হুমায়ুন কবির হিমু’র জনপ্রিয় উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’ (২য় পর্ব)
জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।
পাঠকদের জন্য আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গলবার ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হবে ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়। আজ রইল উপন্যাসের (২য় পর্ব)
এই যেমন দেখ, তোর মায়ের জন্য আমাকে তৈরি করা হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ আমার সাথে তোর মায়ের বিবাহ হয়েছিল।
কিন্তু বাবা, আমি মায়ের কাছে শুনেছি তোমাকে মায়ের পছন্দ হয়নি! নানা জানের চাপে পড়ে মা তোমাকে বিয়ে করেছে।
জাকিয়ার কাছে এই কথা শুনে ফরহাদ সাহেব অবাক হয়ে গেল! মেয়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। তার ভয়াবহ রাগ হচ্ছে এই ভেবে যে, এই সমস্ত কথা শামীমা কোন হিসাবে তার মেয়েদের সাথে আলোচনা করল! শামীমার জ্ঞান-বুদ্ধি কি জীবনে হবে না! ফরহাদ সাহেব তার মেয়েকে যা বলার জন্য সেই সাতসকাল থেকে প্রিপারেশন নিয়েছিল জাকিয়ার কথা শুনে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
বাবা, তুমি আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
ফরহাদ সাহেব নিজেকে শান্ত করল। তার স্বাভাবিক হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তোর কি আজ বাইরে যাওয়ার কোনো প্ল্যান আছে?
আছে বাবা।
কখন যাবি?
সকাল এগারোটার দিকে একটু নিউ মার্কেটে যাব। কিছু কেনাকাটা আছে। তুমি কি তোমার জরুরি কথাটা বলবে? না বললে বলো, আমি ফ্রেশ হয়ে নাশতা করব।
একটু আগেই না চা-টোস্ট খেলি!
সেটা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। তাছাড়া তোমার কাছে সৃষ্টির রহস্য শুনতে শুনতে ক্ষুধা লেগে গেছে। তুমি অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি। আর যদি তুমি তোমার জরুরি কথা বলতে চাও বলতে পারো।
না, আমি আর কথা বলতে চাচ্ছি না। তুই যেতে পারিস। তবে যেখানেই যাস, বিকাল পাঁচটার আগে বাসায় ফিরে আসিস।
কেন বাবা?
সেটা তোকে পরে বলছি।
জাকিয়া আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাথরুমের দিকে চলে গেল। যাওয়ার সময় তার বাবার দিকে পিছন ফিরে তাকাল, তার বাবা বিড়বিড় করে কী যেন বলছে।
আনিস প্রায় পনেরো মিনিট থেকে বাথরুমে যাওয়ার জন্য নিজের ঘরে বসে আছে, কিন্তু বাথরুম খালি না থাকায় যেতে পারছে না। তার মেজাজ খারাপ হতে চলেছে। তার রুম মেট আশরাফুল বাথরুমে ঢুকেছে সেই কখন কিন্তু বের হওয়ার নাম নেই। এর মাঝে আনিস কয়েকবার দরজায় ধাক্কা মেরেছে কিন্তু কোনো প্রকার রেসপন্স নেই। মনে মনে আনিস খুবই বিরক্ত, কিন্তু
প্রকাশ করতে পারছে না। তার কারণ আনিস রুমের ভাড়া বাবদ কোনো টাকা দেয় না। আশরাফুলের কাছে একপ্রকার সে আশ্রিত। আশরাফুল তার ছোটবেলার বন্ধু। ভালো চাকরি করে। মোটা অঙ্কের টাকা বেতন পায়।
আনিস গত মাসে রংপুর থেকে ঢাকায় এসে আশরাফুলের মেসে উঠেছে। আশরাফুলের মেসটাকে মেস বলে মনে হয় না। একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে আশরাফুলসহ আরো চারজন থাকে। মোট রুম ডাইনিং রুমসহ চারটি। ফ্ল্যাটটি অনেক বড়। আশরাফুল একাই একটি রুম নিয়ে থাকে। বাকি তিনটি রুমে অন্য চারজন থাকে।
ঢাকার মিরপুরের ১৪ নম্বরে আশরাফুলের মেসটি। পরিবারের অবস্থা ভালো না। বাবা নেই। বাবা সরকারি চাকরি করত। গত ছয় মাস হলো আনিসের বাবা মারা যাওয়ায় তাদের সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে। আনিস রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছে। তার রেজাল্ট হওয়ার আগেই তার বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তাদের পরিবার তার বাবার পেনশনের টাকায় চলছে। