
বাথরুমে ৫ ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলেন ওবায়দুল কাদের
ডেস্ক নিউজ:
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে বিগত প্রায় ১০ মাস লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মুখ খুলেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়ালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রথম সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের উত্তাল জুলাইয়ের সেই সংকটাপন্ন সময় নিয়ে কথা বলেছেন। এতে তিনি বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যাচার করেছেন।
আওয়ামী লীগের তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ৭৩ বছর বয়সী এ নেতা দেশের রাজনীতিতে বরাবরই অত্যন্ত বিতর্কিত ও সমালোচিত। ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত। তবে দলটির উত্থান-পতনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। দ্য ওয়ালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘মৃত্যুর মুখ’ থেকে ফিরে আসার ঘটনাসহ তাকে নিয়ে নানা সমালোচনার ‘উত্তর’ দিয়েছেন। এ নেতা দ্য ওয়ালকে জানান, জীবন বাঁচাতে তিনি পাঁচ ঘণ্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন!
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের দিন সস্ত্রীক এক পরিচিতের বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম। আমার বাসায় তখন হামলা শুরু হয়ে গেছে। সেই সময় যে বাসায় উঠি, সেখানেও হামলা, লুটপাট শুরু হয়ে যায়। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে একপর্যায়ে বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলাম। এরপর হামলাকারীরা বাথরুমে খোঁজ করতে চাইলে বেরিয়ে আসি। স্ত্রীকে বলি যা হওয়ার হবে, ওদের ঢুকতে দাও। সাত-আটটা হিংস্র ছেলে যখন ঘরে ঢুকে, তখন ভাবিনি বেঁচে থাকব।’
তিনি বলেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাকে চিনতে পেরে ছেলেগুলো বলল, আপনার নেত্রী (শেখ হাসিনা) চলে গেছেন। আপনি যাননি কেন? আমি চুপ ছিলাম। ওদের একদল আমাকে সেনা আর একদল জনতার হাতে তুলে দিতে চাইল। তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। একদল আবার আমার সঙ্গে সেলফি তুলল। কী মনে করে ওরা আমাদের রাস্তায় নিয়ে গেল। ধরে নিয়েছিলাম, জনতার হাতে তুলে দেবে। ওরা সেটা না করে আমাদের পোশাক বদল করিয়ে, মাস্ক পরিয়ে একটা গাড়িতে করে দূরে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চেক করা হচ্ছিল। গাড়ি চেক করতে আসা লোকজনকে ছেলেগুলো বলল, আমাদের চাচা-চাচিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ছেড়ে দাও। এরপর বড় রাস্তা থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী দূরে আর এক জায়গায় চলে যাই।’
এ নেতা বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর ঝুঁকি নিয়ে তিন মাস দেশেই আত্মগোপন করে ছিলাম। দেশে থেকে যাওয়ার পেছনে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল।
তার দাবি, ‘আমি অসুস্থ। বাইপাস সার্জারি হয়েছে আগেই। অনেক ওষুধ সেবন করতে হয়। একপর্যায়ে আমার ওষুধ সেবন বন্ধ হয়ে গেল। ধরা পড়লে ওষুধ সেবন করা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত। এদিকে, মাথার উপর ১১২টা খুনের মামলা। একের পর এক নেতা ধরা পড়ছেন। তখন অনেকে বললেন, দেশে থাকা ঠিক হবে না। একপর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হই।‘
গণ-অভ্যুত্থান দমনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মাঠে নামানোর প্রসঙ্গে এ নেতা বলেন, ‘আমি কখনও ছাত্রলীগ, যুবলীগকে অভ্যুত্থান দমন করতে পথে নামতে বলিনি। আমার ভাষণের ভিডিওতে দেখবেন, ছাত্রলীগ কথাটাই আমি উচ্চারণ করিনি। আমি দলের সাধারণ সম্পাদক। তারা আমাদের বিটিভি ভবন, সেতু ভবন পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের অফিসে বারবার হামলা করছে। আমি কি চুপ করে থাকব? আমি কি নিজেকে, পার্টিকে, আমার নেত্রীকে বাঁচাব না? সে সময় দলের নেতা হিসেবে আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তিনিও সেটা করতেন’
