গল্প-কবিতা

হুমায়ুন কবির হিমু’র উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’ (৩য় পর্ব)

জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ‌‌’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।
পাঠকদের জন্য আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হবে ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়। আজ রইল উপন্যাসের (৩য় পর্ব)

কেয়া চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসে আছে। প্রায় বিশ মিনিটের মতো হয়েছে আনিস কেয়াকে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে আছে, কিন্তু কেয়া কোনো কথা বলেনি। শুধু আনিস যা করতে বলেছে কেয়া তা-ই করে যাচ্ছে। আনিস তাকে বলেছে ইংরেজি বইটি নিয়ে বসার জন্য, কেয়া তাই করেছে। আনিস বলেছে, আজ ইংরেজি গ্রামার, ন্যারেশন নিয়ে আলোচনা করব।
কেয়া শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েছে, কিন্তু কোনো কথা বলে নাই। কেয়া ইংরেজি গ্রামার বইটি খুলে চুপচাপ বসে আছে। কিছু বলছে না। আনিস কেয়াকে অবজার্ব করার চেষ্টা করছে। আনিস ঠিক বুঝতে পারছে না কেয়া এমন চুপচাপ বসে আছে কেন।
তোমার কি শরীর খারাপ কেয়া?
কেয়া মাথা নাড়িয়ে না বলল।
তাহলে তুমি চুপচাপ বসে আছ কেন? বাসায় কি কিছু হয়েছে?
কেয়া উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কী ব্যাপার, আমি তোমাকে প্রশ্ন করছি, তুমি তার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকলে তো আমি কিছু বুঝতে পারব না। পড়তে যদি ভালো না লাগে তাহলে বলো, আমি না-হয় আজকের মতো চলে যাই।
কেয়া তবুও কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকল। আনিস একটু বিরক্ত বোধ করতে লাগল। এমন সময় নাশতার ট্রে নিয়ে জাকিয়া কেয়ার ঘরে ঢুকল। আনিস দাঁড়িয়ে জাকিয়াকে সালাম দিল। জাকিয়া একটু লজ্জা পেয়ে গেল।
সেকি, আপনি দাঁড়ালেন কেন? বসেন বসেন প্লিজ। আর আমাকে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়ার দরকার নেই তো! আপনি ভালো আছেন আনিস সাহেব?
জি ম্যাডাম, ভালো আছি।
আনিসের মুখে ম্যাডাম শব্দটি শুনে জাকিয়া শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে জাকিয়া বলল, আপনি আমাকে ম্যাডাম বলছেন কেন? আমার নাম জাকিয়া। আপনার সাথে তো এর আগেও কথা হয়েছে।
তাহলে কী বলে ডাকব?
কেন, জাকিয়া বলে ডাকতে পারেন। আমি আপনার চেয়ে খুব একটা বড় হবো বলে আমার মনে হয় না। আমাকে আপনি জাকিয়া বলে ডাকতে পারেন।
জি আচ্ছা ম্যাডাম।
আবার ম্যাডাম!
জি!
আনিস একটু লজ্জাবোধ করতে লাগল। আনিস সাধারণত মেয়েদের সাথে খুব একটা ফ্রি হতে পারে না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লাইফে আনিসের তেমন মেয়ে বন্ধু ছিল না বললেই চলে। মেয়েরা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু আনিস তেমন তাদের সাথে ফ্রি হতে পারেনি। তাই আনিসের জীবনে কোনো মেয়ে বন্ধু হয়ে ওঠেনি। যেটুকু ছিল, তা শুধু পড়াশুনা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু না।
জাকিয়া বলল, আপনার ছাত্রীর পড়াশুনা কেমন চলছে? কি রে কেয়া তুই এমন মাথা নিচু করে বসে আছিস কেন?
আনিস বলল, আপনাদের বাসায় কি কিছু হয়েছে বা কেয়াকে কি কেউ কিছু বলেছে? পড়াতে আসার পর থেকে কেয়া খুব একটা কথা বলেনি। চুপচাপ বসে আছে। কিছু জিজ্ঞাস করলেও উত্তর দিচ্ছে না।
জাকিয়া আনিসের কথায় হেসে উত্তর দিল, জি হয়েছে। আজ আমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসার কথা ছিল, আমি বারণ করে দেয়ায় বাবা খুব রাগারাগি করেছে। এ নিয়ে মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। তাই আজকে বাসার অবস্থা বেশ থমথমে। বাবার ধারণা, আমার অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে। তাই এটা নিয়ে মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমি নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানানোর পর থেকে বাবা-মায়ের মাঝে এক প্রকার ঠান্ডা লড়াই চলছে। দুপুরের পর থেকে বাবা-মা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
আনিস চোখ বড় বড় করে জাকিয়ার কথা শুনছে। আজ জাকিয়াকে বেশ সুন্দর লাগছে। মনে হয় কিছুক্ষণ আগে জাকিয়া সেজেছে। শাড়ি পরেছে কালো রঙের। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে ব্লাউজ পরেছে কালো রঙের। হাতের চুড়িও কালো, তার সাথে মিল করে কপালে একটি বড় টিপ পরেছে। সব মিলিয়ে জাকিয়াকে আজ অসাধারণ লাগছে! এর আগেও জাকিয়াকে দেখেছে আনিস। তখন সালোয়ার-কামিজ পরা অবস্থায় দেখেছে। এই প্রথম শাড়ি পরা অবস্থায় দেখল। শ্যামলা মেয়েদের কালো রঙের কাপড়ে খুব একটা মানায় না বলেই আনিসের ধারণা ছিল। কিন্তু জাকিয়া আজ তার ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিল। এলো চুলে জাকিয়াকে আজ অন্য রকম লাগছে। কালো শাড়িতে জাকিয়াকে আজ অসাধারণ লাগছে। আনিসের মনে হচ্ছে, তার সামনে আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো শান্তির পায়রা দাঁড়িয়ে আছে।
কী ব্যাপার, আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
জাকিয়ার কথায় আনিসের চিন্তায় বাধা পড়ল। আনিস একটু লজ্জাবোধ করতে লাগল। নিজেকে নিজে একটু ধিক্কার দিল আনিস। ছিঃ ছিঃ, এই সব কী চিন্তা করছে সে! আনিসের কখনো কোনো মেয়েকে দেখে এমনটি হয়নি। এই প্রথম আনিসের এমন উপলব্ধি হলো।
তাহলে আজ বরং আমি যাই ম্যাডাম।
জাকিয়া বলল, আবার ম্যাডাম বলছেন কেন? আর যাবেন কেন? এই যা রে চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল, নিন, চা খান।
এতক্ষণ কেয়া চুপচাপ বসে ছিল। জাকিয়া আর আনিসের কথা শুনছিল। এই প্রথম কেয়া মুখ টিপে হাসতে লাগল।
আনিস অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার! তুমি এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলে, কোনো কথা বলছিলে না। এখন হাসতেছ কেন?
কেয়া কোনো উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কেয়ার হাসির কারণে আনিস আরো বিব্রত বোধ করতে লাগল। এমন সময় জাকিয়ার বাবা ফরহাদ সাহেবের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। কেয়ার নাম ধরে ফরহাদ সাহেব বলছেন, কেয়া, আমি একটু বাইরে গেলাম। আসতে একটু দেরি হবে।

কেয়া তার বাবার গলার আওয়াজ শুনে পড়ার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আনিস এখন আরো বিব্রত বোধ করতে লাগল। কারণ কেয়া না থাকায় জাকিয়া আর আনিস ছাড়া এই ঘরে আর কেউ নেই। আনিস মাথা নিচু করে বসে আছে। আনিসের এই অবস্থা দেখে জাকিয়া বেশ জোরেই একটু হেসে উঠল। আপনি মনে হয় বিব্রত বোধ করছেন। আর মনে মনে চিন্তা করছেন, আমি আপনার সাথে এত কথা বলছি কেন, তাই না? বিব্রত বোধ করার কিছু নেই। কয়েক দিন থেকেই আপনার সাথে কথা বলব বলব করে করা হয়ে উঠছে না। আমার ধারণা, আপনি মানুষ হিসাবে একজন ভালো মানুষ। আর আমি ভালো মানুষদের পছন্দ করি। বর্তমান যুগে আপনার মতো মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। এ যুগের ছেলেরা যা হয়, আপনি তাদের মতো নয়। তাই আপনার সাথে কথা বলতে আসলাম। কিছু মনে করবেন না। আমি আবার কথা না বলে থাকতে পারি না। আমার অতি কথায় বাবা-মা যেমন বিরক্ত ঠিক তেমনি আমার অফিসের কলিগরাও তাই। আপনি কি আমার কথায় বোর ফিল করছেন?