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার চালানো মোটামুটি কঠিন হয়ে পড়েছে। আনিসের ছোট একটি বোন আর তার মা ছাড়া তাদের সংসারে আর কেউ নেই। ঢাকায় তার একমাত্র মামা বজলুর রহমান বজু থাকে ধানমন্ডিতে। মামার অবস্থা বেশ ভালো। ধানমন্ডির মতো জায়গায় পাঁচতলা বাড়ি বানিয়েছে। সচিবালয়ে চাকরি করে। সরকারের একজন বড় আমলা। মামার তিন সন্তান। দুই ছেলে, এক মেয়ে। মামার বড় ছেলে ফিরোজ একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট ছেলে ফুয়াদ একটি আইটি ফার্মে চাকরি করে। একমাত্র মেয়ে তাহিতি ধানমন্ডি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। মামার মোটামুটি সুখের সংসার। আনিস ইচ্ছে করলে তার মামার বাসায় উঠতে পারত। কিন্তু আনিস তা করেনি। তার কারণ আশরাফুল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আনিস যখন আশরাফুলের সাথে একটা চাকরির বিষয়ে কথা বলেছে, তখন আশরাফুলই আনিসকে ঢাকায় আসার জন্য বলেছে এবং যতদিন একটা চাকরির ব্যবস্থা না হচ্ছে ততদিন তার মেসে থাকার জন্য বলেছে। তাই আনিস আর তার মামার বাসায় ওঠেনি। তার মামি আনিসকে বলেছিল তার বাসায় ওঠার জন্য এবং তাহিতিকে একটু পড়ানোর জন্য। কিন্তু আনিস তাতে মত দেয়নি। যার কারণে তার মামি তার উপর একটু বিরক্ত। ঢাকায় আসার পর আশরাফুল আনিসকে মোহাম্মদপুরে আপাতত একটি টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে।
আনিস পড়াশুনায় বেশ ভালো। ইংরেজি সাহিত্যে সে মাস্টার্স করেছে। মোহাম্মদপুরে ফরহাদ সাহেবের ছোট মেয়ে কেয়াকে আনিস সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে যায়। গত দুই মাস হলো কেয়াকে আনিস পড়াচ্ছে। মেয়েটি ভালো। কিন্তু চুপচাপ স্বভাবের। কথা কম বলে। প্রশ্ন করলে বলবে, না করলে চুপচাপ পড়ে যাবে। ছাত্রী হিসাবে ভালো। একটা জিনিস একবার বুঝিয়ে দিলে আর বুঝাতে হয় না। কেয়ার এই গুণটি আনিসকে মুগ্ধ করেছে। কেয়ারা দুই বোন। তার বড় বোন জাকিয়া একটি এনজিওতে চাকরি করে। দু-একবার তার সাথে দেখা হয়েছে। জাকিয়া মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দর। তবে আনিসের মনে হয়েছে জাকিয়া কেয়ার পুরাই উল্টা স্বভাবের। অযথায় হাসে। কথা মনে হয় একটু বেশি বলে।
প্রথম যেদিন আনিস কেয়াকে পড়ানোর জন্য কেয়াদের বাসায় গেল, ঘরের দরজা কেয়ার বড় বোন জাকিয়া খুলে দিয়েছিল। আনিস দরজা খোলা মাত্রই সালাম দিয়েছে। জাকিয়া সালামের উত্তর দিয়ে বলেছে, জি বলেন, কাকে চাই?
আনিস একটু বিব্রতবোধ করে বলেছে, জি আমাকে ফরহাদ স্যার আসতে বলেছেন উনার মেয়েকে পড়ানোর জন্য।
আনিসের মুখ থেকে এই কথা শোনা মাত্র জাকিয়া মুচকি হেসে বলল, ও আচ্ছা, আপনি কি আনিস সাহেব?
জি, আমি আনিস।
আসুন ভিতরে আসুন। আপনার ছাত্রী একটু ঘুমিয়েছে। আপনি একটু বসুন, আমি কেয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা।
আপনি কি চা খাবেন?
জি না, ঠিক আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বসুন, আমি কেয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এই বলে জাকিয়া ভিতরে চলে গেল। যাওয়ার সময়ও একটু মুচকি হাসি দিয়ে গেল। জাকিয়া হাসলে তার গালে টোল পড়ে। টোল পড়া মেয়েরা নাকি ভাগ্যবতী হয়। জাকিয়া দেখতে ভয়াবহ সুন্দর। হাসার সময় গালে টোল পড়ার জন্য আরো বেশি সুন্দর লাগছিল।
কি রে! মাথা নিচু করে কী ভাবছিস?
আশরাফুলের কথায় আনিসের ধ্যান ভাঙল।
না, তেমন কিছু না। তোর বাথরুম সারতে এত দেরি হলো?
আর বলিস না দোস্ত, পেটটা জানি সকাল সকাল কেমন মোচড় দিচ্ছিল। পেটের ভিতরে নানান রকম রিংটোন বাজতেছে। মিসড কল দিতে যেয়ে আরো বিপদে পড়েছি! দেখি কল রিসিভ হয়ে যাচ্ছে! তাই একটু দেরি হলো। কিছু মনে করিস না দোস্ত। তুই কয়েকবার ধাক্কা মেরেছিস, কিন্তু কোনোভাবেই পেট ক্লিয়ার হচ্ছিল না। স্যরি দোস্ত। যা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বের হয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, তোকে নিয়ে একটু বের হব।
বের হবি মানে! আজ তো শুক্রবার। তুই কোথায় যাবি?
আছে একটা কাজ। যেখানে যাব সেখানে একা গেলে কাজ হবে না, ম্যান পাওয়ার লাগবে।
ম্যান পাওয়ার লাগবে মানে?
এত প্রশ্ন করিস না তো! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
কিন্তু আমি তো মামার বাসায় যাব। মামি ফোন দিয়েছিল যাওয়ার
জন্য। ওখানে দুপুরে খেতে বলেছে। মামার বাসা থেকে মোহাম্মদপুরে টিউশনিতে যাব।
টিউশনিতে যাবি মানে! আজ না শুক্রবার?
