গল্প-কবিতা

হুমায়ুন কবির হিমু’র উপন্যাস ‘ভালোবসায় বজ্রপাত’ (৭ম পর্ব)

জনপ্রিয় তরুণ লেখক হুমায়ুন কবির হিমু’র প্রেমের উপন্যাস ‌‌’ভালোবাসায় বজ্রপাত’ উপন্যাসটি পড়তে চোখ রাখুন ‘চিত্রদেশ’ এর সাহিত্য পাতায়।

পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ‘ভালোবাসায় বজ্রপাত’ প্রকাশিত হচ্ছে । আজ রইল উপন্যাসের (৭ম পর্ব)

জাকিয়ার আজ মন খুব ভালো। কারণ আজ তার বেতন হয়েছে। যেদিন জাকিয়ার বেতন হয় সেদিন জাকিয়ার মনটা অনেক ভালো থাকে। বেতন হলে জাকিয়া বাসার সবার জন্য কেনাকাটা করে। কেনাকাটা জাকিয়ার একট শখ। সবাইকে কিছু দিতে পারলে জাকিয়ার অনেক আনন্দ হয়। বেতনের টাকা বুথ থেকে তুলে জাকিয়া সোজা চলে গেল নিউ মার্কেটে। তার বাবার জন্য একটা ভালো দেখে পাঞ্জাবি আর মায়ের জন্য একটা সুন্দর টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ি কিনল। কেয়ার জন্য জামা না কিনে কেয়ার পছন্দের কিছু কসমেটিকস কিনল। তার নিজের জন্য একটি নীল রঙের শাড়ি কিনল। নীল রংটা জাকিয়ার সব সময়ের জন্য প্রিয় রং। এই শাড়িটা জাকিয়া কিনেছে একটি বিশেষ দিনে পরার জন্য। জাকিয়া মনে মনে ঠিক করে রেখেছে যেদিন সে আনিসের সাথে প্রথম বাইরে ঘুরতে যাবে সেদিন সে এই শাড়িটি পরবে। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে জাকিয়া চুড়ি আর কিছু কসমেটিকস কিনল। আর আনিসের জন্য একটি কালো রঙের ফতুয়া কিনল। এই ফতুয়াটি জাকিয়া আনিসকে উপহার দিবে। সব কিছু কিনা শেষ করে জাকিয়ার মুখ দিয়ে এমনিতেই একটা তৃপ্তির হাসি বের হলো। তার খুব আনন্দ হচ্ছে। বাসায় গেলে নিশ্চয়ই এই সব কেনাকাটার জন্য মায়ের একগাদা বকা খাবে। জাকিয়া নিউ মার্কেট থেকে একটা রিকশা ঠিক করে সোজা বাসায় চলে এলো। কলিংবেল টিপতেই শামীমা দরজা খুলে মেয়ের দিকে হাতে শপিং বেগ দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল।
মা, তুমি তোমার চোখ ছোট করো। তা না-হলে যেকোনো সময় তোমার চোখ বের হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে পারে। তখন তোমাকে নিয়ে হবে আরেক বিপদ। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর মা, এত তাড়াতাড়ি এই পৃথিবীটাকে তুমি অন্ধকার করে দিও না।
জাকিয়ার রসিকতায় শামীমার চোখ আরো বড় হয়ে গেল। তুই আবার একগাদা কেনাকাটা করেছিস? প্রতি মাসে এই কাজ না করলে কি তোর পেটের ভাত হজম হয় না? তোকে কতবার নিষেধ করেছি এই সব না করার জন্য! তারপরেও তুই প্রতি মাসে এই কাজ করে যাচ্ছিস। আমাদের কি কাপড়-চোপড়ের কোনো অভাব হয়েছে? টাকা-পয়সা একটু সঞ্চয় কর রে মা। সামনে তোর বিয়ের জন্য অনেক খরচ লাগবে। তখন অনেক খরচের ব্যাপার হবে। তাই বলি, প্রতি মাসে এই সমস্ত অযথা খরচ না করে ভবিষ্যতের জন্য কিছু জমিয়ে রাখ। তাতে করে তোর ভালো হবে।
মা, তোমার এই সমস্ত কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমার বিয়ের জন্য আমাকে টাকা জমাতে হবে কেন? তোমার এই জাকিয়াকে বিয়ে দেয়ার জন্য তোমাদের কোনো টেনশন করতে হবে না মা। আমার বিয়েতে টাকা-পয়সার কোনো প্রয়োজন হবে না। আমাকে যে বিয়ে করবে সে-ই সব কিছু ম্যানেজ করে আমাকে বিয়ে করবে। তোমার এই মেয়েটির চেহারা কি খুব খারাপ নাকি মা? কথাগুলো জাকিয়া তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল।
নে অনেক হয়েছে। এখন এই সব রেখে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি তোর জন্য নাশতা রেডি করে আনছি।
বাবা কোথায় মা?
তোর বাবার শরীরটা মনে হয় ভালো না। তার ঘরে শুয়ে আছে। আর কেয়া তার ঘরে পড়ছে।
ঠিক আছে মা, আমি বাবার ঘরে যাচ্ছি, তুমি আমার আর বাবার জন্য চা করে নিয়ে আসো। আর কেয়াকে বাবার ঘরে আসতে বলো।

ফরহাদ সাহেব বিছানায় খাটের সাথে হেলান দিয়ে টিভিতে পুরানো একটি ছবি দেখছে। ছবির নাম দীপ জেলে যাই। উত্তম-সুচিত্রার বিখ্যাত ছবি। এইবার নিয়ে ফরহাদ সাহেব এই ছবিটি মনে হয় পঞ্চাশবার দেখছে। উত্তম-সুচিত্রা ফরহাদ সাহেবের প্রিয় নায়ক-নায়িকা। রিমোটের মাধ্যমে চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে কোনো চ্যানেলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি হলেই ফরহাদ সাহেবের চোখ স্থির হয়ে যায়। তিনি চোখ বড় বড় করে মুখ হাঁ করে ছবি দেখতে থাকেন। তাকে তখন দেখলে মনে হবে, সে ছবি দেখছে না, ছবি গিলছে। মানুষ এত সুন্দর করে কীভাবে অভিনয় করে? এই প্রশ্নটা তার মনে বারবার উঁকি মারে।
বাবা তুমি কেমন আছ? মা’র কাছে শুনলাম তোমার নাকি শরীরটা
ভালো না?
জাকিয়া যে তার ঘরে ঢুকে তাকে পর পর দুটি প্রশ্ন করেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। তিনি হাঁ করে চোখ বড় বড় করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন।
জাকিয়া আর কথা না বলে ফরহাদ সাহেবের পাশে যেয়ে তার গায়ে হাত দিয়ে বলল, কী ব্যাপার বাবা, তুমি এমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো কী দেখছ?
ফরহাদ সাহেব চোখের ইশারা দিয়ে জাকিয়াকে চুপ করতে বলল। জাকিয়া একটু অবাক হয়ে চুপ করে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। যার অর্থ হচ্ছে, তার বাবা ফরহাদ সাহেবের কানে এখন কিছুই ঢুকবে না। তার বাবা এখন মহাকাজে ব্যস্ত। উত্তম-সুচিত্রার ছবি হলে ফরহাদ সাহেবের খাওয়া-দাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। এই নিয়ে তার মায়ের সাথে কয়েকবার ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে গেছে। কোনো উপায় না পেয়ে জাকিয়াও বাবার সাথে খাটে বসে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতে লাগল।
শামীমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল বাবা আর মেয়ে চুপচাপ খাটে বসে টিভি দেখছে। শামীমা যে ঘরে ঢুকেছে ফরহাদ সাহেব তা দেখেনি। আসলে সে এখন কিছুই দেখছে না। তার চোখের সামনে এখন উত্তম-সুচিত্রা ছাড়া আর কিছুই নেই।
শামীমা চায়ের পিরিচটা টি-টেবিলে রেখে টিভিটা অফ করে দিয়ে বলল, অনেক হয়েছে। এই একই ছবি বিয়ের পর থেকে কতবার দেখেছ তোমার মনে আছে? যখনই এই ছবি হয় তখনই দেখতে হবে। বললাম তোমার শরীর যখন ভালো না, বিছানায় শুয়ে একটু রেস্ট নাও। আমার কথা কি তোমার কান দিয়ে ঢুকে?
