গল্প-কবিতা

আমার মনে হয় লেখক একজন আবিষ্কারকও : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

স্টাফ রিপোর্টার:
নমস্কার,

আমি ভাবছিলাম এতসব বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার পর আমার আর কিছু বলার থাকে না, কী আর বলব!

প্রথমে সাধনের কথা বলি, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের…সে আমাকে ফোন করেছিলো, যোগাযোগ হয়েছিলো, তারপর বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা হয়। দেখলাম সাধন, প্রশ্নাতুর-জিজ্ঞাসু একজন মানুষ। আমার সঙ্গে খুব মেলে, আমিও খুব প্রশ্নাতুর-জিজ্ঞাসু। সাহিত্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, এ নির্ধারণ করা খুব শক্ত, কঠিন। সাধন যে জিনিসটা দেখে, তার মধ্যে মানুষ আছে, অনেকাংশে রাজনীতি আছে, আর ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাও আছে। কখনো কখনো সে আমার কাছে বসেছে…আমার বাড়িতে, এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা তার সঙ্গে বকবক করেছি—যা প্রাণে আসে উল্টা-পাল্টা যুক্তি বিবর্জিত মনের কথা বলা। আমার মাঝে মাঝে প্রশ্ন এটা হয় যে, লেখক আর সাংবাদিক তো এক নয়। আমি মাঝিদের নিয়ে লিখলাম, যারা পূজা-পার্বণ করেন তাদের নিয়ে লিখলাম বা কোনো একটা বিশেষ গ্রাম নিয়েই লিখলাম… আমি সংবাদ সরবরাহকারী কি? আমি কি তাদের খবর দিচ্ছি মানুষকে? লেখকের কাজ তা নয়। আমার মনে হয় লেখক একজন আবিষ্কারকও বটে। সে কোথাকার কোন খবর দিলো, কবেকার মানুষ কী খেয়ে বেঁচে আছে, কত দারিদ্রের মধ্যে বেঁচে আছে, এটা সাংবাদিকের কাজ, লেখক শুধু এইটাই অনুসরণ করেন না। অনুধাবন করতে গায়ে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ান না, তার আরো কিছু কাজ আছে, দায়িত্ব আছে। সেটা হচ্ছে মানুষের মনের খবর দেওয়া, মানুষকে বারবার আবিষ্কার এবং পুনঃআবিষ্কার করা। তাতে মাঝি-মল্লার খবর থাকলো কি, না-থাকলো, তা বড় কথা নয়, তাকে বারবার খুঁজে বের করতে হবে যে, মানুষের গহীন অতলান্ত যে সাবকন্সিয়াস, তার মনের মধ্যে যে নানা রকম চিন্তা-ভাবনা তার প্রকাশভঙ্গি, তার সম্পর্ক এবং এই, আমার এই চারদিকের যে ব্যপ্ত জগত, তার সঙ্গে তার কী রিলেশন, তা বারবার আবিষ্কার করতে হয়।