জি না।
আচ্ছা ঠিক আছে, আজ আর কথা বাড়াব না। আপনার সাথে আরেক দিন কথা বলব। আপনি কেয়াকে পড়াতে থাকুন। কেয়া, এই কেয়াÑ
কেয়াকে ডাকতে ডাকতে জাকিয়া ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় আনিস মুগ্ধ হয়ে জাকিয়ার পিছনে ছড়িয়ে দেয়া চুল দেখল। বাহ! মেয়েটির চুল তো অনেক বড়! সব কিছু মিলিয়ে জাকিয়াকে আজ অসাধারণ লাগল আনিসের। সুন্দর বলতে যা বুঝায় আনিসের কাছে জাকিয়াকে তাই মনে হলো। আনিস কেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

মিরপুরে আশরাফুলের মেসে ফিরতে ফিরতে আনিসের রাত নয়টা বেজে গেল। এর মধ্যে আশরাফুল আনিসকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে বললেও রাস্তায় জ্যামের কারণে আনিস তাড়াতাড়ি ফিরতে পারেনি। আশরাফুল আনিসকে জানিয়েছে, আজ মেসে ফিক্সড ডে’র আয়োজন করা হয়েছে। উন্নত মানের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হবে। খাওয়া-দাওয়ার পর হালকা কিছু পানিয়র আয়োজন আছে। রান্নাবান্নার ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। রান্না করবে নাকি মেসের সবচেয়ে দক্ষ কুক মি. শাহাদৎ। শাহাদৎ সাহেবের বাড়ি বরিশালের বাকের গঞ্জে। তার হাতের রান্না নাকি বাংলাদেশের সেরা কুক টমি মিয়াকে হার মানিয়ে দিবে। শাহাদৎ সাহেবের সাথে আনিসের কখনো কথা হয়নি। আশরাফুলের কাছে শুনেছে। মেসের অন্য চারজন হচ্ছে রিপন। রিপন সাহেবের বাড়ি কুমিল্লায়। মনোয়ার সাহেবের বাড়ি নোয়াখালী। জাহিদ সাহেবের বাড়ি গাজীপুরে। তাদের সাথেও আনিসের সেইভাবে পরিচয় হয়নি। শুধু হায়-হ্যাঁলো হয়েছে। কারণ তারা সবাই প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। সকালে বের হয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত হয় যায়। তাই তাদের সাথে আনিসের সেইভাবে আলাপচারিতা হয়ে ওঠেনি।
আনিস মেসে যাওয়া মাত্র আশরাফুল আনিসের উপর অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। তোকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি তাড়াতাড়ি ফিরার জন্য, আর তুই ফিরলি এখন! তোকে বলেছি যে আজ মেসে ভালো কিছুর আয়োজন করা হবে, তারপরেও তুই ফিরতে দেরি করলি! সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
আনিস আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, মামার বাসা থেকে বের হয়ে টিউশনি শেষ করে ফিরতে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল দোস্ত! তাছাড়া তোদের ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট তো আর আমাদের রংপুরের মতো ফাঁকা থাকে না। প্রচুর জ্যাম। কাজীপাড়া থেকে দশ নম্বর পর্যন্ত আসতেই জীবন বের হয়ে যায়! স্যরি দোস্ত, কিছু মনে করিস না। তুই যেভাবে আমার উপর রেগে রেগে কথা বলছিস, তাতে করে মনে হচ্ছে আমি ভীষণ অন্যায় কিছু করে ফেলেছি।
আরে ব্যাটা, তুই ভালো করেই জানিস যে আমি কাদের সাথে মেসে থাকি। একমাত্র আমিই মফিজ, বাকিগুলো তো মহাপ-িত! একজন বরিশালের, আরেকজন নোয়াখালীর আর অন্যজন ঢাকার অদূরের গাজীপুরের! এরা মানুষ হিসাবে ক্যামন হয় তোর জানা আছে?
কেন! তুই না এর আগে বললি তোর মেসমেটরা সবাই বেশ ভালো!
ভালো সবাই, কেউ খারাপ না। কিন্তু ওরা খুব চালাক প্রকৃতির হয়। তুই আগে আসতে পারলে তোকে ওদের সাথে সাথে রাখতাম। কারণ আমাদের দুইজনের চাঁদা বাবদ এক হাজার টাকা দিয়েছি। বাজার খরচ করেছে রিপন। রিপন হচ্ছে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চালাক। তুই তাড়াতাড়ি আসতে পারলে রিপনের সাথে তোকেও বাজারের দায়িত্ব দেয়া যেত। তুই ওর সাথে থাকলে রিপন খুব একটা চালাকি করতে পারত না। এখন দেখা যাবে, রিপন একটা লম্বা হিসাব দিয়ে দিবে। হয়তো বলবে, যা বাজেট করা হয়েছিল তা ফেল হয়ে গেছে। রিপনের পকেট থেকে আরো বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেছে। সবাই মিলে আবার তাকে টাকা দিতে হবে। যদিও আমি জানি রিপন এই আয়োজনে কোনো টাকাই খরচ করবে না। শালা চালাকের যম! যা হওয়ার হয়েছে। তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে। আমি দেখি ওদের কী অবস্থা।
আশরাফুলের রুমটি ফ্ল্যাটে ঢুকতে পড়াই আনিসের সাথে অন্য কারো দেখা হয়নি। ডাইনিং রুমটি ফ্ল্যাটের মাঝখানে।
আনিস ফ্রেশ হওয়ার জন্য সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। বাথরুম থেকে বের হতেই আনিস ডাইনিংরুম থেকে আশরাফুলের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। আশরাফুল গলার সাউন্ড বেশ উপরের স্কেলে নিয়ে যেয়ে বলছে, আরো টাকা লাগবে মানে! আরো টাকা লাগবে মানে কী? আমরা এখানে মানুষ হচ্ছি গিয়ে সর্বমোট ছয়জন। ছয়জনের খাওয়ার আয়োজন করতে সাত হাজার টাকা লাগে! আমরা সবাই এক হাজার করে টাকা দিয়েছি। আরো দুইশ’ টাকা করে দিতে হবে কেন?
রিপন সাহেবের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রিপন সাহেব বলছে, আশরাফুল সাহেব, আপনি অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা বলছেন। আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি বাজার করতে গিয়ে টাকা মেরে দিয়েছি! টাকা কেন বেশি লাগছে তার ব্যাখ্যা না শুনে আপনি এইভাবে উঁচুস্বরে কথা বলা শুরু করেছেন যে আমি বাজার করতে গিয়ে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। আপনি আমার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারেন না আশরাফুল সাহেব। নো, কোনোভাবেই বলতে পারেন না।
আনিস ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। আনিস চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে। সে কিছু বলছে না। কারণ, আনিস এই মেসে মেহমান। তার কথা বলা উচিত হবে না।
শাহাদৎ রান্নাঘর থেকে বের হয়ে রিপন আর আশরাফুলের উদ্দেশে বলল, ভাই আপনারা দয়া করে থামেন। এইভাবে চিল্লাচিল্লি করলে আমাদের সবাইকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবে। কেন ভুলে যান যে অনেক কষ্টে এই ফ্ল্যাটটি মেস হিসাবে পেয়েছি। এটা ফ্যামেলিদের বাসাবাড়ি। বাড়িওয়ালা খেপে গেলে আর রক্ষা নেই। তাহলে সবাইকে এই বাসা ছাড়তে হবে। প্লিজ, দয়া করে চুপ করেন। রিপন সাহেব, বাজারে কত কী খরচ হয়েছে, তার লিস্ট নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে?
অবশ্যই আছে। আলবাত আছে। রিপন এত বোকা ছেলে না। রিপন রংপুরের মফিজদের ভালো করেই চেনে।
রিপনের মুখ থেকে মফিজ শব্দটি শুনার পর আশরাফুল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। মফিজ মানে? আপনি আমাকে মফিজ বললেন! আপনার সাহস তো কম না। ব্যাটা নোয়াখাল্ল্যা কোথাকার। ঠিকমতো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না আর অন্যকে বলে কি না মফিজ!
কি আমি ঠিকমতো কথা বলতে পারি না! আমি পারি না! শাহাদৎ ভাই, এর কিছু একটা করেন, তা না-হলে কিন্তু মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!
আমি রিপন কিন্তু সহজ পাত্র না। আপনি এর বিচার না করলে ভয়াবহ কা- ঘটে যাবে!
জাহিদ সাহেব এতক্ষণ কোনো কথা বলছিল না। মনোয়ার সাহেবকে দেখা যাচ্ছে না। জাহিদ সাহেব রিপনকে বলল, রিপন ভাই, আপনার কিন্তু আশরাফুল ভাইকে মফিজ বলা ঠিক হয়নি। আপনি মফিজ না বললে আশরাফুল ভাই এত উত্তেজিত হতো না। যাক যা হওয়ার হয়েছে, এখন দয়া করে ঠান্ডা হোন। আপনার কাছে বাজারের হিসাব আছে। খাওয়া শেষে আপনি আপনার হিসাব দিয়ে দিবেন, তাহলে ঝামেলা চুকে যাবে। যদি টাকা সবাইকে দিতে হয় দিব। কিন্তু এইভাবে মেসের পরিবেশ নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না।
মনোয়ার সাহেব মনে হয় এতক্ষণ বাথরুমে ছিল। বাথরুম থেকে বের হয়ে মনোয়ার সাহেব বলল, কী সব ছোটলোকের মতো আচার-আচরণ শুরু করেছেন আপনারা? মেসটাকে তো আপনারা বস্তি বানিয়ে ফেলেছেন!
কথাগুলো মনোয়ার বলল রিপনের দিকে তাকিয়ে। তাতে রিপন এমনভাবে মনোয়ারের দিকে তাকাল যে মনোয়ার আর কথা বলার সাহস
করল না।
শাহাদৎ বলল, ভাই অনেক হয়েছে, রাতও বেড়ে যাচ্ছে। এখন বাজে প্রায় এগারোটা। দয়া করে সবাই ফ্রেশ হয়ে বসে পড়েন। রান্নার কাজ শেষ। খাওয়া শেষে সবাই আশরাফুল সাহেবের রুমে যাব। সেখানেই পানীয় পানের আয়োজন হবে। প্লিজ আর এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কইরেন না।
রিপন আর আশরাফুল এই নিয়ে আর কথা বাড়াল না। সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। সবই হাই ক্লাসের খাওয়া-দাওয়া। মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা, গরুর মাংসের তরকারি, ইলিশ মাছ ভাজা। কয়েক পদের ভর্তা। সবজি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। আনিস বেশ অবাক হলো এই ভেবে যে এত খাওয়ার আয়োজন শাহাদৎ সাহেব একাই করেছে!
