গল্প-কবিতা

মিতালী হোসেনের গল্প ‘‌তবুও ভোর হয়’

মিতালী হোসেন

দর-দরজা খোলার শব্দে হাতের ঝাঁটা ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল রাহেলা। বিকৃত মুখে তাকাল রান্নাঘরের দিকে। সেখানে কুটনো কুটছেন বড়জা আসমা। চোখে চোখ পড়তেই বড় জা ভ্রুভঙ্গিতে ইঙ্গিত করলেন-ঐ যে এসেছে।
ষোলো বছরে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে সকালবেলা এই বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ান আফজাল শরীফ। সেই কুণ্ঠিত ভঙ্গি। সলজ্জ মুখ। এসে দাঁড়ান। একটু অপেক্ষা করেন। তারপর ডাক দেন-কইরে মা সুমনা অথবা ভাবী। সুমনা বা আসমা কেউ-একজন এসে হাত থেকে বাজারের ব্যাগ, ফলের ঠোঙা, শাড়ির প্যাকেট এরকম যা-কিছু থাকে নিয়ে নেয়। বসতে বলে। পাখা ছেড়ে দেয়। চা-নাশতা দেয়। আফজাল শরীফ বসলে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন রাহেলার স্বামী শাহেদ আলী। কখনও রাহেলার ভাশুর মোজাফফর আলী। খানিকক্ষণ গল্পগুজব হয়।
শাহেদ আলীর বাল্যকালের বন্ধু আফজাল শরীফ। এক শহরে আজন্ম বাস। এক স্কুল-কলেজে পড়াশেষে এই শহরেই চাকরি-ব্যবসা। এখান থেকে আর নড়াচড়া করা হয়নি
দু’বন্ধুর। পড়াশোনা শেষে আফজাল শরীফ নাজিরের চাকরি পেলেন ডিসি অফিসে। আর শাহেদ আলী কুমিল্লা সদর হাসপাতালের পাশে ওষুধের দোকান দিয়ে বসলেন। ব্যস, সেই থেকেই একই তালে বয়ে যাচ্ছে জীবন। বয়স বেড়েছে শাহেদ আলীর। দু’মেয়ের বাবা হয়েছেন। চুলে সাদার আভাস দু’জনেরই। শাহেদ আলীকে বাড়তি দুটো ঘর তৈরি করতে হয়েছে। শাহেদ আলীর ওষুধের দোকানটা বড় হয়েছে। রোজগার বেড়েছে। টাকার জোরে ক্রমশ সমাজের মাথা হয়ে উঠেছেন শাহেদ আলী। এর মধ্যে ছুটির দিন রোববার থেকে বদলে শুক্রবার হয়েছে। ব্যস, আফজাল শরীফের জীবনে এই একটি মাত্র পরিবর্তন। আর বাকি সব স্থির দাঁড়িয়ে একই জায়গায়। আফজাল শরীফের বাস তাঁর বাবার বাড়িতে ভাইদের সাথে। সেই টিনশেড বাইরের ঘর। ঘরের সাদা দেয়াল। সরু সিঙ্গেল খাট। আর আফজাল শরীফের সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট। কালো জুতো। তাঁর জীবনে একটা মাত্র বদল ঘটেছে। এখন আফজাল রোববারের বদলে শুক্রবার সকালে হাজিরা দেন শাহেদ আলীর বাড়িতে।
রান্নাঘরের মেঝেতে বাজার ঢেলে গোছানোতে ব্যস্ত হয় রাহেলা। রুইমাছটাকে কাটতে কাটতে আসমা গুনগুন করে গান করেন-‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না।’ ধমকে ওঠে রাহেলা-আহ্ বুবু থামো তো! এতখানি বয়স হলো তবুও তোমার ছেলেমানুষি গেল না!
খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়েন আসমা, কেন, কী ছেলেমানুষী করলাম? আর বুড়োমি করতে হবে কেন? তুই জানিস না শম্পার ছেলে আমায় নানি নয়, আপামণি ডাকে? আর তুই-ই বরং দেবদাস। নাহ্, ভুল বললাম, দেবদাসীর ভাব ছাড়। একটা ভালো কাপড় পর। মুখ ধুয়ে চুল বাঁধ।
শুধু এতেই হবে? খোঁপায় ফুলের মালা, গলায় সাতনারি হার, কোমরে বিছা, পায়ে মল নয় কেন? সত্যিই তুমি না বুবু!
রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল সুমনা। রাহেলার বড় মেয়ে। মা, বাবা চা-নাশতা দিতে বললেন। তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বাবা হালুয়া দিতে বলেছেন।