ফরহাদ সাহেবের মেজাজের স্কেল সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেলেও চুপ করে রইল। ইদানীং শামীমার সাথে সে খুব একটা ঝগড়ায় জড়ায় না। কারণ শামীমা রাগলে দুর্গার রূপ ধারণ করে। তখন তাকে থামানো শুধু মুশকিলই নয় নামুনকিনভি হ্যায়। ফরহাদ সাহেব ছবিটি শেষ করতে না পেরে মুখ কালো করে মাথা নিচু করে বসে রইল।
ফরহাদ সাহেবের এই চেহারা দেখে জাকিয়ার খুব খারাপ লাগতে লাগল। পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য জাকিয়া বলল, বাবা, আজ তোমার জন্য একটি চমৎকার পাঞ্জাবি এনেছি। যা পরলে তোমাকে উত্তম কুমারের চেয়ে কোনো অংশেই কম লাগবে না।
তাতেও ফরহাদ সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হলো না। তিনি শুধু একবার তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
বাবা, এইভাবে মুখ পাতিলের মতো কালো করে বসে থেকো না তো। তোমার মন খারাপ দেখলে আমার ভালো লাগে না।
জাকিয়ার মুখে মুখ পাতিলের মতো কালো শব্দটি শুনে ফরহাদ সাহেব উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। ফরহাদ সাহেবের হাসিতে শামীমা তার স্বামীর দিকে চোখ বড় বড় করে থাকিয়ে থাকল। তুই এই শব্দটি কোথায় পেলি রে মা?
কোন শব্দটি বাবা?
এই যে বললি, মুখ পাতিলের মতো কালো করে বসে থেকো না তো বাবা।
শামীমা রাগতস্বরে বলল, কোথায় শিখবে আবার! তোমার কাছ থেকে শিখেছে। তুমি যেমন আমাকে বলো। তোমার মেয়ে আজ তাই তোমাকে বলেছে। এই কথা বলে শামীমা একটু মুচকি হাসি দিল।
ফরহাদ সাহেব শামীমার দিকে উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে, তার কাছে মনে হচ্ছে কতদিন পর শামীমার হাসি সে দেখল! তার মনটা ভালো হয়ে গেল। সকাল থেকে যে তার শরীরটাতে একটা খারাপ ভাব ছিল, শামীমার হাসি দেখে তা মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
আপা, তুমি নাকি সারা মার্কেট নিয়ে আজ বাসায় এসেছ? কেয়া তার বাবার ঘরে ঢুকেই জাকিয়াকে চোখে-মুখে এক সমুদ্র আনন্দ নিয়ে প্রশ্ন করল। কই দেখি কার জন্য কী এনেছ? আমার জন্য কসমেটিকসের কথা বলেছিলাম। তুমি সেগুলো এনেছ তো?
মা তুমি খাটে এসে বসো। আমি এক এক করে দেখাচ্ছি।
শামীমা এসে তার স্বামীর পাসে বসল। এইটাও ফরহাদ সাহেব বেশ অবাক হয়ে লক্ষ করল। কাহিনি কি? শামীমা কি আগের চেয়ে একটু চেঞ্জ হয়ে গেল নাকি? ফরহাদ সাহেব মনে মনে একটু আনন্দবোধ করতে লাগল। জাকিয়া এক এক করে সবার প্যাকেট খুলে যার যার কাপড় তার তার হাতে তুলে দিল। কেয়া তো তার মনের মতো কসমেটিকসগুলো পেয়ে মহাখুশি। খুশিতে সে জাকিয়াকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটি চুমু দিয়ে বলল, আপা, তুমি গ্রেট। তুমি আমার লক্ষ্মী আপু।
শামীমা বলল, আমার শাড়িটা তো খুব সুন্দর কিনেছিস! দাম কত
নিয়েছে রে?
এই তো মা, তুমি আমার মনটা খারাপ করে দিলে, তোমার পছন্দ হয়েছে এটাই বড় কথা। দাম শুনে কী হবে!
ওমা, শাড়িটার দাম শুনার মাঝে তোর আবার মন খারাপ হবে কেন?
হবে মা হবে, কারণ দাম শুনলে তুমি আবার আমাকে বকাবকি করতে থাকবে, তখন আমার মনটা খারাপ হবে। তাই দাম তোমাকে বলা যাবে না।
তার মানে শাড়িটার দাম অনেক বেশি, তাই না?
খুব একটা বেশি না মা, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
দাম শুনে শামীমা তার চোখ কপালে তুলে বলল, আমার জন্য পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি তোকে কে কিনতে বলেছে?
জাকিয়া তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আমার দশটা না পাঁচটা না, একটা মাত্র লক্ষ্মী মা, তার জন্য কি আমি কম দামি শাড়ি কিনব, তুমিই বলো?
জাকিয়ার কথায় শামীমার চোখে পানি আসার জোগাড় হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে শামীমা বলল, আজ একটু পায়েস করেছি, তোরা
বস, আমি নিয়ে আসছি। শামিমা নিজেকে আড়াল করার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
যার ঘরে তোর মতো মেয়ে আছে, তার কি আর ছেলে সন্তানের প্রয়োজন আছে? আমি অনেক গর্বিত তোদের মতো সন্তান আমার আছে বলে। আমি গর্ব নিয়ে বলতে পারি, আমার মেয়ে দুটিই আমার ছেলে সন্তানের চেয়ে ঢের ভালো। ফরহাদ সাহেব তার দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে কথাগুলো বলতে লাগল।
আবার শুরু করলে বাবা! তোমাকে না বলেছি আমাদের নিয়ে তুমি কোনো প্রকার টেনশন করবে না।
টেনশন করি না রে মা, গর্ব করি। এখন শুধু একটি ভালো ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে পারলেই আমি মরেও শান্তিতে থাকতে পারব।
আমার জন্য তোমার ভালো ছেলে খুঁজতে হবে না বাবা।
কেন, তুই কি কোনো ভালো ছেলের সন্ধান পেয়েছিস নাকি?
ফরহাদ সাহেবের এই কথায় জাকিয়া মনে হয় একটু লজ্জা পেয়ে গেল। কি রে চুপ করে আছিস যে, কাউকে কি তোর পছন্দ হয়েছে নাকি রে মা?
তুমি কী যে বলো না বাবা, আমার কাউকে পছন্দ হবে আর তুমি জানবে না, তাই কি হয়? সবার আগে আমি তো তোমাকেই সে কথা বলব।
কেয়া জাকিয়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আর মুখ টিপে মুচকি মুচকি হাসছে।
আমাদের জন্য যা এনেছিস তা তো দেখালি, তোরটা তো দেখালি না
রে মা।
জাকিয়া তার জন্য আনা নীল রঙের শাড়িটা প্যাকেট থেকে বের করে দেখাল। শাড়িটা দেখে কেয়া বলে উঠল, ওয়াও আপু। এই শাড়ি পরলে তো তোমাকে পরির চেয়ে সুন্দর লাগবে! অসম্ভব সুন্দর শাড়ি আপু!
খুব সুন্দর হয়েছে রে মামা। এই প্যাকেটটাতে কী এনেছিস?
বাবার কাছে এই প্রশ্ন শুনে জাকিয়া একটু থতমত খেয়ে গেল। আনিসের জন্য কেনা ফতুয়ার প্যাকেটটা যে তার ঘরে রেখে এসে বাবার ঘরে ঢুকবে সেটা তার মনে ছিল না। জাকিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ওটাতে বাবা আমার কিছু পার্সোনাল জিনিস আছে বাবা।
ও আচ্ছা, ঠিক আছে।
বাবা তুমি রেস্ট নাও, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে তোমার সাথে গল্প করব। এই কথা বলে জাকিয়া তার বাবার সামনে থেকে বের হয়ে এলো। বের হয়ে এলো না বলে বলা যায় জাকিয়া তার বাবার ঘর থেকে পালিয়ে এলো। অল্পের জন্য রক্ষা হয়েছে। এক্ষুনি ধরা খেয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল।
জাকিয়ার পিছে পিছে কেয়াও বাবার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তাদের ঘরে ঢুকে কেয়া বলল, আপা, প্যাকেটটাতে কার জন্য কী আছে?
কেন, বললাম না আমার কিছু পার্সোনাল জিনিস আছে।
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না আপা।
তোর কী মনে হচ্ছে তাহলে?
