কানিজ কাদীরের গল্প-‘অন্তরালে, নীরবে, নিঃশব্দে’
ক’দিন যাবৎ টেলিভিশনের একই খবর, একই আলোচনা, একই চিত্র। মিসেস আফিয়ার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। কি হচ্ছে এসব! চারদিক শুধু খুন, ধর্ষণ, গাড়ি ভাংচুর, পোড়ানো, বোমাবাজি, মারামারি,দলাদলি, হিংসা, হানাহানি। এ সবই কি হবে একটি স্বাধীন দেশে! মানুষ মানুষকে এত নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে! মিসেস আফিয়ার চোখে পানি এসে গেল, কষ্টে যেন বোবা হয়ে গেল মন। কিছু কিছু জিজ্ঞাসা মনের অজান্তেই তৈরি হলো।শুধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? রাত দশটা বাজে। ডা. মুহিব হোসেন এখনো চেম্বার থেকে আসেনি । আগামিকাল ডা.মুহিব দেশের বাইরে যাবেন তিন মাসের জন্য।এ তিন মাস একাই সব দায়িত্ব পালন করতে হবে মিসেস আফিয়ার। এসব কথাও ভাবছিলেন আফিয়া। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল এক ঘন্টার জন্য।আফিয়া অন্ধকার ঘরেই বসেছিল। ছেলে সিয়ান এসে চার্জ লাইটটা দিয়ে গেছে। আইপিএসটা কয়েকদিন ধরে কাজ করছে না। ঘরটা আলো-আঁধারিতে মায়াময় লাগছে। আফিয়া একা ঘরে থাকলে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে যায়। একধরনের অবুঝ মায়া দানা বাঁধে তার মনে পৃথিবী, সন্তান, স্বামী, সংসার, আত্মীয়স্বজনদের জন্য। চারদিকে তার এত মানুষ তারপরও তার কেন জানি একাকি লাগতে থাকে। পাশের ঘরে মেয়ে সেমন্তী রেডিওতে গান শুনছে ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে, তুমি আনমনে বসে আছো..। আফিয়ার ভালো লাগে। ইলেকট্রিসিটি এসেছে।মুহিব এখনো আসেনি। আফিয়া টেলিভিশন অন করল। আবারো সেই কষ্টের ছিব। আফিয়া টেলিভিশনের চ্যানেল ঘুরাল।মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পুরনো দিনের গান হচ্ছিল কলকাতার বাংলা চ্যানেলে। ‘বনে নয় মনে মোর পাখী আজ গান গায়, ঝিরি ঝিরি হাওয়া দোলা দিয়ে যায়।’ আফিয়া আনমনা হয়ে গেল। নিজেকে তরুণী মনে হতে থাকে আফিয়ার। কলিং বেলের শব্দে আফিয়া উঠে যায়। এই তো মুহিব এসেছে।
দুপুর ২টায় ডা.মুহিব হোসেনের ফ্লাইট। সকালে বাবার কাছে বিদায় নিয়ে সিয়ান
স্কুলে পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। ‘বাবা আসি’ বলে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। বাবাও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেছে ‘ভালো থেকো বাবা, পড়াশুনা করো মন দিয়ে, মাকে বিরক্ত করো না।’ সিয়ানের চোখে পানি। বাবার জন্য কি অনুভূতি । চোখে মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আফিয়া আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল। সকাল থেকেই মুহিবের কাপড়চোপড় ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। শুকনো খাবার, ওষুধপত্র, ছোট ব্যাগ, চাবি ইত্যাদি দিতে ভুল হলো না। একটা কাগজে যানবাহনে উঠার দোয়া লিখে দিল। আফিয়া স্বামীকে নানারকম উপদেশ দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল স্বামী দূরে যাবে বলে স্বামীর প্রতি যত মান অভিমান কোথায় যে উবে গেল। এক ধরনের আপনকারা অনুভূতি স্বামীর প্রতি তাকে দুর্বল করে নিচ্ছিল।
সকাল দশটার দিকে মুহিব, আফিয়া ও সেমন্তী এয়ারপোর্টে পৌঁছাল। মেয়ে সেমন্তী ও আফিয়ার জন্য দুটি ভিজিটরস পাস নিয়ে ডা.মুহিব ওদেরকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ডা.মুহিব এয়ার লাইন এর কাউন্টার এর দিকে গেল। মুহিবকে খুব নার্ভাস লাগছিল। ইমিগ্রেশন পার হবার আগে সেমন্তীকে আদর করে মুহিব অনেক উপদেশ দিয়ে গেল।আর স্ত্রী আফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-‘আসি, ভালো থেকো, আমার জন্য দোয়া করো।’ আফিয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। আফিয়া ভাবল এই যে চাওয়া সে তো শুধু শুধু নয়। একই ছাদের নিচে একই সাথে দীর্ঘদিন বসবাস। কি যেন মায়াবী বন্ধন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কত তর্কবির্তক, কত মান অভিমান, কত ক্ষোভের প্রকাশ। কিন্তু আবারো সেই একই বিছানা, একই খাবার টেবিল , একই ঘর। মুহিবের উপর মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় আফিয়ার। আবার কখনো মুহিবের কোনো কাজ বা ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যায় আফিয়া।
এক মাস হলো ডা.মুহিব বিদেশে। মাঝে মাঝেই ছেলেমেয়ে ও আফিয়ার সাথে মোবাইলে কথা হয়। আফিয়ার ভালো লাগে। মুহিবের একধরনের আলাপে আফিয়া যেন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল । মুহিবের রাজনীতির কথা, সরকারের কথা, চাকরির কথা, চেম্বার, প্র্যাকটিসের কথা, পদোন্নতি না পাওয়ার কথা, কি যে এক ঘেয়েমি লাগত আফিয়ার। রাতে ঘুম আসছিল না আফিয়ার। একটা ট্যাব টেনিল খেয়ে নিল আফিয়া। আজ সারা দিনই মুহিবের কথাই মনে পড়েছে। মুহিব দূরে বলে আফিয়ার এত খারাপ লাগছে কেন?
