৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের ঐতিহাসিক বিজয়
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
কমলা হ্যারিসকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এক মেয়াদের বিরতিতে দ্বিতীয় বারের মতো হোয়াইট হাউসের মসনদে ফিরলেন রিপাবলিকান এই নেতা।
নির্বাচনের আগের জনমত জরিপের সব হিসেব-নিকাশ উল্টে দিয়ে মার্কিনিরা আবারও বেছে নিলেন সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে। এর মধ্যদিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি এমন কীর্তি গড়েছেন, যা তার আগে সম্ভব করতে পেরেছিলেন মাত্র একজন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে গিয়ে পরাজিত হওয়ার পর ফের নির্বাচনে লড়ে প্রেসিডেন্ট পদে জয় পেয়েছেন।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মাত্র একজন প্রেসিডেন্টের ঝুলিতেই ছিলো এমন কৃতিত্ব। তার নাম গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ক্লিভল্যান্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনে গিয়ে পরাজিত হওয়ার পর ফের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে উইলিয়াম পিটারসন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক লুইস পিকোনে বলেন, গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প দুইজনই অনন্য। এই দুই সাবেক প্রেসিডেন্টই, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে পরাজিত হওয়ার পরও, ফের বিজয়ী হয়েছেন। তবে সাফল্য না পেলেও আমেরিকার ইতিহাসে আরও বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টও, পরাজিত হওয়ার পরও ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে ট্রাম্প বা ক্লিভল্যান্ডের মতো ভাগ্য সহায় হয়নি তাদের।
এছাড়াও সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্টিন ভ্যান বুরেন ১৮৪৪ এবং ১৮৪৮ সালে এবং মিলার্ড ফিলমোর ১৮৫৬ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণ করলেও জয়লাভে অসমর্থ হন তারা। তবে এই দুইজনই অবশ্য তাদের সময়ে খুব একটা জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন না।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া সত্ত্বেও একই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিলেন ইউলিসেস এস গ্রান্ট, টেডি রুজভেল্ট। ইউলিসেস গ্রান্ট ১৮৮০ সালে এবং ১৯১২ সালে টেডি রুজভেল্ট এই চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হন। তবে ট্রাম্পের আগে শুধুমাত্র ক্লিভল্যান্ডই এই অসাধ্য সাধনে সমর্থ হন এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরাজিত হয়েও ফের হোয়াইট হাউজ পুনরুদ্ধারে সমর্থ হন।
নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট রাজনীতিক গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ১৮৮৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও ১৮৮৮ সালের নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে বেনজামিন হ্যারিসনের কাছে হেরে যান। অবশ্য জনপ্রিয় (পপুলার) ভোটে তিনিই বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে হেরে গেলেও দমে যাননি ক্লিভল্যান্ড, ১৮৯২ সালের নির্বাচনে বেনজামিন হ্যারিসনকে হারিয়েই ফের হোয়াইট হাউজ দখল করেন তিনি।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে রাজনৈতিক জীবনে ফিরে এসে অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন ইতিহাসও রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে জেমস ম্যাডিসন এবং জেমস মুনরো উভয়ই ১৮২৯-১৮৩০ সালের ভার্জিনিয়ার কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে পরবর্তীতে কংগ্রেস নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড রয়েছে শুধুমাত্র জন কুইনসি অ্যাডামের। অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের কাছে পরাজিত হওয়ার দুই বছর পর তিনি মার্কিন কংগ্রেসে নির্বাচন করেন এবং নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে ১৮৩১ থেকে ১৮৪৮ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
অন্যদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনেরও অবশ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর মার্কিন পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার রেকর্ড রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ১৮৬৮ সালে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইমপিচমেন্টের শিকার হওয়ার পরও ১৮৭৫ সালে নিজ রাজ্য টেনেসি থেকে সিনেট নির্বাচনে জয়লাভ করেন অ্যান্ড্রু জনসন।
এদিকে বুধবার ভোট গণনায় সুইং স্টেট উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে তিনি ম্যাজিক নম্বর ২৭০ পার করে ফেলেছেন। আর এর মাধ্যমে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হলো। বার্তাসংস্থা এপির তথ্য অনুযায়ী, উইসকনসিনের ১০ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে ট্রাম্পের ভোট এখন ২৭৭, আর কমলা হ্যারিসের ২২৪।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচনি ফল অনুযায়ী, দেশটির নির্বাচনে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য ২৭০টির প্রয়োজন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ সময় বুধবার বেলা দেড়টার দিকেই এই ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে যান। দেশটির নির্বাচনে ফল নির্ধারণী ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্য খ্যাত জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, ফ্লোরিডা, মেইন, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিনে লাল শিবিরের জয়ে হোয়াইট হাউসের মসনদ নিশ্চিত হয় ট্রাম্পের।