আমার মনে হচ্ছে তুমি আজও আনিস স্যারের জন্য কিছু কিনেছ।
জাকিয়া তার ছোট বোনের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। মনে মনে জাকিয়া ভাবতে লাগল, কেয়ার কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে নাকি? কেয়া কীভাবে জানল যে সে আনিসের জন্য কিছু কিনেছে?
কী আপা, আমি ঠিক বলিনি?
জাকিয়া চোখ বড় বড় করে কেয়াকে বলল, তুই কীভাবে জানলি?
কেয়া তার বোনের এই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি মুচকি
হাসতে লাগল।
জাকিয়া কথা ঘুরানোর জন্য বলল, কি রে কেয়া, তোর স্যার কি
আজ আসবে?
না আপা, আজ আসবে না, স্যার বরিশালে যাবে। তার মেসের নাকি একজনের আগামীকাল বিয়ে হবে। মেসের সবাই মিলে তারা আজ রাতে বরিশাল যাচ্ছে। তাই আসতে পারবে না।
কেয়ার কাছে কথাটা শুনে জাকিয়ার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। কেয়ার চোখ তা এড়াল না। কেয়া জাকিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আপু, তোমার সাথে আনিস স্যারের বিয়ে হলে তুমি অনেক সুখে থাকবে। আনিস স্যার অনেক ভালো মানুষ আপু। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, তোমার মনের কথা আনিস স্যারকে বলে দাও। তা না-হলে দেরি হয়ে যেতে পারে।
জাকিয়া কেয়ার কথার কোনোই উত্তর না দিয়ে কেয়ার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল।

শেরোয়ানি, পায়জামা, পায়ে কলাপুরি বাদশাহী চটি আর মাথায় বিয়ের টুপিতে শাহাদৎকে জামাই হিসাবে দেখতে দারুণ লাগছে। বরযাত্রী হিসাবে প্রায় একশ’ জন রওনা হয়েছে। একটি প্রাইভেট কার, চারটি মাইক্রো বাস আর একটি বাস নিয়ে শাহাদৎ বিয়ে করার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। শাহাদতের সাথে প্রাইভেট কারে বসেছে আশরাফুল, মনোয়ার, জাহিদ, রিপন আর আনিস। সামনের সিটে বসেছে রিপন আর আনিস। পিছনের সিটে নতুন জামাইয়ের সাথে আছে জাহিদ, মনোয়ার আর আশরাফুল।
শাহাদৎ তার মুখে রুমাল দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তা দেখে রিপন বলল, শাহাদৎ ভাই, এখন তো মুখে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার কোনো কারণ নেই। যখন কনের বাড়ির কাছাকাছি চলে আসব, তখন মুখে রুমাল দিলেই হলো।
রিপনের কথায় শাহাদৎ মনে হয় একটু লজ্জা পেল। শাহাদৎ দেখতে একটু ফর্সা প্রকৃতির। উচ্চতাও খুব একটা বেশি না। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির মতো হবে। বিয়ে করার জন্য গাড়িতে ওঠার আগ থেকেই শাহাদৎ লজ্জায় লাল
হয়ে আছে।
মনোয়ার বলল, শাহাদৎ ভাই, আপনার তো কপাল ভালো, আপনার বয়স অনুযায়ী তো ফাটাফাটি টাইপের মেয়ে বউ হিসাবে পেয়েছেন। আমার তো মনে হয় আপনার বয়সের সাথে আপনার বউয়ের কমপক্ষে দশ থেকে বারো বছরের গ্যাপ।
এই কথা শুনে শাহাদৎ মুখ থেকে রুমাল খুলে মনোয়ারের দিকে কড়া চোখে তাকাল। আপনি কী করে বুঝলেন যে আমার চেয়ে আমার বউয়ের বয়সে এত গ্যাপ? যা বলার বলেছেন ভাই, দয়া করে মেয়ের বাড়িতে যেয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বইলেন না। এমনিতেই অনেক কষ্টে আব্বা আমার জন্য এই মেয়েটি আমার বিয়ের জন্য ঠিক করেছে। মেয়েটি দেখতে-শুনতে ভালো। তাদের পরিবারও তাদের এলাকার নামী-দামি। তাই ভাই এমন কিছু বইলেন না যে আমার বিয়েতে সমস্যা হয়।
জাহিদ মনোয়ারের দিকে লক্ষ করে বলল, মনোয়ার ভাই, আপনি আসলেনই আজ সকালে। এত তাড়াতাড়ি আপনি আবিষ্কার করে ফেললেন যে শাহাদৎ ভাইয়ের চেয়ে তার বউয়ের বয়সের গ্যাপ এত। বেচারা বিয়ে করতে যাচ্ছে, আর আপনি তার আগেই এই রকম একটা আপত্তিকর কথা বলতে পারলেন?
রিপন জাহিদের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, কারে কী কন জাহিদ ভাই, সেই বুদ্ধি কি তার মাথায় আছে যে কোথায় কী বলতে হবে?
রিপন এই কথা শেষ করতেই মনোয়ার রিপনের উপর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, মুখ সামলে কথা বলবেন রিপন সাহেব। আপনার অনেক কথা আমি সহ্য করেছি। আজেবাজে কথা বলার একটা লিমিট আছে। আপনি কি বুঝাতে চান? আমি বোকা? আমার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই।
গাড়িতে রীতিমতো একটা ঝগড়ার পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। শাহাদৎ কোনো কথা না বলে সবার দিকে অবাক চোখে তাকাতে লাগল। আনিস চুপচাপ সবার কথা শুনছে। কিছু বলছে না। কারণ আনিস তাদের মেসে নতুন। আনিস জানে যে মেসের সবাই একে অপরকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে আর ভালোবাসে। তাই বন্ধুদের মাঝে সে চুপচাপ থাকাই নিরাপদ মনে করল।
ভাই, আপনারা একটু চুপ থাকেন। এইটা তো আমাদের মেস না। আমরা একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। প্লিজ, দয়া করে আমরা এমন কিছু না করি যে শাহাদৎ ভাইয়ের বিয়ের ক্ষতি হোক। আশরাফুল সবাইকে লক্ষ করে কথাগুলো বলল।
আশরাফুলের কথায় মনোয়ার চোখ-মুখ লাল করে চুপ করে থাকল। আনিস লক্ষ করল, রিপন মুখ টিপে মুচকি মুচকি হাসছে। রিপনের হাসি লক্ষ করে জাহিদ আর আশরাফুলও মুখচাপা দিয়ে হাসছে।
মনোয়ার তা লক্ষ করে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ওই ড্রাইভার, গাড়ি থামাও। আমি যাব না। আমি এখান থেকে ঢাকায় চলে যাব। আমাকে নিয়ে ফাজলামো শুরু হয়েছে! আমি যাব না। শাহাদৎ ভাই, আমাকে মাফ করে দেন। আমি আপনার বিয়েতে থাকতে পারছি না বলে।
শাহাদৎ গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, আপনি গাড়ি থামাবেন না। আপনি গাড়ি চালিয়ে যান। মনোয়ার ভাই, প্লিজ আপনি একটু শান্ত হন। ভাই আপনার হাতে-পায়ে ধরি, এমন কিছু কইরেন না, যাতে আমার বিয়ে ভেঙে যায়। পিছনের গাড়িতে আমার আব্বা আর আত্মীয়স্বজনরা আছে। তারা এই অবস্থা বুঝতে পারলে আমাকে আর ঢাকায় ব্যাক করতে দিবে না। তাদের ধারণা হবে, আমি যাদের সাথে থাকি তারা মানুষ হিসাবে সুবিধার না। আপনাদের সম্পর্কে বাজে ধারণা হবে। প্লিজ ভাই, চুপচাপ করে বসে থাকেন। আর রিপন ভাই, আপনি আর মনোয়ার ভাইয়ের পিছনে লাইগেন না। আপনি ভালো করেই জানেন, মনোয়ার ভাই সব কিছুতেই সিরিয়াস হয়ে যায়।
শাহাদৎ ভাই, আপনিও তো বাজে কথা বললেন ভাই। আমি সব কিছুতে সিরিয়াস হয়ে যাই মানে! আমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলবে আর আমি চুপচাপ তা শুনে যাব? আপনিও তো ভাই রিপনের পক্ষে কথা বললেন। মনোয়ার কথাগুলো একটু উচ্চৈঃস্বরেই বলল।
শাহাদৎ করুণ চোখে আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই আনিস, আপনি চুপ করে আছেন যে, কিছু একটা বলেন!
