গল্প-কবিতা

প্রেম, প্রকৃতি এবং পরাবাস্তব নিয়ে লিখে চলেছেন কবি ‘সেলিমুজ্জামান’

সেলিমুজ্জামান। কবি এবং আবৃত্তিকার। পেশায় প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী।  জীবন ও তার চারপাশের যাবতীয় বিষয়কে যিনি কবিতা করে তুলতে পারেন। সেলিমুজ্জামান কবি এবং কবিতার ভেতরে নিমগ্ন এক ধ্যানী মানুষ। যার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলি মুক্তছন্দের ওপর ভর করে স্বচ্ছন্দে পাঠকের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। তারপর আলোড়িত করে হৃদয় এবং শেষাবধি তা অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীরবতার ভেতরে, তখনই মুখর হয়ে ওঠে পরিপার্শ্ব, তারা আকাঙ্খার কথা বলে, আঙুল তুলে দেখায় সততা ও ন্যায়পরায়ণতা, আবার কখনো কখনো তার ভালোবাসার মানুষের জন্য তার দীর্ঘ অপেক্ষা। একই সঙ্গে নগর যন্ত্রণা সেই সাথে অপরিকল্পিত নগর রুপায়নের সাথে পরাবাস্তব প্রেম মিশে গেছে তার কাব্যে।

নব্বই দশকের কবি সেলিমুজ্জামানের লিখায় সুনীল, জয় গোস্বামী এবং জীবনানন্দ দাশ দাপটের সাথে রাজত্ব করছেন।
গতানুগতিক যাত্রার বাইরে তিনি তার কবিতায় জীবনবোধকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখাতে চেয়েছেন।

এবারের একুশে বইমেলায় আসছে তার চতুর্থ কাব্য গ্রন্থ ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’। এ পর্যন্ত তার লেখায় প্রকাশিত কবিতার বই বের হয়েছে তিনটি। প্রথম কাব্য গ্রন্থ-‘তুমি এক অদ্ভুত হেমলক’ (২০০৮) দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘জলপদ্মের কাছে ঋণী’ (২০০৯) তৃতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘স্বপ্নের তৃতীয় প্রহর’। ‘ ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’ তার চতুর্থ কবিতার বই।

কবিতা, কবিতায় জীবন যাপন, লেখালেখি, সাহিত্য ভাবনা নিয়েই সম্প্রতি চিত্রদেশ এর মুখোমুখি হয়েছিলেন কবি সেলিমুজ্জামান। তারই অংশ বিশেষ আজ পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছি।

সাক্ষাতকার নিয়েছেন – শেখ লাভলী হক (লাবণ্য)

 

চিত্রদেশ: এবারের অমর একুশে বইমেলায় আপনার কোন বই প্রকাশিত হয়েছে:

কবি সেলিমুজ্জামান: এবারের ২০২০ অমর একুশে বইমেলায় আমার চতুর্থ কবিতার বই ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’। পারিজাত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মূল্য ১৫০ টাকা।

চিত্রদেশ: আপনার ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’-কবিতার বইয়ে কবিতার বিষয়বস্তুু সম্পর্কে পাঠকদের যদি একটু বলতেন?