আমি তৈরি করে দিচ্ছি। তুই দিয়ে আয়-না মা!
মিনতি করল রাহেলা।
সুমনা একটু থমকাল। সে জানে মা আফজাল চাচার সামনে যেতে চান না। তবুও সে রাজি হয় না। কারণ সুমনা চা- নাশতা নিয়ে গেলেও কোনো না কোনো ছুঁতোয় বাবা মাকে ডেকে বসার ঘরে নিয়ে যাবেন। আর বসিয়ে রাখবেন। মা যদি ট্রে টা নিয়ে যান তবে রান্না ছুতোয় চট করে ছাড়া পেয়ে যবেন, যদিও বাবা এরই মধ্যে আফজাল চাচার পছন্দের তরকারিগুলোর রান্নার হুকুম দিয়ে দেবেন।
আসমা তাড়া দেন-সুমনা তুই পড়তে যা। আামি দেখছি। আর তোর ভাইদের বল টেবিলে গিয়ে নাশতা খেয়ে নিতে।
গজগজ করতে থাকেন আসমা-জ্বালিয়ে খেল এই ছেলে দুটো। বেলা নয়টা বাজে এখনও ঘুম ভাঙে না। এরা নাকি ছাত্র!
দু’ছেলে এক মেয়ে আসমার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। জামাই জনতা ব্যাংকে চাকরি করে। থাকে খুলনায় । ছেলে দুটো কলেজে পড়ে। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। কিন্তু হাসি-তামাশায় চব্বিশ বছর বয়সীদেরও হার মানিয়ে দেন। তবে মনটি খুব ভালো। একেবারে সাদা দিল যাকে বলে। খুব ভালোবাসেন ছোট জা রাহেলাকে। দু’জায়ের মধ্যে একটা অলিখিত বোঝাপড়া রয়েছে। প্রাণবন্ত আসমার পাশে রাহেলাকে বেশি বেশি বিষণ্ন মনে হয়। আসমা প্রায়ই ছোট জা কে বলেন, কী এত ভাবিস বল তো? ডুবাপিঠার মতো সারাক্ষণ বিষণ্নতায় ডুবে থাকিস।
কথাটা মিথ্যে নয়। ভুলেও রাহেলা জোরে হাসে না। কেউ কখনও তাকে জোরে কথা বলতে শোনেনি।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম কী হাসিখুশি ছিল রাহেলা-ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আসমা। মাত্র দুই ভাই আসমার স্বামীরা। বড় জন ধীর-স্থির, শান্ত। কথা কন কম, কাজ করেন বেশি। আর দেবর শাহেদ আলী, যেমন বদমেজাজি- তেমনি নিষ্ঠুর। আনন্দ-বেদনা, ক্রোধ-ঘৃণা সবকিছু জানতে দিল আফজালকে। আফজাল একদিন শাহেদকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। দুজনকে সামনাসামনি করে দিয়ে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
রাহেলা স্পষ্ট উচ্চারণে জানায়,‘যে-কোনো শর্তে শাহেদের সাথে ফিরে যেতে চায় সে। তার দু’চোখ বেয়ে সে-সময় গড়িয়ে পড়ছিল ফুটন্ত আগুন।
ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি হেসে শাহেদ বলেছিলেন, ঠিক আছে ব্যবস্থা করছি। বিদ্রুপের সেই হাসিতে রাহেলার তরুণী হৃদয় অপমানের বিষে জ¦লে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল বলে দেয় সে যাবে না। কিন্তু কিছুই বলা হয়নি। কারণ তার ফিরে যাবার কথায় বাড়িতে আনন্দের ঢেউ বয়েছিল। শুধু নতুন ভাবি একবার মৃদু স্বরে বলেছিল, সে কী, ফিরে যাওয়া এত জরুরি হলো কেন? এতে তোমার মান থাকল?
