প্রধান সংবাদসাক্ষাৎকার

লেখকদের চিন্তা শক্তি বাড়াতে পড়তে হবে: কানিজ কাদীর

কানিজ কাদীর। পেশায় একজন চিকিৎসক। জন্ম টাঙ্গাইল জেলায়। শিক্ষিত ও সাহিত্যিক পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই গান, গল্প, কবিতার প্রতি ছিল তাঁর প্রচন্ড ভালোলাগ। কিছু লেখালেখি করেছেন। লেখকের বেশ কিছু চিকিৎসা বিষয়ক লেখা, গল্প ও কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। লেখকের লেখা এ পর্যন্ত ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কবিতার বই ‘মন’ ‘স্নিগ্ধ ভালোবাসা চাই’ এবং ‘ শব্দটি ভাষা পেল’। আত্মউপলব্দিমূলক লেখা নিয়ে ‘ অনুধাবন’ এবং স্মৃতি কথামূলক ছোট গল্প ‘টুকরো কথা’ এবং সম্পদনায় বের হয়েছে ‘মায়ের চিঠি’। বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, শিরীন পাবলিকেশন্স, কারুবাক ও পারিজাত প্রকাশনীতে।

কবিতা, লেখালেখি এবং সাহিত্যে ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি লেখক কানিজ কাদীরের মুখোমুখি হয়েছিল
জাতীয় দৈনিক অনলাইন পত্রিকা ‘চিত্রদেশ’। লেখক তার কবিতা ও সাহিত্য ভাবনাগুলো বলে গেছেন অকপটে। তারই কিছু অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো চিত্রদেশের পাঠকদের জন্য

সাক্ষাতকার নিয়েছেন- শেখ লাভলী হক লাবণ্য

চিত্রদেশ: আপনি কবে থেকে লেখালেখি করেন?

কানিজ কাদীর: বেসিক্যালি আমি অনেক আগে থেকেই লেখালেখি শুরু করি। আমি যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করি তখন এবং বিয়ের পর আমি খুব ছোট ছোট ডাইরী মেইন- টেইন করি। আমার যখন যা মনে আসে তখন তাই লিখতাম। এমনকি সারা বছরের প্রতিদিনের লেখাও আমার সেই ডাইরিতে আছে। এখনো আছে। তারপর এমন লিখতে লিখতে, এমনকি কবিতা লিখাও আসতে লাগলো। ২০০৪ কি ২০০৫ সালে আমার মনে হল আরে, আমার মা তো কিছু লিখছে। আমার মা তার কিছু স্মৃতি কথা লিখছেন। আমার ও মনে হলো আমার তো কিছু কবিতা লেখা হয়ে গেলো। কয়েকটা কবিতা জমা হয়েছে। এদিকে আমার মায়েরও কিছু লেখা জমে গেলো। আমার মা আমাকে বলল, আমি মারা গেলে আমার এই লেখাগুলো বই আকারে বের করবা। তখন আমি বললাম , আমার মা মারা গেলে কেন তার বই বের করতে হবে? আমার মার তো খুব ইচ্ছে ছিল সমাজে তার একটা নাম হবে। অবস্থান হবে। তখন আমার মনে হলো তাহলে আমার মা না হয়, সমাজে লেখিকা হিসেবেই নাম করবেন। আম্মার সেই লেখা দিয়েই ২/১ টি বই বের করা যায় কিনা, সেই ব্যবস্থা আমি করতে লাগলাম । সেই অনুযায়ী আমি আমার মায়ের কাছে সেসব লেখাগুলো কালেক্ট করলাম। আম্মা প্রথমে না করলেও আমি নিয়ে এলাম এবং অবশেষে আমার মায়ের লেখা প্রথম স্মৃতিচারণমূলক বই ‘গোধূলী বেলায় জীবনের প্রতিচ্ছবি’ নামে বইটি ২০০৮ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হলো।

চিত্রদেশ: বইমেলায় এ পর্যন্ত আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে?

এবারের একুশে বইমেলায় লেখকের আত্মউপলব্ধি মূলক বই ‘অনুধাবন’ এবং কবিতার বই ‘মন’ প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ এবং কারুবাক প্রকাশনী থেকে।

কানিজ কাদীর: বইমেলার এ পর্যন্ত আমার ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আর একটি বই মানে আমার মায়ের লেখা একটি বই আমি সম্পাদনা করেছি । আমার প্রথম কবিতার বই ‘স্নিগ্ধ ভালোবাসা চাই’ পারিজাত প্রকাশিত থেকে বের হয়েছে। দ্বিতীয় বই হলো আমার সম্পদনায় ‘মায়ের চিঠি’। এটাতে আমার মায়ের সংগ্রহে বিভিন্ন সময়ে উনার লেখা অনেক চিঠি ছিল তখন আমার মনে হলো আমার মায়ের এসব চিঠিগুলো নিয়ে তো একটা বই বের করা যেতে পারে। সেই চিন্তা থেকে আমার মায়ের ‘মায়ের চিঠি’ নামক বইটি সম্পাদনা করা। সেটাও একই প্রকাশনীতে থেকে প্রকাশ হয়েছে। তারপর আমার তৃতীয় কবিতার বই বের হলো ‘ শব্দটি ভাষা পেল’ যেটা শিরীন পাবলিকেশন্স থেকে বের হয়েছে। তারপর বের করলাম। স্মৃতি কথামূলক ছোট গল্প ‘টুকরো কথা’। যেটা ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে বের হয়েছে। এছাড়াও এবারের একুশে বইমেলায় কবিতার বই আত্ম উপলব্ধি মূলক লেখা নিয়ে ‘অনুধাবন’ প্রকাশিত হয়েছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ ‘মন’ বের হয়েছে কারুবাক প্রকাশনীতে।

