খেলাধুলাপ্রধান সংবাদ

১৩ বছর পর ভারতের ঘরে বিশ্বকাপ

মহেন্দ্র সিং ধোনি মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নুয়ান কুলাসেকেরার বলে ছয় হাঁকাচ্ছেন, এটাই গত ১৩ বছর ধরে ভারতের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ছিল। একটা বিশ্বকাপের জন্য এরপর থেকে হন্যে হয়ে ঘুরেছে টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু আসেনি। সাতমাস আগেই নিজেদের মাটিতে হেরেছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল।
সেই আক্ষেপ মিটল নিজ থেকে বহুদূরের মাটিতে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপ বার্বাডোজের কড়া রোদের নিচে আরেকবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত। ১৩ বছর পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত। হোক ভিন্ন ফরম্যাটে। তবুও ভারতের পাশে এখন বিশ্বসেরার স্বীকৃতি। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের হিসেবে অপেক্ষাটা ১৭ বছর। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের শিরোপা ঘরে তুলেছিল ম্যান ইন ব্লুরা। সেটা দিয়েই শিরোপার পথে নেমেছিল ধোনির ভারত। লম্বা অপেক্ষা শেষে আবারও সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়েই শিরোপাখরা ঘুচালো দলটা।

বার্বাডোজে উৎসবের মঞ্চ আগেই সাজিয়ে রেখেছিল ভারত। ১৭৬ রানের শক্ত সংগ্রহ তারা দাঁড় করায় ফাইনালের মঞ্চে। বল হাতে শুরুটাও ছিল চ্যাম্পিয়নদের মতোই। মাঝে কুইন্টন ডি কক আর হেনরিখ ক্লাসেন দাঁড়ালেন দেয়াল হয়ে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার জয়টাও ছিল সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার নামের পাশে যে লেগে আছে চোকার্স তকমা। ২৪ বলে ২৬ রানের সমীকরণটাই আর মেলানো হয়নি তাদের। আর্শদ্বীপ সিং আর জাসপ্রিত বুমরাহ একের পর এক ডট ডেলিভারিতে চাপ বাড়িয়েছেন। সঙ্গী ছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। স্নায়ুচাপের লড়াইয়ে জয় হলো ভারতেরই।
শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৬ রান। হার্দিক পান্ডিয়ার ওই ওভারের প্রথম বলেই বাউন্ডারি লাইনে মিলারকে দুর্দান্ত এক ক্যাচে ফেরালেন সুর্যকুমার যাদব। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ শেষ হয়ে গেল সেখানেই। শেষ ওভারে এলো ৮ রান। ব্যর্থ হলো হেনরিখ ক্লাসেনের ২৭ বলে ৫৪ রানের দুর্দান্ত সেই ইনিংস। ৭ রানের জয়ে বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন ভারত।
কেনসিংটন ওভালে শনিবার ২০ ওভারে ভারত তোলে ৭ উইকেটে ১৭৬ রান।
যার ফর্মহীনতা নিয়ে আলোচনা ছিল অনেক, সেই কোহলি রানে ফিরলেন সবচেয়ে বড় ম্যাচেই। আসরে আগের সাত ম্যাচ মিলিয়ে তার রান ছিল ৭৫, ফাইনালেই করলেন ৭৬। সঙ্গে আকসার প্যাটেল, শিভাম দুবের কার্যকর অবদানে ভারত পেল ওই পুঁজি।