এই কথায় বেচারা ভাবির যা হেনস্থা হয়েছিল তা চোখে দেখার মতো নয়।
শাহেদ রাহেলাকে নিয়ে যাবেন এটা ঠিক হওয়ার পরই তাদের বাড়িতে আফজাল হয়ে উঠলেন অনাহূত। তিনি এলেই বাড়িতে কানাকানি শুরু হয়ে যেত। সবাই বিরক্ত। মা একদিন সরাসরিই রাহেলাকে না করলেন ওর সাথে গল্প করতে। শাহেদ সবার সামনেই আফজালকে নিয়ে নানা ঠাট্টাবিদ্রুপ করতেন, যদিও আফজাল তাঁর বন্ধুর সাথেই আসতেন বেশির ভাগ সময়।
এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় আফজালকে একটু সময়ের জন্য একা পেয়ে রাহেলা বলল, আর কেন আসেন আপনি?
আফজাল রাহেলার কান্নাভেজা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর উঠে এলেন। হাত বাড়িয়ে মুছে দিলেন রাহেলার চোখের পানি।
বললেন, তোমাকে দেখব বলে আসি। ঠিক আছে আর আসব না।
উথালপাতাল বৃষ্টিতে ভিজে চলে গেলেন আফজাল।
প্রায় একমাস কেটে গিয়েছে। শাহেদ একাই আসেন। চা খান। গল্প করেন। নিজে থেকেইে বলেন, আফজালটা কী যে এত ব্যস্ত বুঝি না! আসতে বললেই বলে আজ নয় আর একদিন। শাহেদ জানিয়ে দিয়ে গেলেন, আগামী পরশুদিনই সবকিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পরশু সোমবার সন্ধ্যায় ভাবি আসবেন রাহেলাকে নিতে।
রোববার সকাল থেকে কী যে হলো রাহেলার! সে ছটফট করতে থাকল। বারবার মনে হতে লাগল ও-বাড়িতে চলে যাবার আগে দেখা হবে না।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে রাহেলা বাড়ি ছেড়ে বেরুল। রিকশা নিয়ে অনায়াসে পৌঁছে গেল আফজালের বাড়িতে। গেটের সামনে কোদাল-হাতে কাজ করছিলেন একজন বৃদ্ধ। তিনিই দেখিয়ে দিলেন। বললেন, যান-না! ঐ তো বাইরের দিকের ঘর। ঘরেই আছেন ছোটসাব।
দরজার সামনে একটা কাঁঠাল গাছ। ছোট্ট গোল বারান্দা । ঘরের দরজায় পর্দা ফেলা। দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল রাহেলা। তারপর নিজের শরীর ও মনের সবটা শক্তিকে একত্র করে ঢুকল ঘরে।
বিছানায় খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে শুয়ে ছিলেন আফজাল। রাহেলাকে দেখে চমকালেন না। অবাকও হলেন না। আড়মোড়া ভেঙ্গে বসে বললেন, কী খবর?
এমন ভাব যেন প্রতিদিনই এ-ঘরে রাহেলার পা পড়ে। তাপর কতক্ষণ দুজনে মুখোমুখি বসে ছিল মনে করতে পারে না রাহেলা। চারদিক নীরব সুনসান, মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছিল বউ-কথা-কও পাখি। কাঁঠাল পাতার ঝরে পড়ছিল টুপটাপ।। রাহেলা উঠে দাঁড়াল, দুহাতে ধরল আফজালের হাত। বলল, কাল আমি চলে যাব ওদের বাড়ি।
বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছিলেন আফজাল। শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন রাহেলার কাঁধ। বলেছিলেন, কী হয় যদি না যাও?
