কানিজ কাদীরের ছোট গল্প ‘পিতা’
ঈদ-উল-আযহা এখন ঢাকায়ই সাধারণত করি। দু বছর হলো সোয়াইর (গ্রামের বাড়ি) আমার শ্বশুর বাড়িতেও গরু কুরবানি দেয়া হয়। গরুর মাংস গ্রামের লোকদের বিলিয়ে দেয়া হয়। গতবার আমরা ঈদে বাড়িতে যাইনি। কিন্তু গরু কুরবানি দিয়ে মাংস গ্রামের লোকদের বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল। এবার ডাক্তার সাহেব আমার হাসবেন্ড সিদ্ধান্ত নিলেন কুরবানির ঈদ ঢাকায় করবেন তবে ঈদের পরের দিন সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাবেন। ঈদের একদিন পর গরু কুরবানি দিবেন আর নিজ হাতে মাংস গ্রামের লোকদের বিলাবেন। আমরা ভাবছিলাম এত দূরের রাস্তা মাইক্রোবাস নিয়েই যাব। কিন্তু বাড়িতে দু-তিন দিন থাকলে তো মাইক্রো রেখে দেয়া অসুবিধা। ভাড়াও দিতে হবে তিনগুণ। অনেক ভেবেচিন্তে আমরা ঠিক করলাম আমাদের প্রাইভেট কার নিয়েই গ্রামের বাড়িতে যাব। আমাদের কার ড্রাইভার। এস.এস.সি পাশ। অন্য ড্রাইভারের চেয়ে কথাবার্তায়, চালচলনে ভিন্ন। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাকে নিয়েই শ্বশুরবাড়ি সোয়াইর যাব ভাবলাম, কি বলো তুমি।’ ড্রাইভার উত্তর দিল, ‘আপনারা নিয়া গেলে তো আমার যাওয়াই লাগবে।’
: গাড়ি নিয়ে কোনো অসুবিধা হবে না তো।’ বললাম।
: আমার গাড়ি চালাইতে কোনো অসুবিধা হবে না। শুধু ঐ একটু চিন্তা করতেছি. . .
আমি ড্রাইভারকে বললাম, ‘তুমি কি চিন্তা করছো। তোমার ফ্যামিলির কথা?’
ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ, আমার মেয়েটা আমারে ছাড়া থাকতে চায় না। ‘রাতে ভয় পায়।’
হ্যাঁ, ড্রাইভারের স্ত্রী ও মেয়ে ঢাকাতেই থাকে কিছুদিন হলো। আদাবরে একটা ছোট ঘর নিয়ে ওরা থাকে। ড্রাইভারের স্ত্রী বেশ ধনী পরিবারের মেয়ে। ড্রাইভারেরও নাকি নিজস্ব ট্যাক্সি ক্যাব ছিল। চুরি হয়ে গেছে। নানা কারণে ওর এখন অন্যের গাড়িই ড্রাইভিং করতে হচ্ছে। ড্রাইভারের একটি মাত্র মেয়ে। পড়ে ক্লাস ফোরে । গ্রামের স্কুল থেকে নিয়ে এসেছে। সে ক্লাসে প্রথম হয়। আমি একদিন ওর মেয়েটাকে আমার বাসায় নিয়ে আসতে বলেছিলাম। ড্রাইভার মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল। কি মিষ্টি দেখতে মেয়েটা। দেখতেও বেশ নম্র ভদ্র মনে হচ্ছিল। ওকে আমি পায়েস খেতে দিলাম। ও ওর বাবার কাছে জিজ্ঞেস নিল সে পায়েস খাবে কিনা। ওকে আমি একটা ছোট প্লাস্টিকের পুতুল দিতে চাইলাম।’ ও কিছুতেই নিতে চাইল না। পরে ওর বাবা বলাতে ও পুতুলটা নিল। দেখলাম মেয়েটা বাবার খুব আদরের।
আমরা একটু চিন্তা করছিলাম ড্রাইভারকে নিয়ে, প্রাইভেট কারে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারব কিনা। ওর পরিবারের কথাও চিন্তা করছিলাম। কিন্তু ড্রাইভারই আমাদের সাহস দিল, ‘ম্যাডাম কিছু চিন্তা কইরেন না। আমিই আপনাদের নিয়া যাব। আপনারা আমার উপরে ভরসা করছেন আর আমি যাব না তা কি হয়?