অপু, কলকাতা আসার সময় যে মেস বাড়িতে থাকত, তার উল্টো দিকে জানালার কপাটে কে একজন হঠাৎ লিখলো, ‘হেমলতা, আপনাকে বিবাহ করিবো!’ এই হেমলতা কে, অপু জানে না। এর উল্টো দিকে একটা মেয়ে থাকতো, সেই মেয়ে ওই মেয়ে, যার নাম কপাটে লিখেছিলো ‘হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবো’। পরে জানা গেল হেমলতা একটি পাগল মেয়ে, মাথা ঠিক নেই। কিংবা আপনারা হয়ত মনে করতে পারেন যে, অপুর কথাই আরেকবার বলি, অপু যখন তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেলো, একটা পোস্টকার্ডে চিঠি এলো যে, ‘তোমার মা মারা গেছেন’, দুনিয়াতে মা ছাড়া অপুর আর কেউ নেই। কিন্তু অপুর প্রথম রিয়াকশনটা কী? আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ভক্তি-মুক্তি? পৃথিবীতে তার একটিই বন্ধন ছিল ‘মা’। মাকে ছেড়ে সে বাউণ্ডুলে হয়ে যেতে পারত না, মা তার বন্ধন। সংসার খুঁটির সঙ্গে মা তাকে আঁটকে রেখেছিল অথচ তার প্রাণ ছটফট করছে ‘হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনখানে’। এই যে মুক্তির আনন্দ, এইটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কেটে গেল, হঠাৎ তার র‍্যাসনালিটি ফিরে এলো, সে ভাবলো এ কি এ আমি কী করছি, আমার তো মা মারা গেছে, আমার তো শোক করা উচিত। তখন সে কাঁদল মায়ের জন্য, যা হোক, সেই কান্নায় কোনো অভিনয় ছিল না, এতটুক সত্যি! কিন্তু এই যে আবিষ্কার, হঠাৎ করে মানুষ ধরা পড়ে গেল, যে শোক ও আনন্দ দু’টোই যুগপৎ শক্তি। যদি আমরা ‘মেটামরফোসিস’ গল্পটির কথা আরেকবার স্মরণ করি, যেখানে এক সকালে গ্রেগার সমসা নামের একটি লোক হঠাৎ উঠে দেখলো যে, সে একটা পোকা হয়ে গেছে, সেই পোকাকে নিয়ে পরিবারে সে-কী ভোগান্তি, ইশ! কত বড় লজ্জার কথা, ছেলে পোকা হয়ে গেছে, বিরাট বড় একটা পোকা ঘরের মধ্যে। তাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হলো, কিন্তু পোকা হলেও সে তো ছেলে। তার দেখভাল করার জন্য একটি মেয়েকে রাখা হলো, একটি মহিলা মধ্যবয়েসি। সে তাকে খাবার-টাবার দিতো। সে নরমাল খাবার খেতে পারত না, পচা, দুর্গন্ধযুক্ত বাসি জিনিস খেতো, কথা বলতে পারতো না। মাঝে মাঝে তার বোন বেহালা বাজালে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতো, এবং তাকে দূর-দূর করে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এইভাবেই চলছে, বাবা রিটেয়ার্ড করেছিলেন, গ্রেগার সামসার পয়সায় সংসার চলছিলো। বাবাকে আবার চাকুরি খুঁজে নিতে হলো। মেয়েটি বড় হচ্ছে তার বিয়ে দিতে হবে, কী সংকট, কী সমস্যা! ছেলে পর হয়ে গেছে, তারপর একদিন সকালবেলা তারা যখন ব্রেকফার্স্ট টেবিলে বসে আছে, সে গ্রেগারের মা-বাবা এবং বোন, তখন হঠাৎ সেই পরিচারিকা এসে খবর দিলো যে, পোকাটা মরে গেছে, কী করব! তো মা-বাবা একটু গম্ভীর হয়ে গেলো, বোন মাথা নিচু করলো, পরে বাবা বলল, ফেলে দাও। তো সেই পোকাটিকে ফেলে দেওয়া হল। তারপরে সেদিন খুব সুন্দর দিন, মেঘ কেটে সূর্য উঠেছে, ঝলমল করছে, ভারী সুন্দর! সেই মা-বাবা আর মেয়ে বেড়াতে গেল শহর, ট্রামে করে তারা যাচ্ছে শহর দেখতে। মেয়েটি সামনের সিটে বসে আছে, মা-বাবা পেছনের থেকে দেখছে—তার মেয়েটি বড় হয়েছে, ডাগর হয়েছে, দেখতে ভারী সুন্দরও হয়েছে, এবার আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায় সহ আরও অনেকে। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

গল্প এখানেই শেষ। এই গল্পের মধ্যে দিয়ে যে কী বার্তা বয়ে আনলো, একটু তলিয়ে দেখলে দেখবেন, লেখক কূট-কৌশলে আমাদের রিলেশনটাকে একটা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কী সে প্রশ্ন? যে বাৎসল্যের কথা বলো, সন্তান স্নেহের কথা বলো, কোথায়? তুমি ভণ্ড, তুমি জালিয়াত…তোমার এগুলো কিছু নেই, আসলে তোমার কিছু নেই! বাৎসল্য নেই, থাকলে এই যে ছেলের মৃত্যু, সে পোকা হয়ে মরেছে তাতে কী? তোমার শোক কোথায়? তোমার তো আনন্দ!

মানুষকে এসব জায়গায় ধরে ফেলা, তার সাব-কন্সাস থেকে কী উঠে আসে, না-আসে, আমরা জানি না। এই হচ্ছে লেখক। এক শব্দে লেখক এবং আবিষ্কারকও বটে! দার্শনিক কী-না, তা জানি না, দার্শনিক তো সবাই, কে না দার্শনিক, কে না দর্শন পড়ছে, এবং দুনিয়াকে নিয়ে পারিপার্শ্বিককে নিয়ে ভাবছে। সবাই ভাবছে।

