গল্প-কবিতা

হুমায়ুন কবির হিমু’র উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’ (৬ষ্ঠ পর্ব)

জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ‌‌’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।

পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হচ্ছে । আজ রইল উপন্যাসের (৬ষ্ঠ পর্ব)

জাকিয়াদের বসার ঘরে ফরহাদ সাহেব ও আনিস পাশাপাশি সোফায় বসে আছে। ফরহাদ সাহেবকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে। আনিস দরজা নক
করার পর ফরহাদ সাহেবই দরজা খুলে দিয়েছে। দরজা খুলে আনিসকে দেখতে পেয়েই ফরহাদ সাহেব অনেকটা খুশি হয়েই বলেছে, আরে মাস্টার সাহেব যে! তুমি ভালো আছ তো বাবা? তোমাকে তুমি করে বললাম, কিছু মনে করোনি তো?
আনিস বিনয়ের সাথে বলেছে, না না, আপনি আমার চেয়ে অনেক বড়, আপনি তো আমাকে তুমি করেই বলবেন।
দুজনে সোফায় বসে ফরহাদ সাহেব শামীমাকে চা দিতে বলেছে। শামীমা বিস্কুট দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। তেমন একটা কথা বলেননি। শুধু আনিসকে বলেছে, তুমি ভালো আছ বাবা?
আনিস বলেছে জি, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?
শামীমা আনিসের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। আনিসের কাছে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হয়নি। শামীমা ভিতরে চলে যাওয়ার পর ফরহাদ সাহেবও চুপ করে আছে। আনিস ঠিক কী বলবে তা বুঝতে পারছে না। কেয়া বা জাকিয়া ম্যাডাম কাউকেই সে দেখতে পারছে না। ওরা কি বাসায় নাই নাকি? আনিস বসার ঘরের চারদিকটা দেখতে লাগল।
ওরা দুই বোন একটু পাশের টেইলার্সের দোকানে গেছে। এখনই এসে পড়বে। আচ্ছা মাস্টার সাহেব, তোমার ছাত্রী মানে আমার মেয়ে কেয়া ছাত্রী হিসাবে কেমন? সামনে ওর পরীক্ষা। আমি তো খুব একটা খোঁজ নিতে পারি না। যদিও আমি সারাদিন বাসাতেই থাকি। আমার ছোট মেয়ে কেয়া ছোটবেলা থেকেই একটু চুপচাপ স্বভাবের। কথা কম বলে। কোনো কিছু জিজ্ঞাস করলে বলে না করলে বলে না। পুরাটাই ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে। আর আমার বড় মেয়েটি হয়েছে আমার মতো। কথা না বলে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। বড়ই মিশুক স্বভাবের মেয়ে আমার জাকিয়া। কই মাস্টার সাহেব, তুমি তো বললে না যে আমার কেয়া কেমন পড়ছে?
আপনার মেয়ে কেয়া খুব ভালো ছাত্রী। ওকে একটি জিনিস একবার বুঝিয়ে দিল দ্বিতীয়বার আর বলতে হয় না। পড়াশুনায় খুব ভালো। আপনি টেনশন করবেন না। আপনার কেয়া পরীক্ষায় ভালো করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর স্যার, আপনাকে একটি রিকোয়েস্ট করি, সেটা হচ্ছে দয়া করে আমাকে মাস্টার সাহেব বলে ডাকবেন না। আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবেন। প্লিজ।
ও আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি তো আমার ছেলের মতোই। তোমার নাম ধরে আমি ডাকতেই পারি। জানো আনিস, আজ কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি, জাকিয়া কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে। অফিস থেকে বাসায় এসে আগের মতো খুব একটা কথা বলে না। কেমন যেন মনমড়া হয়ে থাকে। এই বিষয়ে কেয়াকে জিজ্ঞাস করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তুমি কি কিছু জানো আনিস?
জি মানে আমি। আনিস অনেকটা অবাক হয়ে বলল, না, আমি জানব কেমন করে! আমার সাথে জাকিয়া ম্যাডামের খুব একটা কথা হয় না। মাঝে মাঝে একটু-আধটু কথা হয়। স্যরি স্যার, আমি ঠিক বলতে পারব না।
ঠিক সেই সময় কেয়াসহ জাকিয়া বসার ঘরে ঢুকল। বসার ঘরে ঢুকেই কেয়া আনিসকে সালাম জানিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। জাকিয়া ভিতরে না ঢুকে তার বাবা ফরহাদ সাহেবের পাশের সোফায় বসে আনিসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল, কেমন আছেন আনিস সাহেব? আমাদের বেশি দেরি হয়ে যায়নি তো? মানে আপনাকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখিনি তো?
না না, আমি একটু আগেই এসেছি। স্যারের কাছে শুনলাম আপনি কেয়াসহ একটু বাইরে গেছেন।
বাবা, তুমি চা খেয়েছ? আনিস সাহেব, আপনাকে চা-নাশতা দেয়া হয়েছে তো?
ফরহাদ সাহেব বললেন, সেই পর্ব একটু আগেই শেষ হয়েছে রে মা। তোর মনটা কি আজ একটু ভালো রে মা?
সেকি! আমার মনের আবার কী হলো বলো তো বাবা?
না মানে, কয়েক দিন থেকে দেখছি তুই ঠিক আগের মতো বাসায় কথাবার্তা বলছিস না। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে থাকিস। তোর কি কিছু হয়েছে রে মা?
আরে না। আমার কিছু হয়নি বাবা। তুমি শুধু শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করছ। আমার কিছু হলে তো সবার আগে তুমিই জানবে। এমনিতেই একটু চুপচাপ থেকে সারাদিন কথা বলার জন্য একটু চার্জ দিয়ে নেই আর কি।
বাবা, তোমার ফোন বাজছে। কেয়া ঘরের ভিতর থেকে চিৎকার করে বলা মাত্রই ফরহাদ সাহেব তার ঘরের দিকে চলে গেল।
ফরহাদ সাহেব চলে যাওয়ার পর জাকিয়া আনিসের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল। আনিস একটু বিব্রত বোধ করতে লাগল। আনিস মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। কিছু সময় দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ আনিসকে অবাক করে দিয়ে জাকিয়া তার স্বভাবসুলভ সেই বিখ্যাত হাসি হেসে উঠল। আনিস একটু অবাক হয়ে জাকিয়ার দিকে তাকাল। জাকিয়া বেশ জোরেই হাসছে।
জাকিয়ার হাসি দেখে আনিসের মনে একধরনের ভালোলাগার শিহরণ বয়ে গেল। জাকিয়াকে এই হাসিতে যে কী সুন্দর লাগে দেখতে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আনিস আর নিচের দিকে না থাকিয়ে অপলক দৃষ্টিতে জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
কী ব্যাপার মাস্টার সাহেব, আপনি আমার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কেন?
জাকিয়ার কথায় আনিস লজ্জা পেয়ে জাকিয়ার দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার মাথা নিচু করে থাকল। আনিস এতটাই লজ্জা পেয়েছে যে, তার শরীর দিয়ে লজ্জার ঘাম বের হচ্ছে।
হয়েছে হয়েছে আনিস সাহেব, এত লজ্জা পেতে হবে না। আপনি তো দেখছি লজ্জায় লাল টুকটুকে বউয়ের মতো হয়ে গেছেন। আচ্ছা, আপনি এত সাধারণ কেন? এ যুগের কোনো ছেলে এতটা সাধারণ হয়? আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই আনিস সাহেব। বেশ কয়েক দিন থেকেই বলতে চাচ্ছি, কিন্তু বলা হচ্ছে না। আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
আনিস মাথা না তুলেই বলল, সেকি আপনি আমার কাছে অনুমতি নিচ্ছেন কেন? আপনি কিছু বলতে চাইলে অবশ্যই বলবেন ম্যাডাম।
আপনি আমাকে আবার ম্যাডাম বলে ডাকছেন! আপনাকে না বলেছি, আমার নাম ধরে ডাকবেন। আচ্ছা আপনি কী! আপনি সবার সাথেই এই রকম বিনয়ের সাথে কথা বলেন? আপনি যেমনটা ভালো আপনার আশেপাশের জগৎটা কিন্তু এত ভালো না। একটু চালাক-চতুর না হলে বর্তমান সমাজে টিকে থাকা খুব কঠিন আনিস সাহেব। একটু চালাক হওয়ার চেষ্টা করুন। আর হ্যাঁ, আপনার সরকারি চাকরির কোনো ব্যবস্থা হলো? যদি সরকারি চাকরি না করে প্রাইভেট চাকরি করার ইচ্ছা হয়, তাহলে আমাকে জানাবেন। আমি আপনার জন্য একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি।
জি না, এখনো চাকরির কিছু হয়নি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে যাবেন কেন আমার জন্য?
