হুমায়ুন কবির হিমু’র জনপ্রিয় উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’ (১ম পর্ব)
জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।
পাঠকদের জন্য আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গলবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হবে ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়। আজ রইল উপন্যাসের (১ম পর্ব)-
#. জাকিয়ার বাবা ফরহাদ সাহেব আজ অনেক সকালে উঠেছেন। তিনি সাধারণত এত সকালে ওঠেন না। কিন্তু আজ উঠেছেন। কারণ আজ জাকিয়াকে ছেলে পক্ষরা দেখতে আসবে। ছেলেটি দেখতে-শুনতে ভালো। অনেক ভালো চাকরি করে। বিসিএস ইঞ্জিনিয়ার। ছেলের পরিবারও অনেক খান্দানি। ঢাকার মিরপুরে থাকে। পরিবারে তেমন ঝামেলা নাই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মিরপুরে নিজের বাসা। যেভাবেই হোক, এই ছেলের সাথে জাকিয়ার বিয়ে দিতেই হবে। এখন জাকিয়াকে রাজি করাতে পারলেই হয়। এর আগেও চারটি ভালো ছেলের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু জাকিয়া এই মুহূর্তে কোনোভাবেই বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে। ফরহাদ সাহেব জাকিয়াকে নিয়ে বড়ই চিন্তিত। তার মনে একটাই ভয়, জাকিয়ার আবার অন্য কারো সাথে সম্পর্ক নেই তো? নাহ, জাকিয়া তার লক্ষ্মী মেয়ে। কোনো ছেলের সাথে কিছু থাকলে অবশ্যই সে জানাত। কারণ তার সাথে তার মেয়ের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুর মতো। কোনো ছেলের সাথে কিছু থাকলে জাকিয়া নিশ্চয়ই বলত। এটা জাকিয়া না হয়ে যদি কেয়া হতো তাহলে তার ভয়ের কারণ ছিল। কেয়া জাকিয়ার ছোট বোন। সবে মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। কেয়া হয়েছে জাকিয়ার পুরোই উল্টা। সারাদিনে দশটা কথা বলবে কি না সন্দেহ। প্রয়োজন হলে কথা বলবে না হলে বলবে না। কিন্তু জাকিয়া সারাদিন বকবক করতেই থাকবে। কথা না বলে এক মুহূর্ত থাকতে পারবে না। অফিস থেকে বাসায় আসার পর থেকে শুরু হয় তার বকবকানি। মাঝে মাঝে ফরহাদ সাহেব বিরক্ত হয়ে যায় জাকিয়ার অতি-কথনে। জাকিয়া ঢাকা ভার্সিটি থেকে সদ্য ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স শেষ করে একটি বিদেশি এনজিওতে চাকরিতে ঢুকেছে প্রায় দুই মাস হলো।
ফরহাদ সাহেব সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। কয়েক মাস হলো অবসর নিয়েছেন। তার কোনো ছেলে সন্তান নেই। জাকিয়া, কেয়া আর শামীমাÑএই তিনজনকে নিয়েই ফরহাদ সাহেবের সংসার। শামীমা ফরহাদ সাহেবের স্ত্রীর নাম। সারা জীবন চাকরি করে পেনশনের টাকা আর জমানো টাকা দিয়ে মোহাম্মদপুরে ছোট একটি দোতলা বাড়ি ফরহাদ সাহেব বানিয়েছেন। পেনশন বাবদ যা পান আর জাকিয়ার বেতনের টাকায় এখন তাদের সংসার ভালোই চলে যায়। কারণ জাকিয়া বেতন মন্দ পায় না। বিদেশি এনজিও তো, তাই।
বাড়ির বারান্দায় বসে বসে ফরহাদ সাহেব ভাবছেন, কীভাবে এই বিয়েতে জাকিয়াকে রাজি করানো যায়। আজ যে জাকিয়াকে ছেলেরা দেখতে আসবে এই কথা শুধু শামীমা আর তিনিই জানেন। জাকিয়া এবং কেয়াকে জানানো হয়নি। কেয়া সারাক্ষণ চুপচাপ থাকলেও জাকিয়াকে সে কোনো কথা না বলে থাকতে পারে না। তাই কেয়াকেও জানানো হয়নি। আজ শুক্রবার হওয়ায় জাকিয়া বাসাতেই আছে। কেয়ার কলেজ বন্ধ। তাই ফরহাদ সাহেব আজকের দিনটাকেই বেছে নিয়েছেন। তিনি বসে বসে নানান চিন্তা করছেন কীভাবে জাকিয়াকে কথাটা বলা যায়! এমন সময় মিসেস শামীমা চায়ের কাপ আর টোস্ট হাতে বারান্দায় আসল। ফরহাদ সাহেব শামীমার পায়ের শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকাল। শামীমার হাতে চায়ের কাপ দেখে তিনি একটু আনন্দ বোধ করল। তুমি কীভাবে বুঝতে পারলে যে আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে?
বিয়ের ত্রিশ বছরে তোমাকে চিনার বা বুঝার আমার আর বাকি নাই। তুমি সকালে উঠে এক কাপ চা আর টোস্ট খেতে পছন্দ করো, সেটা তো আমি জানি। এটা জানার জন্য তো আমাকে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নাই। কথাটা মিসেস শামীমা একটু ঝাঁঝালো গলায় বলল!
