুই যাবি?
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বরং একাই যাও। কারণ আমি থাকলে তোমাদের দুজনের মাঝে আমি কাবাবমে হাড্ডি হয়ে থাকব। সেটা তোমাদের জন্য খুব একটা মঙ্গলজনক হবে না। যাওয়ার সময় আগে শাহবাগ থেকে কিছু ভালো দেখে ফুল নিয়ে যেও। সম্ভব হলে বেলী আর বকুল ফুল নিয়ে যেও। আমি স্যারের কাছে শুনেছি, বেলী আর বকুল হচ্ছে স্যারের প্রিয় ফুল।
তুই তোর স্যারের অনেক কিছুই জানিস দেখছি! জাকিয়া কেয়ার কথায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তুই তাহলে বলছিস আনিসের মেসে যাওয়ার জন্য!
বলছি মানে, অবশ্যই বলছি। আমার একমাত্র বোন যে কিনা বলিউডের কাজলের চেয়ে কিউট সে কিনা মনে মনে একজনকে ভালোবেসে কষ্ট পাবে? তাই কি হয় বলো আপু?
কাজল না ছাই। আমি দেখতে তেমন সুন্দর না।
কে বলেছে আপু, তুমি অনেক সুন্দর। তোমার মতো এত সুন্দর মুখের মেয়ে আমি খুব একটা দেখিনি। আনিস স্যারের ভাগ্য বলতে হবে যে তোমার মতো এত সুন্দর একটা বউ পাবে।
কেয়ার মুখে বউ শব্দটি শুনে জাকিয়ার মুখ লাল হয়ে গেল। ছোট বোনকে শাসনের সুরে বলল, অনেক হয়েছে। খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা শিখেছিস। তুই ঠিকানা বের কর। কাল সকালেই যাব। বলে তারা ঘুমোতে গেল।
পরদিন সকালে জাকিয়া আনিসের মেসে যাওয়ার জন্য জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। জাকিয়া যখন ওয়াশ রুম থেকে তৈরি হয়ে বের হলো, কেয়া অবাক বিস্ময় নিয়ে জাকিয়াকে দেখতে লাগল। কেয়ার চোখে যেন পলক পড়ছে না। কি রে, এইভাবে কী দেখছিস? তুই কি আমাকে আজই প্রথম দেখছিস নাকি?
আপা, নীল শাড়িতে তোমাকে যে কী অসম্ভব সুন্দর লাগছে, যা তোমাকে ভাষায় বুঝাতে পারব না। এই অবস্থায় তোমাকে দেখে শুধু আনিস স্যার কেন, স্বয়ং শাহরুখ খান দেখলেও তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।
তুই থামবি। আমি এমনিতেই অনেক ফুলে আছি, আমাকে আর ফুলানোর দরকার নেই। আমার শাহরুখ খানের প্রয়োজন নেই। আমার আনিসকে হলেই চলবে। কই ঠিকানাটা দে। রাত গিয়ে সকাল হলো, এখনো ঠিকানাটা দিলি না। কেয়ার কাছে আনিসের মেসের ঠিকানা নিয়ে কয়েকবার ঠিকানাটা ভালো করে দেখে নিল। আনিসের জন্য নিউ মার্কেট থেকে কিনে আনা ফতুয়ার ব্যাগটি সাথে নিয়ে কেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় কেয়া জাকিয়ার মাথায় হাত রেখে তার মুখে একটু ফুঁ দিয়ে দিল।
তুই আমার মুখে ফুঁ দিলি কেন?