কেন, আমি কি আপনার জন্য চেষ্টা করতে পারি না? আপনি একজন চমৎকার ভালো মানুষ, আর ভালো মানুষদের জন্য কিছু করতে পারাটা পুণ্যের কাজ। এই কথা বলে আবার জাকিয়া তার সেই ভুবন দুলানো হাসি দিল।
জাকিয়ার হাসিতে আনিসের সমস্ত শরীর দিয়ে একটি রিমঝিম ঢেউ খেলে গেল। আচ্ছা, আমার এমন লাগছে কেন? জাকিয়া নামের এই মেয়েটির হাসি তাকে ভালোলাগা নামের অন্য ভুবনে নিয়ে যায় কেন? জাকিয়ার হাসি তাকে এতটা দুর্বল করে দেয় কেন? জাকিয়ার হাসি শুনলে আনিসের সমস্ত শরীর এতটা দুর্বল হয়ে যায় কেন? আনিস চুপচাপ জাকিয়ার সামনে মাথা নিচু করে সোফায় বসে থাকল।
আবার আপনি মাথা নিচু করে বসে আছেন? ঠিক আছে, আপনাকে আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে না। আপনি ভিতরে যান, কেয়া মনে হয় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
আপনি জানি কী বলবেন বলছিলেন?
আমার কথাই কিছুটা বলার চেষ্টা করেছি। বাকি গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু আপনাকে আমি পরে বলব। তবে এখানে নয়। অন্য কোথাও। আমি আপনাকে ফোন দিলে যেখানে আসতে বলব আপনি চলে আসবেন। আপনার সাথে কোথাও বসে চা খেতে খেতে বাকি কথাটুকু বলব। কি, আমি ডাকলে আসবেন তো?
আনিস জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে কোনোরকম বলতে পারল, জি, বাইরে কোথাও মানে, ঠিক বুঝলাম না।
আপনাকে এত বুঝতে হবে না। আপনি এখন কেয়াকে পড়াতে কেয়ার ঘরে যান। এই কথা বলে জাকিয়া মুচকি হাসি দিয়ে তার ঘরে চলে গেল।
জাকিয়া চলে যাওয়ার পরেও আনিস কিছুক্ষণ সোফায় বসে থাকল। আনিস ঠিক বুঝতে পারছে না জাকিয়া তাকে কী এমন কথা বলবে, যা এখানে না বলে বাইরে কোথাও বলতে হবে। জাকিয়াকে আনিসের ভীষণ রকমের ভালো লাগে। জাকিয়ার সামনে আনিস যতটা নার্ভাস থাকে অন্য কারো সামনে আনিসের এমনটি হয় না। এই নার্ভাসনেসের কারণ আনিসের জানা নেই। কেন আনিস জাকিয়ার সামনে দাঁড়ালেই তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়? আচ্ছা, আমি কি জাকিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছি? জাকিয়াকে আমার ভালো লাগে, এটা আমি জানি। কিন্তু ভালোবাসলাম কখন? আর ভালোবাসলে তো আমি জানতাম। নাকি নিজের অজান্তেই আমি জাকিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছি? জাকিয়া ম্যাডামও কি আমাকে ভালোবাসে? তা না-হলে উনি আমাকে বাইরে নিয়ে কথা বলতে চান কেন? কিন্তু জাকিয়া ম্যাডাম তার মতো একজন অতি সাধারণ টাইপের ছেলেকে ভালোবাসতে যাবেন কেন? ছিঃ ছিঃ, আমি এসব কী ভাবছি! আমি কি পাগলটাগল হয়ে গেলাম নাকি!
আনিস আর কিছু চিন্তা না করে বসার ঘরের সোফা থেকে উঠে সোজা কেয়ার ঘরের দিকে চলে গেল কেয়াকে পড়ানোর জন্য।

রিপনের সামনে অনেকটা পীরের মুরিদের মতো ফুয়াদ বসে আছে। রিপনকে ঘিরে মেসের আর সবাই বসে আছে। ফুয়াদ সকাল সকাল আনিসের মেসে এসে হাজির হয়েছে। মেসের তখন কেউ ঘুম থেকেই ওঠেনি। ফুয়াদের দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দে আনিসের ঘুম ভেঙে যায়। আনিস মনে করেছিল কাজের বুয়া খালা এসেছে। বুয়া সকাল সকাল এসে তাদের জন্য সকালের নাশতা বানিয়ে দিয়ে যান। আনিস দরজা খুলে অনেকটা অবাক হয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি সেই আধা ঘণ্টা থেকে দরজায় ধাকাচ্ছি। তোমার মোবাইলে কয়েকবার রিং দিয়েছি। তোমাদের কেউ দরজা খুলার নাম নেই। সেই সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়েছি। নাশতা পর্যন্ত করিনি। কী ব্যাপার, তুমি দরজার সামনে এমন জেলখানার সেন্ট্রির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমাকে কি বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি ভিতরে ঢুকতে দিবে?
এখন কয়টা বাজে ফুয়াদ? তোকে আমি গতকাল রাতে ফোনে আমার মেসের ঠিকানা দেয়ার সময় বলেছি যে সকাল দশটার সময় আসবি। এখন বাজে সকাল সাতটা। তুই এত সকালে আসতে গেলি কেন? এখনো মেসের কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি।
সকালবেলা আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আজ ডিউটিতে পর্যন্ত যাইনি। তাছাড়া গতকাল রাতে টেনশনে ঘুমাতে পারিনি। তুমি তো জানো যে আমি মানসিক টেনশনে আছি। আর আমার টেনশন হলে কোনো কাজ যেমন ঠিকমতো করতে পারি না, ঠিক তেমনি ঘুমাতেও পারি না। বলতে পারো কাল সারারাত একপ্রকার জেগেই ছিলাম। আনিস ভাই, প্রচু- ক্ষিদা পেয়েছে। তোমাদের মেসের যেহেতু কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি, তাই নাশতার আয়োজনও নিশ্চয়ই এখনো হয়নি। তুমি একটা কাজ করো, তুমি জাস্ট বাথরুমে যেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আসো। দুই ভাই মিলে আজ বাইরে নাশতা করি। আমরা নাশতা করে ফিরতে ফিরতে ততক্ষণে নিশ্চয়ই মেসের আর সবাই ঘুম থেকে জাগবে। তোমাদের বাসার রাস্তার পাশে একটি রেস্টুরেন্ট দেখলাম। সকাল সকাল গরম পারাটা ভাজছে। তাড়াতাড়ি করো, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
আনিস ফুয়াদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। ফুয়াদ ভিতরে ঢুকার পর আনিস দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফুয়াদকে বসার
ঘরে বসতে বলে বাথরুমের দিকে চলে গেল। আনিস বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফুয়াদকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাসার নিচে নেমে রেস্টুরেন্টে চলে গেল।
ফুয়াদকে অনেকটা উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। আনিস ভাই, রিপন ভাই কি খুব পাওয়ারফুল মানুষ নাকি? উনি কি কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত? উনার কি প্রশাসনে খুব প্রভাব আছে? কী ব্যাপার, আমি এতগুলো প্রশ্ন তোমাকে করলাম, তুমি চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছ, কোনো কথা বলছ না যে?
খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে হয় না ফুয়াদ। চুপচাপ খেয়ে নে। তুই তো আগে এত কথা বলতি না ফুয়াদ! হঠাৎ করে এত কথা বলা শুরু করলি কবে থেকে? তুই তো দেখছি ওই পুরান ঢাকার মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে গেছিস! তোর এই অস্বাভাবিকতা কি মেয়েটি লক্ষ করেছে ফুয়াদ?
আনিস ভাই, তুমি প্রেম করোনি তো তাই কথাগুলো সহজভাবে বলতে পারছ। নাজমার বিয়ে দেয়ার জন্য ওর বাবা ছেলে খুঁজছে আর আমি নাজমার ভালোবাসার মানুষ হয়ে চুপচাপ ধ্যানে বসে থাকব? তোমার কথা অনুযায়ী চললে আমার জীবনে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। এখন বলো, তোমার সেই রিপন ভাই আমার কাজ করে দিতে পারবে তো?
আমি জানি না পারবে কি না। তবে এটুকু বলতে পারি, রিপন ভাই খুব কাজের মানুষ। ঢাকা শহরে তার বেশ জানাশুনা আছে। তার কাছে শুনেছি, তার এক বাবার সাথে ভালো কানেকশন আছে। তার নাম হচ্ছে চুলকানি বাবা। মানুষের শরীরের পিঠে সামান্য চুলকিয়ে নাকি বলে দিতে পারে তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। মুহূর্তের মধ্যেই নাকি মানুষের সমস্যার সমাধান দিয়ে দেন। আমি অবশ্য বিষয়টি পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। তবে রিপন ভাই যখন কথাগুলো বলছিল, তার কথার মাঝে আমি তার দৃঢ়তা দেখেছি। তাতে মনে হয়েছে তার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। তাছাড়াও রিপনের ঢাকা শহরে যোগাযোগ বেশ স্ট্রং।
আমি নাজমার কাছে শুনেছি, তার বাবা নাকি একটু ভীতু প্রকৃতির। জাস্ট উনাকে একটু ভয়-ভীতি দেখালেই কাজ হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। চল মেসে ফিরা যাক। এখন প্রায় নয়টা বেজে গেল। নিশ্চয়ই এখন সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে।
নাশতার বিল আনিস দিতে গেলে ফুয়াদ বলে উঠল, কিপ ইট।
ফুয়াদ এত জোরে কথাটি বলল যে রেস্টুরেন্টের অন্যান্য কাস্টমার নাশতা খাওয়া বন্ধ করে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। ফুয়াদের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। আনিস একটু বিব্রত বোধ করতে লাগল। ফুয়াদের আচার-আচরণ আনিসের কাছে ভালো ঠেকছে না। ফুয়াদ কি পাগলই হয়ে গেল নাকি?
রিপনকে ঘিরে বসার ঘরে সবাই গোল হয়ে বসেছে। আশরাফুল রিপনের হাতে সিগারেট ধরিয়ে দিল। রিপন চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে আর মুখ দিয়ে গোল করে সিগারেটের ধুঁয়া ছাড়ছে। সবাই বেশ চুপচাপ। মনোয়ার অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলল, কী ব্যাপার রিপন সাহেব, আপনি কি ধ্যানে বসেছেন নাকি? এমন একটা ভাব করছেন, যেন আমরা সবাই এখানে আপনার মুরিদ আর আপনি পীরের ভূমিকা পালন করছেন।
মনোয়ার ভাই, আনিস সাহেবের ছোট ভাই একটা বিপদে পড়েছে। আনিস ভাই অনেকটা আশা নিয়ে তার ভাইকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। তার তো একটা সমাধান দিতে হবে নাকি! আপনার মতো মাথামোটা মানুষ হলে আমার চলবে না রে ভাই। আমাকে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে কীভাবে বেচারাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করা যায়।
আমার মাথামোটা মানে! আপনি আমাকে মাথামোটা বললেন মানে! আমি মাথামোটা মানুষ? মুখ সামলে কথা বলবেন রিপন সাহেব। এর আগেও আপনি আমাকে নানান ভাবে নানান কথা বলেছেন, আমি কিছু বলিনি। আজ বাসায় একজন মেহমান এসেছে, তার সামনে আপনি আমাকে মাথামোটা বলবেন আর আমি চুপ করে থাকব? কোন যুক্তিতে আপনি আমাকে মাথামোটা বললেন এর ব্যাখ্যা আপনাকে দিতে হবে। ফাজলামোর একটা লিমিট থাকা দরকার। আপনি আপনাকে কী মনে করেন? আপনি মহা প-িত আর আমি রাম ছাগল?
আপনি একটু শান্ত হন মনোয়ার ভাই। সাতসকালে এত চেঁচামেচি করা ঠিক হচ্ছে না। জাহিদ মনোয়ারকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
শান্ত হবো মানে! দেখছেন না সাতসকালে রিপন সাহেব আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছে?
স্যরি মনোয়ার ভাই, মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না ভাই। স্যরি। আশরাফুল ভাই আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে দেন তো। মাথায় বুদ্ধি আসছে না, কীভাবে ফুয়াদ সাহেবের সমস্যার সমাধান করা যায়। ঠিক আছে আনিস ভাই, আপনার ভাইকে বলেন উনার প্রেমিকার বাবার নাম আর দাদার নামটা সংগ্রহ করার জন্য। কারণ বাবার কাছে গেলে বাবা এই দুইজনের নাম চাইবে কাজ করার জন্য। আশরাফুল ভাই, আপনি রেডি আছেন তো? আজ আপনাকে বাবার কাছে নিয়ে যাব। সাথে ফুয়াদ সাহেবকে নিয়ে যাব। একসাথে দুইজনের ঝামেলা মিটিয়ে দিব। কারণ আপনাদের দুইজনের ঝামেলা অনেকটা একই রকম। একসাথে দুই কাজ হয়ে যাবে।
এমন সময় মনোয়ারের ফোন বেজে উঠল। মনোয়ার পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল, শাহাদাৎ ফোন করেছে। জি শাহাদাৎ ভাই ভালো আছেন? কবে বললেন? আগামী পরশু? সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে? জি ভাই, আমি সবার সাথে কথা বলে আপনাকে ফোন দিব। ঠিক আছে ভাই, ভালো থাকবেন। মনোয়ার ফোনটা রেখে সবাইকে লক্ষ করে বলল, আগামী পরশু শাহাদাৎ ভাইয়ের বিয়ে। আগামীকাল আমাদের যেতে বলেছে। আপনারা সবাই যাবেন তো?
যাব না মানে, অবশ্যই যাব। কতদিন কারো কোনো বিয়ে খাই না। তাছাড়া শাহাদাৎ ভাইয়ের বিয়ে আর আমরা যাব না তাই কী হয়! জাহিদ অনেকটা আনন্দের সাথে কথাগুলো বলল। জাহিদের কথার সাথে সবাই সায় দিল। তাহলে আমি শাহাদাৎ ভাইকে জানিয়ে দিচ্ছি যে আমরা সবাই আগামীকাল যাচ্ছি।
ফুয়াদ একটা কাজ কর, তুই নাজমাকে ফোন দিয়ে ওর বাবা আর দাদার নাম জেনে নে। আনিস ফুয়াদকে নাজমাকে ফোন করে জানতে বলল।
ফুয়াদ সাথে সাথেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাজমাকে ফোন করল। কয়েকবার রিং বাজতেই নাজমা ফোন ধরে হ্যালো বলল।
নাজমা তোমার বাবার নাম বুলবুল মিয়া না?