কী ব্যাপার, তুমি কি কোনো কারণে উত্তেজিত বা রাগান্বিত?
কই না তো!
তাহলে এইভাবে কথা বলছ যে!
না তেমন কিছু না।
তেমন কিছু না মানে, অবশ্যই তেমন কিছু! আলবাত তেমন কিছু!
আস্তে কথা বলো, জাকিয়া, কেয়া উঠে যাবে!
ফরহাদ সাহেব একটু উত্তেজিত হয়েছিলেন। শামীমার কথায় ঠান্ডা হলেন। তুমি ভালো করেই জানো, বহু কষ্টে এই ছেলের সন্ধান পেয়েছি। গত রাত থেকে আমি চিন্তায় অস্থির আছি, কীভাবে জাকিয়াকে বিষয়টি আমি জানাব। তার মাঝে সাত সকালে যদি তোমার এই পাতিল মার্কা মুখ দেখতে হয় তাহলে তো আমার সমস্ত প্ল্যান ধ্বংস হয়ে যাবে!
শামীমা ফরহাদ সাহেবের মুখের দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে!
কী ব্যাপার, তুমি আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
তুমি আমাকে কী বললে? আমি কিসের মতো মুখ করে আছি?
ফরহাদ সাহেব মাথা নিচু করে চুপ করে গেলেন। কারণ পাতিলের মতো এই শব্দটা ব্যবহার করা তার উচিত হয়নি! কাজটা অন্যায় হয়েছে। স্যরি, কিছু মনে কোরো না। মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। স্যরি।
শামীমা কিছু কড়া কথা বলতে যাবে, এমন সময় বারান্দায় জাকিয়া ঢুকল। জাকিয়াকে দেখে তারা দুজনেই চুপ মেরে গেলেন।
মা, এক কাপ সুপার টাইপের চা করে খাওয়াও তো। চায়ের সাথে অবশ্যই দুইটা টোস্ট দিবে। অনেক ক্ষিদে পেয়েছে।
শামীমা কোনো কথা না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। জাকিয়া তার বাবার সামনের চেয়ারে বসল।
কী খবর বাবা, তুমি কেমন আছ? তোমার শরীরটা ভালো আছে তো? পেটের ব্যথাটা কি আগের মতো আছে বাবা?
না রে মা, তেমন ব্যথা আর নেই। এখন অনেক ভালো আছি। মা রে, তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিস ভালো হয়েছে। রাতে ঘুম ভালো হয়েছে তো মা?
হ্যাঁ বাবা, অনেক দিন পর একটা জোশ ঘুম দিলাম। এক ঘুমে রাত পার। আর একটু ঘুমাতে পারতাম, কিন্তু কিসের একটা শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। বিছানা থেকে উঠে তোমাদের ঘরে যেয়ে দেখি তোমরা নেই। তারপর বুঝতে পারলাম তোমরা বারান্দায়। তাই আর ঘুমালাম না। বলো কী বলতে চাও। সিরিয়াস কিছু?
না রে মা, সিরিয়াস কিছু না।
তাহলে বলো।
মা রে আমরা মানুষগুলো বড়ই অদ্ভুত তাই না?
জাকিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়াল।
মহান আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামিন মানুষকে তাঁর সৃষ্টির সেরা করে এবং তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর করে বানিয়েছেন তাই না রে মা?
জাকিয়া মাথা নাড়াল।
তিনি কাউকেই পৃথিবীতে একা পাঠাননি। হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর তাঁর একাকিত্ব দূর করতে আল্লাহ্ মা হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। পরে ঘটনাক্রমে আল্লাহ্ একসাথেই তাঁদের দুনিয়াতে পাঠালেন, তাই না রে মা?
জাকিয়া মাথা নাড়াল। জাকিয়া জানে তার বাবা তাকে কী বলবে। তারা তাকে না জানালেও তাদের কাজের বুয়া মরিতন তাকে গতকাল অফিস থেকে ফিরার পরে জানিয়েছে। মরিতন তার বাবা-মায়ের কথা শুনতে পেয়েছে। মরিতন যে শুনেছে তার বাবা-মা জানে না। জাকিয়াও মরিতনকে নিষেধ করেছে, এই বিষয়ে কারো সাথে আলোচনা না করার জন্য।
জাকিয়া অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবা ফরহাদ সাহেব কখন, কীভাবে ধর্মতাত্ত্বিক বিষয় থেকে তার বিয়ের বিষয়ে আলোচনা শুরু করবে।
তুই সারা পৃথিবীজুড়ে এমন একটা প্রাণী দেখবি না, যার সঙ্গী নাই। সবার একজন করে সঙ্গী আছে। সঙ্গী ছাড়া কেউ একা একা চলতে পারে না। জীবজগৎ থেকে শুরু করে মানুষের ক্ষেত্রেও এই প্রথা প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামিন সবার জন্য একজন করে সঙ্গী তৈরি করেই প্রত্যেক মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আমার কথা কি তুই বুঝতে পারছিস?
পারছি বাবা।
(চলবে)