আমি বললাম ‘তোমার পরিবারের কি করবা।’ ড্রাইভার বলল, ‘দুইদিন ওরা একলাই থাকব। কিছু হইব না ইনশাললাহ।’
ঈদের একদিন পর আমরা পুরো পরিবার সকাল সকালই ড্রাইভার আর প্রাইভেট কার নিয়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ হয়ে সোয়াইর এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ড্রাইভার গাড়ির গতি বেশ বাড়িয়েই যাচ্ছিল। আমি ড্রাইভারকে বললাম, ‘ড্রাইভার গাড়ির স্পিড একটু কমিয়ে আস্তে ধীরে যাও, আমি বেশ ভয় পাই।’ আমি বলার পর দেখলাম ড্রাইভার গাড়ির গতি একটু কমিয়ে বেশ সুন্দরভাবে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
আমার মেয়ে, ছেলে, ওদের বাবা ও আমি বেশ গল্প করতে করতেই গেলাম সারা রাস্তা। ড্রাইভারও মাঝে মাঝে আমাদের গল্পে শরীক হলো। আমরা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম সন্ধ্যার দিকে । ড্রাইভার একেবারে যেন মিশে গেল। গ্রামের ক্ষেতে ঘুরে বেড়ানো, গাছ থেকে কাঁচা মরিচ তোলা, লেবু তোলা, মাছ ধরা ইত্যাদি নানা আনন্দে মেতে উঠছিল ড্রাইভার আমাদের সাথে। আমি ড্রাইভারকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ তোমার বাসায় ফোন দিয়েছিলা?
ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ ফোন দিছিলাম, একটু কথা হইছে। আমার মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকতেছে না তো বেশি কথা বলতে পারি নাই।’
ওকে দেখে একটুও বিচলিত বা চিন্তিত মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও যে একটু চিন্তিত ছিল তা আমি বুঝতে পারিনি।
জ্যোৎস্না রাত। আমরা সবাই বারান্দার সিঁড়িতে বসে গল্প করছিলাম। আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার নানা রকম মজার মজার ভূতের গল্প শুনাচ্ছিল। আমরা সবাই নানা রকম গল্পে মেতে উঠলাম। ড্রাইভার আমাদের সাথে ওর বাড়ির নানা গল্প যোগ করল। আমি ড্রাইভার ভূতের ভয় দেখালাম। ও ইচ্ছা করেই গত রাতে ভূতের ভয় পেয়েছে বলে অভিনয় করল। যাক ভূত নিয়ে আমরা খুব শিহরিত হচ্ছিলাম। এমন সময় ড্রাইভার আমাকে বলল, ‘ম্যাডাম আপনের মোবাইলটা একটু দিবেন। আমার মোবাইলে নেটওয়ার্ক নাই। বাসায় ফোন দিব। মেয়েটা নাকি খালি বাসায় কি দেইখা ভয় পাইতেছে’। আমি ওকে আমার মোবাইলটা দিলাম। ও ফোনটা নিয়ে একটু দূরে উঠানের কিনারে গেল। আমি ওর কথোপকথন সব শুনছিলাম। ও বলল, ‘মা, কেমন আছো? কি করতেছ? মেয়ে মনে হয় ওপাশ থেকে বলেছে, ‘ ভালো আছি, শুইয়া আছি বা অন্য কিছু।’ মেয়ে সম্ভবত বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তুমি কি খাইছ বাবা? বাবা বলছে, ‘হ্যাঁ মা, খাইছি।’ মেয়ে হয়তো জিজ্ঞেস করেছে, কি দিয়া খাইছ?’ ড্রাইভার বলছিল, ‘আমি অনেক কিছু দিয়া খাইছি-মাছ, মাংস আরো অনেক কিছু। মেয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘বাবা তুমি কখন আসবা।’ বাবা বলছে, ‘মা, তুমি চিন্তা কইরো না, ভয় পাইও না, এই তো আমি কালকেই আইসা পরব।’
ড্রাইভার আর ওর মেয়ের কথোপকথন শুনে আমার মনে হলো পৃথিবীতে সব পিতা আর সন্তানের সম্পর্ক একই রকম। এখানে ধনী নাই গরীব নেই, দিনমজুর নইে, ডাক্তার নেই, ইঞ্জিনিয়ার নেই, মিস্ত্রি নেই, ড্রাইভার নেই। এ পিতা আর সন্তানের সম্পর্ক যেন এক শ্বাশত রুপ। পিতা- সন্তানের এ বন্ধন, মায়া চিরকাল এক ও অবিচ্ছেদ্য।
পরদিন সকালবেলা আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ড্রাইভারকে গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি, তোমার কেমন লাগল।’
ও মুখে স্মিত হেসে মেখে বলল, ‘খুব ভালো লাগছে, ম্যাডাম।’
আমি দেখলাম ও ওর চাকরির দায়িত্বেও পাশাপাশি পিতা সন্তানের বন্ধনের যে আকুলতা তা অন্তরের ভিতরে রেখেছে গোপনে, নীরবে।
ঢাকার বাসায় গাড়ি থেকে নেমেই ড্রাইভারকে একটা ধন্যবাদ দিলাম, ও খুব সুন্দর ড্রাইভ করেছে বলে। ওকে বিদায় জানালাম ‘মেয়ের কাছে যাও’ বলে।
অক্টোবর,-২০১২