আনিস বেশ অবাক হয়ে শাহাদতকে বলল, শাহাদৎ ভাই, আপনি সব খাবার একাই রান্না করেছেন? সর্বনাশ! আপনি তো বিশাল বড় মাপের রাঁধুনি ভাই! রান্নার যে ঘ্রাণ পাচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে রান্না বেশ মজাদার হবে।
আনিসের কথায় শাহাদৎ তেমন কিছু বলল না। সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার আগে রিপন আর আশরাফুলের হট্টগলের কারণে খাওয়ার পরিবেশটা একটু গুরুগম্ভীর হয়ে গেছে। তাই খাওয়া-দাওয়া পর্বটা অনেকটা নীরবেই হলো।
আশরাফুলের খাটের উপর সবাই গোল হয়ে বসেছে। এখন পানীয় পানের আয়োজন হবে। রিপন সাহেব একটা ব্যাগ থেকে একটা বড় আকারের বোতল বের করল। বোতলটি কাগজে মোড়ানো। বোতল থেকে কাগজের আবরণ খুলে যা দেখা গেল আনিস তা দেখে রীতিমতো অবাক না হয়ে পারল না! আনিস মনে করেছিল পানীয় পানের আয়োজনের মানে হচ্ছে কোক জাতীয় কিছু হবে। কিন্তু আনিস দেখল বোতলের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রাশিয়ান ভোদকা! তার মানে এরা সবাই এখন মদ খাবে! আনিস একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
আশরাফুল মনে হয় আনিসের মনের অবস্থা বুঝতে পারল। তাই আনিসের দিকে তাকিয়ে আশরাফুল বলল, আনিস তুই একটা কাজ কর, তোর এখানে থাকতে যদি খারাপ লাগে তাহলে অন্য রুমে যেয়ে টিভি দেখতে পারিস।
মনোয়ার বলল, কেন, আনিস সাহেব, আপনার এসব চলে না?
না, আমি কখনো খাইনি। আনিস অনেকটা লাজুক ভঙ্গিতে মনোয়ারের প্রশ্নের উত্তর দিল।
রিপন বলল, আরে বসেন, এক দিন খেলে কিচ্ছু হবে না।
জাহিদ আর শাহাদৎও আনিসকে বসার জন্য বলল।
আনিস বলল, না ঠিক আছে। আপনারা পানীয় পান করেন, আমি বরং টিভি দেখি।
সবাই একসঙ্গে বলল, ঠিক আছে, কোক আছে, আপনি বরং কোকের বোতল থেকে কোক ঢেলে খেতে পারেন।
আশরাফুল বলল, রাশিয়ান ভোদকা ঢাকায় পাওয়া যায়! আশরাফুল অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
রিপন বলল, অসম্ভবকে সম্ভব করাই রিপনের কাজ। খুব তো আমার সাথে ঝগড়া করলেন যে টাকা লাগবে কেন? এই এক বোতলের দামই নিয়েছে চার হাজার টাকা। তাও আবার চোরাই মাল বলে এত কম পেয়েছি। আমার এক বন্ধু এয়ারপোর্টে চাকরি করে। ও ম্যানেজ করে দিয়েছে।
আশরাফুলকে এখন অনেকটাই শান্ত মনে হচ্ছে। কারণ আশরাফুল এই লাইনে অনেক পুরাতন। আশরাফুল জানে কোন মদের দাম কত। তাই আর রিপনের কথার কোনো উত্তর সে দিল না।
সবার হাতে গ্লাস আছে। ভোদকা পরিবেশন করছে রিপন। অনেক বড় বোতল। একেকজনের কয়েক প্যাক করে হয়ে যাবে। আনিস কোকের বোতল থেকে কোক ঢেলে সবার পানীয় পান করার দৃশ্য দেখছে।
দুই প্যাক শেষ করার পর আশরাফুল বেশ উচ্চৈঃস্বরে হাসতে লাগল। রিপনকে উদ্দেশ করে বলল, স্যরি মেরি ইয়ার, তুই কিছু মনে করিস না। না বুঝে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেছি। মেরি জানে দোস্ত, মুঝে মাফ কার দো মেরি পেয়ারে।
আনিসসহ সবাই বুঝতে পারল, আশরাফুল মাল খেয়ে এখন পুরাই টাল অবস্থায় অবস্থান করছে। রিপন কিছু বলল না। শাহাদৎ ঝিম মেরে বসে আছে। জাহিদের অবস্থাও তাই। হঠাৎ মনোয়ার আশরাফুলের ঘরের আলমিরার সামনে দাঁড়িয়ে পরনের লুঙ্গি উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল!
এই দৃশ্য দেখে রিপন বলল, কী করেন মনোয়ার ভাই?
প্রস্রাব করব।
প্রস্রাব করবেন মানে! এইখানে কেন? বাথরুমে যান।
এইটাই তো বাথরুম!
আশরাফুল টাল হয়ে গেলেও মনে হয় কিছুটা ঠিক আছে। আশরাফুল মনোয়ারকে ধমক দিয়ে বলল, বাথরুম মানে! আমার ঘরটা আপনার বাথরুম মনে হয়?
পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে যেতে পারে ভেবে শাহাদৎ মনোয়ারকে ধরে ফেলল। বলল, মনোয়ার ভাই, এটা বাথরুম নয়, এখানে আপনি কী করেন। যান বাথরুমে যান। হোয়ার ইজ বাথরুম? বাথরুম কাঁহা পে হায়
মেরি সাধু।
শাহাদতের বুঝতে বাকি নেই মনোয়ার পুরাই আউট হয়ে গেছে। তার কারণ মনোয়ার তাকে সাধু বলে ডাকছে! শাহাদৎ মনোয়ারকে ধরে বাথরুমের দিকে নিয়ে গেল। আশরাফুল বলল, এই শালা রিপনকি বাচ্চে, মাল খতম হো গায়া ক্যায়া?
রিপন অনেকটাই শান্ত। কারণ এর আগে একবার এখানে পানীয় আয়োজনের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। আশরাফুল টাল হয়ে গেলে মাথা ঠিক থাকে না। উল্টাপল্টা কাজ করে। পরনের কাপড়েরও ঠিক থাকে না। তাই রিপন বলল, আশরাফুল ভাই, সব শেষ হয়ে গেছে। যদিও তখনো বেশ কিছু বোতলে ছিল।
জাহিদ বলল, রিপন ভাই, আম অ্যাম গোয়িং মাই ভিলেজ। বিকজ মাই বেড ইজ ওয়েটিং দেয়ার।
রিপনের বুঝতে বাকি রইল না যে জাহিদের অবস্থাও গেছে। রিপন জাহিদকে ধরে তার রুমের দিকে এগিয়ে দিতে গেল। যাওয়ার সময় আনিসকে বলল, আনিস ভাই, আপনি আশরাফুলকে নিয়ে শুয়ে পড়েন। আমি গেলাম।
সবাই চলে যাওয়ার পর আনিস আশরাফুলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আশরাফুল চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে আছে। আনিস আশরাফুলকে বিছানায় লম্বা করে শুইয়ে দিল। আশরাফুল কোনো কথা বলল না। তার মাথার নিচে বালিশ দেয়ার সাথে সাথে সে অচেতন অবস্থায় পড়ে রইল। আনিস ঘরের লাইট অফ করার সময় পাশের রুম থেকে জাহিদের কথার শব্দ শুনতে পেল।
জাহিদ বেশ শব্দ করে বলছে, ওই মনো, তুই কই? মনো রে, ও আমার মনো। ওই সাধুকা বাচ্চা! শাহাদৎ, ওই শাহাদৎ।
রাত অনেক হয়েছে। এখন প্রায় দুইটা। আনিসেরও অনেক ঘুম পেয়েছে। কিন্তু ওদের বুঝতে দেয়নি। কে চিল্লাচিল্লা করে করুক। আনিস বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। ঘুমানোর আগে মনে মনে আল্লাহ্্র কাছে দোয়া করল, যাতে আশরাফুল আবার ঘুম থেকে জেগে কোনো কাহিনি না করে।

ফরহাদ সাহেবের মনটা আজ ভালো নেই। শরীরটাও কেমন কেমন জানি লাগছে। জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে। অথচ শরীরের তাপমাত্রা উত্তপ্ত নয়। একেবারেই ঠান্ডা। কেমন জানি একটা অস্বস্তি লাগছে। তিনি তার বড় মেয়ে জাকিয়ার কারণে চিন্তিত। এই নিয়ে চারটি ভালো বিয়ের প্রস্তাব জাকিয়া ফিরিয়ে দিয়েছে। বিয়ের কথা বললেই জাকিয়ার একটাই কথা, এই মুহূর্তে সে বিয়ে করবে না। কেন করবে না, এর কোনো উত্তর জাকিয়া বলে না। তার একটাই কথা, সবে মাত্র চাকরিতে জয়েন করেছে। নিজেকে আরো কিছু গুছিয়ে তার পর বিয়ের কথা। এর আগে নয়। তাকে বহুবার বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে ভালো ছেলে সব সময় পাওয়া যায় না।
জাকিয়া ভালো ছেলে বলতে কী বুঝায় এই নিয়ে তার সাথে তর্ক করেছে। জাকিয়া বলেছে, তুমি যাকে আজকে ভালো ছেলে বলছ, কাল সে খারাপ হবে না, তার গ্যারান্টি কী? তাছাড়া কিসের ভিত্তিতে তুমি ভালো ছেলে বলছ?
কেন, ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা ভালো, দেশের বাইরে থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। ভালো চাকরি করে, পরিবার ভালো। সংসারে ঝামেলা নেই, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সব মিলিয়ে একটা চমৎকার ছেলে। এর চেয়ে ভালো সম্পর্ক তো আর হতে পারে না। বিয়ের পর তুই রাজার হালে থাকবি। টাকা-পয়সার অভাব নেই। আমি বাবা হয়ে তো তোর জন্য খারাপ ছেলে ধরে এনে তোকে বিয়ে দিয়ে দিব না!