আনিস বলল, আমি সবার উদ্দেশেই বলছি, আমি যতটুকু জানি এর আগে শাহাদৎ ভাইয়ের কয়েকটি বিয়ে ভেঙে গেছে। বিয়ে হতে হতে বিয়ে হয়নি। তাই আমরা একটু চুপচাপ থাকি। কারণ আমরা ঢাকা থেকে শাহাদৎ ভাইয়ের বিশেষ গেস্ট হিসাবে এসেছি। আমরাই যদি নিজেদের মাঝে এই রকম শুরু করি তাহলে কিন্তু শাহাদৎ ভাইয়ের বিয়েটা সুস্থভাবে হতে সমস্যা হবে। মনোয়ার ভাই, প্লিজ আপনি একটু শান্ত হন। আপনি চলে গেলে জিনিসটা ভালো দেখাবে না। একসঙ্গে এসেছি, শাহাদৎ ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে আবার আমরা একসঙ্গে চলে যাব। প্লিজ ভাই, একটু শান্ত হন।
আনিসের কথায় মনোয়ারসহ আর সবাই চুপ করে রইল। কিন্তু শাহাদৎ মনে মনে চিন্তা করতে লাগল, আল্লাহ্্ই জানে তার আজ কপালে কী আছে। বিয়ের বাড়িতে যাওয়ার আগেই এই অবস্থা, বিয়ে বাড়িতে না জানি তার জন্য কী অপেক্ষা করছে।
তাদের গাড়ি মেয়ে পক্ষের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। ‘বর আসছে বর আসছে’ বলে চারিদিক থেকে চিৎকার শুনা গেল। মেয়েদের বাড়ির সামনে বিশাল বিয়ের গেট বানানো হয়েছে। সেই গেটে বেশ কয়েকটি মেয়ে একটি লম্বা ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদৎদের গাড়ি ছাড়া বাকি সব গাড়ি থেকে বরযাত্রীরা নেমে গেছে।
শাহাদতের বাবা ছেলের গাড়ির সামনে এসে বলল, বাবা শাহাদৎ, গাড়ি থেকে নামো।
শাহাদৎ গাড়ি থেকে নামতে যাবে এমন সময় রিপন বলে উঠল। আপনি গাড়ি থেকে নামবেন না। চাচাজান, আপনি শাহাদৎ ভাইকে গাড়ি থেকে নামতে বললেন যে? কনে পক্ষের কেউ আসলে তারপর তো শাহাদৎ ভাই গাড়ি থেকে নামবে। আমাদের ছেলেকে তো কনে পক্ষের কেউ এসে নিয়ে যাবে! চাচাজান, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা ছেলে পক্ষ। আমাদের এত নমোনীয় হলে চলবে না।
রিপনের কথায় জাহিদ আর আশরাফুলও সায় দিল। শুধু মনোয়ার চোখ-মুখ কালো করে বসে রইল।
শাহাদতের বাবা রিপনের কথায় হেসে বলল, দেখো বাবা, তোমাদের বন্ধুর বিয়েতে এসেছ, তোমরা যা ভালো মনে করো। কিন্তু মেয়ে পক্ষের কোনো মুরব্বিকে তো দেখছি না। হঠাৎ করে শাহাদতের আব্বা মনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি? তুমি এমনভাবে মুখ করে বসে আছ কেন?
মনোয়ার একটি কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল, নানা চাচাজান, তেমন কিছু হয়নি। গতকাল সারারাত জার্নি করেছি তো, তাই একটু খারাপ লাগছে।
মনোয়ারের কথা শেষ হতেই রিপন কিছু বলতে যাবে এমন সময় একজন বয়স্ক করে লোক গাড়ির সামনে এসে শাহাদতের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বিয়াই ভালো আছেন তো? আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো?
না না। কষ্ট হয় নি। আপনি ভালো আছেন তো বিয়াই?
আছি বিয়াই ভালো আছি। কই আমার বাবাজি কই?
গাড়ির সবাই বুঝতে পারল এই বয়স্ক করে মানুষটি মেয়ের বাবা। তিনি গাড়ির সামনে এসে গাড়ির দরজা খুলে শাহাদৎকে গাড়ি থেকে নামতে বলল। শাহাদৎসহ গাড়ির সবাই গাড়ি থেকে নেমে এলো। মেয়ের বাবার সাথে আরো একজনকে দেখা গেল। অনেকটা লম্বা করে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখে সানগ্লাস। তিনি এসে বরযাত্রীর সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করে শাহাদৎকে কোলে তুলে নিল। শাহাদৎকে কোলে তুলে নেয়ার সময় শাহাদতের মাথার টুপি পড়ে গেল। তা দেখে আশেপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। রিপন শাহাদতের টুপি মাটি থেকে তুলে তার মাথায় পরিয়ে দিল। বরযাত্রীকে গেটে আটকে দেয়া হলো। কোনোভাবেই তাদের গেট দিয়ে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। বেশ কয়েকজন মেয়ে হলুদ শাড়ি পরে গেটের সামনে ফিতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দাবি দশ হাজার টাকা দিতে হবে। তা না-হলে তারা গেট ছাড়বে না। মেয়ের বাবা গেট ছেড়ে দিতে বললেও তারা গেট ছাড়ছে না। তাদের দাবি না মানা হলে তারা গেট ছাড়বে না। রিপন এগিয়ে গিয়ে দশ হাজার থেকে কমাতে কমাতে শেষমেশ তিন হাজার টাকায় একটা রফাদফা করে গেট দিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।
বরের জন্য একটি প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সেখানে শাহাদৎ মুখে রুমাল দিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। তাকে ঘিরে রিপন, জাহিদ, মনোয়ার, আশরাফুল আর আনিস বসে আছে। মাঝে মাঝে মেয়ে পক্ষের
কেউ কেউ এসে শাহাদৎকে দেখে যাচ্ছে। তাতে করে শাহাদৎ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।
আশরাফুল বলল, শাহাদৎ ভাই, এইভাবে মাথা নিচু করে বসে আছেন কেন? মাথা সোজা করে এদিক-সেদিক একটু তাকান। তা না-হলে তো মেয়ে পক্ষের মানুষ বলবে ছেলে তো লাজুক প্রকৃতির। সেটা আপনার জন্য খুব একটা মঙ্গলজনক হবে না। আশরাফুলের কথায় শাহাদৎ মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে বসল।
বরযাত্রীদের হালকা নাশতা দেয়া হয়েছে। নাশতার ম্যেনু দেখে রিপন অবাক হয়ে বলল, একি! সামান্য একটি মিষ্টি আর একটা সিঙ্গারা মানে! এইটা কোনো নাশতা হলো! রিপন কথাটা একটু জোরে বলাতে যিনি নাশতা পরিবেশন করছিলেন তিনি সম্ভবত কথাটা শুনতে পেয়েছেন। তিনি রিপনের দিকে একটু বিরক্ত নিয়ে তাকালেন। লোকটি যে তার দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়েছে রিপন তা দেখতে পেল। তাদের পাশে বসা ছিল শাহাদতের বাবা। তিনি সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। এই নিয়ে কেউ যেন কোনো কথা না বলে তা জানিয়ে দিল।
ইতিমধ্যে কাজি সাহেব চলে এসেছে। কাজি সাহেব নাশতা করছে। নাশতা করেই মেয়েকে কবুল পড়ানোর জন্য তিনি মেয়ের কাছে যাবেন। কাজি সাহেব নাশতা করে শাহাদতের বাবার কাছে যেয়ে একটি রেজিস্ট্রি বই বের করে প্রয়োজনীয় কিছু লেখালেখির কাজ শেষ করল।
রিপন বলল, আনিস সাবেব চলেন, আমরা একটু মেয়েকে দেখি আসি। জাহিদ সাথে আসতে চাইলে রিপন বলল, আপনারা শাহাদৎ ভাইয়ের সাথে বসেন। সবাই চলে গেলে শাহাদৎ ভাই লজ্জায় মারা যাবে। আমরা দেখে আসলে তারপর আপনি, মনোয়ার ভাই আর আশরাফুল ভাই দেখতে যাবেন।
রিপন আনিসকে সাথে নিয়ে বউকে দেখার জন্য স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল। ভিতর বাড়িতে ঢুকে আনিস আর রিপন দেখতে পেল কেমন যেন একটা কানাঘুষা চলছে। সবাই কেমন জানি চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। বাইরের পরিবেশ আর ভিতরের পরিবেশের মাঝে কেমন যেন একটা তফাৎ দেখতে পেল তারা। রিপনের কেমন জানি একটা সন্দেহ হতে লাগল। আনিসকে বলল, আনিস ভাই, নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।
শাহাদৎকে যে লম্বা ছেলেটি কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়েছে তাকে রিপন দেখতে পেল। তার সামনে যেয়ে রিপন জিজ্ঞাস করল, ভাই সবাই চুপচাপ কেন? কিছু হয়েছে নাকি? আমরা একটু বউকে দেখতে চাচ্ছিলাম।
ছেলেটি রিপনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা বাইরের দিকে চলে গেল। রিপনের আরো বেশি করে সন্দেহ হতে লাগল।
আনিস বলল, রিপন ভাই, বিষয়টা কী?