কবি সেলিমুজ্জামান: : আমার ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’ কবিতার বইয়ের বিষয়বস্তুগুলো একটু অন্যরকম। এখানে প্রেম আছে। তবে এই প্রেমগুলোতে কেমন যেন ঘোর লাগা প্রেম। কোন কোন প্রেম আছে এখানে সমান্তরাল প্রেম। এই প্রেম থেকে কোন ফলাফল আসবে বলে মনে হয় না। যদিও আমার মতে প্রেমের ফলাফল খুজঁতে যাওয়াটা খুব একটা বোকামি। সাধারণত যে প্রেমগুলো আমরা ফলাফল চিন্তা করি সেগুলোর বাইরে আমার কবিতার প্রেমগুলো। কিছু কবিতা আছে সাধারণ মানুষকে নিয়ে, কিছু কবিতা আছে আমার এই প্রিয় শহরকে নিয়ে। শহরের নগরায়ণ নিয়ে। আমি এই শহরে বড় হয়েছি। আমার চোখের সামনে যে নগরায়ণের যে পরিবর্তনগুলো হলো যেগুলো চোখে পড়ে তা নিয়ে। কিছু কবিতা রয়েছে প্রকৃতি নিয়ে। আর আমার প্রিয় কবিদের নিয়ে যেমন আমার প্রিয় কবি জয় গোস্বামী কে নিয়েও ২/৩ টা কবিতা আছে। জীবনানন্দকে নিয়ে কবিতা আছে। আমি সুনীলের চরিত্র যে ‘নীরা।’ আমার কেন যেন মনে হলো খানিকটা ‘নীরা’ কে উনি আমার কাছে রেখে গেছেন তো, সেই ভাবনা থেকে প্রায় ৭টার মতো কবিতা আছে ‘নীরা‘কে নিয়ে। আর আছে আমাদের বুয়েটের আবরার কে নিয়ে। আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল আবরারের কোন প্রেমিকা আছে কীনা। ঐ মুহূর্তে তার অনুভূতিটা কেমন ছিল তা নিয়ে। অনেকটা শহর, নাগরিক, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, প্রেম, প্রকৃতি। একটা ঘোর লাগা সময়। পরাবাস্তব সবকিছু মিলিয়ে আমার কবিতার বই ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’।

চিত্রদেশ : আপনার ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’ কবিতার বইয়ে মোট কয়টি কবিতা স্থান পেয়েছে?

কবি সেলিমুজ্জামান:ঝরা পাতা হয়ে যাব’ কবিতার বইয়ে মোট ৬৩টি কবিতা রয়েছে।

চিত্রদেশ: এই বই থেকে আপনার প্রিয় তিনটি কবিতার নাম বলুন?

কবি সেলিমুজ্জামান: : কবিতা ‘সাহেবরা’ এই কবিতাটা হলো এই শহরে যারা ফুটপাতে রাস্তা কাটে, মাটি কাটে। তারা আমাদের জন্য রাস্তা বানিয়ে চলছে। মাটি কেটে চলছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসে না। তারপর কবিতা ‘দয়া করুন’ এটা জয় গোস্বামী কে নিয়ে লেখা। উনার কবিতা পড়তে গেলে আমার শুধু মনে হয়, আমার অনেক কথা লিখে ফেলেন। এটা একদিকে আনন্দের। অন্য দিকে কষ্টদায়ক। একটা কবিতায় আমি জয় গোস্বামীকে সবিনয় অনুরোধ করেছি যেন উনি এই কবিতাটা না লেখেন। একটা জায়গায় যাবার পর আমার মাথায় চিন্তা ভর করলো বা একটা কবিতা ভর করলো তখন আমার মনে হলো উনি হয়তো এই কবিতা লিখে ফেলেছেন। তো ‘দয়া করুন’ কবিতাটা উনাকে অনুরোধ করে বলা হয়েছে যেন উনি কবিতাটা না লেখেন। সুনীলের ‘নীরা‘র প্রতিও আমার কতগুলো রিকোয়েস্ট আছে ‘নীরা’কে আমি ঈর্ষান্বিত করতে চাই মাঝে মাঝে। অন্য বনলতা নামক আরেকজনের সাথে আমি কথাবার্তা বললাম কিন্তু ‘নীরা’কে ছেড়ে আবার যেতেও পারি না। ‘নীরা‘ কে ঈর্ষান্বিত করা সম্ভব না আসলে আমার পক্ষে। আমার মনে হয় হয়তো রাস্তায় কখনো কখনো দেখা হয়ে যায়। হয়তো রিক্সা দিয়ে যাচ্ছি. . .সে হয়তো রাস্তার ঐ পাড়ে, আমি এই পাড়ে। সে কই যাচ্ছে এটা নিয়েও কবিতা আছে। ‘বছরের শেষদিন’ নামক কবিতা রয়েছে একটি। সেখানে সারাবছরে আমি কি করলাম সে টা লেখা হয়েছে। আরেকটি কবিতা রয়েছে ‘লাল মেঝের বাসা’ আস্তে আস্তে আমাদের জীবন থেকে ‘লাল মেঝের বাসা’ গুলো হারিয়ে যাচেছ। সব টাইলসের বাসা হয়ে যাচেছ। আগের সেই লাল মেঝের বাসাগুলোতে দরজা খোলা থাকতো। ইচ্ছে করলে যে কেউ ঢুকতে পারতো। সেখানে একজন বটবৃক্ষের মত লোক থাকতো। সে সমস্ত বাসাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আর এখন লতাগুল্মের মত পরনির্ভরশীল লোকে ভরে যাচ্ছে। আর রয়েছে ঢাকা শহরের কর্মজীবি মেয়েদের নাগরিক যন্ত্রণা। তারা হোস্টেলে থাকে। একদিন এক সকাল বেলা আমি হোস্টেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। একটি বারান্দায় টবে কিছু গোলাপ, জিনিয়া, ডালিয়াসহ কিছু ফুল ফুটেছিল ওগুলো দেখে আমার মনে হয়েছিল। আজ শুক্রবার তারা এই ফুলগুলো হয়ে ফুটে আছে। কিন্তু বাকি ছয়দিন তারা বেশ কষ্ট করে জীবন যাপন করে। এছাড়া আরেকটি কবিতার কথা না বললেই নয় ‘লাল দেয়াল’ কবিতাটা আসলে আমি যে একধরনের জীবন যাপন করি মাঝে মাঝে, আমি হেরে যাই। পরাজিত হই। অপারগ হই। তখন নিজেকে আমি একটা বৃত্তে বন্দি করি। আমরা সবই হয়তো এটা কম বেশি করি। এই বিষয়টাও আমি কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছি।