চিত্রদেশ: আপনার লেখা কোন বইটি আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ লেখা বলে মনে হয়?

কানিজ কাদীর : একজন লেখকের সব লেখাই তাঁর কাছে প্রিয়। তবে মানুষ মনে রাখে এমন বই কি লিখতে পেরেছি? আমার লেখা উপলব্ধি মূলক বই ‘অনুধাবন’ বইটি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়।

চিত্রদেশ: আপনিক কোন ধরনের পাঠকদের কথা মাথায় রেখে বই লেখেন?

কানিজ কাদীর: আমি সব ধরনের পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই বই লিখি। তবে তরুণ প্রজন্মদের কথা একটু বেশি প্রাধান্য দিই। আমার উদ্দেশ্য হলো আমার লেখা পড়ে যেন এই প্রজন্মের তরুনরা ভালো কিছু অর্জন করতে পারে।

চিত্রদেশ: কার অনুপ্রেরণায় আপনার লেখালেখিতে আসা?

কানিজ কাদীর: আসলে আমাদের পরিবারটাকে লেখক পরিবার বলা চলে। আমি একটা লেখালেখির আবহেই বড় হয়েছি। লেখালেখিতে আমাদের পরিবারের সবাই অভিজ্ঞ বলা চলে। আমার মা-বাবা, ভাই- বোনেরা, আমার নানী, মামা-খালারা, ফুফুরা- চাচারা। আমি ছোটবেলা থেকে তাদেরকে দেখে এসেছি উনারা সবাই লেখালেখি করতেন। আমার নানা ওই সময় লেখালেখি না করলেও উনি প্রচন্ড জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। এবং আমার নানী এতো গল্প আমাদের কে বলতেন। উনার মামা ছিলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ। যার অনুপ্রেরণা উনি পেয়েছিলেন। সেই সূত্রে আমার মামা-খালারাও লেখালেখি করতেন। উনারা গান ,গল্প, কবিতা ভালবাসতেন। তাদের জন্য আমরা ছোটবেলা থেকেই একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছি। তারা খুব শিল্পমনা ছিলেন। আমার মা ও দেখি খুব লেখালেখি করতেন। মার অনুপ্রেরণা এবং নিজস্ব একটা চেতনা ও তৈরি হয়ে গেছে অটোমেটিক। যার জন্য আমি লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। ভিতর থেকে কিছুটা তাগিদ ও অনুভব করতাম। যে আমাদের কিছু করা উচিত কেন লিখব না। সেই অনুভূতি থেকেই আমার লেখাগুলো তৈরি হয়ে গেলো।

চিত্রদেশ: আপনি কোন ধরনের বই লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?

কানিজ কাদীর: আমি প্রতিদিনের ঘটনাই হয়তো আমি যা দেখছি। আমার মনে হলো এই ধরনের ঘটনা থেকেও তো একটা বই হতে পারে। আমি নিত্যদিনের ঘটনা থেকে আমি একটা কিছু খুজেঁ আনার চেষ্টা করি। সমাজকে একটা মেসেজ দিতে চেষ্টা করি। তো সেটা দিয়েই হয়তো দেখা গেল আমার একটা গল্পই লেখা হয়ে গেল। সেটা হতে পারে কোন মনে রাখার মত স্মৃতি। অথবা প্রাত্যহিক কোন ইস্যু নিয়ে গল্প লিখে ফেললাম।

চিত্রদেশ: আপনার প্রিয় লেখকদের নাম বলুন? কোন কোন লেখকদের লেখা পড়তে আপনি পছন্দ করেন?

কানিজ কাদীর: রবীন্দ্রনাথ, নজরুল উনারা দুজন তো খুবই প্রিয়। এছাড়া হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হকের লেখাও আমার খুব ভালো লাগে।

চিত্রদেশ: এমন একটি বইয়ের নাম বলুন? যে বইটি বারবার পড়তে মন চায়?

কানিজ কাদীর: আনিসুল হকের ‘মা’ বইটি।

চিত্রদেশ: ডিজিটাল যুগের তরুনদের বিষয়ে একটি অভিযোগ রয়েছে যে, তারা তেমন একটা বই পড়ে না। একজন লেখক হিসেবে আপনার কি মনে হয়? এই প্রজন্ম এই বই বিমূখ কেন? সেটা কি লেখকদের কোন ব্যর্থতা?