আওয়ামী লীগ শেষ পর্যায়ে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। এত দীর্ঘ সময় তারা দেশ চালিয়েছে। এত বড় একটি দল। মানুষের এত ক্ষোভ এ দল ও প্রশাসন কেন বুঝতে পারল না? এ প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি একটি আকস্মিক ঘটনা। এটা শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন দিয়ে, শেষ হয় এক দফা দাবি দিয়ে। এটা ষড়যন্ত্র ছিল। এ ক্ষেত্রে ইন্টেলিজেন্সের যে ব্যর্থতা ছিল, সেটা তো মানতেই হবে।’
দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অভ্যুত্থান মোকাবিলা করতে না পারার দায় নিচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে নেত্রী যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে কাজ করেছি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার ভূল-ত্রুটি থাকতে পারে। আই অ্যাম নট ইমিউনড ফ্রম মিসটেকস। মানুষ মাত্রই ভুল করে। এমন তো নয় যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভুল করেন না।’
দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজের কোনো ভুল চিহ্নিত করতে পারেন কী না? এ প্রসঙ্গে কাদের বলেন, ‘চাঁদাবাজি করিনি, কমিশন খাইনি, টাকা নিয়ে দলের পদ দিইনি। এসব ব্যাপারে আমি নির্দোষ। বলতে পারি, আমি কাজ করেছি। আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করতে কমিশন নিইনি। কমিশনের বিনিময়ে কাউকে পদ দেইনি। সেদিক থেকে আমি নিজেরে নির্দোষ বলে দাবি করতে পারি’।
তিনি বলেন. ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ১৫ বছর আগের আর পরের উন্নয়নে দিন আর রাতের মতো পার্থক্য। আমাদের সমালোচনা তারাই করেন, যারা দিনের আলোয় রাতের অন্ধকার দেখেন, আবার ঘোর অমাবস্যাকে পূর্ণিমা বলে দাবি করেন। সমালোচনা করার মতো বিষয় অবশ্যই আছে। সময় হলে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই সব কিছুরই উত্তর আমরা দেব।’
আপনার এতদিনের নীরবতার পেছনের কারণ কি? এটি কি কোন ধরনের শাস্তি? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নীরব ছিলাম। কারণ আমাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। এটা একটি শাস্তি- কিছু লোক আছেন, যারা এসব বলে শান্তি পান। এসব বলার মধ্যে তাদের এক ধরনের সুখানুভূতি আছে। আমাকে তিনবার দলের সাধারণ সম্পাদক করেছেন নেত্রী। এটা তো অনেকের পছন্দ হওয়ার কথা না। আমাদের মতো দলে অনেক প্রতিযোগিতা থাকে। আমি যখন দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলাম, তখনও ছিল। এটা অবাস্তব কিছু নয়। আমাদের মতো দেশে আওয়ামী লীগের মতো মাল্টিক্লাস পার্টিতে এটা স্বাভাবিক।’
তার দাবি, ‘নেত্রীর নির্দেশে নীরব ছিলাম, তিনিই এখন সক্রিয় হতে বলেছেন। আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, তোমাকে এখন কিছু করতে হবে না। তুমি ভালো করে নিজের চিকিৎসা করাও।’
আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে মতবিরোধ প্রসঙ্গে এ নেতা বলেন, ‘এ কামড়াকামড়ি অসুস্থ রাজনীতি। এখনও আমরা দেশের বাইরে। দেশ নিয়ে আমাদের আগে ভাবা দরকার। এখানে বসে পদ নিয়ে কামড়াকামড়ি করলে আমাদেরই ক্ষতি।’
সবশেষে আওয়ামী লিগের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে ওয়ায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিজেদের জায়গা ফিরে পাব, এ নিয়ে শতভাগ আশাবাদী। জনমত সমীক্ষার প্রতিবেদন দেখুন, বেশিরভাগ মানুষ বলছেন, শেখ হাসিনাই ভালো ছিলেন। আগে ভালো ছিলাম।‘
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা নিয়ে ভারত সরকার ছাড়া আর কোনো দেশ প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তাহলে আওয়ামী লীগ কি একঘরে হয়ে আছে? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মোটেই না। আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে কোনো দেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে চাই না।’
সবশেষে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করে এ নেতা বলেন, ‘ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে সেটা দেশে ফিরে বলব। ভারতে বসে বলব কেন? আমার, আমাদের ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে সেটা বলার জন্য আমাদের নেত্রী আছেন। তিনিই দেশে ফিরে দেশবাসীকে বলবেন। এখান থেকে বলা কি ঠিক?’