হুমায়ুন কবির হিমু’র উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’ (৫ম পর্ব)
জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।
পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হচ্ছে । আজ রইল উপন্যাসের (৫ম পর্ব)
সকাল সকাল আশরাফুল খুব উত্তেজিত হয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। তার কথার ধরন শুনলেই বুঝা যায় যে সে তার গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করছে। মাঝে মাঝে সে নরম সুরে কথা বলছে আবার একটু পরেই উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছে। দেখো, তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। কথাগুলো তোমার সাথে শেয়ার করা আমার জন্য জরুরি। প্লিজ জানু, আজ একটু দেখা করো। কতদিন হয়ে গেল তোমার সাথে দেখা হয় না, তা তোমার মনে আছে? প্লিজ টুনটুনি, একটু সময় বের করে দেখা করার ব্যবস্থা করো। আমি তোমার জন্য কার্জন হলের সামনে ঠিক দশটার সময় দাঁড়িয়ে থাকব! কী বললে, তুমি আসতে পারবে না! আমি তোমাকে এত রিকোয়েস্ট করছি, তার পরেও আসতে পারবে না! আচ্ছা, তুমি একটা সত্য কথা বলো তো, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? কী ব্যাপার, কথার উত্তর দিচ্ছ না যে? দেখো, আমার সাথে তুমি কাহিনি করার চেষ্টা করবে না। তুমি ভালো করেই জানো আমি যেমন ভালো ঠিক তেমনি খারাপ। তুমি আমার ভালোবাসা দেখেছ, আমার ঘৃণা কিন্তু দেখোনি! না, না জানু, আমি তোমাকে হুমকি দিতে যাব কেন? তুমি তো জানো, তোমার সাথে দেখা হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। তোমাকে আমি কী পরিমাণ ভালোবাসি তা তো তুমি জানো। তাহলে কেন তুমি বেশ কিছুদিন থেকে এমন করছ? প্লিজ বুলবুলি, আজকে একটু দেখা করো। প্লিজ, প্লিজ! কী বললা, দেখা করতে পারবে না!
আশরাফুলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে আনিসের ঘুম ভেঙে গেছে। আনিস কোনো কথা না বলে চুপচাপ আশরাফুলের কথা শুনে যাচ্ছে। আনিস যে আশরাফুলের সব কথা শুনে ফেলছে সেদিকে আশরাফুলের কোনো লক্ষ নেই। আশরাফুল একমনে নরম এবং গরম সুরে তার বান্ধবীর সাথে কথা বলে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে মনে হয় আশরাফুলের বান্ধবী লাইন কেটে দিয়েছে। আশরাফুল উত্তেজিত কণ্ঠে হ্যালো হ্যালো করে চিৎকার করছে।
আনিস বিছানা থেকে উঠে বসে আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে, সাতসকালে তুই কার সাথে এত উত্তেজিতভাবে কথা বলছিস?
আনিসের কথায় আশরাফুল কোনো উত্তর না দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। তাকে এই মুহূর্তে বড় হতাশাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এখনই সে কান্না করবে।
আনিস আবার বলল, কি রে কী হয়েছে? আমার সাথে কি শেয়ার করা যায়? তুই কি কাঁদছিস নাকি আশরাফুল?
আশরাফুল চোখ-মুখ লাল করে বসে থাকল, আনিসের কথার কোনো উত্তর দিল না। ঠিক এমন সময় রিপন তাদের ঘরে ঢুকে আশরাফুলের কাছে পেস্ট চাইল। আশরাফুল মাথা নিচু করে বসে আছে। আনিসও অনেকটা বিমর্ষ!
রিপন কিছু বুঝতে না পেরে আবার বলল, আশরাফুল ভাই, আপনার পেস্টটা একটু নেয়া যাবে? আমার পেস্ট শেষ হয়ে গেছে।
তাতেও আশরাফুলের কোনো সাড়া নেই। রিপন আনিসের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কী হয়েছে জানতে চাইল। আনিস বলল, রিপন ভাই, বাথরুমে পেস্ট আছে, আপনি নিতে পারেন।
রিপন বাথরুম থেকে পেস্ট নিয়ে আশরাফুলের পাশে বসতে বসতে বলল, আশরাফুল ভাই, আপনার কী হয়েছে? কিছু মনে না করলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।
আশরাফুলকে এমনভাবে ভেঙে পড়তে রিপন কখনো দেখেনি। রিপন অনেকটা অবাক হয়ে লক্ষ করল, আশরাফুলের চোখের কোণে পানি। রিপন বলল, আরে ভাই, পুরুষ মানুষের কাঁদতে হয় না। চোখ মুছেন। প্লিজ আশরাফুল ভাই, কী হয়েছে আমাকে বলেন। আপনাকে কে কী বলেছে? আপনার এই রিপন ভাই কিন্তু সহজ জিনিস না। মারাত্মক জিনিস। খালি আমাকে আপনি বলেন, আপনাকে কে কষ্ট দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই সমস্যার সমাধান দিয়ে দিব। প্লিজ ভাই, আপনি আমার সাথে আমার ঘরে আসেন। আনিস ভাই, যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এনে দিবেন প্লিজ। আমি আশরাফুল ভাইয়ের কাছে শুনি উনার কী হয়েছে। প্লিজ ভাই, সিগারেট খাওয়ার ব্যাড়া উঠেছে। আমার আবার সিগারেট না খেলে বাথরুম হয় না ভাই। সিগারেট শেষ হয়েছে রাতেই। আনতে ভুলে গেছি। প্লিজ সিগারেটটা এনে দিন।
আনিস বলল, সমস্যা নেই ভাই। টাকা দেন এনে দিচ্ছি।
রিপন বলল, আপনি আপনার টাকা দিয়ে আনেন, আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমার কাছে ভাংতি টাকা নেই।
আনিস মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। কারণ এর আগের এক প্যাকেট সিগারেটের টাকা রিপন ভাইয়ের কাছে পাওনা আছে। এর আগেও উনি বলছিলেন যে উনার কাছে ভাংতি নেই, পরে দিয়ে দিবেন। কিন্তু আর টাকা দেননি। আনিসও লজ্জায় টাকাটা চাইতে পারেনি। আনিস কিছু না বলে সিগারেট আনার জন্য বাইরে চলে গেল। যদিও আনিস জানে এই টাকাও আর পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
আশরাফুলের কাছে রিপন যা শুনল তার সারমর্ম হচ্ছে, আশরাফুলের বান্ধবী পিংকি ইদানীং তার সাথে টালবাহানা শুরু করেছে। তাকে আর তেমন আগের মতো পাত্তা দিচ্ছে না। অথচ পিংকি এমন ছিল না। এই তো কয়েক দিন আগেও পিংকি আশরাফুলকে ছাড়া কিছু বুঝত না। হঠাৎ করে কী এমন হলো যে পিংকি তার সাথে এমন করছে? কয়েক দিন আগে পিংকিকে অন্য একটি ছেলের সাথে নিউ মার্কেটের দিকে রিকশায় যেতে দেখেছে। এই বিষয়ে পিংকিকে প্রশ্ন করলে আশরাফুলকে পিংকি জানিয়েছে যে সেটা তার কাজিন। আমেরিকায় থাকে। ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। উনি একটু বেড়াতে চেয়েছিল, তাই উনাকে নিয়ে একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম।
সেই দিনের পর থেকেই পিংকি যেন কেমন কেমন আচরণ তার সাথে শুরু করেছে। আশরাফুলের সন্দেহ হচ্ছে যে পিংকি এখন আর তাকে ভালোবাসে না। আমেরিকা থেকে আসা ওই ব্যাটা পিংকির মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু আশরাফুল পিংকিকে ভয়াবহ রকমের ভালোবাসে। তার জীবন পিংকিকে ছাড়া অচল।
আশরাফুলের কাছে বিস্তারিত শুনার পর রিপন বলল, আপনি তো ভাই ছুপা রুস্তম! আপনি তো এই বিষয়ে আমাদের সাথে কখনো আলোচনা করেননি। আপনি একটা মেয়েকে আপনার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসে বসে আছেন, অথচ আমরা আপনার মেস মেট, ভাই বা বন্ধুর মতো, আমাদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা করলেন না! আমাদের সাথে প্রথম থেকে বিষয়টি নিয়ে শেয়ার করলে আজ আপনাকে এই বিপদে পড়তে হতো না। সে যাই হোক, আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। মেয়েটির আচরণে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এত দিন আপনার প্রতি যে ভালোবাসা ছিল তা এখন রূপান্তর হয়ে ওই আমেরিকা-ফেরত তার কাজিনের দিকে ধাবিত হয়েছে বা হওয়া শুরু করেছে। আপনি শান্ত হন, আমি একটা উপায় বের করছি।
আনিস সিগারেট নিয়ে এসে রিপনকে দিল।
আনিস ভাই, আপনার বন্ধুর তো পোয়া বারো!