এমন সময় ভিতরের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। আল্লাহ্্রে বলে চিৎকার করে একটি মেয়ে মানুষের কান্না তারা শুনতে পেল। আনিস আর রিপন অবাক হয়ে সেই ঘরের দিকে যেতে চাইলে কেউ তাদের সেখানে যেতে দিল না। তারা থতমত খেয়ে গেল। ঘটনা কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে তারা বুঝতে পারছে না। রিপন একজন মুরব্বি টাইপের মহিলাকে জিজ্ঞাস করল, চাচিজান কী হয়েছে?
মুরব্বি টাইপের মহিলার কাছে তারা যা জানতে পারল, তাতে করে তাদের দুজনের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। মহিলাটি যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে, মেয়েটি এই বিয়েতে রাজি ছিল না। তার বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। মেয়েটির তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম ছিল। একটু আগেও মেয়েটি তার ঘরে ছিল। কিন্তু এখন তাকে ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। তার চাচাতো ভাইকেও পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো মেয়েটি তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে পালিয়েছে।
আনিস চোখ বড় বড় করে রিপনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে রিপন ভাই?
রিপন কোনো কথা না বলে চুপ করে মাটিতে বসে পড়ল। তার মনে পড়ল চুলকানি বাবার কথা। তার বাবা যা বলেছিল তাই সত্য হলো। রিপন তার চুলকানি বাবাকে শাহাদতের বিয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাস করেছিল। বাবা বলেছে, তোর বন্ধুর বিয়ে হতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে। বেশ কয়েকটা বিয়ে ভাঙার পর তোর বন্ধুর বিয়ে হবে। বিয়ের দিন তোর বন্ধুর হবু বউর পালিয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে।
রিপন মনে মনে তার বাবার কারিশমাতে মুগ্ধ হয়ে ‘জয় চুলকানি বাবার জয়, জয় চুলকানী বাবার জয়’ বলতে লাগল।
আনিস বলল, রিপন ভাই কী হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন তো?
রিপন স্বাভাবিক হয়ে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম। বাবা যেহেতু বলেছে এমন একটা হবে, আজ তাই হলো। চলেন বাইরে যাই। শাহাদৎ ভাইয়ের বাবাকে বিষয়টি জানানো দরকার।
তারা ভিতর বাড়ি থেকে বাইরে স্টেজের সামনে চলে এলো। ভিতরের খবর মনে হয় বাইরেও চলে এসেছে। রিপন স্টেজের কাছে যেয়ে দেখতে পেল শাহাদৎ মাথায় পাগড়ি আর মুখে রুমাল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। রিপন আর আনিস বুঝতে পারল, এখনো এখানকার কেউ মনে হয় বিষয়টা জানে না।
শাহাদতের বাবা রিপনকে জিজ্ঞাস করল, কী বাবা, আমার বউ মাকে কেমন দেখলে?
রিপন বা আনিস কেউ কোনো কথা বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তিনি আবার জিজ্ঞাস করলেন, কী হলো, বললে না যে?
রিপন বলল, চাচাজান, আপনি ভিতরে কান্নার শন্দ শুনতে পারছেন না?
তা তো পারছি। বিয়ের বাড়িতে তো এমন কান্নাকাটি হবেই। মেয়ের মা হয়তো কাঁদছে। তাদের মেয়ে আজ এই বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে যাবে, তাতে করে তো তাদের কষ্ট হবেই। তাই কাঁদছে।
রিপন আর কোনো কথা না বলে জাহিদ, মনোয়ার আর আশরাফুলকে মঞ্চ থেকে নেমে আসতে বলল। রিপন আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই আনিস, কিছু মনে না করলে কি আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিতে পারবেন? প্রচ- টেনশন হচ্ছে। আমার আবার টেনশনের সময় সিগারেট না খেলে খুব কষ্ট হয়। প্লিজ ভাই, কিছু মনে করবেন না। এইটা নিয়ে আপনার চার প্যাকেটের দাম আমার কাছে পাওনা রইল। ঢাকায় যেয়েই দিয়ে দিব। প্লিজ ভাই, একটু কষ্ট করেন না। প্লিজ।
রিপনের মুখে এই কথা শুনার পর আনিসের মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তার মুখ দিয়ে কঠিন কিছু কথা বের হতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু না বলে সিগারেট আনার জন্য বাইরে চলে গেল।
রিপনের মুখে বিস্তারিত শুনে মনোয়ার, জাহিদ আর আশরাফুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এক বুক হতাশা নিয়ে জাহিদ বলল, বলেন কী রিপন ভাই, এই ঘটনা! এখন শাহাদৎ ভাইকে কী বলবেন?
মনোয়ার ঠান্ডাভাবে বলল, যা সত্য তাই তো বলতে হবে। মনোয়ার ভাই, আপনি যেয়ে শাহাদতের বাবার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আমাদের মাঝে আপনিই মুরব্বি।
আশরাফুলের কথা শুনে মনোয়ারের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। আমি মুরব্বি মানে? আমি মুরব্বি মানে কী? আপনাদের চেয়ে আমার বয়স কি বেশি নাকি? রাগতস্বরে কথাগুলো বলল মনোয়ার।
স্যরি ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। আশরাফুল মনোয়ারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল।
জাহিদ বলল, মনোয়ার ভাই, এখন রাগারাগির সময় নয়। এখন কী করবেন তা-ই নিয়ে ভাবুন। চলেন, আমরা সবাই মিলে বিষয়টি নিয়ে শাহাদৎ ভাইয়ের বাবার সাথে কথা বলি। কারণ বেশিক্ষণ এই বিষয়টি আমাদের গোপন রাখা ঠিক হবে না।
তারা সবাই আবার স্টেজের সামনে এসে দাঁড়াল। শাহাদৎ মাথা উপরে তুলে একবার শুধু সবার দিকে তাকিয়ে আবার মুখে রুমাল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল।
শাহাদতের বাবা একটু বিরক্ত ভাব নিয়ে বলল, কী ব্যাপার, কাজি সাহেব আসার অনেকক্ষণ হয়ে গেল। বেয়াই সাহেব আসছি বলে ভিতরে গেল। তার তো আসার আর নাম দেখছি না। বাবা রিপন, তুমি একটু ভিতরে যাও তো। দেখো তো ভিতরের কী অবস্থা।
রিপন বলল, চাচাজান, আপনি একটু আমার সাথে আসেন।
রিপন আর মনোয়ার শাহাদতের বাবাকে নিয়ে স্টেজ থেকে একটু দূরে যেয়ে মূল ঘটনা বলল। ঘটনা শুনে শাহাদতের বাবার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাকে দেখে এই মুহূর্তে যে কেউ ভাববে একটি বৃদ্ধ মানুষের মূর্তি।
বরযাত্রী হিসাবে যারা এসেছে তাদের মাঝে ইতিমধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মাঝে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভাব। একটা বিরক্ত ভাব। কেউ কেউ ইতিমধ্যে রাগ হয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে কথাবার্তা বলছে। শাহাদতের এক খালু চেঁচিয়ে বলতে লাগল, এইটি কি খামখেয়ালি নাকি? এইটা কি পুতুল খেলা? আমাদের সাথে ফাজলামো শুরু করেছেন আপনারা? মেয়ের যে এই কাহিনি আছে আমাদের আগে বললেই হতো। আমাদের ছেলেকে আমরা বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে আসতাম না। কেমন শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে, বিয়ের বাড়ি থেকে মেয়ে অন্য ছেলের সাথে চলে যায়? বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার!
রিপনরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। তারা যেন বোবা হয়ে গেছে। তারা স্টেজের সামনে এসে শাহাদতের পাশে দাঁড়াল। শাহাদৎ তার খালুর কথাবার্তা সব শুনতে পেয়েছে। শাহাদৎ মাথা নিচু করে মুখে দেয়া রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে মনে হয় কাঁদছে।
শাহাদতের জন্য রিপন, মনোয়ার, জাহিদ, আশরাফুল আর আনিসের খারাপ লাগতে লাগল। আনিস শাহাদতের কাছে যেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করল। শাহাদৎ নিজেকে সামলে নিয়ে রিপনকে বলল, আব্বা কোথায়?
রিপন বলল, স্টেজের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
এই প্রথম শাহাদৎ স্টেজ থেকে নেমে পিছনের দিকে যেয়ে দেখল, তার বাবা কাঁদছে। শাহাদৎ তার বাবার কাছে যেয়ে বলল, আব্বা, আপনি কষ্ট পাবেন না। আল্লাহ্্ যা করে ভালোর জন্যেই করে। যা হওয়ার বিয়ের আগেই হয়েছে। এই ঘটনা যদি বিয়ের পর ঘটত তাহলে আমাদের জন্য বড়ই লজ্জার হতো। এইখানে আমার বিয়ে আমার কপালে লেখা ছিল না। তাই হয়নি আব্বা। আপনি কাঁদবেন না। আপনি শান্ত হন আব্বা।
ঠিক এমন সময় মেয়ের বাবা এসে শাহাদতের বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, বেয়াই সাহেব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি আমার মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দিতে পারলাম না। আমি আমার মেয়েকে মানুষ করে গড়ে তুলতে পারি নাই। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন। এই কথা বলে মেয়ের বাবা হুহু করে কাঁদতে লাগল। একপর্যায়ে তিনি শাহাদতের পা ছুঁয়েও কাঁদতে লাগলেন। তাতে করে শাহাদৎ একটু অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগল।
শাহাদৎ মেয়ের বাবাকে টেনে তুলে দাঁড় করাল। শাহাদৎ বলল, ছিঃ ছিঃ আপনি আমার মুরব্বি। আপনি আমার পা ছুঁলে আমার পাপ হবে। প্লিজ এইভাবে কাঁদবেন না। আপনি শান্ত হন। বিয়ে-শাদি আল্লাহ্্র হাতে। আপনার মেয়ে আমার নসিবে ছিল না। তাই এমনটি হয়েছে। আপনি শান্ত হন খালুজান। এই কথা বলে শাহাদৎ মনোয়ারকে বলল, মনোয়ার ভাই, আপনি আব্বাকে নিয়ে আসেন। আমি যেয়ে গাড়িতে বসছি। আর রিপন ভাই, আপনি আর সবাইকে শান্ত হতে বলেন। সবাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আপনি নিয়ে আসেন। সবাই আমাদের বাড়িতে খেয়ে তারপর যে যার গন্তব্যে চলে যাবে। আপনি একটু ম্যানেজ করেন ভাই। মনোয়ার ভাই, আপনি আব্বাকে নিয়ে আসেন। এই কথা বলে শাহাদৎ রুমাল দিয়ে নিজের চোখ একবার মুছে রুমালটি ফেলে দিয়ে গাড়ির দিকে চলে গেল।
আনিস অবাক হয়ে শাহাদতের কথাগুলো শুনল। শাহাদতের কথায় আনিস মুগ্ধ না হয়ে পারল না। এই অবস্থায় কীভাবে সে নিজেকে এইভাবে সামাল দিতে পারল? কত সুন্দর করে নিজে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়েও সে তার বাবা এবং মেয়ের বাবাকে সান্ত¡না দিয়ে গেল। শাহাদতের প্রতি আনিসের শ্রদ্ধা হাজার গুণ বেড়ে গেল। শাহাদৎকে আনিসের কাছে মনে হচ্ছে, হি ইজ অ্যা রিয়াল ট্র্যাজিক হিরো।

তাহিতিকে আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক সুন্দর লাগছে। মুরব্বিরা বলে মেয়েদের বিয়ের কথা শুরু হলে নাকি মেয়েদের রূপ সামান্য হলেও বেড়ে যায়। তাহিতির তো শুধু বিয়ের কথা নয়, আজ রীতিমতো তাহিতির বিয়ে। গতকাল তার ফুফু এবং ফুফাতো বোন রংপুর থেকে তাদের বাসায় এসেছে। তার ফুফু এখন শুধু তার ফুফু নয়, তার শাশুড়ি হওয়ার পথে। তাহিতি নিজেকে আজ বেশ কয়েকবার আয়নায় দেখেছে। নিজের চেহারা আয়নায় দেখে নিজে নিজেই লজ্জা পেয়েছে। নিজের কাছে আজ নিজেকে অন্য এক তাহিতি মনে হচ্ছে তাকে। তার মনে আজ যারপরনাই আনন্দ। এতদিন যাকে মনে মনে ভালোবেসে এসেছে, আজ সে তার একান্তই নিজের হতে যাচ্ছে। এখন আনিস শুধু তার মনের মানুষ নয়, তার জীবনসঙ্গী হতে যাচ্ছে। এই কথা ভাবতেই তাহিতি বারবার লজ্জায় আর আনন্দে নিজের মুখে নিজেই হাত দিয়ে ঢাকছে। আনিস ভাই এখনো বিষয়টি জানে না। ফুফু যে এসেছে তাও আনিস ভাইকে জানানো হয়নি। তাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলা হয়েছে। তাহিতির বাবা বজলুর সাহেব আনিসকে ফোন করে সকাল সকাল আসতে বলেছে। ফুফুর কথা বলা হয়নি কারণ আনিসকে একটা সারপ্রাইজ দেয়া হবে বলে। আচ্ছা বিয়ের পর আমি আনিস ভাইকে আনিস ভাই বলে ডাকব নাকি স্যার বলে ডাকব, নাকি আনিস বলে ডাকব? তাহিতি নিজেকে নিজে এই প্রশ্ন করে নিজে নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। আনিস ভাই বাসায় আসলে তার সামনে সে কীভাবে দাঁড়াবে? নানান চিন্তা করতে করতে তাহিতি রীতিমতো অস্থির।
এমন সময় তাহিতি তার ঘর থেকেই তার বাবা বজলুর সাহেবের উচ্চকণ্ঠ শুনতে পেল। জোরালো গলায় ‘তাহিতি! তাহিতি!’ বলে তাকে ডাকছে। তাহিতি নিজের চোখ-মুখ স্বাভাবিক করে তার ঘর থেকে বার হয়ে বসার
ঘরে এলো। বসার ঘরে ঢুকেই সে একটু ছোটখাটো ধাক্কার মতো খেলো। কারণ বসার ঘরে বাসার সবাই গোল হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে জরুরি কোনো মিটিং চলছে। মিটিংটি যে তাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে তাতে করে তার সন্দেহ নাই।
তাহিতি অনেকটা ভয়ে ভয়ে সবার সামনে যেয়ে দাঁড়াল। যদিও এখানে তার ভয়ের কোনো কারণ নেই। বসার ঘরের সবাই একযোগে তার দিকে তাকাল।
বজু সাহেব বলল, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর জন্য একটি সিট রাখা হয়েছে। সেখানে বস। আর এমন ভীতুর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমরা সবাই তো এখানে তোর বিচার করে তোর ফাঁসি কার্যকর করারা জন্য তোকে ডাকিনি। তোর বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য তোকে ডেকেছি।
তাহিতি তার বাবার মুখে তার বিয়ের কথা শুনে আরো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তাহিতির বাবার কথা শুনে তাহিতির মা রাহেলা বেগম তীব্র চোখে তার স্বামীর দিকে তাকাল। যে তাকানোর অর্থ হচ্ছে, তোমার কি এ জীবনে কোনো আক্কেল হবে না? কোথায় কী কথা বলতে হবে, তাও কি তোমার জানা নেই? মেয়ের সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে?