কবি সেলিমুজ্জামান

চিত্রদেশ: আপনার ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’ কবিতাগুলো কোন শ্রেণীর পাঠকাদের কথা মাথায় রেখে করেছেন।

কবি সেলিমুজ্জামান: : এই কবিতাগুলো একটু বোদ্ধা শ্রেণীর পাঠকদের জন্য। একটু ম্যাচিউরড পাঠক শ্রেণীর যারা কবিতা নিয়ে চিন্তা করেন। কবিতার মধ্যে যারা জার্নি করতে চান। জাস্ট পড়ার জন্য পড়া না। কবিতার হাত ধরে ঐ রাস্তা ধরে হাটতে চান যিনি। মানে কবিতাটা বুকে ধারণ করতে হবে। একটু গভীর চিন্তার পাঠক হতে হবে সোজা কথা।

চিত্রদেশ: এই কবিতাগুলোর মধ্যে দিয়ে আপনি সমাজে কোন ধরনের মেসেজ দিতে চান?

কবি সেলিমুজ্জামান: খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন আপনি। ম্যাসেজ বলতে আসলে এই নগরায়ণের ম্যাসেজটা। আমাদের নগরটা আর কত ধারণ করতে পারে? একজন মিস্ত্রি আছে মুন্নাফ মিস্ত্রি। সেই প্রায়ই বিভিন্ন বাসায় কাজ করে চলে। যারা হয়তো এক দালান থেকে আরেক দালানে কাজ করে চলে। সেই ম্যাসেজটা । মাটি কাটা শ্রমিকের কথা, যারা নগরের ঝুপড়িতে রাত কাটায়। আবার যারা মিছিলে যায়। আবার মিছিল শেষে বাসায় ফিরে আসে। নেতা যায় নেতা আসে। কিন্তু ওদের ভাগ্যোর উন্নয়ন ঘটে না। বেসিক্যালি শহরের রুপান্তর নিয়ে। কিছু কিছু কবিতায় আবার ঘোর লাগা প্রেম চলে এসেছে। এছাড়াও আমরা বর্তমানে অস্থিন সময় পার করছি। সেটা নিয়েও আমি লিখেছি। এই বইয়ে ‘রুপা’ নামে একটা কবিতা রয়েছে। যেখানে আজ থেকে ২০ বছর আগে সে বলেছিল ছাদে উঠলে নাচ দেখাবে। আমি এখন রাস্তায় রাস্তায় রুপা কে খুজিঁ। কিন্তু রুপা কি আদৌ আছে এখন? এখনকার সময়ে ভালোবাসার সজ্ঞাটাই বদলে গেছে। পুরানো ভালোবাসায় সঙ্গে নতুন ভালোবাসায় তুলনা করা হয়েছে। কারণ এখন মোবাইল, ফেসবুক, ইন্টারনেট কৃত্রিম জিনিসের ভীড়ে, সেই পুরানো ভালোবাসারর সিন্ড্রোমটা বদলে গেছে। সেই সিন্ড্রোম নিয়ে আমার কিছু কবিতা রয়েছে ‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’ কবিতার বইয়ে।