পোয়া বারো মানে?
পোয়া বারো মানে হচ্ছে, আপনার বন্ধু যে ডুবে ডুবে প্রেমকলা খাচ্ছে তা কি আপনি জানেন?
প্রেমকলা মানে?
আরে বাবা, আপনাকে ঢাকায় আসার পাসপোর্ট কে দিয়েছে রে ভাই? সহজ কথা বুঝতে পারছেন না! আশরাফুল ভাই তো তার প্রেমের ক্লাইমেক্স মুহূর্তে বর্তমান অবস্থান করছে।
রিপন ভাই একটু খুলে বলবেন কি, কী হয়েছে?
আশরাফুল চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। রিপন আশরাফুলের কাহিনির সারমর্ম আনিসকে বলল। আনিস শুনে অনেকটাই অবাক হলো। আশরাফুলের এখানে আসার কয়েক মাস হয়ে গেল। আশরাফুল আর আনিস একই খাটে কয়েক মাস থেকে ঘুমাচ্ছে অথচ এর বিন্দু পরিমাণ কাহিনি আশরাফুল তার সাথে শেয়ার করেনি! ছোটবেলা থেকে আনিস জানে যে আশরাফুল একটু চাপা স্বভাবের। কিন্তু এতটা চাপা!
রিপন একটা সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে যাওয়ার আগে আশরাফুলের পিঠে হালকা একটা চাপড় দিয়ে বলল, টেনশন করবেন না ভাই। আপনি আপনার এই ভাইকে আপনার মনের দুঃখের কথা খুলে বলেছেন, এখন থেকে আপনার ঝামেলা মানে আমার ঝামেলা। আপনার আর টেনশন করার কিছু নেই। আপনি এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারেন। জাস্ট এক সপ্তাহ সময় আমাকে দিবেন, দেখবেন এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আপনার পিংকি আপনার সাথে দেখা করার জন্য পাগলের মতো ছুটে আসবে। এখন আপনার যা করতে হবে তা হচ্ছে, একটি সাদা কাগজে পিংকি আর পিংকির বাবা-মায়ের নাম লিখে আমাকে দিবেন। আগামীকাল রাতের বেলায় আমি আপনাকে একটা তাবিজ দিব, সেই তাবিজ আপনি পিংকিদের বাসার দরজার সামনে পুঁতে থুয়ে আসবেন।
আশরাফুল অবাক হয়ে বলল, তাবিজ পুঁতে থুয়ে আসব মানে? আপনি কি কবিরাজ বা পীর-ফকির নাকি?
রিপন অনেকটা বিজ্ঞের হাসি হেসে বলল, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে ঢাকা শহরে আমার এক বাবা আছে। উনার নাম হচ্ছে চুলকানি বাবা। উনি জাস্ট আপনার পিঠে চুলকাতে চুলকাতে আপনার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বলে দিবে। বিরাট কামেল আদমি। আমার অফিসের এক বস আমার সাথে নানান কাহিনি শুরু করেছিল। আমি জাস্ট ওই বসের নামসহ উনার বাবা আর মায়ের নাম সংগ্রহ করে বাবাকে দিয়েছিলাম। বাবা আমাকে তা দিয়ে একটি তাবিজ করে বসের টেবিলের নিচে রেখে দিতে বলেছিল। আর বলেছিল সাত দিনের মধ্যে তাবিজের কারিশমা দেখার জন্য। সাত দিন লাগেনি, তার আগেই বস কাবু। এখন তো বস এই রিপন ছাড়া বাথরুমে মুতার জন্য যায় না। যেখানেই যাবে আমাকে সাথে নিয়ে যায়। এক কথায় এখন সেই বস এই রিপন ছাড়া অচল।
আনিস আর আশরাফুল চোখ বড় বড় করে রিপন সাহেবের কথা
শুনতে লাগল। তারা দুজন রিপনের কথা বিশ্বাসও করল না আবার অবিশ্বাসও করল না।
আশরাফুল বলল, আপনি সত্যি বলছেন তো রিপন ভাই, এটা সম্ভব?
সম্ভব না মানে! একশ’তে একশ’। আপনি খালি আমি যা বললাম তাই করেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তার ফল পাবেন।
আশরাফুলের চোখ চকচক করতে লাগল। আশরাফুল রিপনের কথায় অনেকটাই আশ্বস্ত মনে হচ্ছে। তার কারণ এর আগেও শাহাদতের বিয়ের ব্যাপারে রিপনের বাবার কথা ফলে গিয়েছিল। তাই আশরাফুল অবিশ্বাস করতে পারল না। আশরাফুল রিপনকে বলল, রিপন ভাই, চলেন আমরা দুজন একসাথে বের হবো। বাইরে আপনাকে আমি পিংকির ইনফরমেশন যা দেয়ার দিয়ে দিব। আনিস তুই তো আজ আর দুপুরে ফিরবি না, তাই না?
আনিস বলল, হ্যাঁ। আমি একটু পরেই মামার বাসায় ধানমন্ডি যাব। সেখান থেকে টিউশনি শেষ করে ফিরব। আজ মামার বাসায় আমার মামাতো ভাই ফিরোজের বিয়ের কথা পাকাপাকি হবে। মামা আমাকে তা-ই জানিয়েছে। আর আমাকে সকাল সকাল যেতে বলেছে।
ঠিক আছে, তুই তাহলে তোর মামার ওখানে যা, রাতে তোর সাথে
বিস্তারিত আলোচনা হবে। রিপন ভাই, একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বের হন। আমি রেডি হচ্ছি।
আশরাফুল আর রিপন রেডি হয়ে বাসা থেকে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আনিস রেডি হয়ে মামার বাসার উদ্দেশে রওনা হলো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় জাহিদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলল। সকাল থেকে যে বাসায় এত কিছু হয়ে গেল জাহিদ আর মনোয়ারের সেদিকে লক্ষ নাই। তার নাক ডেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
তুমি যেদিন প্রথম আমাদের বাসায় এসেছিলে সেই দিনের কথা তোমার
মনে আছে?