বাবা, তুমি ভালো করেই জানো যে টাকা-পয়সার উপর আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার আশাও খুব একটা বড় নয়। আমার চাহিদাও তেমন নেই। তুমি অনেক যতœ নিয়ে আমাদের দুই বোনকে মানুষ করেছ। আমাদের অভাব খুব একটা বুঝতে দাওনি। টাকা-পয়সা আমিও কি খুব আয় করছি? তোমাদের দোয়ায় আমার চাকরিটাও অনেক ভালো। বেতনও ভালো পাই। তুমি এও জানো যে, এ যুগের অন্যান্য মেয়ের মতো আমি নই। আমার জগৎটা অনেক ছোট বাবা। আমার এই ছোট জগৎটাকে আমি আমার মতো করে সাজাতে চাই। প্লিজ বাবা, আমাকে আমার মতো করে আমার জগৎটাকে সাজাতে দাও। তোমার কাছে আমি যখন যা চেয়েছি, তাই দিয়েছ। প্লিজ, আমাকে এই অনুমতিটা দাও। বাবা, তুমি যে কয়েকটি ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ তারা তাদের জায়গায় প্রত্যেকেই ভালো। আমি তাদের খারাপ বলছি না। আমি এও বলছি না যে এদের কারো সাথে বিয়ে হলে আমি অসুখী থাকতাম। আমি বাবা অনেক বড়লোকের ঘরে যেতে চাই না। আমি আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। ঠিক আমাদের সংসারের মতো সংসারে। অনেক টাকা-পয়সা আছে, অনেক বড় চাকরি করে, বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে, এমন কোনো ছেলে আমি চাই না বাবা। আমি একটি ভালো মনের ছেলে চাই। তার টাকা-পয়সা বা বিশাল কোনো ডিগ্রি আমি চাই না। জাস্ট আমাকে প্রচুর ভালোবাসবে এমন ছেলে আমি চাই। তুমি যেসব ছেলে দেখেছ, তারা আজীবন টাকার পিছনে দৌড়েছে। বিয়ের পরও তাই করবে। কারণ ওরা ছোটবেলা থেকে তাদের বাবাকে টাকার পিছনে ছুটতে দেখেছে। ওদের বাবা ওদের তা-ই শিখিয়েছে। তাই ওরা তা-ই করবে। আমি সেখানে জাস্ট একটা পুতুল হয়ে থাকব। আমাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ওদের শোকেসে সাজিয়ে রাখবে, আর প্রয়োজনমতো আমাকে ব্যবহার করবে। এর চেয়ে বেশি কিছু না। আমার যখন যা কিছু প্রয়োজন ওরা হয়তো আমাকে তা দিবে কিন্তু আমার মনের ভাষাটা ওরা বুঝার চেষ্টা করবে না। কারণ আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মন-মানসিকতার সাথে তাদের মন-মানসিকতার বিস্তর ফারাক বাবা। তুমি আমার বিয়ে নিয়ে টেনশন কোরো না। শুধু তুমি তোমার জাকিয়ার উপর আস্থা রেখো। তোমার মেয়ে এমন কিছু করবে না যে তোমার মান-সম্মানের ক্ষতি হয়।
তোর কি কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে?
না বাবা, আমার সে রকম কারো সাথে সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে বড় কথা বাবা, তোমার এই মেয়ের কোনো ছেলে বন্ধু নেই। আর আমার কারো সাথে কোনোরকম সম্পর্ক থাকলে সবার আগে আমি তোমাকে জানাতাম। তাই এই নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।
এই সমস্ত নানান কথা ফরহাদ সাহেব বসে বসে ভাবছে। মেয়েটাকে একটা ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলে সে অনেক হালকা হতে পারে। কিন্তু জাকিয়াকে কোনোভাবেই বিয়েতে রাজি করানো যাচ্ছে না। এই সমস্ত নানান কারণে ফরহাদ সাহেবের মনটা বিষণœ। শরীরটাও খারাপের দিকে যাচ্ছে। মন ভার করে সে তার রুমে বসে বসে এসব কথা ভাবছে। শামীমার ডাকে তার ভাবনার অবসান হলো।
শামীমা তার ঘরে ঢুকে বলল, কী ব্যাপার, তুমি চোখ-মুখ অন্ধকার করে একা একা ঘরে বসে আছ যে?
ফরহাদ সাহেব শামীমার কথার কোনো উত্তর দিল না। দেয়ার কথাও না। কারণ জাকিয়ার বিয়ের বিষয়ে শামীমার কোনো আগ্রহ তিনি লক্ষ করেননি! চার চারটি বিয়ের প্রস্তাব জাকিয়া ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু মা হিসাবে শামীমা তার মেয়েকে কোনো প্রকার শাসন তো দূরের কথা, একটা শব্দও করেনি। জাকিয়ার প্রতিটি কাজের সাথে শামীমা একমত পোষণ করে। শেষ যে ছেলেটির সাথে জাকিয়ার বিয়ের কথা হয়েছিল সেই ছেলেটি ফরহাদ সাহেবের অফিসের কলিগের ছেলে ছিল। অনেক দিনের সম্পর্ক ফরহাদ সাহেবের সাথে। মোটামুটি ফরহাদ সাহেব এক প্রকার চূড়ান্ত পর্যায়েই চলে গিয়েছিল যে এইখানে জাকিয়ার বিয়েটা হয়ে যাবে। কিন্তু না হওয়ায় তার দীর্ঘদিনের কলিগের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। শামীমা যদি জাকিয়ার বিয়েতে বড় ভূমিকা পালন করত, তাহলে হয়তো জাকিয়াকে বুঝানো সহজ হতো। কিন্তু শামীমা তা না করে উল্টাপথে চলেছে। যে কারণে গতকাল তার সাথে একপ্রকার ঝগড়া হয়ে গেছে। শামীমা বলেছিল, সে আর তার সাথে কথা বলবে না। অথচ আজ সে-ই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এসেছে। অবশ্য বিয়ের আটাশ বছরের মাঝে যতবার তাদের মাঝে ঝগড়া বা মান-অভিমান হয়েছে ততবারেই শামীমাই আগে এসে তার সাথে কথা বলেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শামীমার এই গুণটি ফরহাদ সাহেবের খুবই পছন্দের। তারপরেও ফরহাদ সাহেব মনটা ভার করে বসে থাকল। শামীমার কথার কোনো প্রকার জবাব দিল না।
তুমি এইভাবে মর্তির মতো বসে আছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ নাকি?
ফরহাদ সাহেব চুপ। কোনো কথা বলল না। শামীমা তার স্বামীকে বেশ ভালোভাবেই চিনে। তাই শামীমা ঘর থেকে বের হয়ে একটু পরে আবার এক কাপ চা আর টোস্ট নিয়ে ঘরে ঢুকল। ফরহাদ সাহেব অবাক না হয়ে পারল না। শামীমা কীভাবে বুঝল যে ফরহাদ সাহেবের ভয়াবহ রকমের চা খেতে ইচ্ছে করছিল? শামীমার এই গুণটিও ফরহাদ সাহেবের বেশ পছন্দের। শামীমা তার মনের ভাষা পড়তে পারে!
নাও, চা খেয়ে শরীরটা একটু হালকা করো। আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করে আছ। তোমার ধারণা, জাকিয়াকে আমিই বিয়ে করতে নিষেধ করছি। আসলে তোমার ধারণা ঠিক না। আমার চেয়ে কিন্তু তুমিই তোমার দুই মেয়েকে বেশি ভালোবাস। তোমার প্রশ্রয়েই জাকিয়া এমন হয়েছে। তুমি ওকে ছোটবেলা থেকে শিখেয়েছ কীভাবে অন্যের উপর নির্ভর না করে স্বাবলম্বী হতে হয়। কীভাবে নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে হয়। কীভাবে জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে হয়।
শামীমার কথায় ফরহাদ সাহেব অবাক না হয়ে পারল না। আসলেই তো তাই! তিনিই তো এইসব কিছু ছোটবেলা থেকে তার মেয়েদের শিক্ষা দিয়েছেন! কেয়াটা তার মতো না হলেও জাকিয়া তো পুরোপুরি তারই মতো হয়েছে। তিনি যেমন কখনো অন্যের উপর নির্ভর করতেন না, কখনো কারো কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতেন না, নিজের চেষ্টায় চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, তার মেয়ে তো তার মতোই হয়েছে। এই দিকটা তো তার মাথায় একবারের জন্যও আসেনি! বাবা হয়ে এই দিকটা তার মাথায় না আসার জন্য ফরহাদ সাহেব নিজেকে অপরাধী মনে করছেন।
শামীমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ফরহাদ সাহেব বলল, এই কথাগুলো আমার মাথায় একটিবারের জন্যও আসেনি। তুমি ঠিকেই বলেছ। জাকিয়া হয়েছে আমার মতো। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমার উপর মন খারাপ করে আছে, তাই না? জাকিয়া আর কেয়া কোথায়? অনেকক্ষণ ওদের কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। ওরা কি বাসায় আছে?
শামীমা জবাব দিল, না নেই। দুই বোন মিলে নিউ মার্কেটে গিয়েছে। জাকিয়া কেয়াকে সাথে করে নিয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে মেয়ে দুটা আমার কত বড় হয়ে গেল তাই না শামীমা? অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন জাকিয়ার জন্ম হলো। জাকিয়ার জন্য হঠাৎ করেই ফরহাদ সাহেবের চোখে পানি চলে এলো। ফরহাদ সাহেব তার বড় মেয়েটিকে অনেক বেশি ভালোবাসে। অথচ সেই মেয়েটিকেই কিনা বিয়ে দিবার জন্য সে অস্থির হয়ে গেছে! বিয়ে হলেই তো মেয়েটা তার কাছ থেকে চলে যাবে।
শামীমা অবাক হয়ে স্বামীর চোখে পানি দেখে বলল, কী ব্যাপার, তুমি কাঁদছ কেন?
জাকিয়া মনে হয় আমার উপর রাগ করে আছে তাই না শামীমা? মেয়ে বড় হলে বাবার অনেক চিন্তা বেড়ে যায়। এই কথাটা সবাই বুঝতে চায় না শামীমা, সবাই বুঝতে চায় না। মেয়েরা এলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও। অনেক দিন মেয়েদের সাথে মন খুলে কথা হয় না। দাও, চা দাও।
শামীমা ফরহাদ সাহেবের হাতে চা আর টোস্ট দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। চা আর টোস্ট খেয়ে ফরহাদ সাহেব মেয়েদের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগল।

কিরে আপা, তুমি সেই কখন থেকে নিউ মার্কেটে এই দোকান সেই দোকান ঘুরছ, কিন্তু কোনো কিছু কিনছ না, তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো? অনেকটা বিরক্ত হয়ে কেয়া তার বড় বোন জাকিয়াকে বলল।
যা কেনার জন্য এসেছি তা পাচ্ছি না রে। আর কয়েকটি দোকান দেখব, না পেলে কিছু খেয়ে বাসায় চলে যাব।
আরো কয়েকটি দোকান দেখবে! কেয়া অনেকটাই হতাশ। তুমি কী কিনতে চাও সেটাই তো বলছ না! আমাকে বলো, দেখি আমি খুঁজে পাই কি না।
তুই বুঝবি না।
বুঝিয়ে বললেই বুঝব। তুমি তো বলতেই চাচ্ছ না। তুমি কি বিশেষ কারো জন্য বিশেষ কিছু কিনতে চাও?
কেয়ার এই কথায় জাকিয়া একটু অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াল! জাকিয়া কেয়ার কথায় অবাক না হয়ে পারল না। কেয়া কীভাবে বুঝতে পারল যে জাকিয়া তার একজন বিশেষ মানুষের জন্যই বিশেষ কিছু কেনার জন্য নিউ মার্কেটে এসেছে!
তুমি আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছ কেন আপা?
তোর তো অনেক বুদ্ধি হয়েছে রে! তুই কীভাবে বুঝতে পারলি যে আমি বিশেষ কারো জন্য বিশেষ কিছু কিনতে এসেছি?
না, এমনিতেই বললাম। আপা আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। সেই কখন থেকে তুমি আমাকে নিউ মার্কেট, চাঁদনীচক মার্কেট ঘুরিয়েছ। হাঁটতে হাঁটতে আমার অবস্থা খারাপ! এখন কিছু না খেলে আমি আর হাঁটতে পারব না। প্লিজ আপা, আগে কিছু খাওয়াও, তারপর কেনাকাটা করা যাবে। প্লিজ আপা!
ঠিক আছে। চল আগে কিছু খেয়ে নিই।
দুই বোন মিলে একটি ফাস্টফুডের দোকানে যেয়ে একটি পিজার অর্ডার দিল। কেয়া অনেকটা কৌতূহল চোখে জাকিয়াকে প্রশ্ন করল, আপা, তুমি কার জন্য কী কিনতে এসেছ, আমাকে কি বলা যায়?
কেন বলা যাবে না! অবশ্যই বলা যাবে।
তাহলে বলো, কার জন্য কিনতে এসেছ? আমিও শুনি তোমার বিশেষ মানুষটি কে।
আনিস সাহেবের জন্য।
আনিস সাহেব মানে? কোন আনিস সাহেব? তোমাদের অফিসের কেউ?
তুই তো মারাত্মক মেয়ে রে কেয়া! তুই তোর শিক্ষকের নাম জানিস না! জাকিয়া অবাক হয়ে কেয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল।
আমার শিক্ষক মানে? তুমি কি আমার প্রাইভেট টিচার, আই মিন, আমার আনিস স্যারের কথা বলছ?
জি হ্যাঁ মাডাম, আমি তোমার আনিস স্যারের কথাই বলছি। তুই কি লক্ষ করেছিস যে তোর আনিস স্যার প্রায় দিনই একটি শার্ট পরে তোকে পড়াতে আসে। আমার মনে হয় তোর আনিস স্যারের জামা-কাপড় তেমন নেই। আমি জিনিসটা লক্ষ করেছি। বেচারার জন্য আমার খুব মায়া হয়েছে। তোর স্যারটি মানুষ হিসাবে অনেক ভালো। এই যুগেও অনেকটাই সাদাসিধে। অনেকটাই বোকাসোকা! এই যুগে যে এমন টাইপের ছেলে থাকে তা তো আমার মাথায় আসে না। উনার সাথে যে কয়দিন আমার কথা হয়েছে, তাতেই আমি বুঝতে পেরেছি, লোকটি মানুষ হিসাবে একজন ভালো মানুষ। জাকিয়া কোনো বিরতি না দিয়ে একটানা কথাগুলো বলে গেল।
কেয়া অবাক চোখে জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে কোনো পলক পড়ছে না! মনে মনে কেয়া বলছে, তার বোন এসব কী বলছে? তার বোন জাকিয়া কি তার আনিস স্যারের প্রেমে পড়ে গেছে নাকি?
কিরে, তুই আমার দিকে এই রকম পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছিস কেন?
আপা, তুমি কি আনিস স্যারকে ভালোবাসো?
ভালোবাসি কি না এখনো বুঝতে পারছি না। তবে তোর স্যারের জন্য আমার মনে ভালোলাগার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। একটা মায়া তৈরি হয়েছে। সেটা ভালোবাসা কি না এখনো বলতে পারছি না। আচ্ছা, তুই কি মনে করিস, আমি যদি তোর স্যার আনিস সাহেবকে ভালোবাসি এবং ভালোবেসে বিয়ে করি, তাহলে কি খুব একটা মন্দ হবে?
না আপা, মন্দ হবে না। আনিস স্যার মানুষ হিসাবে অনেক ভালো। খুব ভালো পড়াতে পারে। অনেক ভালো বুঝাতে পারে। ছাত্র হিসাবে সে অনেক ভালো ছিল। তার রেজাল্টও অনেক ভালো। তার বাবা সরকারি চাকরি করত। তাদের সংসারটাও নাকি বেশ সুখের ছিল। সরকারি চাকরি করলেও তার বাবা কখনো ঘুষ খায়নি। স্যারের বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের সংসারটা এলোমেলো হয়ে যায়। গ্রামের বাড়িতে তার ছোট বোন আর মা থাকে। তার মায়ের ইচ্ছে, আনিস স্যার যেন তার বাবার মতো একটি সরকারি চাকরি করে। প্রাইভেট জব তার মায়ের পছন্দ নয়। তাই স্যার প্রাইভেট জবের জন্য ট্রাই করে না। তার মাথায় সারাদিন শুধু সরকারি চাকরির চিন্তা ঘুরঘুর করে। চাকরিটা হয়ে গেলে সে তার মা আর বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। অনেক ধুমধাম করে তার ছোট বোনের বিয়ে দিবে। আরো কত কী নিয়ে যে আনিস স্যার সারাদিন ভাবে তার কোনো শেষ নেই।
তুই তোর স্যারের এত সব জানলি কী করে?
স্যার আমাকে পড়াতে পড়াতে এসব বলেছে।
ও আচ্ছা!
তুমি স্যারের জন্য কী কিনতে চাচ্ছ আপা?
একটা শার্ট আর একটা ফতুয়া। শার্ট অবশ্য একটা দোকানে আমার পছন্দ হয়েছে কিন্তু ফতুয়াটা মনের মতো পাচ্ছি না।
আপা, তুমি যে আনিস স্যারকে মনে মনে পছন্দ করেছ, এই বিষয়টা আমি মনে হয় একটু আঁচ করতে পেরেছিলাম।
তুই কীভাবে আঁচ করতে পেরেছিলি?
প্রথমত, বাবা তোমার জন্য এত ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে কিন্তু তুমি বিয়েতে মত দিচ্ছ না। দ্বিতীয়ত, সেদিন যখন তুমি স্যারের সামনে কালো একটি শাড়ি পরে স্যারের জন্য চা আর বিস্কুট নিয়ে আমার রুমে আসলে তখন তোমার ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম, কিন্তু তোমাকে বলার সাহস হয়নি।
তুই তো দেখছি আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমতী হয়েছিস রে কেয়া! আগেভাগে অনেক কিছুই তুই বুঝতে পারিস। গুড, ভেরি গুড। তুই অনেক বড় হতে পারবি। নে চল, এখন আনিস সাহেবের জন্য কেনাকাটা শেষ করি।
আচ্ছা আপা, আনিস স্যারের সাথে তোমার বিয়ে হলেও কি তুমি আনিস স্যারকে আনিস সাহেব বলে ডাকবে?
কেয়ার প্রশ্নে জাকিয়া বেশ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। জাকিয়ার হাসিতে রেস্টুরেন্টের অন্যান্য গ্রাহকরা অনেকটা অবাক হয়ে জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল! জাকিয়া সেদিকে লক্ষ না করে কেয়াকে বলল, হয়েছে, আর পাকনা পাকনা কথা বলতে হবে না। এখন চলেন কেনাকাটা শেষ করে বাড়ির দিকে যাওয়া যাক। আর হ্যাঁ, এই বিষয়টা যেন বাবা-মা কেউ না জানে, ঠিক আছে?
