গল্প-কবিতা

হুমায়ুন কবির হিমু’র উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’(৪র্থ পর্ব)

জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ‌‌’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।

পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হচ্ছে । আজ রইল উপন্যাসের (৪র্থ পর্ব)

ইডেন কলেজের বিপরীত পাশে যে স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে সেখানে কয়েকটি দোকান রয়েছে। সেখানে চা-নাশতা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। ফুয়াদ আজ সকাল সকাল ইডেন কলেজের সামনে এসে হাজির হয়েছে। কারণ গতকাল রাতে নাজমা তাকে সকাল নয়টার মধ্যে তার কলেজের সামনে আসতে বলেছে। ফুয়াদের সাথে নাকি তার জরুরি কিছু কথা আছে। তাই ফুয়াদ আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে।
গতকাল ফুয়াদ নাইট শিফটে কাজ করেছে বিধায় আজ তার সকালে অফিসে যেতে হবে না। তার অফিস আজ বিকাল তিনটা থেকে শুরু হবে। নাইট সিফটে কাজ করে ফুয়াদ বাসায় ফিরেছে ভোর পাঁচটায়। বাসায় এসেই সে দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠে সে বাথরুমের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করেছে। রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মায়ের সাথে দেখা। রাহেলা তার ছোট ছেলের সাতসকালে বাইরে যাওয়া দেখে অনেকটাই অবাক! ফুয়াদের সাধারণত নাইট সিফটে কাজ করলে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস। কিন্তু গতকাল নাইট সিফটে কাজ করে আজ এত সকাল সকাল ফিটফাট হয়ে ফুয়াদের বাইরে যাওয়াটা রাহেলা বেগমের কাছে একটু না, বিরাট আকারের অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রাহেলা তার এই ছোট ছেলেটিকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ফুয়াদ আজ সাদা শার্ট আর কালো জিনস প্যান্ট পরেছে। চোখে কালো সান গ্লাস লাগিয়েছে। ফুয়াদের গায়ের রং ফর্সা হওয়ায় তাকে দেখতে অনেক স্মার্ট এবং অনেক সুন্দর লাগছে।
কিরে ফুয়াদ, এত সকাল সকাল তুই কোথায় যাচ্ছিস? তোর তো আজ এত সকাল সকাল ওঠার কথা না! গতকাল তো তুই নাইট সিফটে কাজ করেছিস! আজকে না তোর বিকালে অফিস যাওয়ার কথা? রাহেলা তার ছেলেকে একসাথে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করে ফেলেছে।
ফুয়াদ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি
মা। সকাল নয়টায় দেখা করতে বলেছে। তাই সকাল সকাল উঠেছি। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো মা। কিছু খাবার থাকলে দাও। ক্ষুধা
পেয়েছে। বাইরের কিছু খাওয়ার চেয়ে ঘরে কিছু খেয়ে ঘর থেকে বের হওয়া অনেক উত্তম।
রাহেলার কাছে ফুয়াদকে অনেক উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। ফ্রিজে গত রাতের রান্না করা মাংস আছে। তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি তোকে রুটি বানিয়ে দিচ্ছি। রুটি আর মাংস খেয়ে বাইরে যেতে পারিস।
সমস্যা নেই মা, তুমি তাড়াতাড়ি করো। একটু পর বাবা উঠে যাবে। আর বাবা উঠলে হাজারটা প্রশ্ন করবে আমার বাইরে যাওয়া নিয়ে। সেটা আমার জন্য একটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে।
রাহেলা লক্ষ করল, ফুয়াদ কথাগুলো বলল বেশ আনন্দের সাথে। গতানুগতিকের চেয়ে আজ ফুয়াদকে একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে রাহেলার। রাহেলা ফুয়াদকে প্রশ্ন করল, ফুয়াদ, তুই কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস?
লুকাচ্ছি মানে! তোমার কাছে আবার কী লুকাব! ফুয়াদ বেশ অবাক হয়ে তার মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিল।
কিছু না লুকালেই ভালো। এই কথা বলে রাহেলা রান্নাঘরের দিকে
চলে গেল।
ফুয়াদ নাশতার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ফুয়াদ ডাইনিং টেবিলে বসে নাশতার জন্য অপেক্ষা করছে আর ডাইনিং টেবিলে তবলা বাজানোর স্টাইলে হালকা শব্দ করে তবলা বাজাচ্ছে। তার মনে আজ যারপরনাই আনন্দ। নাজমার সাথে দেখা করাটা ফুয়াদের জন্য এক বিশাল ব্যাপার। ফুয়াদের সাথে নাজমার সম্পর্ক প্রায় তিন মাস হতে চলল। এই তিন মাসে নাজমার সাথে তার দেখা হয়েছে মাত্র তিনবার। নাজমা সমসাময়িক অন্যান্য মেয়েদের মতো না বলেই ফুয়াদের ধারণা। কারণ বর্তমানের মেয়েরা যেখানে তার বয় ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করার জন্য এবং রুমডেট থেকে শুরু করে নানান জায়গায় ডেট করার জন্য ব্যস্ত থাকে, সেখানে নাজমা ফুয়াদের সাথে খুব একটা দেখা করে না। নাজমা ফুয়াদকে এই বিষয়ে বলেছে, সে আর দশটা মেয়ের মতো না। তার বাইরে ঘুরতে ভালো লাগে না। তাছাড়া ঢাকা শহরে তাদের আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই। বাইরে ঘুরলে কারো না কারো চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দুজনের মধ্যে দেখা হবে কম কিন্তু ফোনে কথা হবে। দেখা করার প্রয়োজন হলে নাজমাই তাকে জানাবে। এই যেমন গত রাতে নাজমা তাকে ফোন করে আজ সকালে দেখা করার কথা জানিয়েছে।
ফুয়াদ চোখ বন্ধ করে নিচু স্বরে একটি হিন্দি গান গাচ্ছে আর ডাইনিং টেবিলে হাতের আঙুল দিয়ে তবলার সুর তুলছে। ফুয়াদের সামনে যে তার বাবা বজলুর রহমান বজু সাহেব এসে দাঁড়িয়েছে ফুয়াদের সেদিকে খেয়াল নেই। ফুয়াদ মাথা নিচু করে একমনে নিচু স্বরে গান গেয়ে যাচ্ছে আর ডাইনিং টেবিলকে তবলা বানিয়ে তবলা বাজাচ্ছে।
বজু সাহেব তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার ছোট ছেলে কি পাগল হয়ে গেল নাকি? ঢাকা ভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স শেষ করে একটি স্বনামধন্য আইটি গ্রুপে ফুয়াদ চাকরি করে। সেই ফুয়াদ তার বাবার সামনে মাথা নিচু করে গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর টেবিলকে তবলা বানিয়ে তবলা বাজাচ্ছে! বজু সাহেব তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
ফুয়াদ গান থামিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতে গিয়ে তার বাবাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। ফুয়াদের কাছে মনে হলো, তার সামনে তার বাবা নয়, ভয়ংকর কিছু দাঁড়িয়ে আছে! নিজেকে সামলে নিয়ে ফুয়াদ বলল, বাবা, তুমি কখন ঘুম থেকে উঠলে?
বজু সাহেব তার ছোট সন্তান ফুয়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফুয়াদকে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বড় বড় দেখতে লাগল।
এত সাতসকালে তুই এই রকম ফিটফাট হয়ে কোথায় যাস?
মানে বাবা, একজন বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি বাবা।
কোথায় দেখা করতে বলেছে?
এই তো বাবা ইডেন কলেজের সামনে। এই কথা বলে ফুয়াদ নিজের জিহ্বায় নিজেই কামড় দিল।
ইডেন কলেজের সামনে মানে? তুই কি মেয়ে বন্ধু না কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস? ইডেন কলেজে এত সকাল সকাল শুধু তো মেয়েদের আসার কথা। তোর মেয়ে বন্ধুটির নাম কী?
নাজমা বাবা। না না নাজমুল বাবা। নাজমুলরা ইডেন কলেজের পাশে যে স্টাফ কোয়ার্টার আছে সেখানে থাকে। তার বাবা সরকারি চাকরি করে তো, তাই সেখানে কোয়ার্টারে থাকে। আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড। খুব ভালো ছেলে বাবা। ফুয়াদ নিজেকে সামলে নিয়ে অনেকটা স্বাভাবিকভাবে তার বাবার প্রশ্নের উত্তর দিল।
ফুয়াদের কথায় বজু সাহেব খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারল না। বজু সাহেব তার ছোট ছেলে ফুয়াদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। এমন সময় রাহেলা ফুয়াদের জন্য নাশতা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখল। ফুয়াদ তার বাবা-মায়ের দিকে না তাকিয়ে নাশতা খেতে লাগল।
বজু সাহেব বলল, আস্তে খা, তুই যেভাবে খাচ্ছিস তাতে তো গলায় আটকাবে! বাথরুমে যাওয়ার আগে ফুয়াদকে লক্ষ করে বজু সাহেব বলল, ফুয়াদ, তোর মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না! এমন কিছু করবি না যাতে আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়। রাহেলা, তোমার ছেলেকে আমার কথার মানেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিও। এই কথা বলে বজু সাহেব বাথরুমের দিকে চলে গেল। রাহেলা কোনো কথা বলল না।
ফুয়াদ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনে মনে ফুয়াদের সন্দেহ হচ্ছে, তার বাবা কিছু বুঝতে পারল না তো? বুঝলে বুঝুক, পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া। এই বলে বাসার সামনে থেকে একটি রিকশা নিয়ে সোজা ইডেন কলেজের সামনে এসে ইডেন কলেজের পাশের কোয়ার্টারে ঢুকে বেঞ্চে বসে চা আর সিগারেট টানছে।
নয়টা বাজতে এখনো পনেরো মিনিটের মতো বাকি। এর মাঝে ফুয়াদ কয়েকবার নাজমাকে ফোন দিয়েছে। নাজমা শুধু একবার ফোন রিসিভ করে ফুয়াদকে জানিয়েছে সে আসবে না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফুয়াদের বেশ টেনশন হচ্ছে। ফুয়াদ ভাবতে লাগল, নাজমা কী এমন জরুরি কথা বলবে তাকে? তার মাথায় কিছু কাজ করছে না। ফুয়াদ আর একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট শেষ না হতেই নাজমার রিকশা এসে তার সামনে দাঁড়াল।
ফুয়াদ সিগারেট ফেলে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, বাহ! এখন ঘড়িতে জাস্ট নয়টা বাজে। সঠিক সময়েই আসতে পেরেছ।
নাজমা তার এই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, তোমার কাছে ভাংতি টাকা আছে? আমার কাছে ভাংতি টাকা নেই। তুমি রিকশাওয়ালাকে ত্রিশটি টাকা দাও তো।
ফুয়াদ মানিব্যাগ থাকে ত্রিশ টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে দিল। ফুয়াদ বলল, আমরা কি কোথাও যাব, নাকি এখানেই বসে কথা বলব?
না, আজ কোথাও যাওয়া যাব না। আমি জাস্ট তোমাকে কিছু কথা বলার জন্য আজ বের হয়েছি। আজ আমার কোনো ক্লাস নেই। তার পরেও বাসায় মিথ্যা কথা বলে বের হয়েছি।
নাজমাকে অনেকটা চিন্তিত মনে হচ্ছে। ফুয়াদ ব্যাপারটা লক্ষ করে বলল, বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
নাজমা চুপ করে রইল।
কী ব্যাপার, কথা বলছ না যে? তুমি কি বাসায় নাশতা করে বের হয়েছ?
নাজমা বলল, হ্যাঁ, আমি নাশতা করে বের হয়েছি।
নাজমা ধীরে ধীরে ফুয়াদকে যা বলল, তা হচ্ছে, তার বিয়ে দেয়ার জন্য তার বাবা ব্যস্ত হয়ে গেছে। ঘটক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যখন-তখন তার কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। তাই তার পক্ষে ফুয়াদের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ নাজমা তার বাবাকে যমের মতো ভয় পায়। তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু সে নয়, তার পরিবারের কেউ-ই কথা বলতে পারে না। তাই যা করার ফুয়াদকে খুব দ্রুত করতে বলল।
ফুয়াদ নাজমার কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। এই মুহূর্তে ফুয়াদ নাজমাকে ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার বড় ভাই ফিরোজের এখনো বিয়ে হয়নি। সবে মাত্র বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কবে নাগাদ বিয়ে হবে তা বলা মুশকিল। ফিরোজের আগে ফুয়াদ বিয়ের কথা বাসায় বললে বা বিয়ে করলে নির্ঘাত তার বাবা তাকে বাসা থেকে ঘাড় ধরে বের করে দিবে। ফুয়াদ মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাগল নাজমাকে কী বলে সান্ত¡না দেয়া যায় বা নাজমাকে কী বলা যায়।
ফুয়াদকে চুপ করে থাকতে দেখে নাজমা অবাক হয়ে ফুয়াদকে বলল, কী ব্যাপার, তুমি চুপ করে আছ যে? বলো, এখন আমি কী করব? আমার পক্ষে বাবাকে ফেস করা সম্ভব না। তুমি তোমার বাবা-মাকে আমাদের বাড়িতে পাঠাও।
ফুয়াদ ভালো করেই জানে, তার বাবা যখন শুনবে যে তার হবু বিয়াই পুরান ঢাকার বাসিন্দা এবং চকবাজারে টিনের ব্যবসা করে তাহলেই তাকে ঝাঁটাপিটা করবে। সেখানে কিনা নাজমা বলছে বিয়ের কথা বলতে তার বাবা-মাকে তাদের বাড়িতে পাঠাতে! ফুয়াদ মনে মনে ভাবতে লাগল, তার এই মহা বিপদে একমাত্র আনিস ভাই-ই পারে তাকে রক্ষা করতে।
নাজমা অনেকটা বিরক্ত হয়ে ফুয়াদকে বলল, তুমি কিন্তু আমার কথার কোনো জবাব এখনো দাওনি। তার মানে কি আমি ধরে নিব, তোমার কিছু বলার নেই?
বলার নেই মানে! অবশ্যই আছে। তোমার বাবা চাইল আর তোমার বিয়ে দিয়ে দিল! এটা কি মগের মুল্লুক নাকি! তুমি কোনো টেনশন কোরো না, আমি সব কিছু সামলে নিব। তোমার বাবা তোমার সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তুমি স্ট্রেইট তাকে বলে দিবে আমার কথা। তার পরও যদি সে তোমার সাথে কোনো কাহিনি করতে চায় তাহলে আমাকে জানাবে, আমি তোমাদের বাসায় যেয়ে তোমার বাবার স্ক্রু টাইট দিয়ে আসব। ঢাকা শহরে আমার কিন্তু ডেঞ্জারাস ডেঞ্জারাস টাইপের মানুষের সাথে পরিচয় আছে।
নাজমা ফুয়াদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ফুয়াদের কথা শুনছে। নাজমার মনে হলো, তার বিয়ের কথা শুনে ফুয়াদের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল নাকি! নাজমা বলল, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? তুমি আমার বাবার স্ক্রু টাইট করবে মানে কী? আর তুমি এইভাবে কথা বলছ কেন?