জাকিয়ার কথায় আনিস বলল, হ্যাঁ মনে আছে। তুমি দরজা খুলে দিয়েছিলে। আমি সেদিন প্রথম কেয়াকে পড়ানোর জন্য তোমাদের বাসায় যাই। তুমি দরজা খুলে দেয়ার পর তোমাকে দেখে আমি মনে করেছিলাম তুমিই মনে হয় কেয়া। তবে ঠিক আমি মিলাতে পারছিলাম না, ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী এত বড় হবে কেন? তাই আমি একটু বিব্রত বোধ করছিলাম। তুমি দরজা খুলে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলে। আমি যখন বললাম, ফরহাদ সাহেব আমাকে আসতে বলেছেন। তখন তুমি মিষ্টি করে হেসে বললে, ও আচ্ছা, আপনি কি আনিস সাহেব? মানে কেয়ার টিচার? আসুন ভিতরে আসুন। আমি আপনার ছাত্রীকে ডেকে দিচ্ছি। এই কথা বলে তুমি তোমার সেই ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে ঘরের ভিতরে কেয়াকে ডাকতে চলে গেলে। আচ্ছা, তুমি কি জানো, তোমার সব থেকে আকর্ষণীয় দিক কোনটি? আনিস জাকিয়াকে প্রশ্ন করল।
কেন জানব না মিস্টার! সুন্দরী মেয়েরা খুব ভালো করে জানে তাদের আকর্ষণীয় দিক কী কী। আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে আমার হাসি। কারণ আমি হাসলে আমার গালে টোল পড়ে, যা অন্যকে আকর্ষণ করে। এই যেমন তুমি আমার হাসি পাগলের মতো পছন্দ করো। আমি কি ঠিক বলেছি আনিস সাহেব?
জাকিয়ার কথায় আনিস একটু লজ্জা পেয়ে গেল। কারণ জাকিয়া তার মনের কথা একশ’ পারসেন্ট সত্য বলেছে। আনিস মনে মনে একটু অবাক হয়ে গেল। জাকিয়া তার মনের কথা কীভাবে বুঝতে পারল! শুনেছি মেয়েদের নাকি দুই চোখের বাইরে আর একটি চোখ থাকে। যাকে বলে তৃতীয় নয়ন। সেই তৃতীয় নয়ন দিয়ে নাকি তারা ছেলেদের সব কিছু দেখতে পারে, সব কিছু বুঝতে পারে। বুঝতে পারলে সমস্যা তেমন নেই। কিন্তু যদি তারা তাদের সেই বিখ্যাত তৃতীয় নয়ন দিয়ে সব কিছু দেখতে পায় তাহলে আনিসের জন্য বড়ই লজ্জার বিষয় হবে। কারণ তাহলে জাকিয়া তার হারকিউলিক্স মার্কা শরীরটা দেখে ফেলবে। এই কথা মনে মনে ভাবতেই আনিস তার নিজের জিহ্বায় কামড় দিল।
কী ব্যাপার, তুমি তোমার জিহ্বায় কামড় দিলে কেন? তুমি কি মনে মনে কিছু চিন্তা করছিলে?
জাকিয়ার কাছে এই প্রশ্ন শুনে আনিস আরো অবাক হলো। জাকিয়া কীভাবে বুঝতে পারল যে সে মনে মনে কিছু চিন্তা করছে! সর্বনাশ! মনে মনে আনিস কি চিন্তা করছে সেটা যদি জাকিয়া বুঝে ফেলে তাহলে আনিসের লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।
মাস্টার সাহেব, কী হলো চুপ করে আছেন কেন? আমার সাথে বেড়াতে এসে কি খারাপ লাগছে?
কই না তো! আমার অনেক ভালো লাগছে। আচ্ছা জাকিয়া, তুমি তো অনেক ভালো একটা জব করো। সেখানে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর আর স্মার্ট ছেলেরা জব করে। শুনেছি তুমি যে এনজিওতে জব করো সেটা একটা বিদেশি এনজিও। বেতনও নাকি ভালো পাও। আমি এগুলো বলছি বলে তুমি কিছু মনে করছ না তো?
না কিছু মনে করছি না। তুমি তোমার কথা শেষ করো। আমার ধারণা, তুমি তোমার কথা শেষ করোনি। আরো কথা বাকি আছে। সেই বাকি অংশটুকু বলো।
বাকি অংশটুকু হচ্ছে, তুমি এত ভালো আর স্মার্ট ছেলেদের বাদ দিয়ে আমার মতো একজন সাধারণ ছেলেকে ভালোবাসতে গেলে কেন?
তুমি আমাকে প্রশ্ন করেছিলে যে আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কোনটি, তাই না? এখন আমি তোমাকে প্রশ্ন করছি, তোমার আকর্ষণীয় দিক কোনটি, তা কি তুমি জানো?
আমার সবই অতি সাধারণ। আমার আবার আকর্ষণীয় দিক কী! আমার ধারণা, আমার কোনো আকর্ষণীয় দিক নেই। যদি থাকত তাহলে অনেক আগেই আমার একটি সরকারি চাকরি হয়ে যেত। এই কথা বলে আনিস অনেকটা বিমর্ষ হয়ে গেল।
তোমার ধারণা ঠিক নয় আনিস, তোমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, তুমি এই যুগের একজন ছেলে হয়েও আর দশজনের থেকে একদম আলাদা। তোমার সরলতা, তোমার স্পষ্টবাদিতাই হচ্ছে তোমার আকর্ষণীয় দিক। যা আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি, সেদিনই তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি অতি সাধারণের মাঝে একজন অসাধারণ ছেলে। আর আমি আমার সারা জীবনে এমন একজন অসাধারণ ছেলের জন্যই অপেক্ষা করেছি। যাকে আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করব। আনিস, তুমি ভালো করেই জানো যে, বাবা আমার জন্য অনেক ভালো ভালো পাত্রের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। বাবার প্রস্তাবগুলো অতি লোভনীয় ছিল। তাদের মাঝে যেকোনো একজনের সাথে আমার বিয়ে হলে আমি সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে খেয়ে-পরে সারা জীবন পার করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি সেসব প্রস্তাব কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, তুমি জানো?
আনিস জাকিয়ার চোখের সাথে চোখ রেখে মাথা নাড়িয়ে না বলল।
আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম এই কারণে যে, যেসব ছেলের প্রস্তাব বাবা আমার জন্য এনেছিল, তারা সবাই জিনিয়াস, সবাই অনেক অর্থের মালিক। আমি হয়তো কোনোদিন অভাব অনুভব করব না। কিন্তু সেখানে আমি অর্থের অভাব অনুভব না করলেও আমার কাছে সব সময় সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটি তার অভাব আমি প্রতি ক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতাম। সেই জিনিসটি কি তুমি বলতে পারবে আনিস?