রান তাড়ায় শুরুতে হোঁচট খাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবল প্রতাপে ছুটতে থাকল মাঝের সময়টায়। ভারতীয় স্পিনারদের গুঁড়িয়ে বিধ্বংসী ফিফটি করলেন হাইনরিখ ক্লসেন। কিন্তু সপ্তদশ ওভারে তার বিদায় দিয়ে যে পতনের শুরু, প্রোটিয়ারা আর পারল না মাথা তুলে দাঁড়াতে।
কিছুদিন আগে আইপিএলে ফর্মহীনতায় আর মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের নেতৃত্ব মিলিয়ে যিনি ছিলেন ভারতজুড়ে সমালোচনার কেন্দ্রে, সেই হার্দিক পান্ডিয়া ক্লসেনকে ফিরিয়ে ভারতকেও ফেরালেন ম্যাচে। জাসপ্রিত বুমরাহ ও আর্শদিপ সিংয়ের দারুণ দুটি ওভারে আরও শক্ত হলো লাগাম। শেষ ওভারেও কাজটা ঠিকঠাক করলেন পান্ডিয়া। সম্মিলিত পারফরম্যান্সের দারুণ নজির গড়েই শিরোপা জিতল তারা।
ম্যাচের শুরুটা ভারতের ছিল আগ্রাসী। ম্যাচের প্রথম ওভারেই মার্কো ইয়ানসেনকে তিনটি চার মারেন কোহলি। ওভার থেকে আসে ১৫ রান। বিশ্বকাপের ফাইনালে যা সবচেয়ে বেশি রানের প্রথম ওভারের রেকর্ড।
পরের ওভারটি ছিল নাটকীয়। কেশাভ মহারাজের প্রথম দুই বল বাউন্ডারিতে পাঠান রোহিত শার্মা। কিন্তু এই ওভারেই দুই ব্যাটসম্যানকে ড্রেসিং রুমে পাঠান মহারাজ। সুইপ খেলে আউট হন রোহিত ও তিনে নামা রিশাভ পান্ত।

তৃতীয় উইকেট আসতেও দেরি হয়নি। সুরিয়াকুমার ইয়াদাভের ক্যাচ নেওয়ার পর মাটিতে শুয়েই উদযাপন করতে থাকেন হাইনরিখ ক্লসেন, খ্যাপাটে উদযাপনে মেতে ওঠেন বোলার কাগিসো রাবাদা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগের ছয় ইনিংসে যার একটি সেঞ্চুরি আর চারটি ফিফটি, তাকে ফিরিয়ে এমন উল্লাস তো হবেই!
পরিস্থিতির জবাব দিতে ভারত পাঁচে নামিয়ে দেয় আকসার প্যাটেলকে। প্রথম বলেই বাউন্ডারি আর একটু পরেই ছক্কা মেরে তিনি বুঝিয়ে দেন, কোন দায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে। কোহলি মনোযোগ দেন ইনিংস গভীরে টেনে নেওয়ার কাজে।
নিজের কাজটা দুজনই ঠিকঠাক করায় গড়ে ওঠে জুটি। ৫৪ বলে ৭২ রানের এই জুটি থামে আকসারের কিছুটা আলসেমি আর কুইন্টন ডি ককের ক্ষিপ্রতায়। দারুণ খেলে চার ছক্কায় ৩১ বলে ৪৭ করে রান আউটে ফেরেন আকসার।
মাঝের সময়টায় একটু থমকে পড়েন কোহলি। তবে আরেক প্রান্তে রানের ধারা ছিল প্রবাহমান। আকসার বিদায় নিলেও একই স্রোতে বয়ে যান শিভাম দুবে।
কোহলি ফিফটিতে পা রাখেন ৪৮ বলে, সপ্তদশ ওভারে। এরপর ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। রাবাদার ওভারে মারেন ছক্কা ও চার, ইয়ানসেনের ওভারেও তা-ই। আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় তার ইনিংস থামে শেষের আগের ওভারে।
দুবের সঙ্গে তার জুটিতে আসে ৩৩ বলে ৫৭ রান। ১৬ বলে ২৭ করে দুবে আউট হন শেষ ওভারে।
শেষ ৬ ওভারে ৬৮ রান তোলে ভারত।
রান তাড়ার শুরুতে জোড়া ধাক্কায় কিছুটা টালমাটাল হয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। জাসপ্রিত বুমরাহর অসাধারণ এক ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে যান রিজা হেনড্রিকস। পরের ওভারে আর্শদিপের বলে আলগা শটে উইকেট হারান অধিনায়ক মার্করাম।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাহসের বার্তা হয়ে আসেন তরুণ ট্রিস্টান স্টাবস। অভিজ্ঞ কুইন্টন ডি কক সঙ্গ দেন। পাল্টা আক্রমণে বাড়তে থাকে রান ও দলের আশা।
৩৩ বলে ৫৮ রানের জুটি শেষে স্টাবস ফেরেন ৩১ রানে। ডি ককের ইনিংস থামে ৩৯ রানে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস আরও গতিময় হয় ক্লসেনের ব্যাটে।