কেয়া জাকিয়ার কথায় মাথা নাড়াল।
রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে দিয়ে দুই বোন আবার কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে গেল।

প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো হতে চলল আনিস তার বজলুর রহমান বজু মামার অফিসের ওয়েটিং রুমে তার বায়োডাটা হাতে নিয়ে বসে আছে। তার মামা সড়ক বিভাগের এক জরুরি মিটিংয়ে আছেন। মিটিং শেষ হলে তার সাথে কথা বলবেন। সে রকমই আনিসকে তিনি তার অধীনস্ত লোক দ্বারা জানিয়েছেন।
আজ রবিবার। বজলু সাহেব আজকেই আনিসকে তার সিভি নিয়ে তার অফিসে দেখা করতে বলেছিল। কিন্তু তার মনে ছিল না যে আজ তার মন্ত্রণালয়ের জরুরি মিটিং থাকবে। আনিসের এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অপেক্ষা করতে অবশ্য তার খারাপ লাগছে না। আনিসের মামা সড়ক বিভাগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা। তার মামা যে এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এখানে অপেক্ষা করতে করতে আনিস বেশ বুঝতে পারছে। কারণ তাকে বেশ খাতির করা হচ্ছে। আনিস নাশতা করে এসেছে জানার পরেও তার জন্য কেক, কোক, আপেল এবং আঙুর ফলের আয়োজন করা হয়েছে। আনিস বসে বসে সেগুলো খাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে যে তার মামা তার জন্য কী চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে! সড়ক বিভাগে যদি কোনো নিয়োগ থাকত তাহলে তো পত্রিকায় আনিস দেখতে পেত। সকালে উঠে আনিসের এখন প্রধান কাজ হচ্ছে পত্রিকা দেখা। খেলার খবর বা দেশের খবর পড়ার জন্য আনিস পত্রিকা দেখে না। তার একটাই দেখার বিষয় আর তা হচ্ছে সরকারি কোনো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় দেয়া হয়েছে কি না! সকালের নাশতা করার পূর্বেই আনিস পত্রিকা দেখার কাজ শেষ করে। ঢাকায় আসার পর বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ আনিস দিয়েছে। প্রত্যেকটি পরীক্ষায় আনিস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইবা পর্যন্ত গিয়েছে। ভাইবায় আনিস বাদ পড়েছে শুধু টাকার কারণে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকে সরাসরি টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে, আপনার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। চাকরিটা আপনার প্রায় হয়ে গেছে। সামান্য একটু ঝুলে আছে। সেটার সমাধান করলেই আপনার চাকরিটা হয়ে যাবে। আনিস সরলভাবে বলেছে, সামান্য কিছু ঝুলে আছে মানে? এই চাকরি পেতে হলে আপনাকে তিন লক্ষ টাকা দিতে হবে। যান, আগামী দশ দিনের মধ্যে যদি টাকাটা জোগাড় করে আনতে পারেন, তাহলে আপনাকেই নিয়োগপত্র দেয়া হবে। তা না হলে অন্য কেউ চাকরিটা পেয়ে যাবে। আনিস হতাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরেছে। কারণ আনিসের পক্ষে তিন লক্ষ টাকা তো দূরের কথা, চাকরি করার জন্য এক টাকাও সে দিবে না। তার বাবা তাকে শিক্ষা দিয়ে গেছে অন্যায়ের সাথে কখনো আপোস না করা। ঘুষ দেয়া একটা অন্যায়, তাই আনিস কোনোভাবেই ঘুষ দিয়ে নিজের চাকরি জোগাড় করবে না। আনিস নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই চাকরি জোগাড় করবে। এটা তার প্রতিজ্ঞা।
মামার অফিসে নিজের বায়োডাটা নিয়ে বসে থাকার মাঝে আনিসের এক প্রকারের অস্বস্তি আছে বটে, তার পরেও তার মামার কথায় সে এখানে এসেছে। আনিস যদি না আসত তাহলে তার মামা বিষয়টা ভালোভাবে নিত না। আনিসের পরিবারের সাথে তার মামার পরিবারের সম্পর্কটা অনেক আগে থেকেই ভালো ছিল না। তার কারণ হিসাবে আনিসের মা যা জানিয়েছে তা হচ্ছে, আনিসের মা তার নানা এবং মামার মতের বাইরে যেয়ে আনিসের বাবাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। সেই থেকে আনিসের বাবা-মায়ের সাথে তার নানা বা মামাদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।
আনিসের বাবা ছিল অনেক জেদি প্রকৃতির। তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় শত কষ্ট সহ্য করার পরেও তার শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। আনিসের বাবা সরকারের একজন থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি করা অবস্থায় একটি পয়সাও কারো কাছ থেকে ঘুষ নেননি। একজন সৎ কর্মকর্তা হিসাবে অফিসে তার সুনাম ছিল। বেতন যা পেতেন তাই দিয়ে তিনি সংসার চালাতেন। সংসারে টানাটানি ছিল বটে কিন্তু তার জন্য আনিসের মায়ের কোনো অভিযোগ আনিসের বাবার উপর ছিল না। শুধু আনিসের বাবার সততার কারণে আনিসের মা আনিসের বাবাকে ভালোবেসেছিল এবং পরিবারের অবাধ্য হয়ে আনিসের বাবাকে বিয়ে করে পরিবারকে ত্যাগ করেছিল। আনিসের মায়েরও তার পরিবারের প্রতি অভিমান ছিল অনেক।
সে না-হয় ভালোবেসে একজনকে বিয়ে করেছে, তার জন্য পরিবারের সবাই তাকে ত্যাগ করবে! এমন তো না যে সে কোনো খারাপ এবং অশিক্ষিত কাউকে বিয়ে করেছে।
আনিসের বাবার পরিবার তার মায়ের পরিবারের চেয়ে একটু গরিব ছিল বলে আনিসের নানা তার মেয়ের পছন্দ মেনে নেননি। আনিসের নানা যতদিন বেঁচে ছিল একটি বারের জন্যও মেয়ের খোঁজ নেননি। নানার মৃত্যুতে শুধু আনিসের মা এসেছিল। তার বাবাকে আসতে বারণ করা হয়েছিল। আনিসের একমাত্র মামা বজলুর রহমান আনিসের মায়ের বড়। নেকটা তার বাবার মতো। আনিসের ভাবনার এই পর্যায়ে তার মামার পিয়ন এসে অতিনিও কোনোদিন আনিসের খোঁজখবর তেমনটা নেননি। কিন্তু আনিসের মামি তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। তার মামাতো ভাই ফিরোজ, ফুয়াদ এবং বোন তাহিতি তাদের খোঁজ নিত। আনিস যেহেতু ছাত্র হিসাবে প্রথম শ্রেণির তাই তাই তার প্রতি অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করত। সেই আগ্রহের তালিকায় তাহিতিও বাদ যায়নি। আনিসের মামি বা ভাই-বোন তাদের সাথে যোগাযোগ করলেও আনিস কখনো তাদের বাসায় আসেনি। তাছাড়া আনিসের এই প্রথম ঢাকায় আসা। ঢাকায় এসেও আনিস তার মামার বাসায় ওঠেনি। উঠেছে তার বাল্যবন্ধু আশরাফুলের মেসে।
আনিস স্বভাবে হয়েছে আনিসকে বলল, স্যারের মিটিং শেষ
হতে অনেক সময় লাগবে। স্যার আমার কাছে আপনার খাম রেখে যেতে বলেছে। আর আপনাকে এই খামটি দিতে বলেছে। আনিস পিয়নের হাত থেকে খামটি নিয়ে তার খামটি দিল। পিয়ন বলল, আপনাকে কি আরেক কাপ চা দিব স্যার?
আনিস বলল, না ঠিক আছে। আপনি আমার অনেক যতœ নিয়েছেন, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আনিস তার মামার অফিস থেকে বের হয়ে মামার দেয়া খামটি খুলে থমকে দাঁড়াল! চোখ বড় বড় করে আনিস দেখল, খামের ভিতরে একটা দুটো নয় দশ দশটি পাঁচশ’ টাকার চকচকে নোট। টাকার সাথে একটি চিরকুট। সেখানে লেখা, ‘আনিস তোমাকে ডেকেও সময় না দিতে পারার জন্য
আমি আন্তরিকভাবে লজ্জিত। জরুরি মিটিং পড়ে যাবে তা আমার মনে ছিল না। তোমাকে যে আসতে বারণ করব, সেই উপায়ও আমার ছিল না। কারণ তোমার মোবাইল নাম্বার আমার কাছে নেই। তোমার সিভিটা রেখে যেও। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব তোমার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। তোমার মায়ের কোনো ইচ্ছেই আমি পূরণ করতে পারি নাই। আশা করি
এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারব। সময় দিতে না পারার জন্য পুনরায় স্যরি বলছি। কিছু মনে কোরো না। বাসায় এসো। সাক্ষাতে বিস্তারিত আলাপ হবে। তোমার মামা। ’
মামার চিরকুটটা পড়ে আনিসের মনটা ভালো হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই মামার উপর জমে থাকা রাগটা চলে গেল। এতদিন তার ধারণা ছিল, তার মামা অনেকটা রাসভারী মানুষ! কিন্তু আজ তার ধারণা অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হলো। মনে অনেকটা প্রশান্তি নিয়ে আনিস মেসে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠে বসল।

দরজায় নক করার সাথে সাথেই শাহাদৎ দরজা খুলে দিল। আনিসকে দেখে শাহাদৎ অনেকটা আপ্লুত মনে হলো। আরে আনিস সাহেব! যাক আপনি আসাতে আমার উপকার হলো। অনেকটা খুশি মনে শাহাদৎ কথাটা বলল।
আনিস ঠিক বুঝতে পারছে না, আনিস আসাতে শাহাদৎ সাহেব কেন খুশি হবে! শাহাদৎ ভাই, আমি আপনার কথার মানে ঠিক বুঝলাম না! আমার আসাতে আপনি খুশি হচ্ছেন কেন?
