কোটা বাতিলের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’, রাজধানীসহ উত্তাল দেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহালসহ চার দফা দাবিতে দেশজুড়ে চলছে পূর্বঘোষিত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার শাহবাগ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাব মোড়, পরিবাগ, চানখারপুল মোড়, আগারগাঁও মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা।
রোববার (৭ জুলাই) দুপুরে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে টিএসসি হয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়।
দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ঢাবি শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রথমে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাছে চাঁনখারপুল মোড়ে অবরোধ করেন এবং ফ্লাইওভারের র্যাম্প অবরোধ করেন। এরপর তারা সায়েন্স ল্যাব মোড় দখল করে অবস্থান নেয়। পরে একে একে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে যেতে থাকে।
৩টা ৫০ মিনিটের দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ শেষে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ের দিকে আসেন এবং চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে মোড় অবরোধ করেন। এদিকে সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলামোটর এবং কাওরানবাজার মোড়ের দিকে আসেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা যায় তাদের।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করেছেন বলে জানান শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদ আলী। এর ফলে ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
আন্দোলনের ঢেউ চলছে ঢাকার বাইরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শতাধিক শিক্ষার্থী আজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। বেলা ১১টার দিকে জাবি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ডেইরিগেট এলাকায় অবস্থান নেয়। অবরোধের ফলে মহাসড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকে থাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের প্রতিবাদে সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। বিকেল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু হয়। গানে গানে কোটা সংস্কারের দাবি জানান তারা। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতির সংস্কার করা উচিত। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলমান থাকবে।
কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের প্রতিবাদে আজ বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন এবং নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেন। তারা কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলেন। তাদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর মহাসড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজট শুরু হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। রোববার বিকাল ৩টার পর প্রথমে ষোলশহর রেলস্টেশনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে ষোলশহরে সড়কের ওপর বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এতে যোগ দেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কোটা প্রথার কারণে মেধাবিরা বঞ্চিত হচ্ছে দাবি করে তারা ২০১৮ সালে সরকার ঘোষিত পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবি জানান।
একই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্সূমচি পালন করেছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় কোটা বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন শ্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়কে বসে পড়েন তারা। সেখানে কোটা বাতিলের দাবিতে বক্তব্য দেন। পরে পুলিশের অনুরোধে ক্যাম্পাসে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়ক এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করেন এবং কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। তারা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের সামনের মহাসড়কে যান এবং সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এর ফলে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে।
এদিকে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রোববার বিকেল ৪টার দিকে তারা সড়ক অবরোধ করেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।
ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
২০২১ সালে সেই পরিপত্রের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে’র অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওইদিন এই আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন চেম্বার আদালত।
সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে নাকি বাতিল হবে সে ব্যাপারে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
পরে গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে গত এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা।