বেশ কিছুদিন থেকেই আমরা করোনাভাইরাসের কথা বলে আসছিলাম। আমি বিষয়টাকে কতটুকু গুরুত্ব দেবো বুঝতে পারছিলাম না। সাংবাদিকেরা এক দুইবার আমাকে করোনাভাইরাস নিয়ে কী করা উচিত সেটা জিজ্ঞেস করেছেন, আমি যথেষ্ট বিনয় সহকারে বলেছি আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই, কিছু একটা বলে ফেলা উচিত হবে না। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা কী বলেন সেটাই আমাদের শোনা উচিত।
এরকম সময়ে আমার কাছে একটা গ্রাফ এসে পৌঁছেছে। এটা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যার একটা প্লট। বিভিন্ন দেশের তথ্য দেওয়া আছে এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম সব দেশের রোগী বেড়ে যাওয়ার হার হুবহু এক। শুধু তাই নয় ইতালির সাথে তুলনা করে দেখানো হয়েছে পৃথিবীর কোন দেশ ইতালি থেকে কত দিন পিছিয়ে আছে এবং সেই দেশগুলোর অবস্থা কত দিনের ভেতর ইতালির মতো ভয়াবহ হয়ে যাবে। আমি একটু বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি সত্যি সত্যি তা-ই ঘটতে শুরু করেছে। একটুখানি চিন্তা করার পর বুঝতে পেরেছি আসলেই তো এটাই ঘটার কথা। করোনা ভাইরাসটি অসম্ভব ছোঁয়াচে এবং তথ্য অনুযায়ী আনুমানিক গড়ে ছয় দিনের ভেতর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এভাবে বেড়ে যাওয়ার হারটার নাম “এক্সপোনেনশিয়াল” বাংলায় “জ্যামিতিক হার”। বিজ্ঞান করতে যেয়ে এই গাণিতিক প্রক্রিয়াটি আমাকে অসংখ্য বার ব্যবহার করতে হয়েছে, কিন্তু মজার ব্যাপার, সবসময়েই এটা ব্যবহার করা হয়েছে কমে আসার জন্য। যখনই গাণিতিক সমাধানে এভাবে বেড়ে যাওয়ার সমাধান এসেছে আমরা যুক্তি দিয়েছি, এটি বাস্তব সমাধান নয় এবং সেই সমাধানটিকে আক্ষরিক অর্থে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। এই প্রথমবার আমি বাস্তব জীবনে একটা উদাহরণ দেখতে পাচ্ছি যেটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না এবং আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।
এক্সপোনেনশিয়াল কিংবা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া একটি খুবই বিপজ্জনক বিষয়। প্রথমে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয় তখন আলাদা বা বিচ্ছিন্নভাবে এক দুইটি রোগী পাওয়া যায়। তাদেরকে যদি ঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইন করে সারিয়ে তুলে নেয়া যায় তাহলে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের মাঝে থাকে। একবার যদি কোন ভাবে এটা এক্সপোনেনশিয়াল বা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে তখন সেটাকে থামানোর কোন উপায় নেই। শুধু চীন সেটা করতে পেরেছে, ইউরোপের কোন দেশ পারেনি। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং এই দেশ গুলো খুবই বুদ্ধিমানের মতো সময় মত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে করোনা ভাইরাস কে জ্যামিতিক হারে হারে বাড়তে দেয়নি। সারা পৃথিবীতে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেন দায়িত্বহীন দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। আমরা এখন আমাদের চোখের সামনে এই দুটি দেশকে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফল ভোগ করতে দেখবো।
করোনা ভাইরাস এখন আর একটি নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়। এখন এটি সারা পৃথিবীর সমস্যা। সব দেশের করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা প্রতিদিনই তথ্যভাণ্ডারে জমা হচ্ছে এবং সবাই সেটা দেখতে পাচ্ছে। তবে একজন সত্যি সত্যি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কী না সেটা জানতে হলে একটা জটিল এবং খরচ সাপেক্ষ পরীক্ষা করতে হয়। (সত্য মিথ্যা জানি না, খবরের কাগজে দেখেছি আমাদের দেশে এই পরীক্ষা করার উপযোগী কিট নাকী রয়েছে মাত্র হাজার খানেক) কাজেই এই দেশে এখন খুব ব্যাপক ভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব বলে মনে হয় না। তাই এই দেশের জন্য আমরা যে সংখ্যাটি দেখছি তার বাইরেও করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কেউ আছে কী না সেটা নিয়েও একটু দুর্ভাবনা থেকে যায়। এই দুর্ভাবনাটা বিশেষ করে শুরু হয়েছে, যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে কিংবা বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা বিক্ষোভ করে কোয়ারেন্টটাইন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এই অবিবেচক মানুষেরা এবং তাদের আত্মীয়স্বজনেরা দেশের কোন একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্ফোরকের মত করনা ভাইরাসের রোগী জমা করে যাচ্ছেন কী না সেটি কে বলবে? এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটে। যখন সবাই ধরে নিয়েছে সেখানে মাত্র অল্প কয়েকজন করোনা আক্রান্ত রোগী তখন আসলে সেখানে কয়েক হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বসে আছে। হঠাৎ করে অনেক মানুষ মারা যেতে শুরু করেছে।
আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই, তবে গণিত, বিজ্ঞান বা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো সংখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেটাই করার চেষ্টা করছি। গত কয়েকদিন এই বিষয়টি নিয়ে লেখাপড়া করে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে, “আমাদের কিছুই হবে না, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে আছে এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে থাকবে” এটা ধরে নেওয়া মোটেও ঠিক নয়। আমাদের দেশ গরম এবং এখানে জলীয় বাষ্প বেশি তাই এই দেশে করোনা ভাইরাস টিকতে পারে না, সেটা ভেবে নিশ্চিন্তে থাকাও মনে হয় ঠিক হবে না। কারণ মালয়েশিয়ার তাপমাত্রা এবং জলীয় বাস্পের পরিমাণ আমাদের দেশের মতোই কিন্তু সেখানেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে, সময় মত সাহসী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ হয়ে বসে নেই তারা সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছে, নিজেরা “হ্যান্ড স্যানিটাইজার” তৈরি করছে সেটা চমৎকার একটা ব্যাপার। একজন মানুষ বিদেশ থেকে এসে কোয়ারেন্টাইনে সময় না কাটিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে, সেজন্য গ্রামের মানুষ তার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে সেটাও একটা ভালো লক্ষণ, বোঝা যাচ্ছে মানুষ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি গুলোও সময়মতো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অসংখ্য অনুষ্ঠান কোনরকম ভাবাবেগ ছাড়াই মুহূর্তের মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেটি অনেক বড় দায়িত্বশীল একটি ঘটনা। এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সব রোগীরা বিদেশ থেকে আসছে, তাই সব ফ্লাইটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই পৃথিবীতেই অনেক দেশ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে তাই চাইলে আমরাও নিশ্চয়ই পারবো। একটা ঘূর্ণিঝড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ তছনছ হয়ে যায় কিন্তু আমরা ঠিকই সেটা সামলে উঠে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাই। তবে, “আমরা কিছুই করব না নিজে নিজেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে” সেটা কেউ যেন বিশ্বাস না করে। সামনের কয়েকটি সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়, এই সময়ে জাতি হিসেবে কতটুকু দায়িত্বশীল তার একটা প্রমাণ আমরা পেয়ে যাব।
সারা পৃথিবী যখন একটা বিপদের সম্মুখীন তখন আমরা নিরাপদে থাকব সেটা কেউ আশা করে না। তবে এই ভাইরাসে শতকরা আশি জনের উপসর্গ হয় খুবই সামান্য। বিশেষ করে অল্প বয়সী শিশুদের বিশেষ কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কাজেই আতঙ্কের কোন বিষয় নেই তবে অবশ্যই সতর্কতার এবং প্রস্তুতির বিষয় আছে। প্রস্তুতটির কথা সবাই জানে সেটি হচ্ছে সামাজিক ভাবে নিজেকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা।
আমরা জানি ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার একজন গবেষকের লেখার একটি অংশ এরকম: “করোনা ভাইরাস তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। এটি ছুটে আসছে এক্সপোনেনশিয়াল গতিতে। প্রথমে ধীরে ধীরে তারপর হঠাৎ করে। এটি আর মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার কিংবা বড়জোর কয়েক সপ্তাহের। যখন এটি আসবে তখন তোমার হাসপাতাল, ক্লিনিক থমকে যাবে। তোমার দেশের মানুষের তখন চিকিৎসা হবে হাসপাতালের মেঝেতে, করিডোরে। অতি পরিশ্রমে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত হয়ে যাবে ডাক্তার নার্স। অনেকে মারা যাবে। তাদেরকে তখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন দেবে আর কাকে মারা যেতে দেবে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটি মাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে আজকেই নিজেদের সামাজিকভাবে আলাদা করে ফেলা। আগামীকাল থেকে নয়। আজকেই। তার অর্থ হচ্ছে যত বেশি মানুষকে সম্ভব ঘরের ভেতর রাখা। এখন থেকেই!”
আমরা অবশ্যই চাই আমাদের অবস্থা যেন ইউরোপের মত না হয়। আমরা চাই সবাই দায়িত্বশীল হয়ে আমরা যেন এই বিপর্যয় ঠিকভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক