মানুষের ঘুমন্ত বিবেক কে জাগ্রত করাই আমার লেখার মূল লক্ষ্যে: হুমায়ুন কবীর হিমু
লেখক হুমায়ুন কবীর হিমু। একজন জনপ্রিয় উপ্যানাসিক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা তৃতীয় উপন্যাস ‘একজন মতি মাষ্টার’ উপন্যাসটি পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে। এছাড়াও লিখেছেন ‘ভালোবাসায় লোডশেডিং’, ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ ,‘ভালোবাসায় নিম্নচাপ’, এবং ‘রাত্রির সাতকাহণ’। উনার লেখা উপন্যাসগুলো বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে খুব জনপ্রিয়। উনি পেশায় একজন বেসরকারি চাকরিজীবি হলেও উনি মূলত ভালোলাগা থেকে লেখালেখি করেন। এদেশের মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করার লক্ষ্যে উনার এই লেখালেখি। এই পর্যন্ত হুমায়ুন কবীর হিমুর উপন্যাস বের হয়েছে ৫টি। ২০২০ একুশে বইমেলায় আসছে তার নতুন উপন্যাস ‘কবি ’’। তার নতুন উপন্যাস এবং লেখালেখির নানান বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন ’চিত্রদেশ’ এর সঙ্গে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন- শেখ লাভলী হক লাবণ্য
চিত্রদেশ: এ পর্যন্ত আপনার কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে? কী কী এবং কোন প্রকাশনীতে বের হয়েছে?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আমার এ পর্যন্ত মোট ৫টি বই বের হয়েছে। বেশির ভাগ বই ই ’পারিজাত প্রকাশনী’ থেকে। দুটি বই বের হয়েছে ’বর্ণ প্রকাশ’ থেকে ।’
আমার প্রথম উপন্যাস থেকে ‘ভালোবাসায় লোডশেডিং’ (২০১৬), দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ (২০১৭) তৃতীয় উপন্যাস ‘একজন মতি মাষ্টার’(২০১৮),চতুর্থ উপন্যাস ‘ভালোবাসায় নিম্নচাপ’ এবং পঞ্চম উপন্যাস ‘রাত্রির সাতকাহণ’ (২০১৯) বর্ণ প্রকাশ। ২০২০ বই মেলায় আমার নতুন উপন্যাস বের হচ্ছে পারিজাত প্রকাশনী থেকে নাম ‘কবি’।
চিত্রদেশ: এবারের বই মেলায় আপনার কোন বই প্রকাশিত হচেছ?
হুমায়ুন কবীর হিমু: এবারের (২০২০) এ অমর একুশে বইমেলায় আমার ৬ষ্ঠ উপন্যাস আসছে। নাম ‘কবি’ পারিজাত প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে। মূল্য ৩০০ টাকা।
চিত্রদেশ: ‘কবি’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিয়ে যদি পাঠকদের একটু বলেন? কোন শ্রেনীর পাঠকদের কথা মাথায় রেখে ‘কবি’ উপন্যাস লিখেছেন?
হুমায়ন কবীর হিমু: আসলে কবি সাহিত্যিকদের বাইরে থেকে অনেক মানুষ অনেক রকম মনে করে। তবে তাদের জীবনটা যে কত দু:সহ, কতটা অচছলতায় কাটে, সেটা কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে না। একজন লেখক বা কবি কত কষ্ট করে একটি লেখা লেখে সে ভাবে তার লেখা মানুষ পড়বে। কিন্তু মানুষ তো এখন সে জায়গায় নেই। সবাই তো আর এখন হার্ড কপি পড়ে না। সফট কপি পড়ে। লেখকদের সংগ্রাম, কষ্ট, বঞ্চনা প্রভৃতি নিয়েই এই ‘কবি’ উপন্যাস। আসলে মধ্যবিত্ত জীবনের জটিলতা ও দু:খ-কষ্টগুলো ‘কবি’ উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র সানাউল হক দোলনেরা মাধ্যমে এই মধ্যবিত্ত পরিবারের জটিলতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই মূল চরিত্রকে একটা পর্যায়ে দেখা যায়, যে মানুষের কথা ভাবতে ভাবতে মানুষের কথা লিখতে লিখতে কখন যে তার নিজের সময়গুলো ফুরিয়ে গেছে। কখন যে নিজের চাওয়াগুলো পূর্ণতার পেল না। সেটা কখন যে ফুরিয়ে গেছে বুঝতেই পারলো না। যখন বুঝেছে তখন তার কিছুই করার থাকলো না। তার প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে গেছে। চলে গেছে শেষ পর্যন্ত তার একমাত্র অবলম্বন ভালোবাসার লাভলী। সেও ভালোবাসার মানুষও কবি কে বাস্তবতার কারনে গ্রহণ করতে পারেনি। উপন্যাসের নায়িকা লাভলী বুঝেছে কবিতা দিয়ে আর যাই হোক সংগ্রাম চলে না। সেজন্য কবিকে তার ভালোবাসার মানুষ শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করে। তো চাওয়া-পাওয়ার এই বিষয়গুলোকে নিয়েই আমার ‘কবি’ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে।