হ্যাঁ, কেন বলো তো? না মানে তোমাকে বলেছিলাম না, তোমার বাবাকে হালকা একটু ছেঁচানি দিতে হবে? তার জন্য একটু জানা দরকার।
ফুয়াদ তুমি কি সাতসকালে আমার সাথে ফাজলামো করার জন্য ফোন করেছ? আমার বাবাকে ছেঁচানি দিবে মানে? ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার ফুয়াদ।
স্যরি নাজমা, মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি। আসলে তোমার বিয়ের কথা শুনার পর থেকে আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। কখন কী করছি আর কার সাথে কী বলছি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কি তোমার বাবার নাম ঠিক বলেছি নাজমা?
হ্যাঁ, বাবার নাম বুলবুল মিয়া।
তোমার দাদার নামটা কী একটু বলবে?
সোনা মিয়া।
বলো কী? তোমাদের বংশ তো বুলবুলি আর সোনাতে ভরপুর!
আবার শুরু করলে?
না ঠিক আছে। আমি এখন ফোনটা রাখব। জরুরি একটা কাজে আছি।
জরুরি কাজে আছ মানে? এত সকালে তোমার আবার কী জরুরি কাজ?
তোমাকে পরে ফোন করে বিস্তারিত বলব। এখন রাখি জান। আল্লাহ্্ হাফেজ।
ফুয়াদ ফোনটা রাখার পর দেখতে পেল বসার ঘরের সবাই ফরহাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আশরাফুল আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে আনিস, তোর মামাতো ভাই তো বিশ্বপ্রেমিক রে।
আশরাফুল ভাই, আপনি এইভাবে কথা বলতে পারেন না। আমরা এখানে সবাই একটি হৃদয়ঘটিত সমস্যা নিয়ে বসেছি। ফুয়াদ সাহেব, নাম জেনেছেন তো? গুড, তাহলে এক কাজ করা যায়, আপনি আর আশরাফুল ভাই, আপনারা দুজন রেডি হয়ে নেন। আমরা বাবার দরবারে যাব। আশা করছি আপনাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ফুয়াদ সাহেব, সাথে টাকা-পয়সা এনেছেন তো?
ফুয়াদ আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, কত টাকা লাগবে আনিস ভাই?
আনিস রিপনের দিকে তাকাল।
রিপন বলল, তেমন কিছু না, এই মনে করেন হাজার পাঁচেক।
সমস্যা নেই রিপন ভাই, আমার সাথে নেই কিন্তু ব্যাংকে আছে। যাওয়ার সময় বুথ থেকে তুলে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে। তাহলে আশরাফুল ভাই, আপনি তৈরি হয়ে নেন। আমি নাশতা করে ফুয়াদ সাহেবকে নিয়ে বাবার দরবারের দিকে রওনা হবো। আর আশরাফুল ভাই, আপনিও সাথে করে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে নিবেন। ওখানে লাগবে।
মনোয়ার চোখ বড় বড় করে রিপনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিপন সেটা লক্ষ করে বলল, কী ব্যাপার মনোয়ার ভাই, আপনি আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
মনোয়ার রিপনের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
রিপন বলল, ফুয়াদ সাহেব, নাশতা করেছেন তো? না করলে আমার সাথে করতে পারেন।
জি না রিপন ভাই, আমি আর আনিস ভাই আপনারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই নিচে যেয়ে নাশতা করে এসেছি। আচ্ছা রিপন ভাই, আপনার সাথে কি আমি আর আশরাফুল ভাই-ই যাব? আনিস ভাই সাথে গেলে কোনো কি সমস্যা হবে?
না না, বাবার দরবারে প্রয়োজনীয় ছাড়া অপ্রয়োজনীয় মানুষ গেলে বাবা বিরক্ত হয়। আচ্ছা আনিস সাহেব, আপনি তো আমার কাছে দুই প্যাকেট বেনসন সিগারেটের দাম পাওনা আছেন, তাই না? একটা কাজ করেন তো ভাই, আর এক প্যাকেট সিগারেট আমাকে এনে দেন, আমি আজ রাতে তিন প্যাকেটের দাম একসঙ্গে শোধ করে দিব। প্লিজ ভাই কিছু মনে করবেন না।
আনিস মনে মনে তীব্র বিরক্ত হলো কিন্তু প্রকাশ করল না। আনিস রিপন সাহেবের সিগারেট আনার জন্য নিচে চলে গেল। যাওয়ার সময় ফুয়াদকে বলল, তুই একটু বোস, আমি আসছি।
নিচে নামতে নামতে আনিস চিন্তা করতে লাগল, তার চেহারার মাঝে কি চাকর-চাকর একটা ভাব আছে কি না! কারণ ইদানীং তাকে প্রায় অনেকেই ফাইফরমাইস করছে। কারো কিছু দরকার হলেই আনিসকেই তা নিয়ে আসতে বলছে। আনিস তার মুখের উপর হাত বোলাতে বোলাতে নিজের উপর অনেকটা বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে গেল।

বজলুর রহমান সাহেবকে আজ অনেক উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। রাহেলা তার
স্বামীর এই কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তিনি তার স্বামীর দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছেন।
বজু সাহেব বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছে আর একা একা মিটমিট করে হাসছে। রাহেলা যে তার পাশে বসে তাকে লক্ষ করছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তিনি আপনমনে বসার ঘরের সোফায় বসে টিভি দেখছেন আর চা খাচ্ছেন। অফিস থেকে আসার পর থেকেই তিনি বেশ খোশ মেজাজে রয়েছেন। তিনি সাধারণত অফিস থেকে বাসায় এসে গায়ের জামা-কাপড় চেঞ্জ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নেন। তারপর রাহেলাকে এক কাপ চা দেয়ার জন্য বলেন। চা খেতে খেতে বসার রুমে বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখেন। আজ তার ব্যতিক্রম হয়েছে। অফিস থেকে এসেই নিজের রুমে না ঢুকে বসার রুমে সোফায় বসে গলা উঁচিয়ে রাহেলাকে চায়ের অর্ডার দিয়েছেন। রাহেলা তাকে চা দিয়ে তার স্বামীর পাশের সোফায় এসে বসেছে। কিন্তু তার স্বামী বজলুর রহমান সাহেব সেদিকে লক্ষ না করে আপনমনে টিভির দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। টিভিতে একটি নাটক হচ্ছে। কিন্তু রাহেলা নাটকের মাঝে হাসির কিছু দেখছেন না।
কী ব্যাপার, তুমি অফিস থেকে আসার পর থেকেই দেখছি বেশ খোশ মেজাজে রয়েছ। আজ কি বিশেষ কিছু হয়েছে নাকি?
ও রাহেলা। তুমি কখন আবার এলে? আমি তো বুঝতেই পারিনি তুমি আমার পাশে বসে আছ!
বুঝতে পারবে কী করে! তোমার কি প্রমোশন-ট্রমোশন হয়েছে নাকি?
আরে না। চাকরির শেষ স্টেজে এসে আবার প্রমোশন! তেমন কিছু হয়নি। মনটা আজ ভালো থাকার একটা কারণ আছে। আর সেটা হচ্ছে, আনিসের জন্য একটা কিছু করতে পারলাম বলে।
আনিসের জন্য আবার কী করেছ?
আনিসের জন্য আমাদের অফিসে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। পোস্ট খারাপ না। বেতনও ভালো। আনিসকে তার সিভি জমা দিতে বলেছিলাম। আনিস আমার অফিসে গিয়ে সিভি জমা দিয়ে এসেছিল। আমি আমাদের মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কথা বলে আনিসের চাকরিটা আজ ফাইনাল করেছি। ওর কপালটা ভালো। এই রকম চাকরি পেতে হলে কমপক্ষে আট থেকে দশ লক্ষ টাকা লাগত। আনিস ছাত্র হিসাবে খুবই ভালো। তাছাড়া তার রেজাল্টও অনেক ভালো। কিন্তু বর্তমান বাজারে ভালো ছাত্র হলেই আর ভালো চাকরি পাওয়া যায় না, সেটা তো তুমি জানো।
মন্ত্রি সাহেব তোমার কথা তাহলে রাখলেন?