৩.আনিস আবারও কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়াল। আনিসের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। কারণ আনিস মন্ত্রমুগ্ধের মতো জাকিয়া নামের অপার সুন্দরী যে মেয়েটি তার সামনে বসে কথা বলছে, তার কথা শুনছে। আনিস তার চোখ জাকিয়ার দিক থেকে ফিরাতে পারছে না। জাকিয়া শুধু যে সুন্দরী তা নয়, অনেক সুন্দর করে কথাও বলতে পারে।
সেটি হচ্ছে ভালোবাসা! বাবা যে ছেলেগুলোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তারা সারা জীবন পড়াশুনার পিছনে আর টাকার পিছনে ছুটেছে, ভালোবাসা কী জিনিস তারা তা জানে না। তাদের কাছে বিয়ে মানে একটি মেয়ের সাথে শারারিক সম্পর্কের বৈধ লাইসেন্স ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা আমাকে আমার যত চাহিদা তা পূরণ করবে আর আমি তাদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করব। এই জীবন আমি চাইনি আনিস। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি এমন একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছি, যে শুধু আমাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসবে। আমি টাকা-পয়সা নিয়ে কখনো ভাবিনি। ছোটবেলা থেকে বাবা আমাদের সব চাহিদা পূরণ করেছেন। কোনোদিন অভাব বুঝতে দেননি। আমি এমন একজন জীবিনসঙ্গী চাই, যে চালাক হবে কিন্তু শিয়ালের মতো ধূর্ত হবে না। যার ভালোবাসায় কোনো কৃত্রিমতার রং থাকবে না। যে শুধু আমার জন্য আমাকে ভালোবাসবে। আমি তার কাছে আর কিছু চাই না আনিস। আমি তোমার মাঝে আমার মনের মানুষের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম বলেই অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি কি কোনো ভুল করেছি আনিস?
আনিস মন্ত্রমুগ্ধের মতো জাকিয়ার কথা শুনে যাচ্ছে। জাকিয়ার চোখ থেকে আনিসের চোখ সরাতে পারছে না। আনিসের মনে হচ্ছে, সে জাকিয়ার সামনে নয়, ভিন্ন গ্রহের কোনো সুন্দরী রমণীর কথা শুনছে।
কী ব্যাপার, আমি সেই কখন থেকে একা একা বকবক করে যাচ্ছি! আর তুমি মূর্তির মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছ। আজ তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি তোমার কথা আমি শুনব বলে। তা না, উল্টা আমিই বকবক করছি। কী হলো? কথা বলো! তুমি এমনভাবে আমাকে দেখছ, মনে হচ্ছে এই প্রথম তুমি আমাকে দেখলে! কী হলো। চোখ নামাও।
জাকিয়ার ধমকে আনিস সম্বিত ফিরে পেল। এতক্ষণ আনিস অন্য ভুবনে চলে গিয়েছিল। যে ভুবনে শুধু জাকিয়া ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি যেমন আশা করছ, আমি কি তোমার মনের মতো হতে পারব জাকিয়া?
হতে পারবেন না মাস্টার সাহেব, অলরেডি হয়ে বসে আছেন বলেই জাকিয়া তার সেই বিখ্যাত গালে টোল পড়া হাসিটি দিল।
জাকিয়া আর আনিস যেখানে বসে গল্প করছে তার পাশেই ছোট্ট একটি পুকুর আছে। পুকুরে কয়েকটি নীল পদ্ম ফুল ফুটে আছে। জাকিয়ার সেদিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে বলল, আনিস দেখেছ, কী সুন্দর পদ্ম ফুল! প্লিজ আনিস, আমাকে একটি পদ্ম ফুল এনে দাও না, প্লিজ!
ঠিক আছে তুমি বসো, আমি তোমাকে ফুল এনে দিচ্ছি।
আনিস ফুল আনার জন্য পুকুরের কাছে চলে গেল। আনিস যে-ই ফুল ছিঁড়ার জন্য ফুলে হাত দিবে এমন সময় একটি সাপ আনিসের হাতে ছোবল মারল। আনিস জাকিয়ার নাম ধরে চিৎকার করে উঠল। আনিসের চিৎকার শুনে জাকিয়াও আনিস আনিস বলে চিকার করতে লাগল।
আপা! ওই আপা! তোমার কী হয়েছে? এই আপা, আপা।
জাকিয়া ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। জাকিয়াকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে জাকিয়া ভয় পেয়েছে। জাকিয়া বিছানায় বসে চোখ বড় বড় করে কেয়ার দিকে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
কেয়া জাকিয়ার গায়ে হাত দিয়ে বলল, আপা, তোমার কী হয়েছে? কেয়া মুচকি মুচকি হাসছে।
জাকিয়া স্বাভাবিক হয়ে কেয়াকে বলল, তুই মুখ টিপে হাসছিস কেন?
তুমি ঘুমের ঘোরে আনিস স্যারকে ডাকছিলে! ভাগ্যিস ঘরে আমি ছাড়া কেউ ছিল না। মা জানতে পারলে খবর হয়ে যেত। তুমি কি আনিস স্যারকে নিয়ে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলে আপা?
জাকিয়া কেয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ বিছানায় বসে রইল। জাকিয়ার চোখ লাল হয়ে গেল। যেকোনো সময় তার চোখের পানি ঝরতে পারে। ভিতরে ভিতরে জাকিয়া দুমড়ে-মুচড়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের কষ্টের কথা কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে না। এই মুহূর্তে আনিসের জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আনিসের জন্য তার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সে কি আনিসকে ভালোবেসে ফেলেছে? কখন, কীভাবে তার জীবনে এমন ঘটনা ঘটল? জাকিয়া কিচ্ছু মনে করতে পারছে না। এই মুহূর্তে শুধু জাকিয়ার মনে হচ্ছে, আনিসকে সে ভয়াবহ রকমের ভালোবাসে। আনিস তার জীবন পুরোটাই ওলটপালট করে দিয়েছে। তার ভালোবাসার কথা কারো সাথে শেয়ার করতে না পেরে জাকিয়া বুকের মাঝে একধরনের তীব্র ব্যথা অনুভব করতে লাগল।
আপা, আমার মনে হয় তুমি আনিস স্যারের প্রেমে পড়ে গেছ। কিন্তু তুমি মুখ ফুটে তাকে বলতে পারছ না। আমার মনে হয় কি আপা জানো? আমার মনে হয় আনিস স্যারকে তোমার মনের কথা, তোমার ভালোবাসার কথা বলে দেয়া উচিত। তা না-হলে হলে তুমি শুধু নিজেই নিজেই কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাবে। তুমি চাইলে আমি স্যারকে বলতে পারি। আমি কি বলব আপা?
জাকিয়া তার ছোট বোন কেয়ার কথার কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার কারণ, আনিসের জন্য তার প্রচ- কষ্ট হচ্ছে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তার বুকটা যেন কেমন খালি হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করছে জাকিয়া।
জাকিয়া মাথা নিচু করে বিছানায় বসে রইল। তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
আনিসের মামা বজলুর রহমান সাহেবের বাসার সামনে এসে আনিস রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তার মামার বাসার দরজায় নক করল। দরজা খুলে যাওয়ার পর আনিস ঘরের ভিতরে না ঢুকে অনেকটা অবাক
হয়ে তাকিয়ে রইল। তার চোখের পলক পড়ছে না। মুখটাও অনেকটা হাঁ
হয়ে গেল।
আনিসের এই অবস্থা দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাহিতি বলল, আনিস ভাই, আপনি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আর আপনি আপনার মুখ এমন তেলাপিয়া মাছের মতো হাঁ করে আছেন কেন? মুখের সার্টার বন্ধ করেন, তা না-হলে মাছি বা মশা আপনার মুখে ঢুকে যেতে পারে।
তাহিতির কথায় আনিস একটু বিব্রত বোধ করতে লাগল। নিজেকে সামলে নিয়ে আনিস বলল, তোকে আজ অনেক সুন্দর আর অনেক বড় বড় লাগছে! কেমন জানি মহিলা মহিলা লাগছে। শাড়ি যে একটি মেয়েকে এত বদলে দিতে পারে তোকে না দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না!