চিত্রদেশ: আপনার এ পর্যন্ত কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে?

কবি সেলিমুজ্জামান: এ পর্যন্ত আমার ৩টি কবিতার বই বের হয়েছে। আমার প্রথম কবিতার বই-‘তুমি এক অদ্ভুত হেমলক’ (২০০৮) দ্বিতীয় কবিতার বই ‘জলপদ্মের কাছে ঋণী’ (২০০৯) তৃতীয় কবিতার বই ‘স্বপ্নের তৃতীয় প্রহর’‘ঝরা পাতা হয়ে যাব’ আমার চতুর্থ কবিতার বই।

চিত্রদেশ: এইযে চারটা কবিতার বই ইতোমধ্যে আপনার প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আপনার কাছে কোন বইটিকে বেস্ট বলে মনেহয়।

কবি সেলিমুজ্জামান: এটা বলা আসলে মুশকিল। কেননা কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার তিনটা সন্তান থেকে কোন সন্তানটা বেস্ট? সেটা যেমন বলা কঠিন। ঠিক তেমনি এটাও বলা কঠিন। তবে আমার প্রথম কবিতার বই ‘তুমি এক অদ্ভুত হেমলক’ বই হিসেবে অনেকটা প্রথম প্রেমের মতো।

চিত্রদেশ: আপনার লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে?

কবি সেলিমুজ্জামান: আমি পেশায় একজন প্রকৌশলী। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। যদিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের লেখালেখিটা আসলে অনেকে অন্যভাবে নেয়। সবাইভাবে তারা তো যন্ত্র, কঠিন একটা বিষয় নিয়ে তারা আবার লিখবে কী? কিন্তু আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই অল্প অল্প করে লিখতাম। দেয়াল পত্রিকায় বা আমাদের ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন বুলেটিনে। এছাড়াও আবৃত্তি, উপস্থাপনার শখ ছিল সেটাও করতাম। এগুলো করেই আমার লেখাটা আরো ডেভেলপ করে। এবং আমি অনেক দিন বিদেশে থাকি, সেখানে দীর্ঘ সময় একা থাকি। আমি সেই সময়টাতে (৯৫-২০০১) বেশ কিছু লিখা লিখতে পেরেছি। আসলে একাকিত্ব থেকে অনেক কিছু লিখা যায়। এরপর আমি যখন দেশে ফিরলাম তখন দেশে এসে আমার সমস্ত পরিবর্তনগুলো চোখে পড়লো। তখন আমি আমার লেখায় কিছু উপজীব্য পাই।

চিত্রদেশ: আপনার কবিতায় কোন কবির প্রভাব পড়ে বলে কী আপনার মনে হয়? মানে আপনি কার কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হোন?