এইভাবে কথা বলব না তো কোনভাবে কথা বলব? তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দিতে চাইবে আর আমি তাকে ছেড়ে কথা বলব? তোমার বাবাকে এমন শিক্ষা দিব যে তার বাবার নাম আমি ভুলিয়ে দিব। বিয়ে
দিতে চায়।
ফুয়াদ কথাগুলো এমনভাবে বলছিল তাতে করে যে কারো মনে হতে পারে ফুয়াদ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির সাথে ঝগড়া করছে। নাজমা বলল, তোমার মাথা মনে হয় এলোমেলো হয়ে গেছে। তুমি থাকো, আমি বাসায় গেলাম। আমি পরে তোমার সাথে দেখা করব কেমন? আর শুনো, তুমি সোজা বাসায় যাবে। মাথা ঠান্ডা করে আমাকে ফোন দিবে। তার পর আমি তোমার সাথে কথা বলব। কারণ এখন তুমি কী বলছ, তুমি নিজেও জানো না। আর এমন উত্তেজিত হয়ে কথা বলছ যে আশেপাশের মানুষ আমাদের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। তারা মনে করছে আমরা দুজন এখানে স্বাভাবিক কথা বলছি না, ঝগড়া করছি। আমি আজ গেলাম। তোমার সাথে ফোনে কথা হবে কেমন? তুমি একটু শান্ত হও। আমার তো এখনো বিয়ে হয়ে যায়নি। কেবল কথা শুরু হয়েছে। তুমি উত্তেজিত হলে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে পারবে না। তাই আগে মাথা ঠান্ডা করো। তারপর দুজনে বসে সিদ্ধান্ত নিব কী করা যায়।
ফুয়াদ চুপ করে নাজমার কথাগুলো মনোযোগসহকারে শুনল। আসলেই তো, সে এত উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে কেন? নিজেকে সামলে নিয়ে ফুয়াদ বলল, স্যরি, কিছু মনে কোরো না। তোমার বিয়ের কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। তুমি তো জানো, আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। আমার ছাড়া তুমি অন্য কারো হবে এটা আমি কল্পনাও করতে পারি না নাজু। ফুয়াদ নাজমাকে আদর করে নাজু বলে ডাকে।
আমি সেটা জানি। আর জানি বলেই তো তোমাকে সব কিছু জানালাম। আমিও তো তোমাকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। তাই একটা দ্রুত চিন্তা করে বের করো কী করা যায়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বাসায় যাচ্ছি। তোমার সাথে ফোনে কথা হবে কেমন? এই বলে নাজমা রিকশা ঠিক করে চলে গেল।
নাজমা চলে যাওয়ার পর ফুয়াদ ভাবতে লাগল, তার এখন কী করা উচিত। তার কাছে বারবার মনে হতে লাগল নাজমার সাথে এই জীবনে আর মনে হয় দেখা হবে না। ফুয়াদ চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। তার ভালোবাসার তিন মাস যেতে না যেতেই ক্লাইমেক্স শুরু হয়ে গেছে। তার এই বিপদের কথা শেয়ার করার জন্য একজনই আছে, সেটা হচ্ছে আনিস ভাই।
ফুয়াদ আনিসের মোবাইলে ফোন লাগাল। ফোন দিয়ে ফুয়াদ মোবাইলে শুনতে পেল, এই মুহূর্তে আপনি যে নাম্বারে ফোন দিয়েছেন, তা এখন বন্ধ আছে, অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন। স্যরি!
ফুয়াদ আরো কয়েকবার ট্রাই করে একই উত্তর পেল। ফুয়াদ আনিসের বাসার ঠিকানা জানে না। শুধু জানে তার আনিস ভাই মিরপুরে কয়েকজন বন্ধুর সাথে মেস করে থাকে। ফুয়াদ আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে উদাস মনে একটা রিকশা ঠিক করে তার বাসার দিকে রওনা হলো।

শাহাদতের বিয়ে মানে? কবে? কোথায়?
রিপন, আশরাফুল, মনোয়ার আর জাহিদ যে যার কাজ থেকে মেসে ফিরে আনিসের কাছ থেকে শাহাদতের বিয়ের কথা শুনে একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
আমি সকালে মামার অফিসে গিয়েছিলাম আমার একটা কাজে। সেখান থেকে ফিরে আমার সাথে শাহাদৎ ভাইয়ের দেখা। আমাকে দেখে তিনি বেশ খুশি মনে বলল, আমাকে পেয়ে নাকি তিনি খুব আনন্দিত! আমি তার কারণ জানতে চাওয়াতে তিনি আমাকে জানালেন যে তাকে জরুরি কাজে বাড়িতে যেতে হচ্ছে। আমি আরো ভালোভাবে জিজ্ঞাস করাতে তিনি জানালেন যে আগামী শুক্রবার নাকি তার বিয়ে। তার বাবা তাকে আজকে সকালে ফোন করে বাড়িতে যেতে বলেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে যে তিনি বাড়িতে যেয়ে বিস্তারিত জানাবে আর সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে আগামী বৃহস্পতিবারে আমাদের যেতে হবে।
আমাদের যেতে হবে মানে? আমাদের যেতে হবে মানে কী? আনিস সাহেব, আপনি আশরাফুল ভাইয়ের বন্ধু এবং আমাদের এখানে নতুন এসেছেন বিধায় আপনি অনেক কিছু জানেন না। শাহাদতের এর আগেও বিয়ে ঠিক হয়েছিল। এর আগেও শাহাদৎ বলেছিল সব ফাইনাল। কিন্তু বিয়ের ঠিক চূড়ান্ত সময় মেয়ে পক্ষ শাহাদতের বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দেন যে তাদের মেয়ে এই মুহূর্তে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নয়। তাই বিয়েটা আরো পরে হলে ভালো হয়। মেয়ের বাবা সরাসরি তাদের মেয়েকে বিয়ে না দেয়ার কথা না বলে একটু ঘুরিয়ে বলেছে আর কি। শাহাদতের বাবা যেহেতু শিক্ষক মানুষ তাই তার বুঝতে বাকি থাকেনি যে তার ছেলে শাহাদতের বিয়ে সেখানে হচ্ছে না। আমরা যখন সব কিছু গুছিয়ে বরিশালে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি ঠিক সেই সময় শাহাদৎ তার বিয়ে না হওয়ার কথা ফোনে জানিয়েছে। আমি ডেম শিওর, এইবারও তাই হবে। ব্যাটার সাইজ ঠিক নাই, তারপরেও বিয়ে করার জন্য পাগল!
