সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ও লুইজ গ্লুক
সাহিত্য ডেস্ক:
আমার কাছে ঢাউস আকারের দুটো এন্থোলজি আছে, দুটোতেই লুইজ গ্লুকের কবিতা আছে। এর মধ্যে ‘দ্য নর্টন এন্থোলজি অব পোয়েট্রি’-(২০০০ পৃষ্ঠা)-এর চতুর্থ সংস্করণে লুইজ গ্লুকের দুটো মাত্র কবিতা আছে। অন্যদিকে ‘দ্য রিভারসাইড এন্থোলজি অব লিটারেচার’ (২১৭২ পৃষ্ঠা)-এ ছয়টি কবিতা ও একটি প্রবন্ধ আছে।
রিভারসাইড এন্থোলজিটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত আর নর্টনের সংকলনটি ১৯৯৬-এ প্রকাশিত। লুইজ এলিজাবেথ গ্লুক ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দি ওয়াইল্ড আইরিস’-এর জন্য। ২০০৩-২০০৪ সালে তিনি আমেরিকার ‘পোয়েট লোরিয়েট’ হয়েছেন। এই তথ্যটুকু দিয়ে লেখা শুরু করতে হলো এই কারণে যে, নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরেই অনেকেই জানাতে শুরু করলেন তারা লুইজ গ্লুককে চেনেন না। সবার সবাইকে চিনতে হবে তেমন কোনো কথা নেই। তবে ইউরোপ, আমেরিকাজুড়ে লুইস গ্লুক প্রতিষ্ঠিত কবি। তিনি ইতোমধ্যেই আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। কাজেই তাকে না-চেনার মধ্যে অন্তত এটা প্রমাণ করা যায় না যে, আপনি বিশ্ব কবিতার মানচিত্র সম্পর্কে খুব একটা জানেন।
গ্লুক পরিবার আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে আসে তিন পুরুষ আগে। তবে লুইজ গ্লুকের বাবা ডেনিয়েল গ্লুক-এর জন্ম নিউইয়র্কে। এই পরিবারে তিনিই প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে জন্ম নেন। তাঁর পিতৃপুরুষ ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি। মা বিয়াত্রিস গ্লুক ছিলেন রাশিয়ান ইহুদি। লুইজ গ্লুকের বাবা ডেনিয়েল লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে তাঁকে। জীবন ধারণের প্রয়োজনে তিনি লেখালেখিকে সেভাবে আকড়ে ধরতে পারেননি। লুইজের মা গৃহবধূ হলেও ম্যাসাচুটসের ওয়েলেসলি কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন। শিক্ষিত বাবা-মার কাছ থেকেই লুইজ গ্লুক খুব ছোটবেলাতেই গ্রিক পুরাণের পাঠ নিয়েছেন। গ্লুকের কবিতায় পুরাণ, প্রবাদ, উপকথার সমাহার দেখা যায় আধুনিক মনোবিশ্লেষণের পাশাপাশি। আধুনিক মনস্তত্ত্ব তাঁর কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক; কারণও আছে। লুইজ গ্লুক কৈশোরেই Anorexia nervosa নামের একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। এটা খাদ্যগ্রহণ সংস্ক্রান্ত একটি মানসিক সমস্যা। এই সমস্যায় ভোগা রোগিরা নিজেদের অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর বা মোটা ভাবেন, তাই তারা খেতে চান না। অথচ তারা কৃশকায় এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের হয়ে থাকেন। এদের জোর করে খাওয়াতে গেলে বমি করে দেয়। অত্যন্ত অল্প আহার এবং সীমিত কিছু খাদ্য গ্রহণের ফলে এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডে বিবিধ অসুবিধা দেখা যায়। এই মনোদৈহিক সমস্যার কারণেই গ্লুকের কৈশোর-যৌবনের একটা বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্কুলে থাকার সময় এই সমস্যা দেখা দিলেও লুইজ গ্লুক সাত বছরের চিকিৎসার মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য, তার বড়বোন এই সমস্যায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই অসুস্থতার কারণেই তিনি কলেজে পূর্ণকালীন ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে পারেননি। বরং তিনি সারাহ লরেন্স কলেজে ১৯৬৩-৬৫ সাল নাগাদ একটা কবিতার ক্লাস করেন। এরপর তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জেনারেল স্টাডি বিভাগ একটা ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হন। এই কোর্সটি প্রচলিত শিক্ষা যারা নিতে পারবে না তাদের জন্য। সেখানে তিনি মার্কিন দুই পোয়েট লরিয়েট লিওনি এডাম এবং স্ট্যানলি কুনিজকে শিক্ষক হিসেবে পান। নিজের কবি হয়ে ওঠার পেছনে এই শিক্ষকদের ভূমিকাকে উল্লেখযোগ্য মনে করেন লুইজ গ্লুক।
তবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীটিও তিনি শেষ পর্যন্ত অর্জন করতে পারেননি। এরপর তিনি অফিস সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন আর ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ফার্স্টবর্ন’ প্রকাশিত হয়। বইটি আলোচিত হয়। কিন্তু এরপর প্রায় তিন বছর তিনি আর কিছুই লেখেননি। তার দাবি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে তাঁর রাইটার ব্লক কাটে। এ সময় তিনি গর্ডন কলেজে কবিতা বিষয়ে পাঠদান করেন। এই সূত্রেই তাঁর রাইটার ব্লক কাটে এবং ১৯৭৫ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য হাউজ অব মার্সল্যান্ড’ প্রকাশিত হয়। এই কবিতার বইয়ের মাধ্যমেই লুইজ গ্লুককে আলাদা করে চেনা শুরু হয়।
এর পাঁচ বছর পর তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ডিসেন্ডিং ফিগার’ (১৯৮০) প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের কারণে তিনি যেমন প্রশংসিত হন, তেমনি সমালোচিতও হন। বিশেষ করে ‘দ্য ড্রাউন চাইল্ড’ শিরোনামের কবিতাটির জন্য মার্কিন কবি, লেখক, সমালোচক গ্রেড কুজমা তাকে ‘শিশু ঘৃণাকারী’ বলে উল্লেখ করেন।
গ্লুকের ভঙ্গুর কৈশোর আর যৌবনের প্রভাব এই বইয়ের কবিতা রয়ে গেছে। পাঠক কিন্তু তাঁর এই কবিতার বইটি আদরের সঙ্গেই গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, এই বছরই লুইজ গ্লুকের ভারমন্টের বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। তাঁর যাবতীয় সম্পদ ধ্বংস হয়। ব্যক্তিগত এই ক্ষতি গ্লুককে একদিকে তীব্র বিষণ্ন করে, অন্যদিকে সে এই বিষাদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে কবিতার মাধ্যমেই। এই ট্র্যাজেডি কাটিয়ে উঠতেই ১৯৮৫ সালে তিনি ‘দ্য ট্রায়াম্প অব একিলিস’ কাব্যগ্রন্থটি তৈরি করেন। কবি, লেখক এবং ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সমালোচক লিজ রোজেনবার্গ এই কবিতার বই প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি স্বচ্ছ, নিঁখুত এবং তীক্ষ্ম’। ‘দ্য জর্জিয় রিভিউ’-এর সমালোচক পিটার স্টিট তো ঘোষণা দিয়ে বসেন যে লুইজ গ্লুক ‘আমাদের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন।’ এই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা ‘মক অরেঞ্জ’ অসংখ্য এন্থোলজিতে ঠাঁই পায় এবং একাধিক কলেজে পাঠ্য হয়ে ওঠে।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশি দূর না-হলেও লুইজ গ্লুক নিজে শিক্ষকতায় আসেন। ১৯৮৪ সালেই গ্লুক ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়াম কলেজের ইংরেজি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন তিনি। ব্যক্তিগত সাফল্যের এক ধাপ পার না হতেই পরের বছরই তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। এই অপূরণীয় ক্ষতি আবার তাঁকে নতুন কাব্যগ্রন্থের শক্তি দেয়। ১৯৯০ সালে তাঁর ‘আরারাত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হলে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সমালোচক উইট গার্নার এই বই প্রসঙ্গে বলেন, ‘গত ২৫ বছরে লেখা আমেরিকার কবিতার সবচেয়ে নির্দয় আর বেদনাপূর্ণ বই।’ এরপর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে আলোচিত ও বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ’। এই বইয়ের কবিতাগুলোতে ফুলেরা কথা বলে একজন মালি ও দেবতার সঙ্গে প্রাণের প্রকৃতি নিয়ে। এই বইয়ের জন্যই তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান এবং আমেরিকার সমকালের অন্যতম কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। একাধিক সমালোচক তাঁর এই বইকে মহান সৌন্দর্য এবং মাইলফলক কাব্যগ্রন্থ বলে মতামত দেন। লুইজ গ্লুকের কাব্যজীবনে যথার্থই ‘দি ওয়াইল্ড আইরিশ’ একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এই বইয়ের জন্য তিনি দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়ে ওঠেন।
কবি হিসেবে সফল হলেও এই দশকটা তাঁর ব্যক্তিজীবনে আবার ভাঙন আসে। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হয়। স্বামী যেহেতু তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন, এ নিয়েও জটিলতা হয়। তবে এই সময়টা কবি লুইজ গ্লুকের জন্য সবচেয়ে ঊর্বরা। ১৯৯৪ সালে কবিতা বিষয়ক ভাবনা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘প্রুফস অ্যান্ড থিউরিস: এসেজ অন পোয়েট্রি’ প্রকাশিত হয়। এবং ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘মিডোল্যান্ডস’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থ তিনি প্রেম এবং বৈবাহিক সম্পর্কের পতন নিয়ে লেখেন। এরপর ১৯৯১ সালে ‘ভিটা নোভা’ এবং ২০০১ সালে ‘দ্য সেভেন এইজেস’ প্রকাশিত হয়। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর হামলার উপর তিনি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। ‘অক্টোবর’ শিরোনামের ছয় খণ্ডের একটি কবিতা নিয়েই তিনি বই প্রকাশ করেন ২০০৪ সালে। এই কবিতায় তিনি মার্কিন সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে তুলনা করে গ্রীক পুরাণের বিভিন্ন আঘাত ও ভোগান্তি তুলে ধরেন। এ বছরই তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রোজেনক্রানঞ্জ রাইটার ইন রেসিডেন্স’ নির্বাচিত হন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর তিনি কবিতা লেখায় আরো বেশি মনোনিবেশ করেন। ২০০৬ সালে ‘এভেরনো’, ২০০৯ সালে ‘এ ভিলেজ লাইফ’ এবং ২০১৪ সালে ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভিট্রোয়াস নাইট’ প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে যখন তার পঞ্চাশ বছরের কবিতা থেকে বাছাই করে ‘পোয়েমস: ১৯৬২-২০১২’ সংকলনটি প্রকাশ হয় তখন একে ‘সাহিত্য জগতের একটি ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেন মার্কিন সমালোচকগণ। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আমেরিকান অরিজিনালিটি’ (২০১৭)। এটি একটি প্রবন্ধ সংকলন।
লুইজ গ্লুকের জীবন ও বিভিন্ন প্রকাশনা গ্রন্থের ধারাক্রম থেকে দেখা যায়, ব্যক্তি জীবন তাঁর লেখায় ভীষণ প্রভাব ফেলে। একান্ত নিজস্ব ঘটনাকে তিনি তুলে আনেন বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে, অন্যদিকে মনোজগতের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। আর এসব আসে পুরাণ, উপকথা, প্রবাদ প্রবচনের স্বচ্ছন্দ ব্যবহার সহযোগে।
চিত্রদেশ//এল//