না রাখার তো কিছু নেই রাহেলা। আমার চাকরি জীবনে কারো যদি চামচামি করে থাকি সেটা তো একমাত্র মন্ত্রী মহোদয়েরই করেছি। তার যত দুই নাম্বারি কাজ তার সবই তো আমার হাত দিয়েই হয়। তার কাছে খুব করে আনিসের চাকরির বিষয়টি তুলে ধরলে সে আর না করতে পারেনি। আনিসের জন্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগল। আগামী মাসের এক তারিখ থেকেই জয়েন করতে হবে। আনিসকে এখনো সংবাদটা দেয়া হয়নি। ভাবছি ওকে ফোন দিয়ে বাসায় ডাকব।
আনিসের চাকরির খবরটা শুনে রাহেলাকে অনেক খুশি মনে হলো। রাহেলা বেশ আনন্দিত গলায় বলল, তাহলে এখন তাহিতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করা যায়।
তাহিতির বিষয়ে আলোচনা করা যায় মানে! তাহিতির আবার কী হলো?
তোমাকে কয়েক দিন থেকে একটি কথা বলি বলি করে আর বলা হয়নি। আমাদের মেয়েটাও তো অনেক বড় হয়ে গেল। ওর জন্য তো একটা ভালো ছেলের দরকার তাই না? ভালো ছেলে দেখে তো তাহিতির বিয়ে দেয়া দরকার।
বজলু সাহেব রাহেলার দিকে তীক্ষèভাবে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাও একটু পরিষ্কার করে বলো তো। আনিসের চাকরির সংবাদের সাথে তাহিতির বিয়ে দেয়ার সম্পর্কটা কী?
আনিসকে তোমার মেয়ে তাহিতি ভালোবাসে।
ভালোবাসে মানে? কী বলছ তুমি? তোমাকে কি তাহিতি বলেছে?
আমাকে বলতে হবে কেন! আমি মা হয়ে যদি মেয়ের এই বিষয়টা ধরতে না পারি, তাহলে আমি ওর মা হতে যাব কেন? তাছাড়া আমি বুঝতে পারার আর একটা কারণ আছে। সেটা হচ্ছে, তাহিতির বিছানা ঠিক করতে যেয়ে আনিসের একটি ছবি তাহিতির বালিশের নিচে পেয়েছি। পরে তাহিতিকে এই বিষয়ে আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম। তাহিতি আমার কাছে স্বীকার করেছে। আমি ওকে কিছু বলিনি। ফিরোজ বা ফুয়াদ এই বিষয়ে কিছু জানে না।
বজু সাহেবের মুখটা একটু অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তিনি ঠিক কী বলবেন বা করবেন তা বুঝতে পারছেন না। আনিস ছেলে হিসাবে কোনো অংশেই খারাপ না। তাছাড়া আনিসের জন্য যে চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে সেটাও অনেক ভালো। সব মিলিয়ে তার মেয়ে তাহিতি আনিসের সংসারে ভালোই থাকবে। কিন্তু তার মনে একটা সংশয়, নিজেদের মাঝে বিয়ে-শাদি। বিষয়টা তিনি ভালো চোখে দেখছেন না।
কী ব্যাপার, তুমি চুপ হয়ে গেলে যে? তুমি কি অন্য কিছু চিন্তা করছ? কেন, আনিসকে তোমার পছন্দ নয়?
আনিসকে আমার না পছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আনিস আমার বোনের ছেলে, ওকে অপছন্দ করব কেন? কিন্তু নিজেদের মাঝে সম্পর্কটা ঠিক আমার পছন্দ নয় রাহেলা। তাছাড়া তুমি ভালো করেই জানো, এই সব প্রেমট্রেম আমি সহ্য করতে পারি না। আনিসের মা প্রেম করে বিয়ে করেছিল বলেই আমি বা আমার বাবা তা মেনে নিতে পারেনি। আমি দীর্ঘদিন আনিসদের কোনো খোঁজ নেইনি। আর যদি আমি আমার মেয়ের বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়ে নেই তাহলে সেটা কি ঠিক হবে?
দেখো ফিরোজের বাবা, তোমাকে আমি স্পষ্ট করে বলি, সেই দিন আর আজকের দিনের মাঝে আকাশ-জমিন ফারাক আছে। তখনকার দিনে যা অসম্ভব ছিল আজকের দিনে সেটাই সম্ভব এবং স্বাভাবিক। তখন এসব জিনিস পরিবার খুব একটা স্বাভাবিকভাবে নিত না। এখন এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া তোমার মেয়ে তো এমন কারো প্রেমে পড়েনি যে যাকে মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হবে। আমিও আনিসকে খুব পছন্দ করি। ওর মতো ছেলের সাথে তাহিতির বিয়ে হলে আমার মেয়েটা অনেক সুখে থাকবে।
আনিসও কি তাহিতিকে ভালোবাসে?
আনিস বাসে কি বাসে না সেটা তোমার মেয়ে জানে না। কারণ তাহিতি তার মনের কথা আনিসকে জানায়নি।
বলো কী! আনিস জানেই না যে তাহিতি ওকে ভালোবাসে আর তুমি কিনা তাহিতির সাথে আনিসের বিয়ে ঠিক করে ফেলছ! না না রাহেলা, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।
এখানে খারাপ ঠেকার কিছু নেই। তুমি আনিসের জন্য এমন সুন্দর একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করলে। বিনিময়ে আনিসের কাছে তো আমরা কিছু চাইনি। আমার চাওয়া একটাই, আর সেটা হচ্ছে তাহিতির সাথে আনিসের বিয়ে হতে হবে। এখন তুমি কীভাবে কী করবে ভেবে দেখো। তাহিতির সুখের জন্য তুমি নিশ্চয়ই এখানে আর না করবে না। তাছাড়া আমার কাছে মনে হয়েছে, আনিসের প্রতি তাহিতির ভালোবাসাটা খুব তীব্র টাইপের। মেয়েটা আমার এমনিতেই সহজ-সরল। এখানে যদি সে একটি হোঁচট খায়, তাহলে তাহিতিকে সামাল দেয়া খুব কষ্টের হবে। তুমি একটা কাজ করো। তুমি আনিসের মাকে ঢাকায় আসতে বলো। আমি আলেয়ার সাথে কথা বলব। আমার ধারণা, আলেয়া ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিবে। তাছাড়া আমার মেয়ে কোনো অংশেই খারাপ নয়।
বজলু সাহেব তার স্ত্রী রাহেলার কথা সব শুনার পরেও খুব একটা
স্বস্তিবোধ করছে না। তার মনে একটা কাঁটা বিঁধে আছে। আর সে কাঁটাটা হচ্ছে, আনিস বিষয়টা কীভাবে নিবে। আনিস কি মনে করবে না, তাকে একটি শর্তের বিনিময়ে চাকরিটা দেয়া হচ্ছে? বজলু সাহেব নিজেকে বেশ ছোট অনুভব করছে। বজলু সাহেব এই বিষয়টি নিয়েও রাহেলার সাথে আলাপ করল। কিন্তু রাহেলা নাছোড়বান্দা। তার কাছে এখন কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। তার একটাই কথা, আমার মেয়ে যাকে পছন্দ করেছে, তার সাথেই তার বিয়ে হবে। তাছাড়া তার নিজেরও ছেলে হিসাবে আনিসকে পছন্দ। তাই এখানে আর কোনো কথা নাই। তুমি তোমার বোনকে ফোন করে ঢাকায় আসতে বলো। আমি আলেয়ার সাথে বিস্তারিত কথা বলব। আপাতত আনিসকে কিছু জানানোর দরকার নেই। ঠিক আছে, তোমাকে ফোন করতে হবে না। আমি আলেয়াকে ফোন করে ঢাকায় আসতে বলছি। এই কথা বলে রাহেলা বসার ঘর থেকে চলে গেল।
বজলু সাহেব মুখ কালো করে বসার ঘরের সোফায় বসে রইল। তার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। যে আনন্দ নিয়ে অফিস থেকে ফিরেছিল, রাহেলার কথায় সব আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হলো। তার মনে একটাই কথা বারবার উঁকি দিচ্ছে, আনিস কীভাবে নিবে ব্যাপারটা! আনিসের কাছে অনেক ছোট হয়ে যেতে হবে। বজলু সাহেব পড়ে গেল মহা এক ঝামেলায়।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের ভিতরে ছোট্ট একটি ঘরের সামনে বিশাল জটলা। অনেক লোকের সমাগম সেখানে। ঘরের দরজার বাইরে একটি সাইনবোর্ডে লেখা বাবা শাহী চুলকানি। ঘরের দরজায় লাল কাপড়ের পর্দা দেয়া। দরজার বাইরে মাথায় লাল কাপড়ের পাগড়ি মাথায় দিয়ে বাঁশের লাঠির মাথায় লাল কাপড় দিয়ে মোড়ানো দুজন লোক বাঁশ দুটি ক্রস আকৃতি করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের জটলা ঠেলে রিপন লোক দুজনের একজনকে বলল, বাবা কি বিশ্রামে নাকি মোমিন ভাই?
