কানিজ কাদীরের স্মৃতি কথা- ‘বিবর্ণ সময়ের কিছু স্মৃতি’
Time and tide wait for none.
সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। জীবন একটা বহতা নদীর মতো। শুধু সামনের দিকে বয়ে চলাই জীবনের কাজ। প্রকৃতির নিয়মে মানুষকে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বৃদ্ধকাল পাড়ি দিতে হয়। এই তো প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির এই নিয়মে আমরা সবাই কিছু বিবর্ণ সময় পিছন ফেলে আসি। সময় বিবর্ণ হয় ঠিকই কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো কখনো বিবর্ণ হয় না। আনন্দ- বেদনার স্মৃতিগুলো মানুষকে নস্টালজিয়ায় ভরে তোলে, করে তোলে আবেগপ্রবণ। বিবর্ণ সময়ের স্মৃতিগুলো আমাকে প্রায়ই খুব নাড়া দেয়। সেই ছোট্টবেলা লাল জুতা মোজা পড়ে আব্বার হাত ধরে প্রথম স্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাসে প্রতি বছর প্রথম হয়ে ব্যাগ ভর্তি করে কত পুরস্কার নিয়ে বাসায় আসতাম। আম্মা গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর মেয়ে কত পুরস্কার নিয়ে বাসায় এসেছে। আনন্দের সীমা নেই। স্কুলে নাচলাম ‘নাচে ইরানী মেয়ে’। আরো কত গান গাইলাম। আম্মার সে কী আনন্দ, তাঁর মেয়ের গলা কী মিষ্টি! ক্লাস ফাইভে আমি ও ভাইজান ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলাম একই বছর। সে কী আনন্দ বাসায়! আমার পাঁচ ভাইবোনের সাথে মিষ্টি মধুর আনন্দ ও বেদনার কত স্মৃতি। আসলে বিবর্ণ সময়ের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে জীবনের পরতে পরতে। অল্প পরিসরে যা শেষ করা যাবে না। তবুও কিছু উল্লেখযোগ্য আনন্দ ও কষ্টের স্মৃতি বার বার মনে ভেসে উঠে। এমএমবিবিএস পাস করলাম। বাসায় ঢুকতেই আব্বা আম্মা আমাকে গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করলেন। মেয়ে ডাক্তার হয়েছে। তাদের সে কি গর্ব। আমি যেদিন এনেসথেসিওলজিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করলাম সে আনন্দ আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এমনি বিবর্ণ সময়ের নানা স্মৃতি মনকে করে তোলে আন্দোলিত। কিছু কথা কিছু স্মৃতি সব সময় নিজেরই থেকে যায়। যা কাউকেই মন খুলে বলা যায় না। তারপর আমার বিবাহিত জীবন, প্রথম সন্তান লাভের স্মৃতি আমার জীবনে এক পরম পাওয়া। তেমনি একটি সন্তান জন্ম লাভের পরই তার মৃত্যুর করুণ স্মৃতিও আমাকে কষ্ট দেয় খুবই। আবার আমি যখন একটি সুন্দর পুত্র সন্তান লাভ করি আমার মনে হয়েছে আল্লাহ আমাকে একটি বেহেশতের ফুল উপহার দিয়েছেন। আমার ছেলের সেন্ট জোসেফ স্কুলে চান্স পাওয়া ও মেয়ের এসএসসিতে ভালো রেজাল্টের পর খুশিতে-আনন্দে আমি একেবারে কেঁদেই ফেলেছিলাম। দুই বছর আগে আমার বাবার মৃত্যু ও অল্পবয়সী ভাতিজার ক্যান্সারে মৃত্যুবরণের করুণ স্মৃতি আমাকে খুবই কষ্ট দেয়। এমনি কত না বেদনা ও আনন্দের কাব্য নিয়েই তো মানুষের জীবন। আমার মা সারাদিন উনার জীবনের নানা রং-বেরঙের পাওয়া না পাওয়া স্মৃতি আওড়ান। মনে হয় মানুষ তার বিবর্ণ সময়ের স্মৃতি নিয়ে থাকতে পারে বলেই বেঁচে থাকে। যে সময় চলে যাচ্ছে তাই বিবর্ণ সময়, তাই বিবর্ণ হয়ে যায়। আমাদের সবাইর উচিত প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করা ও সুন্দরভাবে কাজে লাগানো।
১৩ নভেম্বর, ২০০৭