প্রধান সংবাদ

‘জিয়াকে মেজর থেকে জাতির পিতাই মেজর জেনারেল করেছিলেন’

স্টাফ রিপোর্টার:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জিয়াউর রহমানকে মেজর থেকে জাতির পিতাই মেজর জেনারেল করেছিলেন। অথচ তিনিই জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদের সঙ্গে সব সময় ছিলেন। জিয়াউর রহমানই ছিল মূল শক্তির উৎস এবং সেই বেইমানিটা করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে শোকের মাস আগস্টের শেষ দিনটিতে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর খামারবাড়ির বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে (কেআইবি) অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে জাতির পিতাকে হত্যার নেপথ্য ক্রীড়ানকসহ এদেশে হত্যা ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদের দম্ভভরে বিবিসিতে প্রদত্ত স্বেচ্ছায় ইন্টারভিউ প্রদানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, কর্নেল ফারুক-রশিদ বিবিসিতে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিল সেখানেও তারা স্বীকার করেছে, শুধু তাই নয় অনেক পত্র-পত্রিকাতেও তাদের বক্তব্য এসেছে-জিয়াউর রহমান এই খুনিদের সাথে সবসময় ছিল। এই জিয়াউর রহমানই ছিল মূল শক্তির উৎস এবং সেই বেইমানিটা করেছিল।

অথচ এই জিয়াকে মেজর থেকে জাতির পিতাই মেজর জেনারেল করেছিলেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘৭৫ এর পর যারা অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেখানে তার দলেরও যেমন বেইমান, মোনাফেক, মীরজাফর ছিল-খন্দকার মোস্তাক গং আর তাদের শক্তিটা ছিল জিয়াউর রহমান।

প্রধানমন্ত্রী জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার করার কথা উল্লেখ করে বলেন, খালেদ মোশাররফ আহত হয়ে গেল এবং জিয়াকে সেক্টর কমান্ডার করা হয়েছিল। কিন্তু সে কখনো পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুলি চালিয়েছে এরকম কিন্তু কোনো নজির নাই। এরকম কোনো নজির কেউ দেখাতে পারবে না।

দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারি বিদেশি শক্তির মদদে স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত এখনও অব্যাহত থাকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধী, পরাজিত শক্তি এবং ১৫ আগস্টের খুনি, ফাঁসি যাদের হয়েছে তাদের ছেলে-পেলে, যুদ্ধাপরাধীদের দোসর এবং বংশধররা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, যে আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল তাদের মধ্যে কেউ এদের মদদ দিয়ে থাকে। কাজেই এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে।

সরকার প্রধান বলেন, এই বাংলাদেশে ১৫ আগস্টের যে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে এবং এরপর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, আমার জীবনের ওপর বহুবার হামলা, ‘৭৪ সালে কামালের (শেখ কামাল) ওপর হামলা হলো। তাকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা হলো যখন দেখল সে বেঁচে গেছে। তার নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হলো। অর্থাৎ পরাজিত শক্তি সবসময়ই এক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল।

অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব এবং ১৫ আগস্টের শহিদদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমান এমপি।

ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সভাপতিত্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের বাৎসরিক প্রকাশনা ‘জন্মভূমি’ এবং ‘জয় বাংলা’ ম্যাগাজিনের (দ্বিতীয় সংস্করণ) মোড়ক উন্মোচন করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জন সেই মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবসময় ছাত্ররাই করেছে। তারাই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।

জাতির পিতার অমোঘ বাণী ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’ উল্লেখ করে তিনি তা সকলকে মনে রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, বাধাবিঘ্ন আসতেই থাকবে। কিন্তু সৎ পথে থাকলে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং আদর্শ নিয়ে যদি চলা যায় তাহলে যে কোন কঠিন পথ পাড়ি দিয়েও অবশ্যই সাফল্য অর্জন করা যায়। তবে, এটাও ঠিক সত্যের পথ সবসময় কঠিন হয়। আর সেই কঠিন পথকে যারা ভালবেসে গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে পারে তারাই সাফল্য আনতে পারে।