আকসার প্যাটেলের এক ওভারে ক্লসেনের দুই ছক্কা দুই চারে যখন রান আসে ২২, দক্ষিণ আফ্রিকা তখন জয়ের সুবাস পাচ্ছে তীব্রভাবেই। ক্লসেন আর ডেভিড মিলার তখন ক্রিজে। বাইরে এতগুলি উইকেট। এই ম্যাচ তো কার্যত শেষ!
কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ তো শেষের আগে শেষ নয়!
১৬ ওভার শেষে হাঁটুর চোট পেয়ে মাঠেই চিকিৎসা নিলেন রিশাভ পান্ত। একটু থমকে থাকল খেলা। ক্লসের মনোযোগেও হয়তো চিড় ধরল। খেলা শুরু হতেই প্রথম ডেলিভারিতে অনেক বাইরের বল তাড়া করে আউট ক্লসেন (২৭ বলে ৫২)।
পরের ওভারে বুমরাহ এসে দুর্দান্ত ডেলিভারিতে মার্কো ইয়ানসেনকে বোল্ড করলেন। ওভারে রান দিলেন স্রেফ দুটি। ম্যাচ একটু একটু করে দূরে সরতে থাকল দক্ষিণ আফ্রিকার। ১৯তম ওভারে আর্শদিপ দিলেন কেবল চার রান।
শেষ ওভারে সমীকরণ দাঁড়াল ১৬ রানের। পান্ডিয়ার প্রথম বলটি উড়িয়ে মারলেন মিলার। চাপের মধ্যে সীমানায় অসাধারণ ক্যাচ নিলেন সুরিয়াকুমার। এরপর ভারতের জয় কেবল আনুষ্ঠানিকতা।
গৌরবময় ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় এসে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেলেন কোহলি। ম্যাচ সেরা হয়ে তিনি এই সংস্করণ থেকে বিদায়ের ঘোষণাও দিলেন হাসিমুখে।
আর রোহিত শার্মা? ভারতের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাক্ষী, কয়েক মাস আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের পরাজিত নায়ক, এবার আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কত্ব থেকেও সরানো হয়েছে যাকে, তিনিই এখন টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক।
গত এক বছরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে যাওয়া দল, অনেক বছর ধরে একটি আইসিসি ট্রফির তেষ্টায় ছটফট করতে থাকা ভারত, অবশেষে পেল একটি বৈশ্বিক শিরোপার স্বপ্নময় পরশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত: ২০ ওভারে ১৭৬/৭ (রোহিত ৯, কোহলি ৭৬, পান্ত ০, সুরিয়াকুমার ৩, আকসার ৪৭, দুবে ২৭, পান্ডিয়া ৫*, জাদেজা ২; ইয়ানসেন ৪-০-৪৯-১, মহারাজ ৩-০-২৩-২, রাবাদা ৪-০-৩৬-১, মার্করাম ২-০-১৬-০, নরকিয়া ৪-০-২৬-২, শামসি ২৩-০-২৬-০)।
দক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ ওভারে ১৬৯/৮ (হেনড্রিকস ৪, ডি কক ৩৯, মারক্রাম ৪, স্টাবস ৩১, ক্লসেন ৫২, মিলার ২১, ইয়ানসেন ২, মহারাজ ২*, রাবাদা ৪, নরকিয়া ১*; আর্শদিপ ৪-০-২০-২, বুমরাহ ৪-০-১৮-২, আকসার ৪-০-৪৮-১, কুলদিপ ৪-০-৪৫-০, হার্দিক ৩-০-২০-৩, জাদেজা ১-০-১২-০)।
ফল: ভারত ৭ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: ভিরাট কোহলি।
ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: জাসপ্রিত বুমরাহ।

 

Related Articles

Back to top button