মোমিন নামের লোকটি রিপনকে জানাল, বাবা, একটু বিশ্রামে আছে। একটু পরেই তিনি জাগ্রত হবেন। তখন তিনি তার কাজ শুরু করে দিবেন। রিপন ভাই কি জরুরি কোনো কাজে এসেছেন?
হ্যাঁ ভাই, জরুরিই বলতে পারেন। আমার দুই বন্ধুর একটু সমস্যা যাচ্ছে। ওদের নিয়ে এসেছি। ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কি ওদের নিয়ে আসব?
আপনি সিরিয়াল দিয়েছেন? দেখছেন না মানুষের লম্বা লাইন। আপনি একটা কাজ করেন, দুজনের জন্য পাঁচশ’ করে এক হাজার টাকা পাশের ঘরে জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে আমার কাছে জমা দেন। দেখি, আমি আপনাদের কয়েকজনের পরেই ঢুকিয়ে দেয়া যায় কি না।
রিপন সেখান থেকে বের হয়ে বাইরে চলে গেল। বাইরে আশরাফুল, ফুয়াদ, আনিস দাঁড়িয়ে আছে। আনিসের আসার কথা না থাকলেও ফুয়াদ আনিসকে ছাড়েনি। তার একা একা আসতে ভয় হচ্ছিল তাই রিপনের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আনিসকে নিয়ে এসেছে। রিপন বাইরে এসেই ফুয়াদ আর আশরাফুলের কাছ থেকে পাঁচশ’ করে এক হাজার টাকা নিয়ে আবার ভিতরে চলে গেল। টোকেন নেয়ার জন্য রিপন বাবার পাশের ঘরে ঢুকে একটু অবাক হলো। এর আগে বেশ কয়েকবার বাবার দরবারে আসলেও এই ঘরে ঢুকা হয়নি। ঘরের ভিতরে একটি কম বয়সী মেয়ে হলুদ টাইপের শাড়ি পরে একটি টেবিল আর চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মেয়েটি দেখতে যারপরনাই সুন্দর। মেয়েটি শুধু শাড়ি পরেছে। শাড়ির ভিতরে কোনো ব্লাউজ না পরায় মেয়েটিকে প্রথম দেখা মাত্রই রিপনের শরীরে একটা ধাক্কা অনুভব হলো। রিপন পলকহীন চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। রিপনের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। বারবার রিপনের মনে হচ্ছে এত সুন্দর একটি মেয়ে বাবার দরবারে এই বেশে বসে আছে কেন?
আপনি কি টোকেন নেয়ার জন্য এসেছেন?
মেয়েটির কথায় রিপনের ঘোর ভাঙল। মেয়েটির কথা বলার স্টাইলও তো ফাটাফাটি। রিপন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, জি ম্যাডাম।
রিপনের মুখে ম্যাডাম শব্দটি শুনে মেয়েটি মুচকি হাসল। এইখানে কেউ তাকে ম্যাডাম বলে ডাকে না। সবাই তাকে ছোট মা বলে ডাকে। মেয়েটি রিপনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুইটি গোল সাইজের প্লাস্টিকের কয়েন টাপের টোকেন ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে ম্যাডাম বলছেন কেন? আপনি মনে হয় আমাকে দেখেননি, তাই ম্যাডাম বলছেন। আমাকে সবাই ছোট মা বলে ডাকে। আমি আপনাদের বাবার ছোট বউ। কয়েক দিন আগে আপনাদের বাবা আমাকে বিয়ে করে এনেছেন।
মেয়েটির মুখে বাবার বিয়ের কথা শুনে রিপনের মুখ তেলাপিয়া মাছের মতো হাঁ হয়ে গেল। বলে কী মেয়েটি! বাবা বিয়ে করেছে? বাবার তাহলে আগেও একটি বউ আছে? তাকে নিশ্চয়ই সবাই বড় মা বলে। রিপন আর কিছু চিন্তা করতে পারছে না। বাবার কাছে রিপন এতবার এসেছে কিন্তু বাবা যে বিবাহিত তা একবারের জন্যও বলেনি। তবে রিপন মনে মনে বাবার পছন্দের তারিফ না করে পারল না।
টোকেন নিয়ে রিপন মোমিনের হাতে দিয়ে বলল, বাবা কি উঠেছে?
হ্যাঁ উঠেছে। ১ নাম্বার সিরিয়াল রোগী ভিতরে ঢুকেছে। আপনার সিরিয়াল তো দেখছি ২৫ নাম্বার। আপনি একটা কাজ করেন, আপনি আপনার বন্ধুদের নিয়ে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে আপনাদের ঢুকিয়ে দিব। আর শুনেন রিপন ভাই, কিছু মনে কইরেন না, সম্ভব হইলে আমার হাতে পাঁচশ’টা টাকা দিয়েন। বুঝেনই তো।
রিপন মোমিনের কথার মানে বুঝতে পেরে পাঁচশ’ টাকা মোমিনের হাতে ধরিয়ে দিল। টাকাটা হাতে নিয়ে মোমিন দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে জটলার মানুষদের উদ্দেশে বলল, এইভাবে এইখানে জটলা না করে সবাই লাইন করে দাঁড়ান। আর চেঁচামেচি করবেন না কেউ। বাবা চেঁচামেচি একদম সহ্য করে না। সবাই লাইনে দাঁড়ান।
রিপন ভাই, আর কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? আনিস অনেকটা ভয়ে ভয়ে রিপনকে প্রশ্নটি করল।
ফুয়াদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শুধু এর মাঝে একবার ফুয়াদ আনিসকে বলেছে, আনিস ভাই, আমার কেমন জানি টেনশন হচ্ছে। বাবা যখন আমাকে ডাকবে, তখন তুমি আমার পাশে থাকবে তো?