আপা, কারো যেন নজর না লাগে আর তুমি তোমার লক্ষ্যে যেন পৌঁছাতে পারো তার জন্য তোমাকে দোয়া দিয়ে দিলাম।
জাকিয়া কেয়াকে জড়িয়ে ধরে কেয়াকে একটু আদর করে তার ঘর থেকে বের হতেই বসার রুমে বাবা-মায়ের সামনে পড়ল। ফরহাদ সাহেব আর শামীমা অবাক হয়ে তাদের বড় মেয়ে জাকিয়াকে দেখছে। জাকিয়া অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মা, আমি আমার এক বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি। আসতে একটু দেরি হতে পারে।
ফরহাদ সাহেব বলল, জাকিয়া, তুই আমার কাছে একটু আয় তো মা।
জাকিয়া তার বাবার কাছে এগিয়ে গেল। ফরহাদ সাহেব জাকিয়ার মাথায় হাত রেখে কেয়ার মতোই একটি ফুঁ দিয়ে দিল। তুই এমনিতেই অনেক সুন্দর রে মা। আজ তোকে রাজরানির মতো সুন্দর লাগছে। শামীমা, তুমি তোমার মেয়েকে দেখেছ, কেমন রাজরানির মতো লাগছে!
শামীমা জাকিয়াকে ভালো করে দেখে বলল, নীল শাড়িতে তোকে আসলেই অনেক সুন্দর লাগছে। আসলেই আমার মেয়েটা অনেক সুন্দর।
মা-বাবার কাছে এই কথা শুনে জাকিয়ার চোখে পানি চলে এলো।
এই দ্যাখো, আপা সুন্দর করে সেজেগুজে তার বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে যাবে আর তোমরা দুজন মিলে আপাকে কাঁদিয়ে দিলে। কেয়া বাবা-মাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল।
জাকিয়া তার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি অনেক সৌভাগ্যবতী যে আমি তোমাদের মতো বাবা-মা পেয়েছি। এই কথা বলে জাকিয়া আবার কাঁদতে শুরু করল।
ফরহাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, দ্যাখো পাগল মেয়ের কা-। এত সুন্দর করে সেজে কেউ কাঁদে নাকি রে! তোর চোখের কাজল নষ্ট হয়ে যাবে।
শামীমা বলল, হয়েছে আর কাঁদতে হবে না। যেখানেই যাস, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরিস। ঢাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। এখানে দিনদুপুরে ছিনতাই-রাহাজানি হয়। সাবধানে যাস আর সাবধানে ফিরিস। শামীমা তার মেয়েকে তার বাবার মতো দোয়া পড়ে জাকিয়ার মাথায় ফুঁ দিয়ে দিল।
শাহবাগ থেকে জাকিয়া আনিসের পছন্দের বেলী আর বকুল ফুলের মালা কিনে একটা সিএনজি ঠিক করল মিরপুর-১৪ যাওয়ার জন্য। সিএনজি উঠে বসার পর থেকে জাকিয়ার মনে অন্য রকম একটা শিহরণ কাজ করছে। অন্য রকম একটা সুখানুভূতি জাকিয়াকে আচ্ছন্ন করে রাখল। আনিসের সাথে দেখা হওয়ার পর জাকিয়া কী বলবে? কীভাবে তাকে ফুলের মালাগুলো দিবে? কীভাবে জাকিয়া আনিসকে তার ভালোবাসার কথা বলবে? এই সব নানান কথা জাকিয়া সিএনজি বসে ভাবতে লাগল। জাকিয়া ধীরে ধীরে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল।
দরজায় কলিংবেল টিপতেই আনিস দরজা খুলে অবাক চোখে জাকিয়াকে দেখতে লাগল। আনিস তার জীবনে এতটা অবাক কখনো হয়নি, যা কিনা আজ জাকিয়াকে দেখে হলো। সে স্বপ্ন দেখছে না তো? আনিস নিজের শরীরে একটা চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো যে সে যা তার চোখের সামনে দেখছে তা স্বপ্ন নয় বাস্তব। জাকিয়াকে সে অনেক বার দেখেছে। তার সাথে কয়েকবার কথাও হয়েছে, কিন্তু তার সামনে এখন যে জাকিয়া দাঁড়িয়ে আছে তা এই জগতের কেউ না। এই জাকিয়া অন্য কোনো ভুবন থেকে আসা। আনিস চোখ বড় বড় করে জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
কী ব্যাপার, আপনি এইভাবে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আর আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমাকে কি ভিতরে আসতে বলবেন না?