এর আগে বুধবার ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে রিপাবলিকান পার্টির প্রধান কার্যালয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে এক বিজয়ী ভাষণ দিয়েছেন তিনি। সেখানে তার নির্বাচনী জয়কে তিনি ‘রাজনৈতিক বিজয়’ বলে মন্তব্য করেছেন। এরপর থেকে তাকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করেছেন বিশ্বনেতারা।
এ তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, হাঙ্গেরির নেতা ভিক্টর অরবান ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও রয়েছেন। বুধবার (৬ নভেম্বর) এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও হিন্দুস্তান টাইমস।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, এটি একটি বিশাল বিজয়। ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্যাবর্তনের জন্য অভিনন্দন! হোয়াইট হাউসে আপনার ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন আমেরিকার জন্য একটি নতুন সূচনা এবং ইসরায়েল ও আমেরিকার মধ্যে মহান জোটের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
এ ছাড়া হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানও একই রকম বার্তায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ট্রাম্পের বিজয় মার্কিন রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রত্যাবর্তন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তার বিশাল জয়ের জন্য অভিনন্দন। বিশ্বের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিজয়।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি বার্তা পোস্ট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি লিখেছেন, ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আমার বন্ধু ট্রাম্পকে আন্তরিক অভিনন্দন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে পরিচিত নরেন্দ্র মোদি। বেশ কয়েকদিন আগেও ট্রাম্প মোদিকে এক এক্স বার্তায় ভালো বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পোস্টে মোদি ট্রাম্পের আগের মেয়াদের সাফল্যের প্রশংসা করে বলেছেন, ভারত-মার্কিন ব্যাপক বৈশ্বিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে আমাদের সহযোগিতার পুনর্নবীকরণের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। আসুন একসঙ্গে আমাদের জনগণের উন্নতির জন্য, বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য কাজ করি।
অভিনন্দন বার্তায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, সম্মান এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে আরও শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আমরা চার বছর ধরে একসাথে কাজ করতে প্রস্তুত।
আর অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার বলেছেন, আমাদের ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ককে আরও সম্প্রসারিত এবং শক্তিশালী করার জন্য বিশ্বব্যাপী সকল চ্যালেঞ্জ একসাথে সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য উন্মুখ তিনি।
সাবেক রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ট্রাম্পের এই বিজয় ইউক্রেনের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। যদিও ট্রাম্প এই যুদ্ধের জন্য মার্কিন আর্থিক সহায়তা কতটা কমাতে পারবেন সে বিষয়ে তিনি অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেন।
হাঙ্গেরির উগ্র ডানপন্থি নেতা ভিক্টর অরবান বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের পথে রয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি শেয়ার করে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, শুভ সকাল হাঙ্গেরি! একটি দুর্দান্ত জয়ের পথে।
এদিকে নির্বাচনের আগে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কথার লড়াই আর বিভাজনের রাজনীতিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। শুরু থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান এই দুই প্রার্থীর মাঝে যে তুমুল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে সেই আভাস দিয়ে আসছিল তাদের মতামত জরিপে। যদিও এসব জরিপের বেশিরভাগেই নীল শিবিরের প্রার্থী কমালাকেই এগিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত দেশটির ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে অটল ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই বেছে নিলেন মার্কিন ভোটাররা।
ট্রাম্পের জয়ের খবরে বিভিন্ন রাজ্যে উৎসবে মেতেছেন তার সমর্থকরা। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের প্রধান কার্যালয় থেকে বিবিসি জানিয়েছে, ফক্স নিউজ যখন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের অনুমান ঘোষণা করছিল তখন হলরুমে উপস্থিত সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তাদের কান ফাটানো জয়ধ্বনিতে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক সমর্থক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ট্রাম্পের নামে স্লোগান দিতে থাকেন।