কানিজ কাদীর: বর্তমান যুগের তরুনরা তেমন বই পড়ে না এটা আমিও মনে করি। তারা প্রযুক্তির কল্যানে সবকিছুই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন মিডিয়া ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। বই পড়ার সময় তাদের হয় না। বর্তমান প্রজন্ম একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি অন্য বই পড়াকে প্রাধান্য দেয় না। তারা মিডিয়ার সাথে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে গভীর রাত পর্যন্ত। তারা থাকে ক্লান্ত। তারা অন্যান্য আনন্দ উল্লাস নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। বই পড়বে কখন। বই পড়াকে তারা বাহুল্য মনে করে। আমি মনে করি এখানে লেখকদের ব্যর্থতার চেয়ে পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা বেশি।

চিত্রদেশ: তাদের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কী করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

কানিজ কাদীর: এ বিষয়ে বাবা-মা’দের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সন্তানদেরকে বই গিফট করতে হবে। সেই বই পড়তে বলতে হবে। সন্তানদের কে বাবা-মা’র বুঝাতে হবে বই পড়তে বলতে হবে যে আমাদের ও একটি ইতিহাস আছে। আমাদের দেশেও বড় বড় লেখক আছেন। সেটা তাকে জানতে হবে। আর সেজন্য পড়তে হবে। আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকাত জানার জন্য বই পড়তে হবে। যেমন বিভূতিভূষনের পথের পাচাঁলী বইটি খুব সুন্দর একটি বই। এছাড়া তাদের প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করাতে হবে। এসব থেকে সন্তানদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।

চিত্রদেশ: ডিজিটাল যুগের তরুন প্রজন্মকে বইমূখী করতে কি করণীয় । এক্ষেত্রে লেখকদের কোন ভূমিকা বা দায়বদ্ধতা রয়েছে কি?

কানিজ কাদীর: ডিজিটাল যুগের তরুণরা খুবই মেধাবী । তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিলে তাদের মেধার সঠিক বিকাশ হয়। এজন্য পারিবারিক সচেতনতা ও শিক্ষা প্রথম দরকার। যা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অতীব জরুরি। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইয়ের বাইরে নানানরকম বই পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা ও বই পড়ার জন্য একটা নির্ধারিত সময় থাকা উচিত।

লেখকেদর ভূমিকা বা দায়বদ্ধতা তো থেকেই যাায়। লেখকদের সব ধরনের পাঠকদের কথা চিন্তা করেই লেখা উচিত। তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে, নিজের ভেতর চেতনা তৈরি করতে লেখকদের লেখার মান অবশ্যই উন্নত হওয়া উচিত। তরুন প্রজন্ম যাতে লেখকদের লেখা পড়ে কিছু শিখতে পারে, মানুষকে ভালোবাসতে পারে, পরিবারকে ভালোবাসতে পারে, এ পৃথিবীর প্রতি তাদের একটা আলাদা মায়াও দায়িত্ববোধ তৈরি হয়।

চিত্রদেশ: নতুন লেখকদের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

কানিজ কাদীর: নতুন লেখকদের বিষয়ে আমার একটাই পরামর্শ সেটা হলো তাদেরকে প্রচুর পড়তে হবে। লেখকরা যদি প্রচুর পড়ে তাহলে লেখকদের এমনিতেই লেখার একটা উপাত্ত তৈরি হয়ে যাবে। চিন্তা চেতনা বাড়াতে হবে । লেখকদের চিন্তা শক্তি বাড়াতে পড়তে হবে। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কোন ঘটনার বিশ্লেষণ করতে হবে। বুঝতে হবে।

চিত্রদেশ: বই পড়ার সময় লেখকদের লেখার কোন বিষয়টা আপনাকে আকর্ষণ করে?

কানিজ কাদীর: লেখার বিষয় তো আছে। এছাড়াও একজন লেখকদের লেখার উপস্থাপনা, শব্দ চয়ন, লেখক সহজভাবে উপস্থাপন করছে নাকি জটিলভাবে উপস্থাপনা করছে। এই বিষয়টা আমি খুব পর্যবেক্ষণ করি। আমি একটা লেখার সহজ সরল উপস্থাপনা খুব পছন্দ করি। যে লেখার একটা মাধুর্য ফুটে উঠে এমন লেখাই আমি পছন্দ করি।

চিত্রদেশ: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?পাঠকরা আপনার কাছে কবিতা ছাড়াও অন্য কোন লেখা পাবেন কি?

কানিজ কাদীর: ভবিষৎ পরিকল্পনা সব লেখকেরই থাকে। তাছাড়া একজন লেখক সবসময়ই কোন না কোন বিষয় নিয়ে লিখতে চায়। হ্যাঁ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর কিছু লেখার ইচ্ছে আছে আমার। কবিতা ছাড়াও অন্য লেখাও আমি লিখেছি। ‘টুকরো কথা’ ও ‘অনুবাধন’ নামক দুটি বই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

চিত্রদেশ: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

কানিজ কাদীর: আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।

 

 

Related Articles

Back to top button