আমি শুক্র, সোম আর বৃহস্পতিÑএই তিন দিন সপ্তাহে পড়াতে যাই রে।
ও আচ্ছা, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ঠিক আছে তুই রেডি হয়ে নে। একসাথে বের হবো। বাইরে নাশতা করে তুই তোর মামার বাসায় চলে যাবি আমি আমার কাজে চলে যাব। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুক। তুই ফ্রেশ হতে হতে আমি একটি এমোডিস ট্যাবলেট জোগাড় করার চেষ্টা করি।
আনিস আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল।
বজলুর রহমান সকাল থেকে বেশ উত্তেজিত। তার উত্তেজিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তিনি সাধারণত ছুটির দিনে অনেক বেলা করে ঘুমান। কারণ সারা সপ্তাহ তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেন। যেহেতু সে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করে, তাই তাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা সপ্তাহ অনেক ঝামেলা তাকে মোকাবেলা করতে হয়। কারণ সড়ক বিভাগের অনেক কাজ থাকে। মাঝখানে একটি ঈদ গেল, কিন্তু তারা ছুটি পাননি। সরকার সকল কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল ঘোষণা করেছিল। সবাই ঈদের ছুটি ভোগ করলেও তিনি করতে পারেননি। তাই শুক্রবার আর শনিবারের ছুটিটি আরাম-আয়েশে কাটাতে পছন্দ করেন। অনেক বেলা করে ঘুমান। জাস্ট জুমার নামাজের পূর্বে ঘুম থকে উঠে নামাজে যান। নামাজ থেকে এসে চারটা খেয়ে আবার ঘুমাতে যান। ঘুম থেকে ওঠেন বিকেলে। বিকালবেলা তিনি একটু হাঁটতে বের হন। কারণ গত এক বছর থেকে তিনি তার বিশাল সাইজের ভুঁড়ি কমানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিয়ম করে প্রতি শুক্র আর শনিবার এক ঘণ্টা করে হাঁটেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! তার ভুঁড়ি কমার চেয়ে বরং আরো বাড়ছে বলে তার ধারণা। গতকাল তিনি অনেক রাত করে ঘুমিয়েছেন। উত্তম কুমারের একটি ছবি দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেছে। উত্তম কুমার তার প্রিয় নায়ক।
চোখ-মুখ লাল করে বজলুর সাহেব বারান্দায় বসে আছে। মেজাজ ভয়াবহ রকমের খারাপ। সকাল ছয়টার সময় রাহেলা তাকে ডেকে তুলেছে। কাঁচা
ঘুম ভাঙায় তিনি মহাবিরক্ত। রাহেলার ডাকাডাকিতে তিনি ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য হন।
কী ব্যাপার, কয়টা বাজে?
সকাল ছয়টা।
রাহেলার কাছে সময় জানতে পেরে তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। চোখ বড় বড় করে তিনি রাহেলার দিকে তাকিয়ে আছেন। এত সাতসকালে রাহেলা কেন তাকে ডেকে তুলল তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। আজকে কি কোনো বিশেষ দিন? তাদের কি আজ বিবাহবার্ষিকী? বা ছেলে-মেয়ের জন্মদিন? তার মাথায় কোনো কিছুই কাজ করছে না! তিনি চোখ বড় বড় করে রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, এত সকালে তুমি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে, এর কারণ কী?
রাহেলা বলল, বাজারে যেতে হবে।
রাহেলার মুখে এই কথা শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন! তিনি কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি শেষ কবে বাজার করেছেন মনে নেই! কারণ বাসার বাজার খরচ সাধারণত তার বড় ছেলে ফিরোজ করে। কিন্তু রাহেলা আজ তাকে বাজার করতে বলছে কেন? তিনি চোখ-মুখ লাল করে রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? আমি বাজারে যাব মানে? আমাকে বাজারে যেতে বলছ! এই কথার মানে কী? ফিরোজ কোথায়? তুমি ভালো করেই জানো যে আমি ছুটির দিনে দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। তুমি আমার কাঁচা ঘুম ভাঙালে কেন?
একসাথে কয়েকটি প্রশ্ন তিনি করে ফেলেছেন। প্রশ্নগুলো তিনি এক নিশ্বাসে করেছেন। তাই তিনি একটু দম নিলেন। স্বামীর কাছে একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন শুনে রাহেলা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল।
কেন, তুমি জানো না ফিরোজ তার বন্ধুদের সাথে সামার ভেকেশন পালন করার জন্য গতকাল কক্সবাজারে গেছে? আর তোমাকে আমি হাজার বার বলেছি, এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে না। মানুষ তার শরীর ঠিক রাখার জন্য ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করার জন্য বাইরে যায়। আর তুমি মাত্র সপ্তাহে দুই দিন ব্যায়াম করার জন্য বিকেলবেলা করে বাইরে যাও।
দিন দিন তো তোমার পেট পাহাড়ের মতো উচ্চ করে চলেছ! সেদিকে কি কোনো খেয়াল আছে? কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামো। ফ্রেশ হয়ে বাজারে যাও। ঘরে কোনো বাজার নেই। তোমার ভাগ্নেকে আসতে বলেছি। দুপুরে খেতে বলেছি। জীবনে অনেক অলস মানুষ দেখেছি, তোমার মতো আর দেখিনি!
রাহেলার মুখে এই কথা শুনে বজলু সাহেবের রাগের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করল। একে তো সকাল সকাল ঘুম থেকে ডেকে তুলার জন্য তার মেজাজ ঘণ্টায় একশ’ বিশ কিলোমিটার বেগে চলছে। বাজারে যাওয়ার কথা শুনে তা দশ কিলোমিটার বেড়ে একশ’ ত্রিশ উঠেছে! রাহেলার মুখে অলস শব্দটি শুনার পর এখন রাগের স্পিড ঘণ্টায় পুরা একশ’ পঞ্চাশ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে!