আমাকে মহিলা মহিলা লাগছে মানে! আপনি এইটা কি বললেন আনিস ভাই! আমি মহিলা হতে যাব কেন? তাহিতির মুখ ভার হয়ে গেল।
আনিসের বুঝতে বাকি রইল না যে তার কথা তাহিতির পছন্দ হয়নি। আনিস তার কথা ঘুরিয়ে বলল, আমি জাস্ট বলতে চেয়েছিলাম যে তোকে আজ অনেক সুন্দর আর বড় বড় লাগছে!
বড় বড় লাগছে মানে! আমি কি এখনো ছোট আছি নাকি? আমি বিবিএ পড়ছি আনিস ভাই। আর একটি মেয়ে বিবিএ পড়া অবস্থায় নিশ্চয়ই আর ছোটটি থাকে না! এই কথাটি মনে হয় আপনার মাথায় নাই আনিস ভাই!
তুই কি আমার কথায় রাগ করেছিস নাকি? তোর কথার মাঝে অনেক ঝাঁজের গন্ধ পাচ্ছি! সে যাই হোক, বাড়ির আর সবাই কোথায়? ফিরোজ ভাইয়ের কি বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?
না হয়নি। এখনো মেহমান আসেনি। বাসার সবাই ফিরোজ ভাইয়ার ঘরে কথা বলছে। এই কথা বলে তাহিতি মুখটা ঘুরিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
আনিস ফিরোজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ফুয়াদ তার ঘর থেকে বসার ঘরে আনিসকে দেখতে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। আরে আনিস ভাই যে! তুমি এত দেরিতে আসলে যে! তোমার না সকাল সকাল আসার কথা? যাই হোক, তুমি এসেছ এটাই আমার জন্য বিশাল কিছু।
তোর জন্য বিশাল কিছু মানে? আমি তো তোর জন্য এখানে আসিনি, আমি এসেছি গতকাল মামা ফোন দিয়েছিল। আজ নাকি ফিরোজ ভাইয়ের বিয়ে। কিন্তু বাসার অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে না যে আজ এই বাড়িতে কোনো বিয়ে হতে যাচ্ছে!
আজ বিয়ে হবে তোমাকে কে বলল? আজ বিয়ের কথা পাকাপাকি হবে। বাবার মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মেয়েপক্ষ ছেলেকে দেখেনি। তারা আজ এখানে এসে ফিরোজ ভাইকে দেখে সব কিছু ফাইনাল করবে। বাবা আগেই সব ফাইনাল করে ফেলেছে। তাই ফিরোজ ভাইকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নাই। আনিস ভাই, ফিরোজ ভাইয়ের ঝামেলা শেষ হলে তোমার সাথে আমার কিছু হট কথা আছে। আমি তোমার জন্য বলতে গেলে তির্থের চিলের মতো অপেক্ষা করছিলাম। যেহেতু আমি তোমার মেসবাড়ি চিনি না, আর তোমার মোবাইলে ফোন দিয়ে কয়েকবার দুঃখিত শুনেছি, তাই তোমার সাথে
আমার হট কথাগুলো শেয়ার করা হয়নি। আজ যেহেতু তোমাকে আমি পেয়েছি, তাই আজ তোমার সাথে আলোচনা করে আমিও একটা জিনিস ফাইনাল করতে চাই।
ফাইনাল করতে চাস মানে? তুই কি তোর সেই পুরান ঢাকার কাহিনি আমার সাথে শেয়ার করতে চাস?
তুমি তো দেখছি শার্লক হোমস হয়ে গেলে আনিস ভাই! আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তুমি কীভাবে জানলে যে আমি নাজমার কথাই তোমার সাথে শেয়ার করব! সর্বনাশ আনিস ভাই! তুমি তো দেখছি মানুষের মনের কথা খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারো!
আরে আনিস! তুমি এত দেরি করলে কেন? তোমার না আরো সকালে আসার কথা কথা?
একটু দেরি হয়ে গেল মামা। স্যরি। মেহমান কখন আসবে মামা?
দুপুরের দিকে আসবে। বজু সাহেব তার ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে ফুয়াদ, তুই এত সাজ সেজেছিস কেন? পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছিস। চোখে কালো কালো এই সব কী দিয়েছিস, সুরমা নাকি? তোকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে ফিরোজের না, তোর বিয়ের কথা আজ পাকাপাকি হবে। কথাগুলো বজু সাহেব একটু বিরক্তের সাথেই বলল।
আমার ভাইয়ের বিয়ে আর আমি সাজব না! এই সব তুমি কী বলো বাবা? আমি ইদানীং লক্ষ করছি তুমি আমাকে অনেক তীক্ষèভাবে ফলো করছ। তুমি ওল্ড ম্যান। তোমার বয়স হয়েছে। তোমার তো এই সব নিয়ে টেনশন করার কথা না বাবা। কয়েক বছরের মধ্যে তুমি অবসর নিবে। তোমার এখন শরীরের প্রতি বেশি নজর দেয়া উচিত। তা না-হলে তো তোমার প্রেসার হাই হয়ে যাবে।
বজু সাহেব তার ছোট ছেলের কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল। কিন্তু ফুয়াদকে তা বুঝতে না দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ফুয়াদ, তুমি একটু ভিতরে যাও। তোমার আনিস ভাইয়ের সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।
কেন বাবা, আমার সামনে আলোচনা করলে তোমার সমস্যা কী?
সমস্যা আছে গাধা। তুই ভিতরে যা। যা বলছি।
বাবা তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আর আমার সাথে তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। এই কথা বলে ফুয়াদ বসার ঘর থেকে ভিতরের ঘরে চলে গেল।
বজু সাহেব কিছুক্ষণ বসার ঘরের সোফায় মাথা নিচু করে ঝিম মেরে বসে থাকল। আনিস কোনো কথা বলছে না। আনিস বুঝতে পারছে তার মামা বেশ চিন্তিত। দুজনেই পাশাপাশি বসে চুপ করে রইল।
নীরবতা বজু সাহেবেই ভাঙল। তুমি বুঝতে পারছ আনিস আমি কেমন আছি? এই হচ্ছে আমার সন্তান। ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া ছেলে আমার ফুয়াদ। কিন্তু ওকে দেখলে সবাই মনে করবে কি চমৎকার ছেলে। কিন্তু ও যে মানসিকভাবে কতটা দুর্বল, তা শুধু ওর কাছাকাছি যারা থাকে তারাই বলতে পারবে। আর আজকে যার বিয়ের কথা ফাইনাল হবে, তোমার আরেক ভাই ফিরোজ, সে তো ফুয়াদের থেকে এক ডিগ্রি উপরে। সারা জীবন শুধু পড়াশুনা ছাড়া আর কিছু করেছে বলে আমার জানা নাই। সংসারের বাইরে যে আরো একটা জগৎ রয়েছে সে বিষয়ে তোমার ফিরোজ ভাই একেবারেই অজ্ঞ। সে শুধু দুটি জিনিস ভালো করতে পারে, এক হচ্ছে পড়াশুনায় ভালো করতে পারে আরেকটা হচ্ছে ভালো বাজার করতে পারে। এই দুই কাজ ছাড়া আর কিছু তাকে দিয়ে হয় কি না আমার জানা নাই। মাঝে মাঝে আমি অবাক হই, এই ছেলে কীভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে! তার ছাত্ররা তার কাছে কী শিখে? তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছ আনিস?