: না তা হয় না।
: কেন হয় না রাহেলা? কেন হয় না?
: হয় না, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার প্রেমকে আমি কিছুতেই ছোট করতে পারব না। যদিও আমি জানি এ-পৃথিবীতে তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু। তোমার কাছে আামি যে -সম্মান, যে-ভালোবাসার পেয়েছি তাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি ঘর করতে।
রাহেলা যখন বাড়িতে ফিরে এল একযোগে সবাই রে রে করে উঠল। মা বললেন, কোথায় গিয়েছিলি? শাহেদ এসে বসে আছে।
বসার ঘরের সোফায় আধশোয়া হয়ে পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছিলেন শাহেদ, রাহেলা এসে দাঁড়াতে ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ও, ফিরলে তবে! আমি তো ভাবছিলাম. . .
কথা শেষ হওয়ার আগেই রাহেলা উঠে দাঁড়াল। বলল, তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।
রাতে বারান্দায় ডেকে নিয়ে নতুন ভাবি বলল, রাহেলা ফিরলে কেন? নিজের যোগ্য জায়গার খোঁজ আমাদের দেশের মেয়েরা পায় না। তুমি কিন্তু পেয়েছিলে।
এবার হেসে ফেলল রাহেলা। নুতন ভাবির মাথায় একটা আলতো চাঁটি মেরে বলল, পাকামি হচ্ছে! বাবা, ভাইয়া কেউ যদি শোনে তো আমার সাথে সাথে তোমারও ফাঁসির আদেশ হয়ে যাবে। হুঁ বাবা।
সেই শুরু। যেদিনই আফজাল আসেন, সে রাত্রেই শাহেদ তার শরীর খুঁড়ে হৃদয় দেখতে চান। কে রয়েছে সেখানে? বিশেষ সে-মুহূর্তে চুল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বারবার পাগলের মতো বলতে থাকেন, চোখ বন্ধ করবে না। আমার দিকে তাকাও।
মাঝে মাঝে সেই বিশেষ সময়েও হাসি পায় রাহেলার। মনে-মনে ভাবে, শাহেদটা এত বোকা কেন?
বারান্দায় বসে তারাদের দেখতে দেখতে রাহেলা ভাবে- সেদিন যদি আফজালে কথা মেনে নিত? যদি ফিরে না আসত? তবে আফজালও কি তার মধ্যে শাহেদকে খুঁজত? নাকি আলতো আদরে, আলতো স্পর্শে তার সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে চাইত? আলতো চুমুতে শুষে নিত তার সব বেদনা, সব অপমান?
রাহেলার পাশে এসে বসলেন আসমা। হাতে আয়োডেক্স। আলতো হাতে সরালেন রাহেলার বুকের কাপড়। ব্লাউজের হুক খুলে আঁতকে উঠে বললেন, ইস! নরম হাতে আয়োডেক্স লাগাতে লাগাতে আসমা বললেন, কী রে লাগছে?
আরামে চোখ বন্ধ করল রাহেলা। বলল, তুমি এখনও ঘুমোওনি? কিন্তু সে জানত আসমা জেগে রয়েছেন। এরকম সব রাত্রে আসমা তার জন্য জেগে থাকেন।
আসমার কাঁধে মাথা রাখল রাহেলা। মাথায় হাত বুলিয়ে আসমা বললেন, শুতে যা, ভোর হতে বেশি বাকি নেই।
———————————————

 

Related Articles

Back to top button