কবি সেলিমুজ্জামান: চমৎকার প্রশ্ন। দুজন কবি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। একজন অবশ্যই জয় গোস্বামী। উনাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করি। জয় গোস্বামী, ঐযে বললাম কবিতা একটা জার্নির মতো। আমার এমনও দিন গেছে, জয় গোস্বামীর একটা কবিতা সাতদিনের মতো পড়েছি। সাত দিন পড়ার পরও আমি কবিতা পড়ার জার্নিটা শেষ করতে পারিনি। যেমন মাটিতে যেমন ছাপচিত্র তৈরি হয় তেমনি আমার মনেও তেমনি ছাপচিত্র তৈরি হয়েছে। আরেকজন তো অবশ্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উনাকে তো একজন লিজেন্ড বলা যায়। দেশভাগ থেকে শুরু করে উনার কবিতায় অসম্ভব শক্তি ধার ছিল। উনার কবিতার বক্তব্যেগুলো আমাকে বারবার নাড়া দিয়েছে। এছাড়া দেশের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ উনাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করি। উনারা কালোত্তীর্ণ কবি।

চিত্রদেশ: উনাদের কবিতার কোন বিষয়গুলো আপনার কাছে ভালো লাগে ?

কবি সেলিমুজ্জামান: সুনীলের কবিতা হচ্ছে ইতিহাসের স্বাক্ষীর মতো। অনেকটা উনার সেই সাতচল্লিশের দেশভাগ যেমন কবিতায় আছে। তেমনি দেশ ভাগ হয়ে গেলো। সবাই খুশি। কিন্তু আমার মা কাদঁছেন । কারণ উনার কামিনী ফুল ফুটবে। উনি দেখে যেতে পারবেন না। এই যে একটা কষ্ট মায়ের, দেশ ভাগের জন্য। কষ্ট টা কিন্তু উনি ধারণ করেছেন। বহুবছর পর উনি ফিরে এসেছে ফরিদপুর জেলায়। সেখানে উনার প্রিয় ছোটবেলার জাম্বুরা গাছটা খুজঁছেন। কিন্তু উনি খুজেঁ পাচ্ছেন না। তো উনার ভিতর এই যে, টানাপোড়েন। দুই বাংলার মধ্যে যে সেতু বন্ধন তৈরি প্রবণতা। সেটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। কবি হেলাল হাফিজের কবিতাগুলোও অসাধারণ শক্তিশালী। উনার কবিতা হলো পড়লে মনেহয় হাতটা মুষ্টিবন্ধি হয়ে যাই। সবসময় একটা অত্যন্ত দৃঢ় সংকল্পের কবিতা লিখেন উনি। আর সৈয়দ শামসুল হক ও অসাধারণ কবি। কিছুদিন আগে উনি যখন ক্যান্সারে রোগ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লিখেছিল। সেই বইটা আমি পড়ছিলাম। আমার মনেহচ্ছিল একজন ক্ষয়ে যাওয়া মানুষের হাত দিয়ে যখন লেখা বের হয়। সেটা যে কত সুন্দর হতে পারে। কতটা টাচি হতে পারে। এটা আসলে তার লেখাগুলো না পড়লে বুঝানো যাবে না। উনার পুরনো ‘নুরুলদিনের সারাজীবন’ এর সনেটগুলো এক কথায় চমৎকার। এছাড়াও রয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। উনার বেশ কিছু কবিতা আমার অসাধারণ লাগে।

চিত্রদেশ: কার অনুপ্রেরণায় আপনার লেখালেখিতে আসা?

কবি সেলিমুজ্জামান: দুইজনের অনুপ্রেরণায়। একজন হচ্ছেন আমার মা। জেবুন্নেসা জামান। আমার মা কবিতা লিখতেন। দূর্ভাগ্যেবশত, উনার কোন বই প্রকাশিত হয়নি। উনি বেগম পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লিখতেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় উনি ২০১৭ তে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। উনি আইসিউতে থাকা অবস্থায়। আইসিউ’র বেডে একটা কবিতা লিখে গেছেন। যখন উনার শরীর একটা যন্ত্র পড়ানো ছিল। যেটা দিয়ে উনি নি:শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছেন। সেই অবস্থায় উনি একটা কবিতা লিখে গেছেন। আরেকজন আমার শ্রদ্ধেয় সেজো মামা । প্রয়াত আখতার আনোয়ার চৌধুরী। উনিও খুব সাবলীল কবিতা লিখতেন। কবি সামসুর রাহমানের সঙ্গে উনার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। উনারা একসাথে কাজও করতেন। এই দুজন মানুষই লিখতেন। তাদের কাছ থেকে আমি মূলত অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমি যখন লেখা শুরু করি। আমার মা ও সেজো মামা আমাকে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন। উনারা আমার লেখাগুলো পড়তেন। অন্যদের দেখাতেন।

চিত্রদেশ: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষৎ পরিকল্পনা জানতে চাচিছ? পাঠকরা আপনার কাছে কবিতা ছাড়াও অন্য কোন লেখা পাবেন কী?