ফুয়াদের কথা শুনে রিপন ফুয়াদকে ধমকের সাথে বলেছে, চুপ থাকেন। বাবার ঘরে আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারবে না।
বেশি মানুষকে একসাথে বাবার ঘরে ঢুকার পারমিশন নাই। আর ফুয়াদ সাহেব, আপনাকে সাবধান করে দেই, বাবা যা বলবে শুধু তারই উত্তর আপনি দিবেন, এর বাইরে একটাও কথা বলবেন না। তাহলে কিন্তু বাবা বিরক্ত
হবে। আর যদি একবার বিরক্ত হয়, তাহলে কিন্তু ভয়াবহ অবস্থা হয়ে যাবে। তাই সাবধান।
রিপনের মুখে এই কথা শুনার পর ফুয়াদের টেনশন বেড়ে গেছে। আর টেনশন হলে ফুয়াদের প্রস্রাবের তীব্র চাপ অনুভব হয়। এর মাঝে ফুয়াদ তিনবার বাইরে যেয়ে রাস্তার পাশের ড্রেনে হালকা হয়ে এসেছে।
আশরাফুলেরও একই অবস্থা। আশরাফুল মনে মনে চিন্তা করতে লাগল, এইখানে আসাটা তার ঠিক হয়েছে কি না। বাবা যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে
এই ভয়ে আশরাফুলের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। রিপনের মুখে
যে কথা শুনল, তা শুনে আশরাফুল বাবার কাছে যাবে কি না তা নিয়েও আশরাফুল দ্বিধায় পড়ে গেল। রিপনের কাছে একটা সিগারেট নিয়ে আশরাফুল টানতে লাগল।
রিপন মনে হয় ফুয়াদ আর আশরাফুলের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারল। তাদের দুজনের সামনে যেয়ে রিপন বলল, টেনশনের কিছু নাই, আমি তো আপনাদের সাথে থাকব। এত ভয়ের কিছু নাই। দেখছেন না, একেকজন মানুষ ভিতরে ঢুকছে আর হাসি মুখ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে! তার মানে হচ্ছে বাবা আজ খোশ মেজাজে রয়েছে। আর বাবা যেদিন খোশ মেজাজে থাকে সেদিন বেশিরভাগ মানুষের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আপনাদের দুজনের কপালটা ভালো। সঠিক সময়েই আজ আমরা এসেছি।
আনিস ফুয়াদের হাত ধরে বলল, টেনশন নেয়ার কিছু নেই। রিপন ভাই তো তোর সাথে থাকবে। তাছাড়া আমি তো পাশেই আছি।
এমন সময় বাবার ঘর থেকে কে যেন বাবারে বলে চিৎকার করে উঠল। লাইনে দাঁড়ানো সবাই বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। বাবার ঘর থেকে বাবারে বাবারে বলে শব্দ শুনা যাচ্ছে। মনে
হচ্ছে কেউ যেন কাউকে পিটাচ্ছে। ফুয়াদ আনিসের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আশরাফুল চোখ বড় বড় করে রিপনকে বলল, ভাই কাহিনি কী? বাবা কি তার মুরিদ বা রোগীকে পেটাচ্ছে নাকি?
রিপনের কোনো ভাবান্তর নাই। রিপন সবাইকে বলল, আপনারা চিন্তা করছেন কেন? হয়তো এই রোগী বাবার কথার বাইরে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে তাই বাবা হয়তো হালকা প্যাঁদানি দিচ্ছে। ও তেমন কিছু না। তার ঠিক পরপরেই দেখা গেল, একটি লোককে বাবার ঘর থেকে বাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ানো দুজন লোক কোলে করে বের করে বাইরে নিয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখার পর ফুয়াদ আর আশরাফুলের অবস্থা কাহিল। তাদের দুজনেরই বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারছে। ট্রেনের গতির চেয়ে দ্রুত তাদের বুকের হার্টবিট হচ্ছে। আশরাফুল রীতিমতো ঘামছে।
এমন সময় মোমিন নামের লোকটি রিপনের সিরিয়াল ধরে ডাকল। ২৪ নাম্বার সিরিয়াল কে? দ্রুত বাবার ঘরে যান।
২৪ নাম্বার সিরিয়াল আশরাফুলের। রিপন আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে অভয় দিয়ে বলল, চলেন। কোনো ভয় নাই। জাস্ট বাবা যা বলবে, শুধু তারই উত্তর দিবেন, আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলতে যাবেন না, ঠিক আছে?
আশরাফুল আনিসের দিকে করুণ চোখে তাকাচ্ছে। যে তাকানোর অর্থ হচ্ছে, ভাই রে, ভাই। আমার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। আশরাফুল ঘামতে ঘামতে রিপনের সাথে বাবার ঘরে ঢুকল।
ভিতরে ঢুকে আশরাফুল অবাক না হয়ে পারল না। ঘরের ভিতরে এসি লাগানো। পুরো ঘর লাল কাপড়ের পর্দা দিয়ে সাজানো। বাবা একটি বাদশাহি চেয়ারে বসে আছে। আর দুজন লাল কাপড় পরা এবং মাথায় লাল টুপি পরা অবস্থায় বাবার হাত এবং পা টিপছে। বাবার পরনেও লাল কাপড়ের ড্রেস। লম্বা সাইজের মাথার চুল। লম্বা দাড়ি। কালো দাড়ির মাঝে ফর্সা চেহারা। চেহারার মাঝে সুফি সুফি একটা ভাব আছে। বাবা মনে হয় পান চাবাচ্ছেন। তার ঠোঁট টকটকে লাল।
গরুগম্ভীর কণ্ঠে বাবা বলল, কি রে রিপন, তুই আবার কাকে আনলি? তোর বন্ধু নাকি? আয় আয়, আমার পাশে আয়। তোকে অনেক দিন পর দেখলাম। মাঝখানে তোকে মনে মনে আশা করছিলাম। কেন জানি তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।
রিপন অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে বাবার সামনে যেয়ে বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল। আশরাফুলকেও বলল বাবাকে সালাম করতে। আশরাফুল রীতিমতো দৌড়ে যেয়ে বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল।
বাইরে দুইজনকে দাঁড় করিয়ে এসেছিস কেন রিপন? যা তোর ওই বন্ধুদেরও নিয়ে আয়।
রিপন অবাক হয়ে গেল। বাইরে যে দুজনকে দাঁড় করিয়ে রিপন আর আশরাফুল ভিতরে ঢুকেছে, এই কথা বাবা জানল কেমন করে? রিপন আশরাফুলের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করল। যে ইশারার মানে হচ্ছে, দেখলেন বাবার কেরামতি!
রিপন কোনো কথা না বাড়িয়ে আনিস আর ফুয়াদকে ডেকে আনার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেল এবং ঝড়ের গতিতে তাদের দুজনকে নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকল। আনিস আর ফুয়াদও বাবার ঘরে ঢুকে একটা ধাক্কা খেল। ফুয়াদ মনে হয় ভয়ে একটু কাঁপছে। আনিস অবাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। রিপন ফুয়াদকে লক্ষ করে বলল, ফুয়াদ ভাই যান, বাবাকে আগে সালাম করে আসেন। রিপনের কথা শুনে ফুয়াদ আনিসের দিকে তাকিয়ে থাকল। আনিস তাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। আর বুঝানোর চেষ্টা করল, ভয় নেই, আমি তো আছি। রিপন আবার বলল, ফুয়াদ সাহেব যান, বাবাকে সালাম করে আসেন।
ফুয়াদ আর দেরি না করে দ্রুত পায়ে বাবার পায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বাবার পা ধরে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, বাবা আমাকে আপনি বাঁচান। আমার নাজমাকে আমার কাছে এনে দেন বাবা। আমি আপনার পায়ে পড়ি বাবা, আমার জন্য একটা কিছু করেন।
ফুয়াদের কান্না দেখে আশরাফুলও বাবার একটি পা ধরে কান্না করতে লাগল। আনিস আর রিপন চোখ বড় বড় করে এই ঘটনা দেখতে লাগল। দুজনের হঠাৎ এই রকম কান্নাকাটিতে বাবাও অনেকটা হতবিহ্বল। ফুয়াদ আর আশরাফুল বাবার পা ধরে টানাটানির একপর্যায়ে বাবা তার চেয়ার সামলাতে না পেরে চেয়ার থেকে বাবা ধপাস করে পড়ে গেল। চেয়ার থেকে পড়ে বাবা কঁকিয়ে বলে উঠলেন, বাবারে।
বাবার পাশে দাঁড়ানো দুইজন বাবাকে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় রিপন আর আনিস টাসকি খেয়ে গেল। ফুয়াদ আর আশরাফুল ভীত চোখে রিপনের দিকে তাকিয়ে থাকল। যে তাকানোর অর্থ হচ্ছে রিপন ভাই, আমাদের বাঁচান। রিপন কালবিলম্ব না করে ত্বরিতগতিতে বাবার পায়ের কাছে যেয়ে বলে উঠল, জয় চুলকানি বাবার জয়।
রিপন চোখ টিপে সবাইকে ইশারা করল, আর তার সাথে সাথে আনিস, ফুয়াদ আর আশরাফুলও গলার পর্দা আর বাবার ঘরের দেয়াল ভেদ করে চিৎকার করে বলতে থাকল, জয় চুলকানি বাবার জয়।
তাদের চিৎকার মনে হয় বাইরেও প্রভাব ফেলেছে। কারণ ঘরের সবাই বাইরে থেকেও চিৎকার করে বাইরে দাঁড়ানো মানুষের কণ্ঠ শুনতে পেল। সবাই জোরে জোরে বলছে জয় চুলকানি বাবার জয়।
বাবা হাতের ইশারায় ঘরের সবাইকে বসতে বলল। রিপনের মাথায় হাত দিয়ে বলল, আমি খুশি হলাম রে রিপন। তোর বন্ধুরা এমনভাবে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করছিল যে ওদের সালামের প্রভাবে আমি চেয়ার থেকেই পড়ে গেলাম। ও তেমন কিছু না। আমি জানি তোর দুই বন্ধুই নারী ঘটিত ঝামেলায় পড়েছে। একজনের সমস্যা হচ্ছে, তার প্রেমের বাঁধন হালকা হয়ে গেছে, কঠিন করে গিট্টু দিতে হয়ে, যাতে হালকা না হয়। আরেকজনের সমস্যা হচ্ছে তার প্রেমের বাঁধন ঠিক আছে কিন্তু তার প্রেমিকার বাবা তার প্রেমিকাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজছে।
বাবার মুখে এই কথা শুনে রিপন, আনিস, ফুয়াদ আর আশরাফুলের আক্কেল গুড়–ম। বাবা এসব কী করে জানল! রিপন সবার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। যে তাকানোর অর্থ হচ্ছে, কী বলেছিলাম না, আমার চুলকানি বাবা বিশাল কামেল আদমি!