তিনি বলেন, জাতির পিতার নামটা মুছে ফেলতে চাইলেও আজকে ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর নামও সারাবিশ্ব জানে। আর কারো পক্ষে এটা মুছে ফেলা সম্ভব না। সেটা সম্ভব হয়েছে কারণ, আমরা তার (জাতির পিতার) আদর্শ নিয়ে চলেছি, লক্ষ্য স্থির করে চলেছি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকদের হাতে একে একে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তাদের তিন সন্তান এবং দুই পুত্রবধূ, বঙ্গবন্ধুর অনুজ ও ভগ্নীপতি এবং সামরিক সচিব কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে কিছু লোক থাকে সবসময় ক্ষমতাসীনদের পদলেহনকারী। এই চাটুকারের দল সব সময় নিজের দেশের এবং নিজের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। সব সময় আঁতাত করে আমাদের দেশের সর্বনাশ করেছে। যে জন্যই ‘৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন স্থানীয় দালাল চক্র এবং পাকিস্তানী বাহিনীর দোসররা কোনদিন চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। আর তারপর যখন বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করল এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরাজিত হলো তখন সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই তারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড করেছিল।

আর এর পরেই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামটা চিরতরে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল। একটা মাত্র টিভি চ্যানেল এবং রেডিওতে এবং স্কুল কলেজের পাঠ্য বইয়ে বিকৃত ইতিহাস প্রচার শুরু হলো। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনাসহ সবকিছু ধ্বংস করা হয়েছিল। ভাবখানা এমন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি আবার পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল এবং সেইসব পাকিস্তানীরা আবার আমাদের ওপর এসে খবরদারি করবে-এটাই যেন আকাঙ্ক্ষা ছিল, বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, মেধাবী ছাত্রদের অস্ত্র, মাদক ও অর্থ তুলে দিয়ে বিপথে নিয়ে গেছে জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে হুমকি দিয়েছিল, আওয়ামী লীগকে মোকবিলা করতে তার ছাত্রদলই যথেষ্ট। তিনিও ছাত্রদলের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা কোনো কাজ অধরা রেখে যাননি। সব কাজের ভিত্তি তিনি প্রস্তুত করে গেছেন। যখনই এই পরাজিত শক্তি দেখল আর বাংলাদেশকে বাধা দিয়ে রাখা যাবে না তখনই কিন্তু ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা।

তিনি বলেন, সেই কথা মনে রেখেই কিন্তু আমাদের পথ চলতে হবে যে আমাদের পায়ে পায়ে শত্রু আছে, পদে পদে বাধা আছে, আমাদের চলার পথ মসৃণ না, কণ্টকাকীর্ণ। আমাদের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যেতে হবে এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে আজকে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, আমার দেখা নয়া চীন ও গোয়েন্দা ডায়েরী সাত খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাস এবং অনেক সত্য বেরিয়ে আসে।

সরকার প্রধান বলেন, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন, বাংলাদেশ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের বইগুলো সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথম প্রকাশিত এমন একটি গ্রন্থ যা কারো বিরুদ্ধে করা গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে, জাতির পিতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত। ছাত্রলীগের প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে তিনি বইগুলো পড়ার আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গমাতার অবদানের কথাও আলোচনায় তুলে আনেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। আর তার পাশে থেকে সবসময় প্রেরণা দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন আমার মা’ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

মায়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, আমার মা ছাত্রলীগ সংগঠনকে গড়ে তোলায় দিকনির্দেশনা দিতেন। আর্থিক সংকট দেখা দিলে নিজের হাতের গয়না বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন। সব সময় আমাদের পরিবারের উপর গোয়েন্দা নজরদারি ছিল। আমার মা এত সূক্ষ্মভাবে কাজগুলো করতেন, গোয়েন্দারা টেরই পায়নি।

প্রধানমন্ত্রী পড়াশোনার পাশাপাশি দেশ ও জনগণের কাজে ছাত্রলীগকে মনোনিবেশ করার নির্দেশ দেন এবং মহামারির সময় দেশের জনগণের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

লাশের দাফন-কাফন থেকে শুরু করে অসুস্থদের জন্য অক্সিজেন, ক্ষুধার্ত জনগণের জন্য খাদ্য সরবরাহ এমনকি কৃষকদের গোলায় ধান তুলে দেওয়ার মাধ্যমে কোন কাজই যে ছোট নয় তারা তা প্রমাণ করেছে এবং এভাবেই মানবসেবার মধ্যদিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা তারা অর্জন করবেন বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জাতির পিতার যে ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের যে আত্মত্যাগ তা কখনও বৃথা যেতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশকে গড়ে তোলার জন্য তোমাদের (ছাত্রলীগ) নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে।

‘৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসকরা জনগণকে অবহেলা করেছিল স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এই জনগণের জন্যই আমাদের রাজনীতি। ওই যে গ্রামে যে মানুষটা পড়ে আছে তাদের জীবন মানটা উন্নত করাই আমাদের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সংগঠন করতে হবে, তৈরি থাকতে হবে এবং মানুষের পাশে থাকতে হবে।

চিত্রদেশ//এফটি//

Related Articles

Back to top button