আমি অলস মানে? তুমি কোন যুক্তিতে আমাকে অলস বললে? আমি যদি অলস হতাম, তাহলে সরকার আমার মুখ দেখে ত্রিশ বছর চাকরিতে রেখেছে? কী ব্যাপার, তুমি চুপ করে আছ কেন? বাতাও, আমাকে তুমি কিঁউ অলস বোলা? (রাগ উঠলে বজলু সাহেবের মাথা ঠিক থাকে না। তখন তিনি হিন্দিতে কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ করেন।)
বজলুর সাহেবের চিৎকারে তাদের একমাত্র মেয়ে তাহিতির ঘুম ভেঙে গেছে। তাহিতি তার ঘর থেকে বের হয়ে বাবা-মায়ের ঘরের সামনে এসে তার বাবা-মায়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে! রাহেলা তাহিতিকে দেখতে পেয়ে বলল, কি রে তুই এত সকাল সকাল উঠতে গেলি কেন? তুই তোর ঘরে যা।
তাহিতি কোনো কথা না বলে তার ঘরের দিকে চলে গেল।
রাহেলা বেশ ঠান্ডাভাবে বলল, তুমি কি আমার সাথে ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিচ্ছ? দেখো, আমি যা বলেছি, তাই করো, তা না-হলে কিন্তু সংসারে কুরুক্ষেত্র শুরু হয়ে যাবে। আর আমাকে ক্ষেপিও না। আমি ক্ষেপলে তুমি ভালো করেই জানো আমি কী করতে পারি।
রাহেলার মুখে এই কথা শুনামাত্র বজলু সাহেবের রাগের স্পিড মুহূর্তের মধ্যে একশ’ পঞ্চাশ কিলোমিটার থেকে দশ কিলোমিটারে নেমে গেল। কারণ তিনি জানেন, রাহেলা একবার ক্ষেপলে তাকে থামানো শুধু অসম্ভবই না নামুনকিনভি হ্যাঁয়। তিনি তার গলার স্বর যতটা সম্ভব নমনীয় করে বললেন, কিছু মনে কোরো না, অনেক দিন থেকে এত সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই তো, তাই মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফিরোজ যে বাসায় নেই তা আমার মনে ছিল না। ফুয়াদ তো বাসায় আছে! নাকি সেও সামার ভেকেশন পালন করতে কোথাও গেছে?
রাহেলা বিছানা ঠিক করতে করতে বলল, ফুয়াদ অফিসের কাজ শেষ করে অনেক রাত করে ফিরেছে। তাই ওকে ডাকা যাবে না।
ডাকা যাবে না মানে! গলার স্বর উচ্চ করতে যেয়েও বজলু সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ও আচ্ছা! ঠিক আছে, আমাকে এক কাপ চা দেয়ার ব্যবস্থা করো। আর বাজার থেকে কী কী আনতে হবে তার একটা লিস্ট করে দিও। কারণ অনেক দিন বাজারে যাওয়া হয় না। বাজার করা প্রায় ভুলে গেছি। আনিস কখন আসবে?
রাহেলা জবাব দিল, সকাল সকাল আসতে বলেছি। আগামীকাল তাহিতির পরীক্ষা শুরু হবে। তাই আনিস যদি তাহিতিকে ইংরেজিটা একটু দেখিয়ে দেয় তাহলে ওর জন্য ভালো হয়। তোমার মেয়ে তো ইংরেজিতে খুব একটা ভালো না। তাই আনিসকে ডেকেছি।
বজলু সাহেব আর কোনো কথা না বলে বারান্দার দিকে চলে গেল।
আনিস তার মামার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপ দেয়া মাত্র দরজা খুলে দিলেন বজলু সাহেব। আনিসের মনে হলো, তার মামা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কারণ কলিংবেল ঠিকমতো বাজাতে না বাজতেই দরজা খুলে গেল। আনিস ঘরের ভিতর না ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার মামার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তার মামা খালি গায়ে লুঙ্গি পরা অবস্থায় মাথায় একটি ভিজা গামছা দিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে!
কি রে, এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? ভিতরে ঢুক।
আনিস ঘরের ভিতরে ঢুকল। আনিস ছোটবেলা থেকেই তার মামাকে ভয় পায়। মা’র কাছে শুনে এসেছে তার মামা ভয়ানক রাগী টাইপের। মামার বাসায় খুব একটা আসা-যাওয়া নেই বললেই চলে। মামাও খুব একটা গ্রামে যান না। তাই মামার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হতো না। আনিসের বাবা মারা যাওয়ার সময় তার মামা পরিবার নিয়ে গিয়েছিলেন।
তোর মামির কাছে শুনলাম, তুই নাকি তোর কোন বন্ধুর মেসে উঠেছিস?
জি মামা।
তা তোর বন্ধু কী করে?
একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে।
তোর বন্ধু চাকরি করে, আর তুই এখনো বেকার!
কয়েকটা জায়গায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু হয়নি।
হয়নি কেন? পরীক্ষা ভালো দিসনি?
পরীক্ষা ভালো হয়েছিল, কিন্তু ভাইবায় যেয়ে আউট হয়ে গেছি।
কেন? ভাইবায় উত্তর দিতে পারিসনি? পেরেছি, কিন্তু অনেক টাকা
চাইল, তাই।
আনিসের কাছে এই কথা শুনে বজলু সাহেব চুপ করে গেল। কারণ আনিস সাহেব নিজেও জানে বর্তমান বাজারে টাকা ছাড়া শুধু মেধা দিয়ে চাকরি পাওয়া কঠিন।
সরকারি চাকরি ছাড়া প্রাইভেট কোনো কোম্পানিতে চেষ্টা করেছিস?
না মামা।
না কেন?
মা’র ইচ্ছা আমি যেন সরকারি চাকরি করি।
তোর মা তো আর জানে না সরকারি চাকরি চাইলেও পাওয়া বড়ই কঠিন।
মামা-ভাগ্নের কথাবার্তার এই পর্যায়ে রাহেলা ঘরে ঢুকল।
তুমি কখন আসলে?
এই মামি, এই মাত্র।
কই আমাকে ডাকোনি কেন? নাশতা করেছ?
জি মামি, নাশতা করে বের হয়েছি। ফিরোজ, ফুয়াদ, তাহিতি এরা কোথায় মামি?
