কানিজ কাদীরের ছোট গল্প ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’
গত বুধবার ২৪-৪-২০১৩ সকাল ৯টার দিকে সাভারে রানা প্লাজার ৯ তলা ভবন ধসে পড়েছে। কি সাংঘাতিক বিপর্যয়। নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে শত শত শ্রমিক। ভবনের তলে চাপা পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক অনেক অনেক শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে। সারা দেশের মানুষ যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে এ ঘটনায়। হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক।সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, আনসার, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী দল, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রেড ক্রিসেন্টের সদস্য, মহিলা কর্মী, কিশোর ছেলেপেলে, নানা পেশার লোক ও সাধারণ জনগন জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়ে উদ্ধার করেছে মৃত, অর্ধমৃত ও জীবিত লোকদের। কাউকে হাত কেটে পা কেটেই বের করা হয়েছে। সরবরাহ করা হয়েছে অক্সিজেন, পানি, পাখা, জুস, নানা খাবার। কেউবা দিয়েছে টর্চ লাইট, কাপড় ইত্যাদি। ইতিহাসের এক ভয়াবহ বিপর্যয় এই রানা প্লাজার এই নয়তলা ভবন ধসে পড়ার দুর্ঘটনাটি। সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে এত বড় বিপর্যয়ের পরেও প্রায় আড়াই হাজার মানুষ জীবিত উদ্ধার হয়েছে। দুর্ঘটনার ছয় দিন পরেও প্রায় আড়াই হাজার মানুষ জীবিত উদ্ধার হয়েছে। মৃতদেহ পাওয়া গেছে চারশোর উপরে। আটদিন পরেও ধ্বংসস্তুপ থেকে মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। বিপর্যয়ের প্রথম দিন থেকেই টেলিভিশনের প্রতিটা চ্যানেল লাইভ উদ্ধার কাজ দেখাচ্ছিল । শ্বাসরুদ্ধকরদৃশ্য। প্রথম দিন থেকেই জনগণ এই ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করছিল অনেক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে। এই বুঝি জীবিত কাউকে পাওয়া যাবে। জনগণ উপচে পড়ছিল ধ্বংসলীলার কাছে। উদ্ধার কাজে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিচ্ছিল অনেকেই । সেনাবাহিনীর লোকজন মাইকিং করে জনগণকে উদ্ধার কাজ ভালোভাবে করার জন্য সহায়তা করার জন্য বলছিল।
টেলিভশনের সময় চ্যানেলে কোনো একজনের মোবাইলে ধারণ করা ঠিক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তটি দেখাচ্ছিল। আমি দেখে শিউরে উঠলাম। এ যেন কিয়ামতের কিয়দংশ দেখছিলাম। মানুষজনের ছুটাছুটি, ভবনটি ধ্বসে পড়া, নারী-পুরুষের গগনবিদারী আর্তচিৎকারে চারদিক যেন প্রকম্পিত হচ্ছিল। ভিতরের মানুষগুলোর এই আর্তচিৎকার ও ভয়াবহ পরিস্থিতি কি এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ওদের নিয়ে যাচ্ছিল তখন, ওরা তখন কতটা অসহায়, কতটা নিরুপায় ছিল এটা ভাবলেই বুুকের ভিতর এক বিরাট বাকরুদ্ধকর চাপা কষ্ট টের পাচ্ছিলাম। আর জীবিত মানুষগলো ঐ অন্ধকারে ইট, সিমেন্টের বিশাল স্তূপের নিচে চাপা পরেও যখন হৃদস্পন্দন টের পাচ্ছিল ওরা না পারছিল বের হতে না পারছিল মরে যেতে। কতটা কষ্ট নিয়ে জীবিতরা ঐ ধ্বংসস্তূপের নিচে তিনচার দিন পর্যন্ত বাঁচার আকুতি নিয়ে বেঁচে ছিল।