আশরাফুল, জাহিদ আর মনোয়ার ভাই, এইবার আপনারা গেলেও আমি যাচ্ছি না। অনেকটা বিরক্ত হয়ে রিপন কথাগুলো বলল।
আপনার ঘটনাটা কী রিপন সাহেব? শাহাদতের বিয়ে এইবারও ভেঙে যাবে আপনাকে তা কে বলল? আর আপনি শাহাদতের সাইজ খারাপ এই কথা কেন বলেন? আমার কাছে তো শাহাদৎ সাহেবকে খারাপ লাগে না। ভালো চাকরি করে, ভালো রান্না করতে পারে, শিক্ষক বাবার একমাত্র ছেলে, তার সাইজ আপনি খারাপ কোথায় দেখলেন? আমার তো মনে হয় যে মেয়ের সাথে শাহাদৎ সাহেবের বিয়ে হবে সেই মেয়ে অনেক সুখী হবে।
জাহিদ আর আশরাফুলও মনোয়ারের কথার সাথে একমত পোষণ করল।
ভাই আপনারা যাই বলেন, অনেক দিন থেকে কোনো দাওয়াত খাওয়া হয় না। শাহাদৎ ভাইয়ের বিয়েটা খাওয়ার ইচ্ছা তীব্রভাবে পোষণ করছি। আর যেহেতু বিয়েটা খেতে বরিশালে যেতে হবে সেটা হবে আরো মজাদার। অনেকটা আনন্দের সাথে জাহিদ কথাগুলো বলল।
কিন্তু মনোয়ার ভাই, রিপন সাহেব যে কথাগুলো বলল তা কিন্তু এক্কেবারে খারাপ বলেনি। শাহাদৎ সাহেবের সাইজ খারাপ না হলেও ভাগ্য খুব একটা ভালো বলে মনে হয় না। কারণ, যে ছেলের প্রথম বিয়ে ভেঙে যায় তার বিয়ের জন্য মেয়ে পাওয়াটা শুধু কঠিন না, ভয়াবহ কঠিন। দেখা গেল সব ঠিকঠাক থাকার পরেও শেষ মুহূর্তে গত বারের মতো কাহিনি ঘটল, তখন কিন্তু একটা বেইজ্জতি ব্যাপার হয়ে যাবে। আশরাফুল অনেকটা ঠান্ডাভাবে কথাগুলো
বলে গেল।
আশরাফুলের কথায় রিপন সমর্থন দিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন ভাই। বেসাইজ্জা পোলাপানের জীবনে বউ জোটে না রে ভাই।
রিপন ভাই, আপনি শাহাদৎ ভাইয়ের পিছনে লেগেছেন কেন বলেন তো? বেচারার জীবনে না একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই বলে কি সব সময় একই ঘটনা ঘটবে? আনিস ভাই আপনি কী বলেন?
আমি আর কী বলব ভাই! আমি তো আপনাদের এখানে নতুন। আপনাদের সবার বিষয়ে আমার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শাহাদৎ ভাইয়েরও তেমন কিছু আমি ভালো জানি না। তবে শাহাদৎ ভাইয়ের রান্নার আমি একজন ভক্ত। সেদিন তার হাতের রান্না খেয়ে আমি তার ভক্ত হয়ে গেছি। তবে আপনারা যে যাই বলেন না কেন, আমার কাছে কিন্তু শাহাদৎ ভাইকে ভালোই লাগে। সহজ-সরল মনে হয়।
আনিসের কথা শেষ হতেই রিপন বেশ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। শাহাদৎ যদি সহজ-সরল হয় তাহলে কঠিনের সংজ্ঞা নতুন করে লিখতে হবে। আশরাফুল ভাই আপনার বন্ধু কী বলে, শাহাদৎ নাকি সহজ-সরল?
আহ! রিপন সাহেব, আপনি অযথাই শাহাদতের পিছনে লেগেছেন। দয়া করে একটু থামেন তো! আমরা সবাই একই ছাদের নিচে থাকি, কোথায় একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে যাব তা নয়, একে অন্যের সমালোচনা করছি! তার চেয়ে আসুন আমরা সবাই কামনা করি যাতে যে মেয়েটির সাথে শাহাদৎ সাহেবের বিয়ে ঠিক হয়েছে তার সাথেই যেন তার বিয়ে হয় এবং শাহাদৎ যদি আগামী বৃহস্পতিবারে ফাইনাল রেজাল্ট আমাদের জানায় তাহলে অবশ্যই আমরা সবাই বরিশালে যাব শাহাদৎ সাহেবের বিয়ে খেতে। কী বলেন আশরাফুল, জাহিদ আর আনিস সাহেব?