না রে ভাই, অন্য কোনো কারণ নয়। আমি আজ জরুরি কাজে বাড়ি যাব। বাড়িতে থেকে জরুরি ভিত্তিতে ফরমান এসেছে, আজকেই বাড়ি যেতে হবে। মেসের সবাই তো যে যার কাজে চলে গেছে, তাই আমি যে বাড়ি যাচ্ছি সে কথা হয়তো ফোন করে সবাইকে বলে যেতে পারতাম, আপনি আসাতে আমার জন্য ভালো হলো এই কারণে যে আমার বাড়ি যাওয়ার বিস্তারিত ঘটনা আপনাকে বলে যেতে পারছি। তাই আপনাকে পেয়ে একটু খুশি হয়েছি।
কোনো বিশেষ কারণে কি আপনি বাড়ি যাচ্ছেন শাহাদৎ ভাই?
আপনি ঠিক ধরেছেন ভাই। আজ হচ্ছে রবিবার, আগামী শুক্রবার আমার বিবাহ ঠিক করা হয়েছে। মেয়ে আমাদের পাশের গ্রামের। অনেক দিন থেকেই কথাবার্তা চলছে। গতকাল রাতে সব কিছু ফাইনাল হয়েছে। আজ সকালে আব্বা ফোন করে যেতে বলেছে। মেয়েটির পরিবার অনেক ভালো। আমি যতটুকু শুনেছি মেয়েটাও নাকি অনেক ভালো প্রকৃতির। ছাত্রী হিসাবেও নাকি অনেক ভালো। বরিশাল বিএল কলেজে ইংরেজিতে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। ম্যাট্রিক আর ইন্টারে আমাদের বাকেরগঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট নাকি আপনার ভাবি করেছিল। আমি অবশ্য বরিশাল ছেড়েছি অনেক আগে। তাই আমার সামনাসামনি আপনার ভাবির সাথে কখনো কথা হয়নি। আমাকে একটি ছবি পাঠানো হয়েছে। আপনার ভাবিকে শুধু সুন্দরী বললে ভুল হবে। তাকে সুন্দরী না বলে বলা যায় সুন্দরের রানি। আমার কাছে অবশ্য ছবিটি আছে। আপনাকে আমি দেখাতে পারি। মেসের কাউকে দেখাইনি। কারণ এর আগেও আমার একটি বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। এই বিষয়টি মেসের সবাই জানে। এটা নিয়ে মনোয়ার আর রিপন সাহেব আমার সাথে প্রায়ই দুষ্টুমি করে। তাই এই বিয়ের কথা এখনো কাউকে জানাইনি। আর আপনার হবু ভাবির ছবিও কাউকে দেখাইনি। আগে সব কিছু ফাইনাল হলে তারপর সবাইকে জানাব। শাহাদৎ বেশ আত্মতৃপ্তির সাথে কথাগুলো বলল! শাহাদৎকে দেখে বেশ সুখী সুখী মনে হচ্ছে আনিসের।
কেন, আপনি না বললেন গত রাতে সব কিছু ফাইনাল হয়েছে? ফাইনাল না-হলে নিশ্চয়ই আপনাকে বাড়িতে যেতে বলত না, তাই না? আপনি কি মেসের সবাইকে দাওয়াত দিবেন না শাহাদৎ ভাই?
দিব না কেন! অবশ্যই দিব। তবে আমি বাড়ি যেয়ে পুরো বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে তারপর সবাইকে জানাব। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বৃহস্পতিবার আপনাদের আসতে বলব। আপনি কিন্তু অবশ্যই যাবেন ভাই। আপনি গেলে খুশি হবো।
তাহলে বিয়েটা নিয়ে আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নন! কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি নিশ্চিত যে এই মেয়েটির সাথেই আপনার বিয়ে হবে। এই যে আপনি কথায় কথায় বলছেন, ‘আপনার হবু ভাবি’। তাছাড়া যার সাথে আপনার বিয়ের কথা চলছে তাকে আপনি এখনো সরাসরি দেখেননি, শুধু ছবি দেখেই আপনি মোটামুটিভাবে তার প্রতি ভয়াবহ রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছেন! মেয়েটির পড়াশুনা নিয়েও আপনি বেশ গর্বিত! সব মিলিয়ে আপনার কথাবার্তায় মোটামুটি একটা জিনিস পরিষ্কার যে এই মেয়েটির সাথেই আপনার বিয়ে হচ্ছে!
আনিস সাহেব, আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না যে আপনি এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন! আপনি আমার প্রতিটি কথা যে খুব মনোযোগসহকারে শুনেছেন, তা আপনার কথা শুনে বুঝতে পারলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন। কথাবার্তা মোটামুটি ফাইনাল বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু ভাইরে, একবার যেহেতু সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরেও ধরা খেয়েছি, তাই মনের কোথায় যেন একটা অজানা শঙ্কা থেকেই যায়। সে যাই হোক, আমি সবার সাথে ফোনে কথা বলব। আর আপনি কিন্তু অবশ্যই সবার সাথে যাবেন। আর হ্যাঁ, আনিস ভাই, আপনার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দেন। আমি আপনার সাথে জরুরি কিছু বিষয়ে ফোনের মাধ্যমে আলোচনা করব।
কেন ভাই, আমার সাথে কেন আলোচনা করবেন? মনোয়ার ভাই, রিপন ভাই, জাহিদ ভাই বা আশরাফুলের সাথে তো আলোচনা করতে পারেন।
তা পারি, কিন্তু ওরা এর আগে আমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমার বিয়ের কথা শুনলেই হাসাহাসি করে। তাতে আমি বিব্রত বোধ করি। আমার খারাপ লাগে। আচ্ছা ভাই, আপনিই বলেন, সব ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর কি মানুষের বিয়ে ভাঙে না? এইটা নিয়ে হাসাহাসি করার কি কিছু আছে? এই রিপন সাহেব, আমাকে বলে আমার সাইজ নাকি মেয়ের পছন্দ হয়নি, তাই আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আচ্ছা ভাই, আমার সাইজ কি খুব খারাপ? আমি দেখতে-শুনতে কি খুব খারাপ? শাহাদৎ অনেক সিরিয়াসভাবে কথাগুলো বলে গেল।
আনিস বলল, সেকি! আপনার সাইজ খারাপ হতে যাবে কেন? আপনি দেখতে-শুনতে তো অনেকের চেয়ে সুন্দর। তাছাড়া আপনি ভালো চাকরি করেন। শুনেছি বেতনও নাকি ভালো পান। শিক্ষিত, সচেতন এবং আধুনিক। রান্নাও ভালো করেন! আপনাকে খারাপ বলার কোনো কারণই নেই। আনিস হেসে কথাগুলো বলল।
শাহাদৎ আনিসের কথায় বেশ খুশি হলো বলে মনে হচ্ছে। কারণ আনিসের কথায় শাহাদৎ মুখ নিচু করে লাজুক হাসি দিয়েছে!
ঠিক আছে, আনিস ভাই, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন বের হবো। সবাইকে বলবেন যে আমি জরুরি কাজে বাড়িতে গেলাম। দয়া করে আমি না জানানো পর্যন্ত আপনি আমার বিয়ের বিষয়টি কাউকে বলবেন
না প্লিজ।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন শাহাদৎ ভাই। আমি কাউকেই আপনার বিয়ের কথা বলব না। দোয়া করি ভালোয় ভালোয় আপনার বিয়েটা হয়ে যাক। বরিশাল পৌঁছে আমাকে ফোন দিয়েন। কী হলো না হলো জানাবেন ভাই। আর হ্যাঁ, টেনশন করবেন না, সব ঠিকঠাকমতো হয়ে যাবে।
শাহাদৎ আনিসের কাছে বিদায় নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হলো।

২.
আনিস খুব মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। পত্রিকার যে খবরটি সে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে তা যে খুব সিরিয়াস কোনো খবর তেমন নয়। আনিস কেয়াকে একটি বিষয়ে লিখতে দিয়ে প্রায় বিশ মিনিট ধরে খবরটি পড়ছে। অনেকের জন্য খবরটি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আনিসের জন্য খবরটি গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকার ভিতরের পাতায় বেশ বড় করে সড়ক বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া
হয়েছে। খবরটি দেখার পর থেকে আনিসের চোখ আনন্দে চকচক করছে। তার বেকারত্বের অবসান হতে চলেছে বলে। কারণ তার মামা যেহেতু
তার বায়োডাটা নিয়েছেন, নিশ্চয়ই তিনি তার একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদবিগুলোও বেশ আকর্ষণীয়। আনিস একটা প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়ল।
কেয়াকে যে বিষয়ে লিখতে দেয়া হয়েছিল, কেয়া তা অল্প সময়ের মধ্যেই লিখে চুপচাপ বসে আছে। যেহেতু তার স্যার গভীর মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছিল, তাই কেয়া আর তাকে তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটায়নি। আনিস একই খবর মানে একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রায় কয়েকবার পড়ে ফেলল। তারপরেও তার মনোযোগ পত্রিকার পাতা থেকে সরেনি। এমন সময় জাকিয়া নাশতার ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। নাশতার ট্রে টেবিলে রেখে জাকিয়া আনিসের দিকে তাকাল। আনিস তার মুখের উপর পত্রিকা ধরে রেখে বসে আছে। ঘরে যে আনিস এবং কেয়া ছাড়াও অন্য কেউ প্রবেশ করেছে আনিস সেটা টের পায়নি। তার মনোযোগ সড়ক বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে।
জাকিয়া কেয়ার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে একটা কাশি দিল। জাকিয়ার কাশির শব্দ আনিসের পত্রিকা পড়ার মাঝে ফাটল ধরাতে সক্ষম হলো। আনিস তার চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে জাকিয়াকে সালাম দিয়ে অনেকটা অবাক হয়ে বলল, আপনি কখন এখানে এলেন? কই টের পেলাম না তো! আপনি ভালো আছেন? আজ অফিসে যাননি?
জাকিয়া তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলল, আপনি বসেন। আর আমাকে দেখে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ভালো আছি। আজ অফিসেও গিয়েছিলাম। দুপুরের পর চলে এসেছি। আপনি ভালো আছেন?