আল্লাহতায়ালা যাদের হায়াত রেখেছেন তাঁরা শত কষ্টে, শত বিপর্যয়ের পর হাত-পা কাটার যে তীব্র যন্ত্রণাও তাদেরকে সহ্য করতে হয়েছে শুধু এই যে মূল্যবান জীবন তা বাঁচানোর জন্য। হায়রে জীবন! কতটা প্রিয় আমাদের এ জীবন। আর এই জীবিত মানুষগুলো যতদিন বেঁচে থাকবে একটা ভয়াবহ তীব্র কষ্ট ও দুঃস্বপ্নের যাতনা নিয়ে বেঁচে থাকবে আর প্রতি মুহূর্তে শিউরে উঠবে এই অন্ধকার ভারী মৃত্যুপুরীর দৃশ্য যখন চোখের সামনে ভেসে উঠবে। আর যারা মারা গেছেন তাদের মা, বাবা, ভাইবোন, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনের যে করুণ আকুতি আমরা দেখেছি তার কি কোনো সান্ত্বনা আমাদের জানা আছে? কেউ কেউ তো তাদের স্বজনদের মৃতদেহও পায়নি। তারা শুধু করুণ আকুতি জানাচ্ছিল যেন তাদের স্বজনদের মৃতদেহটা অন্তত তাদেরকে দেয়া হয়।
এ সময় সরকারের পদক্ষেপ অনেক প্রশংসনীয় ছিল। প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অন্যান্যা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রীও এ অবস্থায় যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিছু ডাক্তার , স্বেচ্ছাসেবীদল, সাধারণ জনগণ বিশেষ করে কিশোর যুবক শ্রেণী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছে। সেনাবাহিনী বিশাল সুরঙ্গপথ করে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছিল কারণ ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে ভিতরে যারা জীবিত আছে তাদেরকেও উদ্ধারে সমস্যা হতে পারে। অবশেষে ছয় দিনের দিনে শাহিনা নামে কুষ্টিয়ার এক মেয়েকে জীবিত বের করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সুরঙ্গপথে আগুন লেগে যায়। উদ্ধারকর্মীরা কোনো রকমে প্রাণ বাঁচায়। শাহিনার বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা ছিল। তার বুকের সামনের অংশ ধ্বংসস্তুূপে আটকে ছিল। উদ্ধারকর্মীরা তার স্তন কেটে তাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, ‘আমার দেড় বছরের বাচ্চা তো তাইলে বুকের দুধ খেতে পারবে না।’ কতটা ইচ্ছা ছিল তাঁর বাঁচার। অবশেষে সে আগুনের ধোঁয়ায় সম্ভবত দম বন্ধ হয়েই মারা গেছে। কারণ পরদিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করার সময়ও তার শরীর নাকি তাজা ছিল। শাহিনাকে বাঁচাতে যেয়ে আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে যে উদ্ধারকর্মী তোফাজ্জল তার শরীরের খানিক অংশ পুড়ে গিয়েছিল। পরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। সাভার রানা প্লাজার এ দুর্ঘটনা দেখে মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের উপরে খুবই অসন্তুষ্ট । তাই এই দুর্নীতিবাজ, দুষ্ট লোকদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য আল্লাহতায়ালা এই নিরীহ মানুষগুলোকে নিয়ে গেলেন। তাও কি হয় শিক্ষা, হয় কোনো পরিবর্তন? হয় কি কোনো অনিয়মের সংশোধন? এর আগেও তো তাজরীন গার্মেন্টেসে আগুন লেগে কত প্রাণ গেল। আরো কত গার্মেন্টেস এ আগুন লেগেছে। হয়েছে কি তার সুরাহা? এ প্রশাসন কেমন! প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, দুর্নীতি। এই ভবনটির অবৈধ অনুমোদন যারা দিয়েছে তাদেরকে গ্রেফতারসহ এ ভবনের মালিক ও গার্মেন্টেস মালিক সোহেল রানার চরম শাস্তি দিতে হবে। কিছু খারাপ লোক আমাদের সমাজের জন্য দুষ্ট গ্রহের মত। এসব পাপী, স্বার্থান্বেষী লোক নিজে আখের গোছাতে যেয়ে আমাদের এত সুন্দর দেশটাকে করেছে