না মামা।
তবে আমার মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী হয়েছে। একমাত্র আমার মেয়ে তাহিতিই আমার মতো হয়েছে মেধাবী আর চালাক। আর ওই দুইটা হয়েছে ওর মায়ের মতো। মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই কিন্তু ভাবখানা এমন যে বিশাল বুদ্ধিমান। তোমার মামি যে কী পরিমাণ আমাকে ইদানীং বিরক্ত করছে তা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। আমি বাজার করা ছেড়ে দিয়েছি কতদিন হলো আমার মনে নেই। সেদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সাতসকালে আমার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিলে বলল বাজারে যাও। আমি তীব্র প্রতিবাদ করতে যেয়েও করি নাই। কারণ প্রতিবাদ করতে গেলে বা আমি যদি বেশি রাগারাগি করে কথা বলি তাহলে সংসারে অশান্তি হবে, তাই চুপ ছিলাম। আজ সকালে আমি নিজেই বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছি। হতে পারে মাছগুলো একটু নরম হয়েছে, তাই বলে সাতসকালে আমার সাথে যা ইচ্ছে তা-ই বলবে! আমি যে কি আজাবে আছি আনিস তোমাকে বলে শেষ করতে পারব না। এই যে একটু পরে মেয়ে পক্ষের লোকজন আসবে সব কিছু ঠিকঠাক করার জন্য অথচ একমাত্র তাহিতি তার মায়ের সাথে রান্নায় হেল্প করছে। অথচ ফুয়াদ নিজে জামাই সেজে বসে আছে। তার ভাই রেডি হয়েছে কি না, তা নিয়ে তার মাথাব্যথ্যা নেই।
আনিস তুমি কি নাশতা করে এসেছ? তাহিতির কাছে শুনলাম তুমি এসেছ। রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে এতক্ষণ আসতে পারিনি। তোমাকে কি নাশতা দিব আনিস?
না মামি, আমি নাশতা করে এসেছি।
রাহেলা তুমি কি আমাকে এক কাপ চা দিতে পারো? সকাল থেকে এখনো চা খাইনি। সকালবেলা তোমার হাতের এক কাপ চা না খেলে সারাদিন আমার সব কিছু খালি খালি মনে হয়।
থাক থাক, হয়েছে। তোমাকে আর আমাকে পাম দিতে হবে না। এমনিতেই আমি ফুলে আছি। আমাকে আর ফুলাতে হবে না। আনিস তোমাকে কি চা দিব?
চা এক কাপ খাওয়া যেতে পারে মামি। রাহেলা আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
আনিস বুঝতে পারল, তার মামা তার মামিকে যমের মতো ভয় পায়। এতক্ষণ কী বলল আর মামি আসার পরে কী বলল।
আনিস তুমি কি তোমার মামির কথায় কিছু বুঝতে পারলে? এই নিয়ে আমি আজ ত্রিশটি বছর পার করে দিলাম আনিস। আমি রেডি হচ্ছি। তুমি একটু ফিরোজের ঘরে যাও। ওকে একটু সাহস দাও। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না যে আজ ওর বিয়ের কথা ঠিকঠাক হচ্ছে। ওকে দেখলে মনে হচ্ছে ওকে আজ ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হবে। যাও বাবা, ওকে একটু তৈরি করো। আমি যে কী নিয়ে আছি রে বাবা। বজু সাহেব বিড়বিড় করতে করতে তার রুমের দিকে এগুতে লাগল।
আনিস ফিরোজের ঘরে যেয়ে দেখল তার ফিরোজ ভাই একটা নতুন পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে তার খাটে বসে আছে। আনিসকে দেখে ফিরোজের কোনো ভাবান্তর হলো কি না বুঝা গেল না।
আনিস তুমি কেমন আছ?
তার কথার ভাবখানা এমন যে আনিস তার রুমে আসবে এটা সে জানত। এত দিন পরে যে আনিসের সাথে দেখা হলো, তা নিয়ে তার কোনো উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেল না।
আমি ভালো আছি ভাই। আপনি ভালো আছেন তো?
এই তো আছি। বাবা যে কী শুরু করল! আমি বিয়ে করতে চাই না আর বাবা বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। যার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে, তাকে আমি দেখিনি। আম্মা আর বাবা দুজন দেখেছে। উনারা যেহেতু বলছে যে ভালো তাই আমি আর কোনো কথা বলিনি। আমি যদি এই মুহূর্তে বিয়ে নিয়ে দ্বিমত পোষণ করি, তাহলে মা-বাবাকে কষ্ট দেয়া হবে, তাই না আনিস?
ঠিক বলেছেন ফিরোজ ভাই। আমি মামার কাছে শুনেছি যে যার সাথে আপনার বিয়ের কথা ফাইনাল হচ্ছে সে নাকি বেশ সুন্দরী। তাদের পরিবারও নাকি অনেক ভালো। সব মিলিয়ে আপনার ভালোই হবে ফিরোজ ভাই। আপনি এ নিয়ে টেনশন করবেন না। তাছাড়া পৃথিবীর কোনো বাবা-মায়েই তার
সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না। এখানে নিশ্চয়ই আপনার মঙ্গল লুকায়িত আছে ফিরজ ভাই।
ফিরোজ কিছুক্ষণ আনিসের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারো আনিস! গুড, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাহিতির কাছে শুনেছি, তুমি নাকি সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য কোনো চাকরি করবে না? আরে সরকারি চাকরি তো করে যারা আনস্মার্ট। স্মার্ট ছেলে কখনো সরকারি চাকরি খোঁজে নাকি? সরকারি চাকরি মানে হচ্ছে কোনো কাজ না করে মাসে মাসে বেতন নেয়া, আর অন্যের কাজ আটকে রেখে মানুষের কাছে ফকিরের মতো হাত পেতে ঘুষ খাওয়া। শুনেছি তুমি ইংরেজিতে পড়াশুনা শেষ করেছ। ছাত্র হিসাবেও নাকি তুমি অনেক ভালো। তুমি খুব সহজেই প্রাইভেট জব পেয়ে যাবে। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য ট্রাই করতে পারি। আমার ছাত্রদের মাঝে অনেক ছাত্রের বাবা বেশ বড় বড় গ্রুপ কোম্পানির মালিক। আমি কি তোমার জন্য ট্রাই করব আনিস?