ফিরোজ নেই। কক্সবাজারে গেছে। ফুয়াদ-তাহিতি আছে। তাহিতির কাল থেকে পরীক্ষা শুরু হবে। তাই তাহিতি ওর ঘরে পড়ছে। আর ফুয়াদ গতকাল অনেক রাত করে অফিস থেকে ফিরেছে, তাই এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। তুমি একটা কাজ করো, তুমি তাহিতির ঘরে যাও। ওকে একটু ইংরেজিটা দেখিয়ে দাও। ও আবার ইংরেজিতে একটু কাঁচা। তুমি তাহিতির ঘরে যেয়ে বসো, আমি তোমার জন্য চা করে নিয়ে যাচ্ছি।
রাহেলা তার স্বামী বজলু সাহেবের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে বলল, তুমি এইভাবে খালি গায়ে মাথায় ভিজা গামছা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও গোসল করে নামাজের জন্য তৈরি হও গিয়ে। আনিস তুমিও তো নামাজ পড়বে তাই না?
জি মামি।
তাহলে যাও, তুমি তাহিতিকে একটু পড়া দেখিয়ে দাও। নামাজের এখনো দেরি আছে। এই ফাঁকে তুমি তাহিতিকে ইংরেজিটা একটু দেখিয়ে দাও, কেমন?
ঠিক আছে মামি।
আনিস আর কথা না বাড়িয়ে তাহিতির রুমের দিকে চলে গেল। বজলু সাহেব এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
রাহেলা এবার একটু ঝাঁজের সাথে বলল, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমাকে না বললাম ফ্রেশ হয়ে নামাজের জন্য রেডি হও?
বজলু সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
আনিসকে দেখে তাহিতির মুখ অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে গেল।
আরে আনিস ভাই যে, কী ব্যাপার? রাস্তা ভুল করে আসেননি তো? ঢাকায় আসার অনেক দিন হয়ে গেল শুনেছি। আর আমাদের এখানে আসার সময় হলো আজকে?
তাহিতি একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাহিতি জানে তার এই ভাইটি একটু লাজুক স্বভাবের। কথা কম বলে। তারপরেও তাহিতি আবারও বলল, কী ব্যাপার, আমি একসাথে এতগুলো কথা বললাম, আর আপনি কোনো উত্তর দিলেন না যে!
আসলে আব্বা মারা যাওয়ার পর সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। তুই তো জানিস, আমি এমনিতেই খুব একটা কথা বলতে পারি না। তার উপর আব্বা মারা যাওয়ার পর কথা বলার মাত্রা আরো কমে গেছে। আনিসা আর মাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি। ওরা বাসায় একা। আনিসারও সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আমারও এখনো একটা চাকরি হলো না। ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট টিউশনি করি। সব মিলিয়ে আমার বা আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। সে যাই হোক, মামির কাছে শুনলাম, কাল থেকে নাকি তোর পরীক্ষা শুরু হবে। তোর ইংরেজিতে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে আমাকে বল, আমি তোকে দেখিয়ে দেই। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নে। নামাজ শেষ করে আমাকে আবার টিউশনিতে যেতে হবে।
কেন? আজ তো শুক্রবার!
সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে হয়। শুক্র, সোম আর বৃহস্পতিবার।
শুক্রবার পড়াতে হয় কেন? শুক্রবারে তো কেউ টিউশনি করে না।
কেয়া করে।
কে করে বললা?
কেয়া। আমি যাকে পড়াই তার নাম কেয়া। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
আনিসের মুখে কেয়া নামটা শুনার পর তাহিতি অনেকটা মলিন হয়ে গেল।
কি রে, তুই এমন চুপ হয়ে গেলি কেন?
না কিছু না। এমনিতেই।
কই তাড়াতাড়ি কর। তোর সমস্যাগুলো কোথায়?
তাহিতি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আনিসকে তার ইংরেজি বই বের করে দিল।
নামাজ শেষ করে সবাই একসাথে খেতে বসল। ফুয়াদ আনিসকে পেয়ে মহা খুশি। ফুয়াদ অনেকটা উৎফুল্ল গলায় বলল, আনিস ভাই, আজকে তোমাকে আর ছাড়ছি না। অনেক দিন পর তোমাকে পেয়েছি। আজ বিকেলবেলা তোমাকে নিয়ে বের হবো। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে। জরুরি কথা। কারো সাথে শেয়ার করা দরকার। সবার সাথে আবার শেয়ার করা যাচ্ছে না। তুমি অনেক বুদ্ধিমান। তোমার সাথে শেয়ার করলে তুমি আমার কিছু প্রবলেম সলভ করে দিতে পারবে। খাওয়া শেষ করে আমার রুমে চলো। প্রাথমিক আলোচনাটা আমরা আমার রুমেই সেরে নিতে পারি।
খাওয়ার টেবিলে সবাই চুপ করে ফুয়াদের কথা শুনছে। ফুয়াদের বাবা বজলু সাহেব ফুয়াদের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। রাহেলা আর তাহিতি চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। আনিস ফুয়াদের কথা বেশ মন দিয়ে শুনছে। ফুয়াদ তার বাবার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার বাবা, তুমি আমার দিকে এমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছ কেন? আমি তো অবাক করার মতো কোনো কথা বলি নাই! কি রে তাহিতি, আমি কি অবাক করার মতো কোনো কথা বলেছি?
তাহিতি তার ভাই ফুয়াদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল।
বজলু সাহেব তার ছেলের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল, তোর আবার কী সমস্যা হয়েছে? কই, আমাদের তো কিছু বলিসনি!