কলঙ্কময়। এ সমাজে কি শুধু এসব খারাপ লোকেরই বসবাস! না এখানে আছে মানুষ নামের অনেক মানুষ। এখানে আছে অনেক অনেক ভালো মানুষ। এরা মানুষকে ভালোবাসে আবার মানুষের বিপদে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এগিয়ে যায় সাহায্য করতে। এমনি ঘটনা ঘটেছে রানা প্লাজা ধ্বসের উদ্ধারকর্মীদের বেলায়। তারা এই উদ্ধারকার্যে এতটাই শ্রম, এতটাই সময় দিয়েছ যা বিস্ময়কর। একটি আঠার বছরের কিশোর নাকি একটি ছোট সুরঙ্গেও মতো জায়গা দিয়ে ধ্বংসস্তুপের ভেতর ঢুকে জীবিত ও মৃতদের খোঁজখবর নিয়ে আসত। আর জীবিতদের খাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করেছে। সত্যিই কিশোরটির সাহসের প্রশংসা না করে পারি না।
বারো দিন পরও সাভার ধ্বংসলীলা থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব মৃতদেহের গলিত, বিকৃত চেহারা দেখে শনাক্ত করা মুশকিল। অনেক স্বজন তাদের আত্মীয়ের লাশটি পাবার অপেক্ষায় আছে। লাশগুলো এখন ডিএনএ পরীক্ষা করে শনাক্ত করা হচ্ছে। ধ্বংসস্তুপ থেকে ১৭ দিন পরে বিস্ময়করভাবে উদ্ধার করা হলো পোশাকর্মী রেশমাকে । তার নাম দেয়া হলো ‘বিস্ময়কন্যা’। ১৭দিন পর, ৩৯১ ঘন্টা ৩০মিনিট পর ১০ মে শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটায়। আটকেপড়া ভবনের ভিতরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শুকনো খাবার ও বোতলের পানি খেয়ে জীবন্ত কবরবাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর তরুণী রেশমা বললেন, ‘শরীরে অনেক ব্যথা। আমি খুব কষ্ট করেছি। আমি এখন ভালো আছি।আমার খুব ভালো লাগছে।’ সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট রাজ্জাক সাহেবের চোখে পড়ে একটা ফুটো দিয়ে নড়তে থাকা স্টিলের রূপালী সরু রড।
ফুটোর মুখে সুরকি, বালু আর জঞ্জাল। একটু সরাতেই জ্বলজ্বল দুটি চোখ দেখে আঁতকে উঠেন। কানে আসে একটি মেয়ের বাঁচার আকুতি। তৎক্ষণাৎ শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। প্রথমেই মেয়েটিকে ফুটো দিয়ে জুস, পানি ও বিস্কুট দেয়া হয়।
সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে নিহত মানুষের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে প্রাকৃতিক দুযোর্গ বা সন্ত্রাসী হামলা ছাড়া ভবন ধসে প্রাণহানির সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ। রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। এর ভিতর অনেকে আরেকটা প্রাণ বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়েছে নিজের প্রাণের, পরিশ্রম করেছেন দিন-রাত। তাদের অনেকের কথা আমরা জানি, অনেকের কথা জানি না, অনেকের কথা হয়তোবা কোনোদিনও জানবও না। এই সব স্বেচ্ছাসেবী সত্যিই গেয়েছে মানবতার জয়গান। তারা সত্যিই প্রমাণ করেছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এই পৃথিবীতে মানুষ নামের শ্রেষ্ঠ জীব শুধু একটাই আছে। এই মানুষের উপর নির্ভর করেই মানুষ বাঁচে। মানুষই মানুষকে হিংসা করে, ক্ষতি করে আবার মানুষই মানুষকে ভালোবাসে। এই পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। তা না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে বলেই মানবতা জেগে আছে। তাই আবারো বলতে চাই চন্ডিদাসের সেই বিখ্যাত উক্তি-‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
লেখক: কানিজ কাদীর