জি ম্যাডাম, আমি ভালো আছি।
আনিসের মুখ থেকে ম্যাডাম শব্দটি শুনে জাকিয়া আবার হাসতে লাগল। জাকিয়ার হাসির সাথে কেয়াও হাসতে লাগল। দুই বোনের হাসার কারণে আনিস অনেকটাই বিব্রত বোধ করতে লাগল। আনিস ঠিক বুঝতে পারল না সে কী এমন কথা বলেছে যে দুই বোন এমন হাসতে লাগল! জাকিয়া হাসলে তার গালে টোল পড়ে, যা আনিসের ভীষণ পছন্দের। কিন্তু জাকিয়া হাসলে আনিস কখনো জাকিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। কারণ আনিসের ধারণা জাকিয়া অনেক বুদ্ধিমতী আর চালাক টাইপের একটা মেয়ে। জাকিয়ার হাসিতে আনিসের যে বুকে হার্টবিট বেড়ে যায়, আনিস যদি জাকিয়ার চোখে চোখ রাখে তাহলে সাথে সাথেই জাকিয়া তা বুঝে যাবে। তখন আনিসের লজ্জার আর শেষ থাকবে না। আনিস মাথা নিচু করে বসে আছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না দুই বোন একসাথে এমন হাসছে কেন!
আপনি এমন মাথা নিচু করে বসে আছেন কেন? সে কি আপনি তো দেখছি লজ্জায় লাল হয়ে গেছেন! আপনি আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকছেন কেন বলেন তো? আমি আপনার চেয়ে ছোটই হবো। আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন।
কেয়া তখনো মিটমিট করে হাসছে। কেয়ার দিকে তাকিয়ে আনিস বলল, কী ব্যাপার কেয়া, তুমি হাসছ যে! এখানে কি হাসির কিছু হয়েছে?
আনিস অনেকটা রাগান্বিত হয়ে কথাগুলো বলল। তাতে কেয়া চুপ হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বসে রইল।
তোমাকে যে একটা বিষয়ে লিখতে দিয়েছিলাম, তা কি লিখেছ?
কেয়া মাথা নিচু করেই বলল, জি স্যার লিখেছি। তাহলে আমাকে দেখাওনি কেন?
আপনি পত্রিকা পড়ছিলেন, তাই আমি আপনাকে বলতে পারিনি।
লেখা শেষ করে বসে আছ, অথচ আমাকে বলোনি!
না, মানে আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন তো, তাই আমি বলতে পারিনি। স্যরি স্যার।
জাকিয়া বলল, আপনি পত্রিকার পাতায় এতটাই ডুবে ছিলেন যে, আমি ঘরে ঢুকেছি, কেয়ার পাশে চেয়ার টেনে বসেছি তাও আপনি টের পাননি। আমি কাশি না দিলে তো এখনো আপনি টের পেতেন কি না সন্দেহ!
জাকিয়ার কথায় আনিসের চোখ-মুখ আবার লাল হয়ে যায় লজ্জায়।
আচ্ছা আনিস সাহেব, কী এমন খবর ছিল পত্রিকায় যে আপনি এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন? আপনার বলতে কোনো সমস্যা না থাকলে আমাদের সাথে কি শেয়ার করা যায়?
আনিস চুপ করে রইল। আনিসের জীবনের অনেক কিছুই সে কেয়ার সাথে শেয়ার করেছে। জাকিয়ার সাথে তার তেমন একটা কথাবার্তা হয় না। মাঝে মাঝে হয়। সেটাও তেমন নয়। জাস্ট কেমন আছেন টাইপের। কিন্তু আনিস বুঝতে পারছে যে আনিসের বিষয়ে জাকিয়া অনেকটাই আগ্রহী। আনিসেরও জাকিয়ার সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে জাকিয়ার সাথে বন্ধুত্ব করতে। কিন্তু আনিসের স্বভাব অনেকটাই দুর্বল প্রকৃতির। বরাবরই আনিসের সাহস কম। তাছাড়া আগ বাড়িয়ে তার এই জীবনে কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে যায়নি। তাই আনিস কিছু আঁচ করতে পেরেও জাকিয়ার ব্যাপারটিতে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি। জাকিয়ার বিষয়ে আগ্রহ না দেখানোর পিছনে আর একটা কারণও আছে। সেটা হচ্ছে, এই মুহূর্তে সে কোনোভাবেই এই টিউশনিটা হাতছাড়া করতে চায় না। যতদিন পর্যন্ত তার একটা চাকরি না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তার এই টিউশনিটা জরুরি। জাকিয়ার প্রশ্নে আনিস মাথা নিচু করে বসে রইল।
আচ্ছা থাক, আপনার বলতে সমস্যা থাকলে বলার প্রয়োজন নেই। তার পরেও চোখ-মুখ এমন লাল করে বসে থাকবেন না। আপনি ছেলে মানুষ। ছেলে মানুষ লাজুক হলে মানায় না, বুঝতে পারলেন আনিস সাহেব। ঠিক আছে আপনি কেয়াকে পড়ান। আমি আসি।
আনিস বলল, বলা যাবে না তা ঠিক নয় ম্যাডাম।
ম্যাডাম শব্দটি মুখ থেকে বের করে আনিস তার জিহ্বায় কামড় দিল। জাকিয়া চোখ বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাকিয়া বুঝতে পারছে না তার সামনে বসা এই অতি সাধারণ টাইপের একটি ছেলের জন্য তার এত শ্রদ্ধা, এত ভালোবাসা কোথা থেকে জন্মাল? কেন আনিস নামের এই ছেলেটিকে জাকিয়ার এত ভালো লাগে? কবে থেকে আনিস নামের এই ছেলেটিকে জাকিয়া ভালোবাসতে শুরু করল? যতক্ষণ জাকিয়া আনিস নামের এই সাধারণ, অতি সাধারণ ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ততক্ষণ জাকিয়ার কী যে একধরনের ভালোলাগা তাকে ঘিরে থাকে, তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। জাকিয়া চোখ বড় বড় করে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি আসলে পত্রিকার একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পড়ছিলাম। সড়ক বিভাগের একটি সার্কুলার হয়েছে। আমি আমার সিভি সড়ক বিভাগে জমা দিয়ে এসেছি। সড়ক বিভাগে আমার মামা চাকরি করেন। উনার কাছেই সিভিটি দিয়ে এসেছি। তাই খবরটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। একটা সরকারি চাকরি আমার খুব প্রয়োজন। আমার মায়ের খুব ইচ্ছে যে আমি সরকারি চাকরি করি। আমার বাবাও একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। বেসরকারি চাকরি আমার মায়ের পছন্দ নয়। তাই আমি এতদিন হয়েছে পাস করে বেরিয়েছি কিন্তু বেসরকারি চাকরিতে ট্রাই করিনি। বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ দিয়েছি। দুই-একটা পরীক্ষায় পাসও করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরিটা আমার হয়নি।
কেন হয়নি? জাকিয়া প্রশ্ন করল।
হয়নি কারণ, চাকরিটি পাওয়ার জন্য সেখান থেকে টাকা চেয়েছিল। সামান্য কোনো ফিগার নয়, মোটা অঙ্কের ফিগার। যা আমার পক্ষে দেয়া অসম্ভব। আমার মামা যেহেতু সড়ক বিভাগের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, তাই উনি আমার কাছ থেকে আমার বায়োডাটা নিয়েছেন। তাই সড়ক বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি দেখে মনে মনে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে যে হয়তো এই পরীক্ষা দিলে আমার চাকরিটা হয়ে যেতে পারে।
জাকিয়ার কেন জানি আনিসের জন্য বুকের ভিতর একধরনের কষ্ট অনুভব হতে লাগল। এই কষ্টের উৎস জাকিয়া জানে। এই কষ্টের নাম ভালোবাসা। আনিসের কাছে কথাগুলো শুনে জাকিয়ার এতটাই খারাপ লাগতে লাগল যে তার চোখে পানি আসার উপক্রম প্রায়! জাকিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কেয়া তুই পড়, আমার একটা জরুরি ফোন দিতে হবে। এই কথা বলে জাকিয়া অনেকটা বিদ্যুতের গতিতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আনিস মাথা নিচু করে থাকায় জাকিয়ার এই অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না। আনিসের চোখে পড়লো না, জাকিয়া নামের একজন অসাধারণ মেয়ের ভালোবাসার অশ্রুসজল চোখ।
কিন্তু জাকিয়ার চোখের কোণে যে ভালোবাসার অশ্রু জমেছে কেয়ার চোখে তা ঠিকেই ধরা পড়ল। জাকিয়ার জন্য কেয়ার অনেক খারাপ লাগতে লাগল। জাকিয়ার অশ্রুসজল চোখ দেখে কেয়ার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কেয়া আনিসকে বলল, স্যার, আজকে আর পড়ব না।
কেন? কী হয়েছে?
এমনিতেই স্যার, ভালো লাগছে না। স্যার, আপনার জন্য একটা গিফট আছে আমাদের দুই বোনের তরফ থেকে। এখানে দেখবেন না। বাসায় যেয়ে প্যাকেট খুলবেন।
আনিস প্রশ্ন করল, গিফট মানে?
এমনিতেই ইচ্ছে করল আপনাকে কিছু দেয়ার, তাই। আপনি আবার অন্য কিছু মনে করবেন না স্যার, প্লিজ।
না না, আমি আবার কী মনে করব!
আনিসের হাতে কেয়া গিফটের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আনিস ঠিক বুঝতে পারছে না প্যাকেটের ভিতরে কী আছে। অনেকটা চিন্তিত হয়ে আনিস কেয়ার গিফটের প্যাকেট নিয়ে কেয়াদের বাসা থেকে বের হয়ে এলো।

(চলবে)

লেখক : হুমায়ুন কবির হিমু

Related Articles

Back to top button