আমার মনে হয় যে, লেখক সাংবাদিক নন, তিনি খবর দিতে আসেন না, তিনি মানুষকে বারবার, বারবার সেই বাল্মীকি-হোমারের আমল থেকে বেদব্যাসের আমল থেকে বারবার মানুষকে আবিষ্কার করা হচ্ছে, আবিষ্কার করা হচ্ছে, আবিষ্কার করা হচ্ছে। আজও মানুষের সম্পর্কে শেষ কথা বলা যায় না। তার এখনো অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে, থাকবে। যা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় না, আমরা এখনো মানুষকে ধরতে পারি না। এমনকী আমি আমাকেও ধরতে পারি না! আমার ভেতর যে রহস্যময় ‘আমি’ লুকিয়ে আছে, মাঝে মাঝে হুট করে সে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ মানুষ চমকে ওঠে ফলে, ‘এটা আমি কী ভাবছি, ভাববো না, এ তো অনৈতিক ভাবনা-চিন্তা, কেন আমি এসব ভাবছি?। কিন্তু ওই ভাবনাটার ভেতরে আছে অচেনা আমিটা, যে আমার ভেতরে বাস করে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে আবার নেইও। একই দেহে একজন বা একাধিক মানুষ বাস করছে, একাধিক সত্তা। সে আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। মাঝে মাঝে টুকি দেয় আবার লুকিয়ে পড়ে, ধরতে পারি না। আমার সঙ্গে আমার যে খেলা কতকাল চলে আসছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা এক মস্ত বড় আবিষ্কারকের কাজ।

দুই.

সিরাজ আমার কতটা কাছের ছিলো, আমার কতটা বন্ধু ছিলো তা আপনাদের বোঝাতে পারবো না। আমার ঘনিষ্টতম বন্ধু ছিলো সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তার সঙ্গে আমার ঠাট্টা-ইয়ার্কি-ঝগড়া-তর্ক বিস্তর রয়েছে, আমি বলতাম, ‘এই, তুইতো ফুটপাত থেকে বই কিনে পড়ে পণ্ডিত হয়েছিস’। আর ও আমাকে উল্টো নানারকম অপমানজনক কথা বলতো। তারপর আবার গলাগলি ভাব দু’জনের। তর্ক করতে করতে আমার মেসবাড়ির ঘরে যেত। তর্ক তর্ক তর্ক, অনেক রাত হয়ে যেতো, তারপর আমি বলতাম তুই বাড়ি যা, রওনা হতো, আমি রাস্তার মধ্যে এগিয়ে দিতাম, বাস-টাস নেই, সব বন্ধ হয়ে গেছে, কী করে ফিরবি? হাঁটতে হাঁটতে সেনটাউনের মার্কেটের বাসায় যেতো, তখন আমি একটু এগিয়ে দিতাম শেয়ালদা পর্যন্ত। এরকম বন্ধুত্ব ছিলো আমাদের। তারপর আমরা একসঙ্গে চাকরীও করতাম আনন্দবাজার পত্রিকায়। আজ সব স্মৃতিই বারবার এসে হানা দেয়। কিন্তু জীবন তো বহমান, সে তো কোনো জায়গায় থেমে থাকে না, চলতেই হয়।

আজকে এখানে অনেক মূল্যবান কথা আমি শুনলাম, আমি মূর্খ মানুষ, বেশি কিছু বুঝি না, আমি ঋদ্ধ হলাম, সমৃদ্ধ হলাম অনেক।

সাধন অনেকদূর যাবে, আমার মনে হয়। না, সাধনের লেখা যখন আমি প্রথম পড়ি, চমকে গিয়েছিলাম। শুনেছিলাম যে, সাধন একজন বামপন্থী লেখক। ও সাংঘাতিক বামপন্থী। একটু ভয়ও পেছিলাম—একরোখা হবে কিনা, রাগী হবে কিনা, কিন্তু যখন তাকে দেখলাম তখন মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রশ্নাতুর মানুষ চাই আমি, সবজান্তা মানুষ চাই না, জিজ্ঞাসু মানুষ চাই। যে সব জানে তাকে দিয়ে আমার কী হবে? আমার সঙ্গী হচ্ছে সত্যিকারের জিজ্ঞাসু মানুষ। বিপন্ন মানুষ, মানসিকভাবে, যে বারবার প্রশ্ন করে অস্তিত্বকে, বারবার বারবার নিজেকে ভাঙে-গড়ে, নিজেকে খোঁজে আর মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষকেও খোঁজে।

সাধন সেরকম একজন মানুষ।

সোজা কথা হলো, লেখককে আবিষ্কারক হতে হয়।

আপনাদের সময় খানিকটা নষ্ট করলাম, ভালো থাকবেন। একটি সুন্দর সন্ধ্যা আপনাদের সঙ্গে কাটালাম, ধন্যবাদ।

 

চিত্রদেশ//এস//

Related Articles

Back to top button