রাহেলার চোখের দিকে তাকিয়ে বজু সাহেব যা বুঝার বুঝে গেল। তিনি আর কথা না বলে চুপ করে গেলেন।
রাহেলা মেয়েকে বলল, আয় মা, আমার এখানে এসে বস।
বসার ঘরে বজলুর সাহেবের বড় ছেলে ফিরোজ, ফিরোজের নতুন বউ, ফুয়াদ, রংপুর থেকে আসা আনিসের মা আলেয়া আর আনিসের ছোট বোন আনিসাও আছে।
রাহেলা আলেয়াকে বলল, তোমাকে তো আসার পর পর সব খুলে বলেছি। আনিসের একটা চমৎকার সরকারি চাকরি হয়েছে। তোমার ছেলেটি হয়েছে ঠিক তার বাবার মতো। এই যুগে এমন টাইপের ছেলে পাওয়া খুবই দুষ্কর। তোমাকে অনেক দিন পর আমাদের মাঝে পেয়ে সত্যি বলছি আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমি কয়েকবার রংপুরে যাওয়ার জন্য প্রিপারেশন নিয়েও যেতে পারিনি। তোমার সাথে অনেক দিন যোগাযোগ ছিল না। তোমার ভাইয়ের ইগোর কারণে তোমাদের অনেক কষ্ট দেয়া হয়েছে। তুমি কিছু মনে রেখো না বোন।
আলেয়া মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। বসার রুমের কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই কেমন জানি গম্ভীর হয়ে আছে।
রাহেলা আবার কথা শুরু করল, আলেয়া, আনিসকে আমার এবং আমাদের সবার খুব পছন্দ। তোমাকে আসার পর কিছুটা বলেছি। এখন সমস্ত কিছুই তোমাকে বলছি। আমার মেয়ে মানে তোমার ভাগ্নি তাহিতিকে তো দেখেছ। আমি আনিসকে আমার তাহিতির সাথে বিয়ে দিতে চাই। আনিসকে আমার শুধু নয়, আমাদের সবারই খুব পছন্দ। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা বিয়ের প্রস্তুতি নিতে পারি।
আলেয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মুখে কোনো কথা নেই। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে সে ফুঁপিয়ে কেদে উঠল। তাতে করে বসার রুমের সবাই একটু অবাক হয়ে গেল। সবাই আলেয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল।
রাহেলা আলেয়ার পাশে যেয়ে আলেয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলল, কী হয়েছে বোন আমার? আমাদের প্রস্তাব কি তোমার পছন্দ হয়নি? না-হলে
তুমি তোমার মতামত দিতে পারো। তুমি না চাইলে আমরাও এখান থেকে সরে যাব।
মায়ের মুখে এই কথা শুনা মাত্র তাহিতির বুকে যেন ঝড়ের দশ নাম্বার সতর্ক সংকেত দেখা দিল। যখন-তখন তার চোখের জল বিশ ফুট উচ্চতা দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। তাহিতি তার মায়ের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তাহিতি চোখের ভাষায় তার মাকে বলতে চাচ্ছে, তোমরা সরে আসবে মানে? তাহলে আমার কী হবে মা? আমার কথা একবারের জন্যও তুমি বিবেচনা না করেই এই কথা বলে দিতে পারলে? আর কেউ জানুক বা জানুক, তুমি তো জানো মা যে আমি আনিস ভাইকে ছাড়া বাঁচব না। আর তুমি কিনা কত সহজে বলে দিলে আমরা সরে আসব।
রাহেলা তার মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন, তোমার এখানে কোনো ভয় নেই। তুমি শান্ত থাকো। আনিসের সাথেই তোমার বিয়ে হবে। আমি থাকতে তুমি এত চিন্তা কেন করো?
আলেয়া এই প্রথম কথা বলা শুরু করলেন। না না ভাবি, এ তো আমার সৌভাগ্য যে তাহিতির মতো একটি লক্ষ্মী মেয়ের সাথে আমার আনিসের মতো অতি সাধারণ একটি ছেলের বিয়ে হতে যাচ্ছে। আমার আনিসকে যে তোমরা সবাই পছন্দ করো, তাতেই আমি মহাখুশি। আনিসের জন্য তোমরা এত সুন্দর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছ, যা আমি সারা জীবনেও করে দিতে পারতাম না। আর আনিসও শত চেষ্টা করেও তা পারত না। কারণ এ যুগে টাকা ছাড়া এমন চাকরি কয়জনের ভাগ্যে হয় বলো? কিন্তু আমার দুঃখ অন্য জায়গায়, আমি কাঁদছিও অন্য কারণে। আজ একই সাথে আমার আনন্দের আর কষ্টের দিন। আনন্দ হচ্ছে আজ আমার ছেলের একটি সরকারি চাকরি হয়েছে এবং একটি চমৎকার ও আমার আপনজনের সাথেই তার বিয়ে হচ্ছে। আর কষ্টটা হচ্ছে, বড় ভাই এতদিন হয়ে গেল, একটি বারের জন্যও আমার বা আমাদের খোঁজ নিল না। আমরা কেমন আছি, কোথায় আছি, কীভাবে আছি, বড় ভাই একটি বারের জন্যও একটি দিনের জন্যও খোঁজ নিল না। আমি না-হয় একটি ভুল করেছিলাম। কিন্তু তার শাস্তি আমাকে বড়ভাবে তোমরা সবাই মিলে দিতে পারলে!
এই কথা বলে আলেয়া অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলে অনেকটা উচ্চৈঃস্বরেই কাঁদতে লাগল। তার কান্না দেখে আনিসের ছোট বোন আনিসাও মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল।
রাহেলা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দিতে লাগলেন। বজলুর সাহেব এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছোট বোনের কথা শুনছিল। কোনো কথা বলেননি। বজু সাহেব যখন মাথা উপরে তুললেন তখন তার মুখ দেখে রাহেলাসহ তার পরিবারের সবাই অবাক হয়ে গেল। রাহেলা অবাক চোখে দেখতে পেল তার স্বামীর চোখে পানি। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলেয়ার কাছে যেয়ে আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, আলেয়া আমার বোন, তোর উপর অনেক অন্যায় করেছি, আমার ভুল হয়ে গেছে লক্ষ্মী বোন আমার, আমাকে তুই ক্ষমা করে দে। তখন অতিরিক্ত রাগে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই রাগে আর ক্ষোভে আমি তোর খোঁজ নেইনি রে। আমি অনেক বড় রকমের ভুল করে ফেলেছি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে বোন। আমাকে তুই মাফ করে দে।
এই কথা বলে বজলুর সাহেব শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তার কান্না দেখে ফিরোজ, ফুয়াদ, তাহিতি, ফিরোজের নতুন বউ আর রাহেলা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। এই প্রথম বজু সাহেবের সন্তানেরা বজু সাহেবের চোখের পানি দেখতে পেল।
ভাইয়ের কথা শুনে আলেয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ছোট্ট বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগল। দুই ভাই-বোনের দীর্ঘদিন পর মিলনের দৃশ্য বসার ঘরের সবার চোখে আনন্দাশ্রু নামিয়ে দিল।
রাহেলা চোখের পানি মুছতে মুছতে ফিরোজ আর ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল, তোরা এখনো এখানে বসে আছিস কেন? বাজার থেকে মিষ্টি কিনে আন। আজ কতদিন পর তোদের ফুফু আর ফুফাতো বোন তোদের মাঝে এসেছে। তাদের জন্য আজ বাজার থেকে ভালো কিছু নিয়ে আয়।
রাহেলার মুখের কথা শেষ না হতেই বজু সাহেব তার কান্না থামিয়ে বলল, রাহেলা, ওদের বাজারে যেতে বলছ কেন? আজ আমি বাজারে যাব। কারণ আমি জানি আমার বোন কী খেতে পছন্দ করে। তুই কি এখনো চ্যাঁপা মাছের শুঁটকি পছন্দ করিস আলেয়া?
এই কথা শুনে আলেয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে মুখে হাসির ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, তোমার এখনো তা মনে আছে ভাইয়া?