ফুয়াদ তার বাবার কথায় স্বাভাবিকভাবে বলল, এটা তোমাদের সাথে ডিসকাস করার বিষয় নয় বাবা। এটা আনিস ভাইয়ের সাথে ডিসকাস করা যেতে পারে। এই কথা বলে ফুয়াদ অনেকটা তৃপ্তির হাসি দিল।
বজলু সাহেব একটু অবাক হলো। কারণ এই প্রথম ফুয়াদ তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল। বজলু সাহেব রাহেলার দিকে তাকাল। যে তাকানোর অর্থ হচ্ছে, ‘তোমার কারণে ছেলেটি আমার রসাতলে যাচ্ছে। ’
রাহেলা স্বামীর চোখের ভাষা মনে হয় বুঝতে পারল। তাই ফুয়াদকে লক্ষ্য করে বলল, কি রে ফুয়াদ, তোর আবার কী সমস্যা? অফিসে কি কিছু হয়েছে?
না মা, তেমন কিছু না। এটা অন্য বিষয়। তোমরা বুঝবে না।
বুঝিয়ে বললেই হয়।
কী আশ্চর্য! তোমরা তো দেখছি আমাকে ঠিকমতো খেতেও দিবে না! আমি কী না কী বললাম, আর তুমি আর বাবা মিলে আমাকে পেয়ে বসলে! বললাম তো, তেমন কিছু না।
আনিস বলল, না রে ফুয়াদ, আজ আমার টিউশনি আছে। খাওয়া শেষ করে আমাকে মোহাম্মদপুরে যেতে হবে পড়ানোর জন্য। তাই আজ আর তোর কথা শুনা হবে না। তুই আমাকে আরেক দিন বলিস।
আনিসের কথা শেষ হতেই ফুয়াদ অনেক উল্লসিত হয়ে বলল, তুমি মোহাম্মদপুরে যাবে? আমিও তো ওই দিকেই যাব। তাহলে তো ভালোই হলো। চলো, আমি তোমাকে নামিয়ে দিব। যেতে যেতে তোমার সাথে কথা বলা যাবে। অনেক দিন তোমার সাথে ঠিকমতো কথা হয় না।
খাওয়ার টেবিলে আর কোনো কথা হলো না। সবাই চুপচাপ খাওয়ার পর্ব শেষ করল। তাহিতির মুখে কোনো কথা নেই। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে তার রুমে চলে গেল।
আনিস তার মামা-মামিকে সালাম জানিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মামা বলল, একটু দাঁড়াও।
জি মামা!
তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি। রাহেলা, তুমি একটু আমার সাথে আসো।
রাহেলা আর বজলু সাহেব একটু পরে বসার রুমে ঢুকল। রাহেলা আনিসের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, আনিস এটা রাখো।
আনিসের বেশ লজ্জা করতে লাগল। আনিস কখনো কারো কাছ থেকে এইভাবে টাকা নেয়নি। তাই আনিস একটু বিব্রতবোধ করতে লাগল।
বজলু সাহেব বলল, কী ব্যাপার, তুমি তোমার মুখ এমন নতুন বউয়ের মতো লাল করেছ কেন? আমি তোমাদের ঠিকমতো খেয়াল করতে পারিনি। তোমাদের কোনো খোঁজও তেমন নিতে পারিনি। বুবু আর তোমরা নিশ্চয়ই আমার উপর রাগান্বিত। তোমাদের উপর আমার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন আমি করতে পারিনি। তোমার মামি তোমাকে খুশি হয়ে দিয়েছে। এতে লজ্জায় লাল হওয়ার কিছু নেই। আর তোমার মায়ের সাথে আমি কথা বলব। দেখি তোমার জন্য একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কি না। তুমি তোমার একটা বায়োডাটা নিয়ে আগামী রবিবারে আমার অফিসে দেখা করো।
মামার কথায় আনিসের চোখে পানি আসার জোগাড়। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে আনিস মামির হাত থেকে টাকাটা নিয়ে মামা-মামিকে সালাম করে ফুয়াদসহ বের হয়ে এলো। তাদের গন্তব্য এখন মোহাম্মদপুর।
রিকশায় করে আনিস আর ফুয়াদ মোহাম্মদপুরের দিকে যাচ্ছে। ফুয়াদ যাবে শ্যামলী। যাওয়ার সময় আনিসকে মোহাম্মদপুরে নামিয়ে দিয়ে যাবে। অনেকক্ষণ দুজন চুপচাপ বসে আছে। ফুয়াদ কী যেন চিন্তা করছে বলে
মনে হচ্ছে।
কি রে, কী ভাবছিস?
না, তেমন কিছু না আনিস ভাই।
তুই না কী যেন বলবি বললি?
বলব আনিস ভাই। তার আগে চলো দুজনে মিলে এক কাপ চা খাই।
চা খাবি মানে! রিকশায় তোকে কে চা খাওয়াবে?
রিকশায় কেন খাব, রিকশাকে বিদায় করে তারপর খাব। আবাহনী মাঠের সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। খুব ভালো চা বানায়। ঢাকা শহরে তো ভালো চা পাওয়া যায় না বললেই চলে! আমি মাঝে মাঝেই এখানে এসে চা খাই। তুমি একবার খেলে তোমারও মাঝে মাঝে এখানে এসে চা খেতে মন চাইবে। এই রিকশা, থামাও।
রিকশাওয়ালা ফুয়াদের কথায় একটু বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল। বিরক্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, তার সাথে কথা হয়েছিল শ্যামলী পর্যন্ত। কিন্তু মাঝপথে তাকে বিদায় দেয়া হচ্ছে! এটা তার কাছে একধরনের অপমানস্বরূপ! রিকশাওয়ালা বিরক্ত নিয়ে আবাহনী মাঠের সামনে রিকশা থামাল। ফুয়াদ রিকশাওয়ালাকে পঁচিশ টাকা দিল। রিকশাওয়ালা মনে হয় তাতে খুশি নয়। মুখে কিছু না বললেও টাকা না নিয়ে তিনি বললেন, টাকা লাগব না!