জাকিয়ার কথায় আনিস যেন জ্ঞান ফিরে পেল। এতক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় শুধু চোখ ভরে জাকিয়াকে দেখছে। আনিস নিজেকে সামলে নিয়ে একটু লজ্জিত হয়ে বলল, সে কি, তা কেন? আসুন ভিতরে আসুন।
মেসে আর কেউ নেই?
এখন নেই। আমি ছাড়াও আরো কয়েকজন এখানে থাকে। আমার বন্ধু আশরাফুল আর আমি এক রুমে থাকি। বাকি দুই রুমে আরো চারজন থাকে। আনিস জাকিয়াকে বসার রুমে বসতে দিয়ে বলল, আপনাকে যে কী খেতে দেই। ঘরে ড্রাই কেক আছে, আপনি ড্রাই কেক খান তো?
আমি শুধু ড্রাই কেক না ভিজা কেকও খাই। সেসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি আমার সামনে বসেন। আচ্ছা, আপনি কয়েক দিন থেকে কেয়াকে পড়াতে যাচ্ছেন কেন বলেন তো? সামনে কেয়ার পরীক্ষা। এই সময় কেউ কি পড়ানোর জন্য না যেয়ে পারে? কেয়া কত টেনশন করছে। ওর টেনশন দূর করার জন্যই আমাকে আপনার এখানে আসতে হলো। আপনার কিছু হয়েছে কি না তা দেখার জন্য এখানে আসা। এখন বলুন তো, আপনার কী হয়েছে? জাকিয়া বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলে গেল।
আনিস দুই চোখ ভরে জাকিয়াকে দেখছে। আজ জাকিয়া এত সুন্দর করে সেজেছে কেন? আজ জাকিয়াকে আনিসের কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি তার সামনে বসে আছে। জাকিয়ার কোনো কথাই আনিসের কানে যাচ্ছে না। আনিস শুধু মন-প্রাণ ভরে জাকিয়াকে দেখছে।
জাকিয়া আনিসকে অবাক করে দিয়ে আনিসের হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কী হলো। আমি কী বলছি তা কি আপনি শুনতে পারছেন?
আনিস জাকিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, শুধু কি কেয়ার টেনশন দূর করার জন্য আপনি এখানে এসেছেন? আর কিছু না?
আনিসের কথায় জাকিয়ার অন্তর কেঁপে উঠল। আনিসের কথায় জাকিয়া মাথা নিচু করে বসে রইল। তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবে কি আনিস তার মনের কথা আগে থেকেই জানে! না জানলে কীভাবে আনিস এই কথা বলল?
কী হলো, শুধু কি কেয়া একাই টেনশন করছে? আপনি করছেন না?
জাকিয়া আনিসের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। আনিস সাহস করে জাকিয়ার একটি হাত ছুঁয়ে বলল, আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন। আমিও যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই পছন্দ করেছি। আপনাকে আমি আমার মনের অজান্তে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি তা আমি নিজেও টের পাইনি। অনেক বার ভেবেছি আপনাকে আমার মনের কথাটি বলল। কিন্তু সাহস হয়নি। ভয়ে বলতে পারিনি।
জাকিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কিসের ভয়?
আপনাকে হারানোর ভয়। যদি আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন, সেই ভয়ে আপনাকে বলার সাহস হয়নি।
আমিও আপনাকে মনে মনে অনেক ভালোবাসি আনিস। আমিও অনেক বার আপনাকে বলতে চেয়েছি কিন্তু বলতে পারিনি লজ্জায়।
কিসের লজ্জা?
যদি আপনি আমাকে ভুল বুঝেন, সেই লজ্জায়।
আনিস দুই হাত দিয়ে জাকিয়ার মুখটি আলতো করে তুলে ধরে তার মুখের সামনে আনল। জাকিয়ার চোখে চোখ রেখে আনিস ঘোরলাগা চোখে জাকিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এইভাবে কী দেখছেন?