মনোয়ারের কথায় রিপন বাদে সবাই একমত হলো। সবাই একমত হওয়াতে রিপনকে অনেকটা বিষণœ মনে হলো। তা লক্ষ করে আশরাফুল বলল, রিপন ভাই, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই বার শাহাদতের বিয়েটা হয়ে যাবে। আপনি দেখবেন, আমার কথা মিথ্যা হবে না। আমরা সবাই মিলে মজা করতে করতে বরিশাল যেয়ে শাহাদৎ সাহেবের বিয়ে খেয়ে আসব। আপনিও অবশ্যই যাবেন। প্লিজ।
আশরাফুলের কথায় রিপন অনেকটা শান্ত হলো। কোনো এক বিচিত্র কারণে রিপন এই মেসের কাউকে না মানলেও আশরাফুলকে মানে। আশরাফুলের উপর অনেকটা ভরসা করে রিপন। তার ধারণা, আশরাফুল সাহেব উল্টাপাল্টা কথা কম বলে। আর না ভেবে কোনো কথা আশরাফুল
বলে না।
আশরাফুল ভাই, আপনি যখন বলছেন আমি অবশ্যই যাব, কিন্তু শাহাদতের মেয়ে ভাগ্য ভালো না, এটা আমি জানি।
আপনি জানেন মানে?
সবাই রিপনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে থাকিয়ে প্রশ্ন করল।
আপনাদের একটি কথা বলা হয়নি। আমি জানি না যে শাহাদৎ ভাই আপনাদের সাথে কথাটি সেয়ার করেছে কি না।
সবাই রিপনের কথা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। সবাই একসাথে জানাল যে শাহাদৎ তাদের সাথে এই বিষয়ে কোনো কিছু শেয়ার করেনি।
শাহাদতের প্রথম বিয়েটি যখন ভেঙে যায় তখন শাহাদৎ মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়ে। আমি প্রায়ই দেখতাম, মেয়েদের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করতে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমার কাছে বা চলনে-বলনে হতাশা প্রকাশ করলেও তলে তলে মোবাইলের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়। মোবাইলে তিন তিনটি মেয়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলে। একপর্যায়ে তিনটি মেয়ের সাথেই শাহাদৎ দেখা করার জন্য যায় এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে আমাকে সাথে করে নিয়ে যায়। কিন্তু প্রত্যেকটি মেয়ে শাহাদৎকে দেখার পর আর বেশিক্ষণ অবস্থান না করে কেটে পড়েছে। এই কথাগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার না করার জন্য শাহাদৎ আমাকে বারণ করেছিল বিধায় আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করিনি। আমি সেই তিনটি মেয়ের একটি মেয়েকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, আপনি কেন শাহাদৎ ভাইয়ের সাথে এমন করলেন? সেই মেয়েটি আমাকে বলেছিল, শাহাদতের নাকি সাইজ খারাপ। বিয়েতে হতাশ হয়ে, মোবাইল ফোনে ব্যর্থ হয়ে শাহাদৎ ভাই অনেকটাই হতাশ। দু’একদিন তাকে আমি কাঁদতেও দেখেছি এই ব্যাপারে। আমি তাকে সান্ত¡না দিতাম। আমার সাথে সব কিছু শেয়ার করত। তার পর আমি তাকে আমার এক পরিচিত বাবার কাছে নিয়ে যাই। বাবা শাহাদৎকে দেখেই বলে দেয় যে, রিপন কাকে নিয়ে আসছিস, তোর সাথে যাকে আমার কাছে যে কাজে নিয়ে এসেছিস, তার সমস্যার সমাধান খুব সহজে হবে বলে মনে হয় না। কারণ সাইজ ভালো না! এখন আপনারাই বলেন, আমি কি সাধে বলি শাহাদতের সাইজ খারাপ! আর এই কথা আমি শাহাদৎকে বলি বলে এখন আর শাহাদৎ আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু শাহাদতের একটি ভালো বিয়ে হোক এটা আপনারা যেমন চান, আমিও তাই চাই। কিন্তু বাবার কথা অবিশ্বাস করি কী করে বলেন?
রিপনের মুখ থেকে শাহাদৎ-বিষয়ক এই সমস্ত অজানা তথ্য জেনে আশরাফুল, মনোয়ার, জাহিদের সাথে আনিসও অবাক না হয়ে পারল না। রিপনের কথার পর সবাই চুপ মেরে গেল।
নীরবতা ভেঙে জাহিদ বলল, যা হয় হোক, শাহাদৎ ভাই যদি আমাদের যেতে বলে আমি যাব। রিপন ভাই, এই সমস্ত বাবাটাবার কথা বিশ্বাস না করে চলেন তো ভাই, সবাই মিলে যেয়ে শাহাদৎ ভাইয়ের বিয়েটা দিয়ে আসি।
জাহিদের কথায় রিপন বলল, ঠিক আছে, আগে শাহাদৎ ফাইনাল রিপোর্ট আগে দিয়ে নিক, তারপর দেখা যাবে। রাত অনেক হলো, এখন চলেন সবাই রাতের খাওয়া খেতে বসি।
তাই তো, রাত তো অনেক হয়েছে। দশটা প্রায়! আশরাফুল অবাক হয়ে ঘড়িতে তাকিয়ে বলল।
মনোয়ার হাসতে হাসতে বলল, যার বিয়ে তার খবর নাই আর আমরা মেসবাসীর চোখে ঘুম নাই।
মনোয়ারের কথায় একসঙ্গে সবাই হেসে উঠল।