ফুয়াদ অবাক হয়ে বলল, লাগব না মানে? তোমাকে কি কম ভাড়া দিয়েছি? ধানমন্ডি ৪-এর থেকে আবাহনী মাঠের ভাড়া কি এর চেয়ে বেশি নাকি?
রিকশাওয়ালা ফুয়াদের কথার কোনো উত্তর দিল না। তাতে করে ফুয়াদের মাথায় রক্ত উঠে গেল! কী ব্যাপার, কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? তোমাকে কি কম ভাড়া দিয়েছি?
আনিস চুপচাপ দুজনের কথা শুনছিল। আনিস বুঝতে পারছে এখন
একটা ঝামেলা হতে পারে। কারণ, ফুয়াদ বেশ রাগান্বিত হয়ে গেছে। তাই আনিস ঘটনাটি বেশি দূর যেতে না দিয়ে বলল, ফুয়াদ, তুই আরো পাঁচ টাকা দিয়ে দে।
তাতে করে ফুয়াদ আনিসের উপর রেগে গেল। পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিব মানে! পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিব কেন? আমি আমার বাসার সামনে থেকে বিশ টাকা দিয়ে এখানে আসি। বলতে গেলে প্রায় দিনই আসি। তুমি ভাড়া নিতে না চাইলে যাও তোমাকে ভাড়া দিব না। আনিস ভাই চলেন!
আনিস ফুয়াদের কথায় সায় না দিয়ে বলল, ফুয়াদ তুই ত্রিশ টাকা দিয়ে দে। আমি বলছি তুই দিয়ে দে।
আনিসের কথায় ফুয়াদ আর কিছু না বলে আরো পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে ত্রিশ টাকা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে বলল, আপনার বয়স বেশি হওয়ায় আপনার সাথে বাড়াবাড়ি করলাম না। তবে আপনি ন্যায্য ভাড়া না নিয়ে প্রায় দশ টাকা বেশি নিলেন।
রিকশাওয়ালা তার কথার কোনো জবাব দিল না। ঝাঁজের সাথে শব্দ করে থুথু ফেলল। এতে করে ফুয়াদের রাগের মাত্রা বেড়ে গিয়ে গামা লেভেলে পৌঁছে গেল! কী ব্যাপার, তুমি আমার দিকে এইভাবে তাকাচ্ছ কেন? তুমি মুরব্বি মানুষ হওয়ায় তোমাকে কিছু বললাম না বলে তুমি লাই পেয়ে গেছ? ত্রিশ টাকা দিয়েছি, তাতেও তোমার পেট ভরে নাই? এই কারণেই তোমাদের সাথে মানুষের ঝামেলা হয়। তুমি কি এইখান থেকে যাবে, নাকিÑ
আনিস ফুয়াদকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ফুয়াদ, তুই চুপ কর তো। মামা, আপনি দয়া করে এখান থেকে যান। আপনাকে ত্রিশ টাকা ভাড়া কম দেয়া হয়নি। এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনি দয়া করে এখান
থেকে যান।
রিকশাওয়ালা আনিসের কথায় সেখান থেকে চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে ফুয়াদের দিকে কড়াভাবে একবার তাকাল। যাওয়ার সময় কী যেন বিড়বিড় করতে করতে গেল। হয়তো মনে মনে বকাঝকা দিল।
আনিস ভাই, তুমি তো ভাই ঢাকা শহরে এইভাবে চলতে পারবে না। রিকশাওয়ালাদের মাথায় তুলবে না। এরা এমনই। তুমি দেখবে যখন তোমার খুব তাড়া থাকবে, তুমি রিকশা খুঁজে পাবে না। আর যদি ভাগ্যক্রমে
পেয়েও যাও, তাহলে দেখবে বিশ টাকার ভাড়া চল্লিশ টাকা চেয়ে বসে আছে! আবার যখন রোদের পরিমাণ বেশি থাকবে বা বৃষ্টি হচ্ছে, তখন দেখবে রিকশাওয়ালাদের চালচলন জমিদারের মতো হয়ে যাবে। তুমি তাকে হাজার বার ডাকলেও তোমার ডাকে সাড়া দিবে না। তারা এমন একটা ভাব করবে, যেন তোমার ডাক তারা শুনতে পায়নি। আর যদি তোমার ডাকে সাড়া দেয়ও তাহলে ভাড়া শুনে তোমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাবে! যেহেতু তুমি বিপদে পড়েছ, তাই রিকশাওয়ালারা তোমার বিপদের সদ্ব্যবহার একশ’ পারসেন্ট করে ছাড়বে! তাই বলছি, এই শহরে রংপুরের সরলতা দেখিয়ে লাভ নাই আনিস ভাই। তুমি যদি ঢাকায় বসবাস করে তোমার উদারতা, তোমার নৈতিকতা, তোমার ভদ্রতা, তোমার নমনীয়তা ঢাকার মতো সব কিছু ঢেকে না রাখতে পারো তাহলে তুমি ঢাকায় বসবাসের অযোগ্য বলে গণ্য হবে।
আনিস চোখ বড় বড় করে ফুয়াদের কথাগুলো শুনছিল। ফুয়াদের কথা শেষ হওয়ার পর বলল, তোর কথা শেষ হয়েছে? এখন দয়া করে তুই তোর বিখ্যাত চায়ের দোকানে নিয়ে চল। তোর যদি কিছু বলার থাকে দয়া করে তাড়াতাড়ি বল, আমার টিউশনির সময় হয়ে যাচ্ছে। আমার নতুন টিউশনি, দেরি করে যাওয়াটা আমার জন্য সুখকর হবে না।
ফুয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চায়ে চুমুক দিয়ে আনিস সত্যি সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেল। চা’টা আসলেই চমৎকার।
বাহ্! চা’টা সত্যিই ভালো তো!