তোমাকে।
কেন, আমাকে এর আগে দেখেননি?
দেখেছি, কিন্তু এত সুন্দরভাবে কখনো দেখিনি। আমি পরির গল্প শুনেছি। শুনেছি পরিরা নাকি অনেক সুন্দর। কিন্তু আমার ধারণা, আমার জাকিয়ার সামনে আজ পরিদের সবচেয়ে যে সুন্দরী পরি আছে সেও কাজের বুয়া টাইপের হয়ে যাবে।
আনিসের মুখে এই কথা শুনে জাকিয়া তার সেই ভুবন দুলানো হাসি
হেসে উঠল।
কী হয়েছে আপা, আপনি হাসছেন কেন? কোনো সমস্যা আপা? সিএনজি ড্রাইভারের কথায় জাকিয়ার ঘোর কেটে গেল। জাকিয়া অবাক হয়ে দেখল, সে সিএনজিতে বসে আছে। তার মানে এতক্ষণ জাকিয়া সিএনজিতে বসে বসে স্বপ্ন দেখছিল। জাকিয়া নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেল। আনিসের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সিএনজি মিরপুর-১৪-এর কাছে চলে এসেছে জাকিয়া তা বুঝতে পারেনি।
সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জাকিয়া আনিসের মেসের ঠিকানা অনুযায়ী আনিসের বাসার কাছে যেয়ে হাজির হলো। বাসার কাছে যেয়ে একজনকে বলল, ভাই, এই বাসায় কি আনিস সাহেব থাকেন?
আনিস সাহেব থাকে কি না জানি না। তবে এই বাসার তিনতলায় কয়েকজন ছেলে মেস করে থাকে।
জাকিয়া লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা বাসাটির তিনতলায় উঠে বাসার কলিংবেল টিপল। দরজা খুলে দিল আনিসের বন্ধু আশরাফুল। আশরাফুল দরজা খুলে একটু ধাক্কা খেল। অনেকটা অবাক হয়ে আশরাফুল জিজ্ঞাস করল, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না? আপনি কার কাছে এসেছেন?
এখানে কি আনিস সাহেব থাকেন?
জি থাকেন। আমি আশরাফুল। আনিসের ছোটবেলার বন্ধু। আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? প্লিজ ভিতরে আসুন।
মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনে রিপন, জাহিদ, মনোয়ারও বসার ঘরে চলে এলো।
জাকিয়া বলল, আমি কেয়া মানে আনিস সাহেবের ছাত্রীর বড় বোন। আমার নাম জাকিয়া। আনিস সাহেব কি বাসায় নেই?
রিপন বলল, কেন ম্যাডাম আপনারা জানেন না? আনিস আপনাদের জানায়নি?
জাকিয়ার বুকটা এক অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠল। কী জানায়নি আনিস?
জাকিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে আশরাফুল বলল, গত পরশু আনিসের বিয়ে হয়েছে তার মামাতো বোন তাহিতির সাথে। আনিসের একটা ভালো সরকারি চাকরি হয়েছে। অবশ্য চাকরিটা আনিসের মামাই জোগাড় করে দিয়েছে। আনিস অনেকটা বাধ্য হয়েই বিয়েতে মত দিয়েছে। আনিসের মা আর বোনও ঢাকায় এসেছে। আনিসের তো আপনাদের বাসায় ফোন করে জানানোর কথা। আপনারা তাহলে জানেন না?
জাকিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। জাকিয়া আর স্থির থাকতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কিন্তু এইখানে আনিসের মেসে কোনো ঘটনা ঘটলে জাকিয়ার জন্য তা হবে অনেক লজ্জার। জাকিয়া নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে কোনোমতে মুখে একটি অবাক আর বিস্ময়ের ভাব নিয়ে বলল, আনিস সাহেবের বিয়ে হয়ে গেছে? কই আনিস সাহেব তো জানাল না? কয়েক দিন থেকে কেয়াকে পড়াতে আসছে না। তাই ভাবলাম উনার আবার অসুখ-বিসুখ হলো কি না। আচ্ছা আপনাদের সাথে কি আনিস সাহেবের দেখা হবে?