কবি সেলিমুজ্জামান: আমার অনেক ছোট গল্প বা কলাম লেখা রয়েছে। আমি বিভিন্ন সময় দেশে বা দেশের বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। মানুষের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে লিখেছি। আমার ভবিষৎতে ইচ্ছে আছে সেই লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করবো। আরেকটা কাজ করছি আমি। বর্তমানে দুটি চিত্রনাট্য লিখছি। ইচ্ছে রয়েছে চলতি বছরেই আমি চিত্রনাট্যগুলো আলোতে নিয়ে আসতে পারবো।

চিত্রদেশ: আপনি কোন ধরনের বিষয় নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

কবি সেলিমুজ্জামান: প্রকৃতি, প্রেম। প্রকৃতি প্রেমের ভিতর পরাবাস্তবতা। যেটা হলেও হতে পারতো। কিন্তু হয়নি । পরাবাস্তব বিষয়ের প্রতি আমার ভীষণ আকর্ষণ। আমার প্রতি লিখাতেই কম বেশি পরাবাস্তব চলে আসে। ঠিক নিজেও জানিনা কেমন করে এটা আসে। লেখা শেষে দেখতে পাই এখানে এমন একটা কিছু আছে যার আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই। তবে যা হলেও হতে পারতো।

চিত্রদেশ: নতুন লেখকদের জন্য আপনি কিছু বলুন? নতুন লেখকদের লেখাকে পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার জন্য কী করনীয়? তাদের কীভাবে তৈরি হওয়া আসা উচিত বলে মনে করেন?

কবি সেলিমুজ্জামান: নতুন লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে হবে। একটা কিছু ট্রান্সমিট করতে করতে হবে জেনারেশনের জন্য। আমরা একটা অস্থির সময় কাটাচ্ছি। কিন্তুু এটা কি আসলে অস্থির সময়? অস্থির সময় কমবেশি সবসময়ই ছিল। এর মধ্যে ও স্থিরতা আছে। আমরা যদি গভীরভাবে জীবন দর্শনটাকে চিন্তা করি। কি করা উচিত। কি করা উচিত না। আমরা আজকে যে যাপিত জীবনটা শেষ করলাম। সেই জীবনে কতটুকু দিলাম। কতটুকু নিলাম। একটু দেনা পাওনার হিসাবগুলোকে যদি একটু সুক্ষুভাবে করি । এবং সুখের সজ্ঞাটাকে যদি আমরা অন্যভাবে চিন্তা করি বা করতে হবে। পাশাপাশি নতুন লেখকদের একটু পড়াশোনা করতে হবে। আমারদের পূর্ববর্তী লেখদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস । যদি এখনকার লেখকরা না জানে, না পড়ে। তাহলে কিন্তু তাদের হাত দিয়ে প্রাঞ্জল লেখা বের হবে না।

চিত্রদেশ: আমরা জানি আপনি পেশায় একজন প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী। অন্যদিকে একজন কবিও। তো এইযে, আপনি পেশাগত কারণে খুব ব্যস্ত জীবন-যাপন করেন। এর মধ্যে থেকে কোন সময় আপনার লেখলেখির মুড আসে বা আপনি কবিতা লিখার জন্য কোন সময়টাকে বেছে নেন?