তুমি সিগারেট খাও আনিস ভাই?
আনিস বলল, না খাই না।
তুমি কিছু মনে কোরো না। আমার সিগারেট খাওয়ার একটু বাজে স্বভাব আছে, কিন্তু তোমার সামনে যেহেতু কখনো খাইনি, তাই একটু বিব্রতবোধ করছি। তুমি অনুমতি দিলে একটা সিগারেট খেতে পারি। কারণ রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া করে মেজাজ বিগড়ে গেছে। তাই সিচুয়েশন ডিমান্ড করছে একটা সিগারেট টানার।
তোর অভ্যাস থাকলে খেতে পারিস। আমি মাইন্ড করব না।
ফুয়াদ সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানতে টানতে ফুয়াদ বলল, আনিস ভাই, এখন তোমাকে যে কথাগুলো বলব, দয়া করে বাসার কারো সাথে শেয়ার কোরো না।
তুই কি সিরিয়াস কিছু কথা বলবি নাকি?
সিরিয়াস কিছু না আনিস ভাই।
তাহলে এমনভাবে বলছিস, মনে হচ্ছে তোর বাসায় শুনলে কেয়ামত নাজিল হয়ে যাবে! অনেকটা সেই রকমই। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
ঠিক আছে ফুয়াদ, অনেক হয়েছে রে ভাই, এখন দয়া করে আসল কথাটা বল, চারটা বেজে এলো প্রায়। আমার যেতে হবে।
আনিস ভাই, আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি। ওর নাম নাজমা। ইডেন কলেজে পড়ে। গত বইমেলায় পরিচয় হয়েছিল। পুরান ঢাকায় থাকে। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। নাজমার একটি ছোট ভাই আছে। বাবা চকবাজারে টিনের ব্যবসা করে। নাজমা দেখতে-শুনতে বেশ সুন্দর। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। কিন্তু ফিরোজ ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে আমি রিস্ক নিতে পারছি না। কারণ বড় ভাইয়ের বিয়ের আগে তো আর ছোট ভাই বিয়ে করতে পারে না, তুমি কী বলো আনিস ভাই?
তা তো ঠিকই। কিন্তু ফুয়াদ, আমি যতটুকু জানি বা লোকমুখে শুনেছি, পুরান ঢাকার মেয়েরা ভালো হয় না। তুই কতদিন থেকে আসমাকে চিনিস?
আসমা না তো, নাজমা।
ও আচ্ছা, নাজমা। স্যরি। এখন তুই বল। তোর সাথে নাজমার সম্পর্ক কত দিনের?
এইটা এপ্রিল মাস তো, বইমেলা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে, তার মানে প্রায় তিন হচ্ছে।
এই তিন মাসে তুই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি!
আনিস ভাই, যাকে বুঝা যায় তাকে বুঝতে তিন মাস লাগে না, তিন দিনেই বুঝা যায়। আমি ওর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মনে হয়েছে, রবনে বানাদে জড়ি।
তার মানে কী?
মানে হিন্দিতে বললাম আর কি। এর মানে হচ্ছে, নাজমাকে আল্লাহ্্ আমার জন্যই তৈরি করেছে।
ও আচ্ছা, তাই নাকি! তবে আমার মনে হয় না তুই মামা-মামিকে রাজি করাতে পারবি।
আরে আমি রাজি করাব কেন! রাজি করাবে তো তুমি।
আমি মানে! আনিস অবাক হয়ে ফুয়াদকে প্রশ্ন করল!
আমি মায়ের কাছে তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। বাবাও তোমার
কথা ভালো বলে। আমার বিশ্বাস তুমি বাবা আর মা’কে খুব সহজেই রাজি করাতে পারবে।
তোর মাথা ঠিক নাই ফুয়াদ। আমি মামাকে যমের মতো ভয় পাই। মামার রাগের বিষয়ে তুই ভালো করেই জানিস। ছোটবেলা থেকেই মামাকে ভয় পেয়ে এসেছি। আর তুই কি না বলছিস আমি তোর বিয়ের ব্যাপারে মামাকে রাজি করাতে পারব! তোর মাথা ঠিক নাই। তোর সাথে এই বিষয়ে আমি আর কথা বলতে পারব না। আমার সময় হয়ে গেছে। আমি এখন মোহাম্মদপুরের দিকে রওনা হবো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আনিস আর কথা না বাড়িয়ে একটা রিকশাকে ডাকল। আমি গেলাম রে, ভালো থাকিস। আর শুন, পুরান ঢাকার মেয়ে বিশ্বাস করিস না, ওরা খুব ডেঞ্জেরাস হয়! তাছাড়া মামা জীবনেও ওই মেয়েকে মেনে নিবে না। মেয়ের বাবা শুনলাম টিনের ব্যবসা করে! এই কথা মামা শুনলেই তোদের বাড়িতে কেয়ামত নাজিল হবে। আমার তো মনে হয় মেয়ের বাবা খুব একটা শিক্ষিতও না। তুই এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল, এই কথা বলে আনিস রিকশায় উঠে বসল।
ফুয়াদ বলল, তাহলে আমি তোমার সাহায্য পাব না?
পাবি না কেন, পাবি। তবে এই বিষয়ে আমি তোকে খুব একটা সাহায্য করতে পারব বলে মনে হয় না। তোর সাথে এই বিষয়ে পরে কথা হবে। ভালো থাকিস। এই বলে আনিস রিকশাওয়ালাকে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে বলল।
আনিস রিকশা থেকে পিছন ফিরে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখল, ফুয়াদ মুখটা পটকা মাছের মতো ফুলিয়ে আনিসের রিকশার দিকে তাকিয়ে আছে।
(চলবে)