আশরাফুল বলল, আমার সাথে দেখা হবে। কেন বলুন তো?
তেমন কিছু না। আনিস সাহেবের সাথে দেখা হলে এই প্যাকেটটা আর এই ফুলগুলো দিয়ে দিবেন। বলবেন তার ছাত্রী তাকে দিয়েছে। আর উনাকে আমার হয়ে বিয়ের শুভেচ্ছা দিয়ে দিবেন কেমন? আমি এখন আসি। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। এই কথা বলে জাকিয়া আনিসের মেস থেকে বের
হয়ে এলো।
তিনতলা থেকে নামতে জাকিয়ার মনে হলো, সে তিনতলা নয় হাজার তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। সিঁড়ি যেন আর ফুরোয় না। জাকিয়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাসার বাইরে এসে দাঁড়াতেই জাকিয়া দেখল সমস্ত আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। জাকিয়ার মনের অজান্তেই তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
একটি রিকশা এসে জাকিয়ার সামনে দাঁড়াল, আপা কই যাবেন?
জাকিয়া নির্বিকারভাবে হেঁটে চলেছে। তার মাথায় কিছুই কাজ করছে না। জাকিয়া কোনো রিকশা বা সিএনজিতে না উঠে একা একা হাঁটতে লাগল। আনিসের মেস থেকে একটু হেঁটে যেতেই আকাশ ভেঙে ঝড়ো বাতাসসহ
ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে জাকিয়া কোথাও আশ্রয় না
নিয়ে বৃষ্টির পানি আর ঝড়ো বাতাস উপেক্ষা করে হাঁটতে লাগল। পথের মানুষগুলো জাকিয়াকে অবাক চোখে দেখতে লাগল। মুহূর্তের মাঝে জাকিয়ার জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মুর্হর্তের মাঝেই শেষ গেল জাকিয়ার স্বপ্ন, জাকিয়ার ভালোবাসা।
আকাশ ভেঙে আজ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ সারা দুনিয়া ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঘন ঘন আকাশ চমকাচ্ছে। ভয়ংকর শব্দ করে কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলো। জাকিয়ার তাতেও কোনো ভাবান্তর হলো না। জাকিয়া বৃষ্টিতে ভিজে আকাশের বিদ্যুৎ চমকানো উপেক্ষা করে হেঁটে চলেছে। সে জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। তার গন্তব্য কোথায়। তার সমস্ত হিতাহিত জ্ঞান মুহূর্তের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। আকাশ যেমন অন্ধকার হয়ে পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিয়েছে ঠিক তেমনি জাকিয়ার মনের মাঝে, জাকিয়ার জীবনে আজ সমস্ত কিছুই অন্ধকার হয়ে গেছে। জাকিয়ার কাছ থেকে একটু দূরেই প্রচ- শব্দে একটি বজ্রপাত হলো। জাকিয়া তাতেও নির্বিকার।
আচ্ছা কারো উপর বজ্রপাত পড়লে নাকি তার শরীরের ভিতর দিয়ে দশ লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে যায়। যার ফলে ঘটনাস্থলেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সে সেখানেই মারা যায়। কিন্তু একজন মানুষের মনে যখন বজ্রপাত আঘাত হানে তাহলে তার মনের ভিতর দিয়ে কত লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়? জাকিয়ার মনে যে বজ্রপাত আঘাত হেনেছে, জাকিয়ার মনের ভিতর দিয়ে কত লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়েছে তা পরিমাপ করার যন্ত্র কি পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পেরেছে?
বি.দ্র. : কাউকে ভালোবাসলে যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করাই উত্তম। তা না-হলে জাকিয়ার মতো আপনারও অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।)