আনিসের মামা বজলুর সাহেব আজ মহাব্যস্ত। সকাল থেকে তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। তিনি সকালবেলা উঠে নিজে বাজারে যেয়ে ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, মুরগিসহ বলতে গেলে পুরো বাজারটাই ঘরে তুলে এনেছেন। তিনি তার বিবাহ জীবনে যতবার বাজার করেছেন তার বাজার করা কোনোদিনেই তার স্ত্রি রাহেলার পছন্দ হয়নি। তার বাজারের কোনো না কোনো খুঁত তার স্ত্রীর কাছে ধরা পড়বেই! আজও যেমন রাহেলার সাথে সকাল সকাল একটি ছোটখাটো ঝগড়া বাজার নিয়ে হয়ে গেল। ঝগড়ার বিষয়বস্তু হচ্ছে তিনি বাজার থেকে যে ইলিশ মাছ এনেছেন তা নাকি কয়েক দিন আগের মাছ। মাছ দিয়ে নাকি পচা গন্ধ বের হচ্ছে। রাহেলার কথা শুনে তার মেজাজ প্রায় একশ’ বিশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে যেয়ে মেজাজের গতিবেগ তিনি কন্ট্রোল করলেন। কারণ আজ রাহেলার সাথে কোনোভাবেই ঝগড়ায় জড়ানো যাবে না। সকাল থেকে তিনি পণ করেছেন যে আজ কোনোভাবেই তিনি উত্তেজিত হবেন না।
রাহেলা জানে যে বাজারসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো উল্টাপালটা কথা বললে তিনি রেগে যান, তারপরেও রাহেলা প্রতিবার বাজার থেকে আসার পর কোনো-না-কোনোভাবে কাহিনি শুরু করবেই। এই কারণেই তিনি বিয়ের পর কয়েক দিন বাজার করে দীর্ঘদিন বাজার করা থেকে বিরত ছিলেন। বাসার বাজার খরচ সাধারণত তার বড় ছেলে ফিরোজই করে থাকে। কিন্তু আজ ফিরোজকে তিনি ডিসটার্ব করতে চাননি। কারণ আজ ফিরোজের বিয়ের কথা ফাইনাল হবে। কয়েক দিন থেকেই এই নিয়ে মেয়ে পক্ষের সাথে কথা চলছে। মেয়েটি বজু সাহেবের পছন্দ হয়েছে। ঢাকা ভার্সিটিতে অনার্স পড়ছে। দেখতে-শুনতে বেশ সুন্দর। ফিরোজের সাথে বেশ মানাবে। ফিরোজ যেমন ঠান্ডা স্বভাবের ঠিক মেয়েটিও তেমন। মেয়ের বাবা পল্লীবিদ্যুতের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান। বাবার একমাত্র মেয়ে। মেয়েটির শুধু একটি ভাই আছে। ভাইটি কানাডায় পরিবার নিয়ে থাকে। আজ দুপুরে মেয়ে পক্ষের অনেকেই ফিরোজকে দেখতে আসবে। মেয়েকে তারা আগেই দেখেছে।
ফিরোজ এখনো দেখেনি। ফিরোজকে জানানো হয়েছে, মেয়ে দেখতে অসাধারণ, তাই তার না দেখলেও চলবে। ফিরোজও বাবা-মায়ের কথা মেনে নিয়েছে। কিন্তু মেয়ের ভাই-ভাবি ফিরোজকে দেখতে চেয়েছে। কোনো চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ফিরোজকে নিয়ে দেখালেই হতো কিন্তু ফিরোজ আর দশটা ছেলের মতো না। ফিরোজ তার বাবা-মায়ের স্বভাবের ধারে-কাছেই যায়নি। এক্কেবারে নিরেট বোকা টাইপের ছেলে বলতে যা বুঝায় ফিরোজ হচ্ছে তা-ই। মাঝে মাঝে বজু সাহেব অবাক হয় এই ভেবে যে তার মতো একজন মানুষের ঘরে এই টাইপের একজন ভোদাই টাইপের ছেলের জন্ম হলো কীভাবে? পড়াশুনার বাইরে ফিরোজকে কোনো কাজ দিলে তা তার পক্ষে করা শুধু অসম্ভবই না আরো অনেক কিছু। কাজের মধ্যে একটা কাজ সে ভালো করতে পারে আর তা হচ্ছে ভালো বাজার করতে পারে! এই রকম একটি ছেলে কীভাবে ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাস করে এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে তাও আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে! সেটা বজু সাহেবের কাছে একটি বিস্ময়।
বজু সাহেব তার মেজাজ ঠান্ডা করে তার স্ত্রী রাহেলার সাথে ইলিশ মাছ যে পচা নয় তার পক্ষে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেছে। কিন্তু কোনো যুক্তিই রাহেলা মানতে রাজি নয়। রাহেলার এক কথা, তুমি কোন যুক্তিতে টাকা দিয়ে সকাল সকাল এই পচা দুর্গন্ধযুক্ত ইলিশ মাছ বাজার থেকে নিয়ে আসলে? টাকার কোনো দাম নেই? নাকি সব ঘুষের টাকা?
এই কথা শুনার পরেও বজু সাহেব তার স্ত্রীর সাথে উচ্চৈঃস্বরে কথা না বলে গলার শব্দ নিচু করে বলেছে, তুমি যে বলছ ইলিশ মাছ পচা, কই আমাকে দেখতে দাও দেখি!
বজু সাহেব ইলিশ মাছে হাত দিয়ে একটু চাপ দিতেই হাত মাছের গায়ে দেবে গেল। বজু সাহেব একটু অবাক হয়ে গেল। মাছ নেয়ার সময় তো টাটকাই মনে হয়েছিল!
রাহেলা তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে বলেছে, এই মাছ তুমি তোমার মেহমানদের খাওয়াবে?