না ফিরোজ ভাই। আমি একটু নিজে নিজেই চেষ্টা করছি। আমার প্রয়োজন হলেই আমি আপনার কাছে এসে বলব।
আনিস, ফিরোজকে নিয়ে এসো। মেহমান চলে এসেছে।
আনিস বলল, ফিরোজ ভাই, মামা ডাকছে। আপনি মাথাটা ভালোভাবে আঁচড়ে নিন। আপনার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। আনিস আর ফিরোজ একসাথে বসার রুমে ঢুকল। বসার রুমে মেয়ে পক্ষের কয়েকজন সোফায় বসে আছে। তার সাথে মামা-মামি, ফুয়াদ আর তাহিতিও বসে আছে। মেয়ে পক্ষের বাবা আর দুই চাচা এসেছে। তারা ফিরোজ ভাইয়ের সাথে কিছু কথাবার্তা বলল। সব মিলিয়ে ফিরোজ ভাইকে তাদের পছন্দ হয়েছে। তাদের পছন্দের কথা মামাকে জানাতেই মামা অনেকটা শব্দ করে আলহাদুলিল্লাহ্ বলে উঠল। মামার আলহামদুলিল্লাহ্ বলার সাথে সাথে আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে সব কিছু ফাইনাল হয়ে গেল।
দুপুরের খাওয়া শেষে মেয়ে পক্ষের বাবা-চাচারা বিদায় নিল। তারা চলে যাওয়ার পর আনিসও মামা-মামিকে বলল, আমি এখন আসি মামি। আমার টিউশনিতে যেতে হবে।
সেকি! একটু রেস্ট নিয়ে যাও। সবে মাত্র খাওয়া-দাওয়া করলে। একটু রেস্ট নিয়ে তার পরে যেও।
না মামি, আমার তাহলে দেরি হয়ে যাবে।
এর মাঝে হঠাৎ তাহিতি বলে উঠল, থাক মা, আনিস ভাইয়ের রেস্ট নেয়ার দরকার নেই। উনার ছাত্রী উনার জন্য অপেক্ষা করছে। উনি সময়মতো না গেলে আবার উনার ছাত্রীর পড়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এই কথা বলে তাহিতি বসার ঘর থেকে ভিতরের ঘরে চলে গেল।
তাহিতির কথায় মামা-মামি, ফিরোজ-ফুয়াদ সবাই একটু অবাকই হলো মনে হয়। কিছু সময়ের জন্য বসার ঘরের সবাই চুপ করে থাকল।
নিজেকে সামলে নিয়ে আনিসের মামি বলল, ঠিক আছে বাবা, তুমি যাও। তবে মাঝে মাঝে একটু সময় নিয়ে এসে তাহিতিকে ইংরেজিটা একটু পড়িয়ে যেও, কেমন? ঠিক আছে মামি।
আনিস ভাই, চলো আমি তোমাকে গিয়ে দিয়ে আসি। তাছাড়া তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। চলো আমরা দুজন একসাথে বের হই।
আনিস সবার কাছে বিদায় নিয়ে ফুয়াদের সাথে ঘর থেকে বের হয়ে মোহাম্মদপুরে কেয়াদের বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা ঠিক করে ফুয়াদসহ রিকশায় উঠে বসল।
রিকশায় উঠে দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ফুয়াদকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। আনিসই কথা শুরু করল।
কি রে, তুই না আমাকে কী যেন বলবি বললি? যা বলার তাড়াতাড়ি বল। আমার টিউশনির সময় হয়ে এলো। আজ আমি কিন্তু তোকে সময় বেশি দিতে পারব না।
আনিস ভাই, আমার জীবন তোমার কাছে বড় নাকি তোমার টিউশনি?
ফুয়াদ চোখ বড় বড় করে আনিসের দিকে তাকিয়ে আনিসকে প্রশ্ন করল, কেন? এখানে তোর জীবনের প্রশ্ন আসছে কেন? দেখ ফুয়াদ, আমার সাথে উল্টাপাল্টা কথা না বলে যা বলার সরাসরি বল, আমার তাড়া আছে। আমার ছাত্রীর সামনে পরীক্ষা।
তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেলে আনিস ভাই। ঠিক আছে তোমার উত্তর দিতে হবে না। আমি আজকে তোমার বেশি সময় নিব না। চলো, সেদিনের সেই চায়ের দোকানে দুই ভাই মিলে এক কাপ চা খেতে খেতে আমি আমার গল্প বলি। জাস্ট চাটুকু খেতে যেটুকু সময় সেইটুকু সময় তো তুমি আমাকে দিতে পারবে, নাকি তাতেও তোমার মহামান্য ছাত্রীর সমস্যা হবে? আচ্ছা আনিস ভাই, তোমার ছাত্রীর সাথে তোমার কোনো কাহিনি নাই তো?
তোর কি মাথা ঠিক আছে ফুয়াদ? তুই কাকে কী বলছিস বুঝতে পারছিস? বড় ভাইকে তুই এইভাবে কথা বলতে পারিস? আমার ছাত্রী সবে মাত্র ইন্টার ফাইনাল দিবে। তাছাড়া আমি ছাত্রীর সাথে কাহিনি করতে যাব কোন দুঃখে? চায়ের দোকান সামনে এসে গেছে। নে রিকশা থেকে নাম। আনিস কথাগুলো রাগের সাথে বলে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দিল।
স্যরি আনিস ভাই, আমি জাস্ট মজা করলাম। তুমি দেখছি সামান্য কথায় সিরিয়াস হয়ে যাও। তোমার হাই প্রেসার নাই তো? সাধারণত হাই প্রেসারের রোগীরা সামান্য কথায় সিরিয়াস হয়ে যায়। যেমন বাবা। সামান্যতেই রাগারাগি শুরু করে দেয়। আর ইদানীং মনে হচ্ছে বাবার প্রেসার আগের চেয়ে ওপরের দিকে উঠছে। কারণ আগের চেয়ে এখন বেশি উত্তেজিত হচ্ছে।
আনিস চোখ বড় বড় করে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কি চায়ের অর্ডার দিয়ে তোর কথা শুরু করবি, নাকি আমি চলে যাব?
আনিস ভাই, তোমাকে তো আমি নাজমার কথা আগে বলেছি। ইদানীং নাকি নাজমার বাবা নাজমার সাথে নানান কাহিনি শুরু করেছে। মানে ওর বাবা ওর বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।
মেয়ে বড় হয়েছে, বাবা তার মেয়ের বিয়ে দিবে, এখানে তুই কাহিনির কী দেখলি?
অবশ্যই কাহিনি আনিস ভাই। তুমি ভালো করে জানো, আমি নাজমাকে কত ভালোবাসি। নাজমা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে আমি আমার বউ হিসাবে জীবনেও মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন নাজমাকে ভালোবাসি নাজমাও আমাকে তেমনি ভালোবাসে। নাজমার সাথে সেদিন দেখা হয়েছে। নাজমা আমাকে যা করার তাড়াতাড়ি করতে বলেছে। এখন তুমিই বলো, ফিরোজ ভাইয়ের বিয়ের আগে আমি কেমন করে কী করব?