চিত্রদেশ: আপনার লেখালেখিটা শুরু কবে থেকে?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আমি যখন কলেজে পড়াশোনা করি তখন থেকে লেখালেখি করি। স্থানীয় পত্রিকায় আমি টুকটাক ছোট গল্প, কবিতা লিখতাম। সে সময় আমি যখন ডিগ্রি কলেজে পড়ি তখন একটা উপন্যাসও লিখেছিলাম। সেটা উপজেলায় সেবা প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপাও হয়েছিল এবং বন্ধুদের মাঝে সেটা ব্যাপক আলোচিত হয়। ৯২-৯৩ সাল থেকে লেখালেখি করি। হুট করে লেখালেখিটা হয় নাই। তবে মাঝখানে কিছু দিন গ্যাপ ছিল আরকি। ২০১১-১২ সাল থেকে আবার নিয়মিত লেখালেখি করি। প্রথমে গল্প লিখতাম। তখন শুভাকাঙ্খীরা বলল যে, উপন্যাস লিখলে ভালো হয়। তখন বিশেষ করে লুৎফুল কবীর মুন্না, আমার স্যার হয়। উনি ওয়ালটনেই জব করেন। বিশেষ করে উনার অনুপ্রেরণায় আমার উপন্যাস লেখায় আসা। এখনও উনি আমার প্রতিটি বই পড়ে বিশ্লেষণ করেন। উনিই আমার ভালো পাঠক। ভালো সমালোচক, ভালো বিশ্লেষক, ভালো আলোচক। একমাত্র মুন্না স্যারের কাছেই আমি সবসময় লেখালেখির বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়ে আসছি। এবং সর্বক্ষেত্রে। উনাকে আমি একটা বইও উৎসর্গ করেছি ‘রাত্রির সাতকাহন’।
চিত্রদেশ: লেখালেখি কী আপনার পেশা? নাকি শখ বা ভালোলাগা থেকে লেখেন?
হুমায়ুন কবীর হিমু: লেখালেখি আমার পেশা না। লেখালেখিটা আসলে আমি ভালোলাগা থেকে করছি।
চিত্রদেশ: আপনার লেখা কোন বইটি আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ লেখা বলে মনেহয়?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আমার চোখে আমার লেখা শ্রেষ্ঠ বই হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘একজন মতি মাষ্টার’। আমাদের জল ঢাকার একজন পোস্ট মাষ্টারের উপর বইট লেখা। যাকে ১৯৭১ এ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যিনি স্বাধীনতা সংগঠক ছিলেন। উনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করলেও তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সংগঠিত করতো। উনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ । উনি বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত ছিল। উনি যেদিন নিজের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাবেন সেদিনই উনাকে স্থানীয় রাজাকাররা পাকহানাদার বাহিনীদের কাছে তুলে দেয়। পাকহানাদাররা উনাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। সত্যিকারের ঘটনা নিয়েই বইটি লেখা হয়। উনি আজো মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পাননি। উনার দুজন মেয়ে রয়েছেন। উনার পরিবারটা এখন খুব অসহায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ‘একজন মতি মাষ্টার’ লেখা। কেননা বাংলাদেশের কাছে বাঙ্গালীর কাছে এক বড় দু:সহ, দুর্যোগের দিনছিল ১৯৭১ সাল। সেই সময়ের মত ত্যাগের দিন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতো আর কোন দিন আমরা কাটাইনি। আমরা যারা তরুণ প্রজন্ম যারা সেই দিনগুলো দেখেন নাই। আর সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশকে কিছু করার ছিল বা দেয়ার ছিল সেই ১৯৭১ সালে। এটি আমার তৃতীয় বই ছিল। বইটি বের হয়েছিল ২০১৮ সালে পারিজাত প্রকাশনী থেকে মূল্য ছিল ২৭৫ টাকা।
চিত্রদেশ: সাহিত্য নিয়ে আসলে আপনি কী ভাবেন?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আসলে সাহিত্য চিন্তাটা ৯০ দশকে ছিল। সে সময়ের চিত্রটা ধরেন তখনকার সময়ে আমরা যখন স্টুডেন্ট ছিলাম তখন সমরেশ মজুমদার, হুমায়ুন আহমেদ বা সুনীল ছিল ক্রেজ। এখনকার জেনারেশনের মধ্যে তো সেই ক্রেজটা নেই। তাদের মধ্যে এই বিষয়টা নেই। আমাদের মধ্যে তখন সাহিত্য চর্চা ছিল। এখনকার প্রজন্মের মাঝে সেই চর্চা নেই।
চিত্রদেশ: এখনকার প্রজন্মের মাঝে সাহিত্য চর্চাটা নেই কেন বলে আপনার মনেহয়?