বজু সাহেব স্ত্রীর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফুয়াদের খোঁজে তার ঘরে গেল। ফুয়াদ তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। বজু সাহেব ফুয়াদের নাম ধরে ডাকতেই ফুয়াদ বিছানায় উঠে বসল। ফুয়াদ মনে হয় জেগেই ছিল। বাবার ডাকে খুব স্বাভাবিকভাবে বিছানায় উঠে বসে বলল, কী ব্যাপার বাবা, কিছু বলবে?
একটা কাজ করত, একটু বাজারে যেতে হবে। বাজার থেকে ভালো দেখে ইলিশ মাছ আনতে হবে।
বাবার কথায় ফুয়াদ যেন আকাশ থেকে পড়ল! তার মনে হলো তারা বাবা তাকে যা বলছে তা তার জীবনে কোনোদিন শুনেনি। ফুয়াদ যেন কিছু বুঝতে পারল না! কী বললে বাবা? কী আনতে হবে?
তুই কি আমার কথা বুঝতে পারিসনি? আমি বললাম একটু বাজারে যেতে হবে। বাজার থেকে ভালো দেখে এক হালি ইলিশ মাছ কিনে আনতে হবে।
ফুয়াদ চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে একটু বিস্ময়ের সাথে বলল, বাবা, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? আমাকে বাজার করতে বলছ মানে? আমি কি আমার এই জীবনে কোনোদিন বাজার করেছি? তাও আবার ইলিশ মাছ কিনে আনতে বলছ! মাংস-টাংস হলেও না-হয় একটু চেষ্টা করে দেখা যেত। শুনেছি মাছ কিনতে হলে অনেক ভেবে-চিন্তে কিনতে হয়। যেখানে আমি কোনোদিন বাজারই করিনি সেখানে আমি কীভাবে মাছ কিনব?
ফুয়াদের কথা শুনে বজলুর সাহেবের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়েও তিনি তার সন্তানকে বললেন না। তার মেজাজ এতটাই খারাপ হয়েছে যে ফুয়াদকে যদি এখন একটা কষে চড় দিতে পারতেন তাহলে হয়তো তার মেজাজ ঠান্ডা হতো।
বজলুর সাহেব ফুয়াদকে বলল, ও আচ্ছা, তুমি তো কচি খোকা, তোমার পক্ষে তো বাজার করা সম্ভব না! তাহলে বিছানায় বসে আছিস কেন? শুয়ে পড়! আমি তোর মাকে বলে দেই একটা ফিডার এনে তোর মুখে ঢুকিয়ে দিক!
বাবা, তুমি শুধু শুধু আমার উপর রাগ করছ। আমি যা সত্যি তাই বললাম। আমি তো কোনোদিন বাজারে যাইনি। তুমি বড় ভাইকে বলো। সে তো বাসাতেই আছে। আমি কি ফিরোজ ভাইকে ডেকে দিব?
না থাক, তোমাকে আর ডাকতে হবে না। তুমি যা করছিলে তাই করো। ফিরোজকে ডাকার দরকার নেই। যদি সম্ভব হয় তোমার মাকে একটু সাহায্য করো। তুমি কি ভুলে গেছ যে আজ তোমার ভাইয়ের বিয়ের কথা ফাইনাল হবে?
বাবার কথায় ফুয়াদের টনক নড়ল! তাই তো! ফুয়াদের একদম মনে ছিল না। কিন্তু ফুয়াদ বাবাকে বুঝতে না দিয়ে বলল, ভুলে যাব কেন বাবা, উনারা কি সকাল সকাল বাসায় এসে গেছে?
না এখনো আসেনি। দুপুরের আগেই আসবে। দুপুরে আমাদের এখানে খাবে। তুমি একটা কাজ করো, আনিসকে খবর দাও। আমি তাকে গতকাল ফোন করে জানিয়েছি। সকাল সকাল আসতে বলেছি। তুমি ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলো। এই কথা বলে বজলুর সাহেব আবার বাজারের দিকে রওনা হলো।
ফুয়াদ বিছানা থেকে দ্রুত নেমে বাথরুমে ঢুকে গেল। ফুয়াদ মনে মনে অনেকটাই আনন্দিত। কারণ তার বড় ভাই ফিরোজের বিয়েটা হয়ে গেলেই নাজমার বিষয়ে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবে। ফুয়াদ নিজে বলবে না। আনিসকে দিয়ে বলাবে। আনিস ভাইকে কয়েকবার ফোন দিয়েও সেদিন পাওয়া যায়নি। আজ আনিস ভাই বাসায় আসলে তার সাথে নাজমার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। ফুয়াদের হাতেও সময় কম। কারণ নাজমার বাবাও নাজমার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। যখন-তখন কাহিনি ঘটে যেতে পারে। তাই আনিস ভাইয়ের সাথে প্ল্যান ফাইনাল করতে হবে। মনে মনে ফুয়াদ মহাখুশি। ফিরোজ ভাইয়ের বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই নাজমাকে এই বাসায় বউ করে আনতে পারবে।
ফুয়াদের ভিতরে একধরনের উত্তেজনা বিরাজ করতে লাগল। তার যেন আর তর সইছে না। খুশি মনে ফুয়াদ ফ্রেশ হয়ে তার প্রিয় গান ‘ভালোবাসি ভালোবাসি, এই সুরে কাছে-দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি, ভালোবাসি, ভালোবাসি’ গানটির সুর আওড়াতে আওড়াতে তার মায়ের ঘরের দিকে রওনা হলো।

(চলবে)

 

লেখক: হুমায়ুন কবির হিমু

Related Articles

Back to top button