কবি সেলিমুজ্জামান: আপনি অনেক দেরি করে অনেক সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছেন। আমি অনেক্ষণ থেকেই এই প্রশ্নটা আশা করছিলাম। আসলে আমি যে কখন লিখবো, সেটাই জানি না। একেবারেই আমি বলতে পারি না। আমার কখনো এমনও হয়েছে, যে আমার রাতে ঘুমের মধ্যে কবিতার কথা মনে এসেছে সেটা হয়তো ঘুম ভাঙ্গার পর মনে পড়েছে। সকালে লিখেছি। কখনো আবার সকালে মনে পড়েছে। আবার দুপুরে লিখেছি। আসলে কোন সময় ঠিক নেই আমার। এ জিনিসটা যেন কেমন! কেমন একটা জিনিস। আমি যেন আমি না। হঠাৎ আমার কাছে মনেহয়। কোন একটা কিছু ভর করলো আমার ভিতরে। কি একটা বের হয়ে আসলো.. .এই হাত আমার না! এই কলম আমার না! এই কাগজ আমার না! আমাকে দিয়ে কেউ যেন লিখিয়ে নিচ্ছে কবিতাটা। লেখাটা যখন শেষ হয়। বিশ্বাস করুন, অদ্ভুত একটা শান্তি লাগে। মনে হয় যেন, আমার ভিতরে একটা সৃষ্টি তৈরি করার যে আকুলতা ছিল সেটা কেটে গেছে। সে সময় অসম্ভব একটা শান্তি লাগে। তখন আমি কিছু সময়ের জন্য চুপ হয়ে যাই। আমার লেখা যখন আমি নিজে পড়ি। আমার কেমন আবেগ তৈরি হয়ে যায়-মনেহয় এটা কি আমার লেখা সত্যি? আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না! তো আসলে আমার লেখার নির্দ্দিষ্ট কোন সময় নেই ।

চিত্রদেশ: লেখালেখি কী আপনার শখ? নাকি পেশা? আসলে কোন তাগিদ থেকে আপনি লেখালেখি করেন?

কবি সেলিমুজ্জামান: খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি একটা ভার বহন করছি। আমরা সবাই তা করছি। ভার বহন করছি। কীসের ভার-জীবনের ভার। কাজের ভার, দায়িত্বের ভার, আমরা সবাই ভারমুক্ত হওয়ার জন্য লিখি। আনন্দে লিখি কিন্তু আনন্দের শেষে এই কথাটিই জরুরি যে, আমি প্রতিদিনকার দৈনন্দিন যে কষ্ট যে ভার বহন করে যাই। এই লেখার মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য আমি অন্য মানুষ হয়ে যাই। সেই অন্য মানুষটাকে আবার আমার এই মানুষটি খুব ভালোবাসে । অন্য মানুষটা হতে পারলে হয়তো আমি সবচেয়ে সুখী মানুষ হতে পারতাম। যেটা কারো পক্ষে সম্ভব না। কক্ষনো সম্ভব না। কিন্তু যতটুকু সময় আমি অন্য মানুষটা থাকি। ঠিত ততটুকু সময়ের অপেক্ষায় আমি থাকি শুধু। আবার এই তেল, চাল, ডালের যে জীবন সে জীবনের বাইরেও একটা জীবন আছে। যে জীবন হয়তো কীর্ত্তণখোলা নদী দেখলে অবাক হয়ে যায়। হয়তো আকাশে একটু সামন্য মেঘ দেখলে অবাক হয়ে যায়। কখনো রবীন্দ্রনাথের মূর্তি দেখলে অবাক হয়ে যায়। একটা শেফালী ফুল দেখলে অবাক হয়ে যায়! এ সমস্ত ভাবনা থেকেই আমি লেখার তাগিদ অনুভব করি। লেখাটা আসলে আমার নেশা এবং ভালোলাগা।

চিত্রদেশ: কোন সময়টাতে আপনার লেখালেখির ভাব চলে আসে?

কবি সেলিমুজ্জামান: যখন সমাজের কোন অসংগতি দেখি তখন আমি আমার লেখার মধ্যে দিয়ে তা তুলে ধরার চেষ্টা করি।

 

চিত্রদেশ//এইচ//

Related Articles

Back to top button