হুমায়ুন কবীর হিমু: কারণ একটাই, এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। এখনকার ছোট বাচ্চারা না খেলে তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য এবং তারা কান্না করলে তাদের শান্ত করানোর জন্য বাবা-মা মোবাইলে গেইম অন করে দিচ্ছে। হাতে ট্যাব ধরিয়ে দিচ্ছে। এখনকার বাচ্চাদের হাতে বই ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে না। তাদেরকেও বই পড়া শিখানো হচ্ছে না। আমাদের ছেলে মেয়েরা এখন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। গেইমস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আগেরকার দিনে রুপ কথার বই, ঠাকুরমা ঝুলি কেউ পড়ে না। আমাদের ছেলো মেয়েদের হাতে কিন্তু আমার মোবাইল দিসি বই দিইনি।
চিত্রদেশ: এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হুমায়ুন কবীর হিমু: সমাজের প্রতিটিা বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে ঘর থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার অভিযান শুরু করতে হবে। প্রতিটি বাবা মাকেই তাদের বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। বই পড়ার প্রতি ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসা জন্মাবে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মালে সেটা ভালো কিছুই হবে। ভালোবাসা জন্মালে সেখানে আর যাই হোক নোংরামি জন্মাবে না। হয়তো আমরা দেখে যেতে পারবো না। একটা প্রজন্ম হয়তো দেখবে আগের সেই বই পড়ার যুগটাই আসবে। আমি আমার লেখনিতেই সেই চেষ্টাই করি। মানুষের ঘুমন্ত বিবেক কে জাগ্রত করা। আর আমরা লেখালেখিরই এটাই হলো মূল লক্ষ্যে।
চিত্রদেশ: আপনি কোন ধরনের লেখা লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন? গল্প, কবিতা, উপন্যাস?
হুমায়ুন কবীর হিমু: অবশ্যই উপন্যাস।
চিত্রদেশ: পাঠকরা কি আগামিতে আপনার কাছে কোন ছোট গল্প বা কবিতা পাবে?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আগামিতে ইচ্ছে আছে ছোট গল্পের একটি বই প্রকাশিত করার। তবে কবিতা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না। কারণ ৮/১০ লাইনের মধ্যে অনেক কিছু প্রকাশ করবো আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়। জটিল মনে হয়। ১০ লাইনের কবিতা লেখায় চেয়ে তার চেয়ে ১৫০ পাতার একটি বই লেখা আমার কাছে খুব সহজ।
চিত্রদেশ: আপনার বইয়ের পাঠক আসলে কোন শ্রেনীর?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আমার পাঠক আসলে তরুণ প্রজন্মই বেশি। তাদের কে যদি আমরা নব্বই দশকের পড়ার স্রোতে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তাইলে মনেহয় যে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটাতে পারবো। কারণ সাহিত্য জগতে একবার একটি তরুণকে প্রবেশ করতে পারবে তারা আর যাই হোক নেশা বা অসামাজিক, অনৈতিক কর্মে জড়িত হবে না। তরুণ প্রজন্মকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনা যাবে। সে দায়িত্বটাই আমরা পালন করতে চাই।
চিত্রদেশ: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষৎ পরিকল্পণা কী?
হুমায়ুন কবীর হিমু: আমি তো আসলে ভালোলাগা থেকে লেখালেখি করি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে-আমরা যে জায়গা থেকে আসছি। সেই জায়গায় ফিরে যাওয়াটা আমার লক্ষ্য। আমায় লেখালেখির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের ঐ যে ঘুমন্ত বিবেক। সেটাকে জাগাতে চাই। সাহিত্য থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। ভালো কাজ থেকে পিছিয়ে আছি। একদিন হয়তো মানুষ জাগবে। মানুষ হুমড়ি খেয়ে বই কিনে পড়বে।
চিত্রদেশ //এস//