রিপন অবাক হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করল, কিন্তু বাবা, আপনাকে তো কিছু জানানো হয়নি। আর আপনি তো এই দুজনের কারো পিঠে চুলকাননি। আপনি কী করে বললেন সব কিছু?
আরে পাগল, তোর দুই বন্ধু যখন আমার পা ছুঁয়ে সালাম করছিল, তখনই আমি ওদের পিঠে হালকা করে চুলকিয়ে ওদের ভিতরের কাহিনি জানার
চেষ্টা করেছি। তোর বন্ধুরা ওদের প্রেমিকার বাবা আর দাদার নাম নিয়ে এসেছে তো?
ফুয়াদ আর আশরাফুল একসঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, জি বাবা এনেছি।
বাবা বলল, একটি কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে আমার হাতে দাও।
তাদের দুজনের হাতে দুইটি সাদা কাগজ দেয়া হলো। তারা সেখানে বড় বড় করে দুজনের প্রেমিকার বাবা আর দাদার নাম লিখে বাবার হাতে দিল। বাবা সেই কাগজ দুটি তার দুই হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বলল। তারপর চোখ খুলে তার পাশে দাঁড়ানো দুইজনকে কী যেন ইশারা করল। তারা সাথে সাথেই দুইটি তাবিজ নিয়ে এসে বাবার হাতে দিল। বাবা সেই কাগজ দুটি দুটি তাবিজের ভিতরে ঢুকিয়ে মোম দিয়ে তাবিজের মুখ বন্ধ করে দিয়ে ফুয়াদ আর আশরাফুলের হাতে দিয়ে আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে বলল, আগামী তিন দিন পর অমাবস্যা। সেই রাতে তোমার প্রেমিকার বাড়ির আশেপাশে যে কবরস্থান আছে, সেখানে রাত বারোটার পরে এই তাবিজটি যেকোনো একটি কবরের পাশে মাটি খুঁড়ে মাটির নিচে চাপা দিয়ে আসবে। ব্যস, তোমার কাজ শেষ। তোমার প্রেমিকা এই কাজের তিন দিনের মধ্যে তার ভুল বুঝতে পেরে তোমার কাছে ছুটে আসবে।
এই কথা শুনা মাত্র আশরাফুলের চোখ-মুখ আনন্দে ঝিলিক মেরে উঠল। আশরাফুল অতি আবেগে গদগদ হয়ে বাবার পা ছুঁয়ে জয় চুলকানি বাবার জয় বলে উঠল।
ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বাবা বলল, এই তাবিজটি তুমি তোমার ডান হাতের বাহুতে বেঁধে রেখে তোমার প্রেমিকার বাসার সামনে দিয়ে আগামীকাল থেকে তিন দিন হেঁটে যাবে। এই তিন দিনের মাঝে তোমার প্রেমিকার বাবাকে একবারের জন্য হলেও তুমি পাশ কাটিয়ে যাবে। তিন দিন পর দেখবে তার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার ভূত তার মাথা থেকে পালিয়ে গেছে।
ফুয়াদও বেশ উৎফুল্ল। সে আশরাফুলের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে
বাবার হাত ধরে কয়েকটি চুমু খেয়ে বলল, বাবাজান, আমার আব্বাজান, আপনি মহান, আপনি মহান। আপনার কোনো তুলনা হয় না হে পেয়ারে চুলকানি বাবা।
বাবা, হাতের ইশারা করে ফুয়াদকে শান্ত হতে বলল। রিপনের দিকে ইশারা করে বাবা যেন কী বুঝাতে চাইল। রিপন বুঝতে পারল, বাবা কী বুঝাতে চাইছেন। বাবার ইশারার অর্থ হচ্ছে, তুই তোর বন্ধুদের নিয়ে এখন বিদায় হ।
আনিসের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। আনিস মুখ হাঁ করে চোখ বড় বড় করে বাবার কা–কারখানা দেখছিল। রিপনের ডাকে আনিসের ধ্যান ভাঙল। আনিস ভাই চলেন, বাইরে বের হই।
বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রিপনকে লক্ষ করে বাবা বলে উঠলেন, রিপন মালটু দিয়েছিস তো?
রিপন বাবার কথায় নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, ভুলে গেছি বাবা, এই কথা বলে পকেট থেকে দ্রুত টাকা বের করে বাবার কদমতলে রেখে দিল। ভুল মার্জনা করবেন বাবা।
ঠিক আছে। ভালো থাকিস।
বাবার ঘর থেকে বের হয়েও যেন আনিসের ঘোর কাটছে না। বাবা কীভাবে সব সত্য কথাগুলো বলে দিল! এ তো ভয়াবহ কা-। এও কি
সম্ভব? আশরাফুল রিপনকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা রিপন ভাই, বাবা চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার পর আপনি হঠাৎ ওইভাবে জয় চুলকানি বাবার জয় বলে উঠলেন কেন?
আমি যদি তখন ওই কাজটি না করতাম, তাহলে আজ একজনেরও পিঠের ছাল-চামড়া থাকত না। সবার পিঠে বাবা এমনভাবে চুলকানো শুরু করত যে কারো পিঠের চামড়া আস্ত থাকত না। বাবাকে খুশি করার জন্য আর বাবাকে শান্ত করার জন্য ওই কাজ করতে হয়েছে।
এমন সময় রিপনের ফোন বেজে উঠল। রিপন ফোন দেখে বলল, জাহিদ ফোন করেছে। রিপন ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো জাহিদ ভাই, ভালো আছেন? কী বললেন? আজকেই রওনা হতে হবে। লঞ্চ কয়টায়? সাতটায়? টিকেট কাটা হয়ে গেছে? ওকে জাহিদ ভাই, আমি আর আনিস ভাই মেসে ফিরতেছি। ফোন রেখে রিপন আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, কালকে শাহাদৎ ভাইয়ের বিয়ে। আজ রাতেই বরিশাল যেতে হবে। জাহিদ ভাই টিকেট ফাইনাল করেছে। চলেন আমরা বাসার দিকে যাই। অনেক কাজ আছে।
ফুয়াদের কাছে বিদায় নিয়ে রিপন, আশরাফুল আর আনিস মেসের দিকে রওনা হলো। (চলবে)

 

লেখক: হুমায়ুন কবির হিমু

Related Articles

Back to top button