সামনে উনিশ তারিখ। এবারো কি মুহিব ভুলে যাবে এই তারিখটা। আফিয়া বাসায় নিজেই স্পেশাল রান্নাবান্না করে এ দিন উপলক্ষে। একরাশ অভিমান এসে জড়ো হয়। এমনি করে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। রোবটের মতো সারাদিন কাজ করে যে বাসার বুয়া, ইট ভেঙ্গে হাতে কড়া ফেলেছে যে নারী শ্রমিক, হাড়ভাঙা খাটুঁনি খাটে যে কৃষাণী, গার্মেন্টসের ওই নারীকর্মী ওরা কি বিয়ে বার্ষিকী পালন করে? ওরাও তো মেয়ে। ওদেরও তো দিন আসে দিন যায়। আফিয়া ভাবে ‘আমি শিক্ষিতা, স্বাবলম্বী বলেই কি ম্যারেজ ডে পালন করার কথা ভাবি। এদিনটাকে এত গুরুত্ব না দিলেও জীবনে কিছু আসে যায় না।’ মুহিব দূরে বলেই কি আফিয়া এসব ভাবছে?
কলিংবেলের শব্দ শুনেই আফিয়া দৌড়ে গেল। রাত ৮টা।’একি মুহিব এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল যে! মুহিবের এক হাতে রজনীগন্ধার গুচ্ছ। অন্য হাতটা পিছনের দিকে। ঘরে ঢুকেই সুন্দর একটা হাসি দিয়েই বলল, ‘হ্যাপি ম্যারেজ ডে টু ইউ’। আফিয়া বলল, ‘থ্যাংকু। হাত বাড়িয়ে ফুলের গুচ্ছ নিয়ে মিষ্টি হেসে মুহিবকে একটু ছুঁয়ে দিল। মুহিব আফিয়ার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল, ‘এটা তোমার জন্য। খুলে দেখ।’ আফিয়া বিস্মিত হয়ে খুলে দেখল, ‘বাহ্ অপূর্ব। তুমি কখন কিনলে?’ আফিয়া শাড়ির সাথে ম্যাচ করে একটা ব্লাউজ দিয়ে শাড়িটা পড়ে নিল। হাতে চুড়ি কপালে টিপ। মুহিব বলল, ‘বাহ্ বেশ লাগছে তোমাকে।’ আফিয়া বলল, ‘চলো রাতের খাবারটা আমরা সবাই মিলে বাইরে খাব। আজ আমি তোমাদের খাওয়াব।’ছেলে ও মেয়ে তৈরি হয়ে নিল। একসাথে ওরা সবাই বের হয়ে গেল।
বেশ ভোরেই আফিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের স্বপ্নটা বেশ ভালোই লেগেছে। একটা ভালোলাগার রেশ যেন আফিয়ার রয়ে গেছে। ভােরে উঠে ফযরের নামাজ পড়ে নিল। ভাবল মুহিবকে একটা ম্যাসেজ পাঠাবে। ভাবল পৃথিবী সত্যি সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীকে ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসতে হবে প্রিয়জনকে। তৈরি করতে হবে ভালোবাসার ক্ষেত্র। ছোট ছোট ক্ষুদ্র স্বার্থকে উর্ধ্বে রেখে প্রিয়জনের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়ালেই পৃথিবী হবে সুন্দর আরো সুন্দর।
তিন মাস পর ডা.মুহিব হোসেন ফিরে এসেছে। কিন্তু মুহিবকে দেখে আফিয়ার এমন লাগছে কেন। সবই ঠিক আছে। কত কিছু এনেছে মুহিব। সেই চেনা মুহিব। সেই অন্তর্মুখী মুহিব। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রকাশ করতে যেয়েও যেন হতে চায় না। আবার সেই জীবন। জীবন বহতা নদীর মতো। সামনে চলাই যার কাজ। সময় থেমে থাকে না। এগিয়ে চলে সম্মুখপানে। অন্তরালে নীরবে নিঃশব্দে রয়ে যায় ভালোবাসা।
মে ২০০৯,’টুকরো কথা’