ফিরোজ ভাইয়ের তো বিয়ে ফাইনাল হয়ে গেছে। এখন তো আর তোর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। দেখ ফুয়াদ, তোকে আমি আগেও বলেছি, পুরান ঢাকার মেয়ের পাল্লায় পড়িস না, লাইফ বরবাদ হয়ে যাবে। তাছাড়া তোর বাবা মানে মামা কোনোদিন তোর সেই নাজমাকে ঘরের বউ হিসাবে মেনে নিবে না। আরো যদি শুনে তোর হবু শ্বশুর চকবাজারে টিনের ব্যবসা করে তাহলে তো তোকে জুতাপেটা করে ঘর থেকে বের করে দিবে। মামা যদি শুনে যে আমি তোকে এই ব্যাপারে কোনো প্রকার সাহায্য করেছি, তাহলে তোর সাথে সাথে আমাকেও জুতাপেটা করবে। তার চেয়ে তোকে ভালোভাবে বলি, তুই ওই মেয়ের পিছন থেকে ফিরে আয়। তাতে তোর এবং তোর পরিবারের মঙ্গল হবে।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি নাজমাকে ভুলে যাই? তুমি পাগল হয়ে গেছ আনিস ভাই! আমি কি নাজমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য ভালোবেসেছি! তুমি কি জীবনে কাউকে ভালোবেসেছ আনিস ভাই?
ফুয়াদের কথায় আনিস চুপ মেরে গেল। আনিসের এই জীবনে কাউকে ভালোবাসা হয়নি বা আনিসের জীবনে ভালোবাসা আসেনি। ইদানীং তার জীবনে একটি জিনিস ঘটছে, আর তা হলো তার ছাত্রীর বড় বোন জাকিয়াকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। এটাকে ভালোবাসা বলা যায় কি না আনিসের জানা নেই।
আনিস ভাই, ভালোবাসা বড় অদ্ভুত জিনিস। তোমার জীবনে ভালোবাসা আসেনি বলে তুমি খুব সহজেই এই কথা বলতে পারছ। আমার পক্ষে নাজমাকে ত্যাগ করা সম্ভব নয় আনিস ভাই। তাতে যদি আমার পরিবারের সাথে আমাকে ফাইট দিতে হয় তাতেও না। আনিস ভাই, নাজমা অনেক কষ্টে আছে। এখন আমার সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে নাজমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্ত করা। এখন আনিস ভাই, প্লিজ তুমি আমাকে একটু হেল্প করো। আমি কারো সাথে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারছি না। আনিস ভাই, আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাস, একমাত্র তুমিই আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারো। যেভাবেই হোক, নাজমার বাবাকে একটু টাইট দিতে হবে। যাতে করে নাজমার বিয়ে নিয়ে আপাতত ওর বাবা আর মাথা
না ঘামায়।
এখানে আমি তোকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? তুই ভালো করেই জানিস যে আমি ঢাকায় একেবারেই নতুন। মাত্র কয়েক মাস হলো আমি ঢাকায় এসেছি। আমি কীভাবে তোকে সাহায্য করব? তাছাড়া আমি শুনেছি, পুরান ঢাকার মানুষ একটু হিংস্র প্রকৃতির হয়। তাদের পড়ালেখা কম থাকায় তাদের ভালো-মন্দ জ্ঞান একটু কম থাকে। তারা যেটা ভালো মনে করে তাদের কাছে সেটাই বড় কথা। মূর্খদের সাথে যুক্তি দিয়ে পারা যায় না ফুয়াদ। আমি কীভাবে কী করব?
তুমি যেভাবেই পারো আনিস ভাই, আমার নাজমাকে তুমি এই বিপদ থেকে রক্ষা করো। নাজমার অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আমি সুইসাইড করব আনিস ভাই। এই কথা বলে ফুয়াদ চায়ের দোকানের অন্যান্য মানুষের সামনে শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
ফুয়াদের কান্না দেখে চায়ের দোকানের অন্যান্য মানুষ অবাক চোখে তাদের দুজনকে দেখছে। আনিস কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। এ কোন মহা বিপদে আমি পড়লাম! ফুয়াদ যে এই রকম পরিস্থিতি তৈরি করবে আনিস বুঝতে পারেনি। তাছাড়া ফুয়াদের মতো এমন একটি স্মার্ট ছেলে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে এইভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে পারে, আনিস জীবনে কল্পনাও করতে পারেনি।
চায়ের দোকানের অন্যান্য লোকজনের মধ্যে কয়েকজন আনিসকে জিজ্ঞাস করল, কী হয়েছে ভাই? উনি এইভাবে কাঁদছেন কেন?
কিছু হয়নি ভাই। ও আমার ছোট ভাই। একটু আগে একটি দুঃসংবাদ শুনেছে তো তাই এইভাবে কাঁদছে। ফুয়াদ আয় আমার সাথে। চায়ের দোকানের বিল দিয়ে এক প্রকার আনিস ফুয়াদকে টেনেই দোকানের সামনে থেকে রাস্তায় নিয়ে এলো। ততক্ষণে ফুয়াদ তার কান্না থামিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়েছে।
তোর কি মাথা ঠিক আছে ফুয়াদ? তুই কি পাগল হয়ে গেলি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ ফুয়াদ, তুই তো দেখছি মামা-মামির মানসম্মান কিছুই রাখবি না। একটি মেয়ের জন্য কেউ এই রকম ঘটনা ঘটায়?
আনিস ভাই প্লিজ, তুমি আমাকে যাই বলার বলো, কিন্তু আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করো।
ফুয়াদের কথায় আনিস আর তেমন কিছু বলল না। ফুয়াদের জন্য একটু মায়াও হচ্ছে আনিসের। এত সুন্দর একটি ছেলে কেমন শিশুর মতো কান্না করছে। ভালোবাসা তাহলে এমনই!
ঠিক আছে ফুয়াদ, তুই শান্ত হ, দেখি তোর জন্য কী করা যায়। আমার তেমন জানাশুনা ঢাকা শহরে নেই। আমার যা আছে আমাদের মেসের কয়েকজনের সাথেই আমার যা যোগাযোগ আছে। দেখি ওদের সাথে কথা বলে কিছু করা যায় কি না। আমাদের মেসে রিপন নামে একজন আছে। উনার ঢাকা শহরে ভালো কানেকশন আছে। দেখি রিপন ভাই তোর জন্য কিছু
করতে পারে কি না। তুই একটা কাজ কর, আগামীকাল সকালে আমাকে ফোন দিয়ে আমাদের মেসে চলে আয়। আমি তোর সাথে রিপন ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিব।
আমি তো সকালে আসতে পারব না আনিস ভাই। সকালে আমার ডিউটি আছে। আমি রাতে আসতে পারব। আর আমি যাবই বা কেমন করে! আমি তোমার মেস চিনি না।
তুই আমাকে ফোন দিলেই আমি তোকে ঠিকানা বলে দিব। তাহলেই তুই সহজে আমাদের মেস বের করতে পারবি। আনিসের কথা শুনে ফুয়াদের মুখে হাসি ফুটল। ফুয়াদ অনেকটাই আশ্বস্ত। ঠিক আছে আনিস ভাই, আমি তোমাকে কালকে অফিস থেকে ফিরে ফোন দিয়ে চলে আসব।
ঠিক আছে। এখন আমি যাই রে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুই বাসায় চলে যা।
এই কথা বলে আনিস মোহাম্মদপুরে কেয়াদের বাসায় যাওয়ার জন্য একটি রিকশা ঠিক করে রিকশায় উঠে বসল। রিকশায় উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে আনিস দেখল, ফুয়াদ মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। ফুয়াদের জন্য আনিসের খুব খারাপ লাগতে লাগল। (চলবে)