মনে থাকবে না মানে। অবশ্যই মনে আছে। তুই সকালবেলা উঠে চ্যাঁপা মাছের শুঁটকির ভর্তা দিয়ে রাতের রেখে দেয়া ভাতে পানি মিশিয়ে বেশ মজা করে খেতি। বয়লার মুরগি তোর চলে না। তোর চাই গরুর মাংস। আমার
সব কিছুই মনে আছে রে। ফিরোজ, বাজারের ব্যাগ নিয়ে আয়। আজ তুই আমার সাথে বাজারে যাবি। আজ বাপ-বেটা মিলে পুরো বাজারসুদ্ধ মাথায় তুলে নিয়ে আসব।
বজু সাহেবের মুখে এই কথা শুনে বসার রুমের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। তাদের হাসি শেষ না হতেই কলিংবেল বেজে উঠল। বজু সাহেব তাহিতিকে লক্ষ করে বলল, তাহিতি দেখ তো মা কে এলো?
তাহিতি দরজা খুলে লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে রইল। আনিস তাহিতির এই দৃশ্য দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল। আনিস ঠিক বুঝতে পারল না, হঠাৎ করে তাহিতির আবার কী হলো। তাকে দেখে এমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার কী আছে! তাহিতি দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। কিন্তু এক বারের জন্যও আনিসের চোখে চোখ রাখল না। তাহিতি আর এক মুহূর্ত বসার রুমে দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা তার ঘরের দিকে চলে গেল। চলে গেল বললে ভুল হবে, দৌড়ে পালাল।
কলিংবেল টিপে তাহিতির কাছে একটা ধাক্কা আনিস খেয়েছে। কিন্তু বসার রুমে যে সে আর একটি ধাক্কা খাবে তার জন্য আনিস প্রস্তুত ছিল না। বসার রুমে যেয়ে আনিস চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগল তার মামা-মামির সাথে একই সোফায় তার মা এবং তার ছোট বোন বসে আছে। আনিস নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। মা এখানে কেন? আর মা ঢাকায় এলো আর আমি জানলাম না! আনিসাও তো তাকে ফোন করে জানাতে পারত। গতকালেই তো মায়ের সাথে কথা হয়েছে, কই মা তো ঢাকায় আসার বিষয়ে কিছু বলল না! ব্যাপারটা কী? আনিস বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে বসার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।
রাহেলা বলল, আরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন আনিস? এসো। বসো।
আনিস আলেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মা তোমরা কখন এসেছ? আর ঢাকায় আসবে আমাকে তো কিছু জানাওনি? কি রে আনিসা, তুইও তো কিছু জানাসনি?
রাহেলা আলেয়াকে কথা বলতে না দিয়ে বলল, তোমার মাকে আমিই তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম। তাই তোমাকে জানায়নি।
আমি ঠিক বুঝলাম না মামি। আমাকে জানানোর জন্য নিষেধ করেছিলেন কেন? আমাকে কি একটু খুলে বলা যায়?
অবশ্যই খুলে বলা যায়। তুমি কি সকালের নাশতা খেয়েছ আনিস?
জি মামি, আমি হোটেলে খেয়ে এসেছি। আজ মেসে বুয়া আসেনি
তো, তাই।
ঠিক আছে। তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলো, আমি তোমার জন্য নাশতা নিয়ে আসি।
না মামি, লাগবে না।
লাগবে না কেন, অবশ্যই লাগবে। মেসে কী খাও না খাও, তার কি কোনো ঠিক আছে। আলেয়া, তুমি তোমার ছেলের সাথে কথা বলো। আর তুমি, তুমিও এখানে বসে আলোচনা শেষ করে তার পর বাজারের দিকে যাও। আমি তোমাদের সবার জন্য কিছু নিয়ে আসি।
মামির কথায় আনিস একটু ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল। মামা আবার কী আলোচনা করবে? মায়ের ঢাকায় আগমন, তাহিতির দরজা খোলার পর অন্য রকম অভিব্যক্তি। মা যে ঢাকায় আসবে তা তাকে না জানানো। আবার মামা আলোচনা শেষ করে বাজারে যাবেÑসব মিলিয়ে আনিসের মাথা তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। আজ কি মামার বাসায় কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকি? আনিস একটু অবাক হয়ে ফুয়াদের দিকে তাকাল। ফুয়াদ আনিসের দিকে তাকিয়ে একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আনিস ভাই, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি এখন আমাদের বাসায় নেই। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তুমি জেলখানায় প্রবেশ করেছ। ও আনিস ভাই, তোমার সাথে আমার একটা জরুরি কথা আছে। কথাটা তোমাকে বলার জন্য গতকাল রাত থেকে ছটফট করছি। তোমাকে সামনাসামনি বলব বলে তোমাকে ফোন করিনি। বাবা, আমি কি আনিস ভাইকে একটু সময়ের জন্য আমার ঘরে নিয়ে যেতে পারি? জাস্ট পাঁচ মিনিট। চলো, আনিস ভাই।
ফুয়াদ তার বাবার কাছে অনুমতি চাইলেও তার বাবা অনুমতি দেয়ার আগেই আনিসকে নিয়ে তার রুমের দিকে হাঁটা ধরল। বজু সাহেব তার ছোট ছেলের কা-কারখানায় অবাক না হয়ে পারল না। তিনি চোখ বড় করে ফুয়াদের আনিসকে নিয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখল।
ফুয়াদ তার ঘরের দরজা আটকে দিয়ে রীতিমতো ফুয়াদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আনিস ভাই, কাম তো হয়ে গেছে।
আনিস অবাক হয়ে বলল, কাম হয়ে গেছে মানে?
মানে আমি বলতে চাচ্ছি, চুলকানি বাবা তো কাম ঘটিয়ে দিয়েছে।
কী ঘটিয়ে দিয়েছে?
বাবার তেলেসমাতি কাজ করা শুরু করেছে।
আনিস বিরক্ত হয়ে বলল, ফুয়াদ, যা বলার তাড়াতাড়ি বল, আমার জন্য আবার মামা বসে আছে। কী বলবি, একটু ক্লিয়ার করে বল।
গতকাল নাজমা ফোন দিয়েছিল। নাজমা ফোনে অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করছিল। ও জানাতে চাইল যে তার বাবা হঠাৎ করে এত পরিবর্তন হলো কী করে? আমি জানতে চাইলাম, কী পরিবর্তন? নাজমা বলল, গতকাল নাকি তাদের বাসায় ঘটক তার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছিল। ঘটককে দেখা মাত্রই তার বাবা নাকি রীতিমতো তেলে-পটলে জ্বলে উঠেছিল। নাজমা তো অবাক। কাহিনি কী। দুই দিন আগেই যে লোক তাকে এত খাতির-যতœ করেছে আজ তাকে দেখেই এত উত্তেজিত কেন?
নাজমার মা তার স্বামীর এই আচরণে অবাক হয়ে বলেছে, কী ব্যাপার, তুমি ঘটক সাহেবকে দেখে এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? উনাকে তো তুমিই আসতে বলেছ নাজমার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য।
নাজমা বাবা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, নাজমার বিয়ে মানে! নাজমার বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি যে নাজমার বিয়ের ব্যাপারে আমি ঘটককে ডাকব? আমার একমাত্র মেয়ে এখনো পড়াশুনাই শেষ করতে পারল না, আর আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিব! তুমি পাগল হয়ে গেলে নাকি? আমাদের পুরান ঢাকা আর আগের পুরান ঢাকা নেই। আমার মেয়ে যত দূর পড়াশুনা করার ইচ্ছা পড়বে। ওর পড়াশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিয়ের আলোচনা যেন তোমার মুখে না শুনি আর এই বাসায় যেন না হয়।
নাজমার মা অবাক হয়ে স্বামীর কথার উত্তর দিয়েছে, আমি আবার কবে নাজমার বিয়ের কথা বললাম? তুমিই তো বললে যে মেয়েদের বেশি পড়াশুনা করে লাভ নেই। বেশি পড়াশুনা করলে মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়। আমাদের পুরান ঢাকায় আমরা মেয়েদের বেশি পড়া পছন্দ করি না। ভালো ছেলে দেখে নাজমাকে বিয়ে দিয়ে দেই।
তুমি কী বলো নাজমার মা! এই কথা তুমি বলে এখন আমাকে বলছ আমি নাজমার বিয়ের জন্য ঘটক ডেকেছি। নাজমার বাবা ঘটকের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি কি বলতে বা বুঝাতে চাচ্ছি, তুমি বুঝতে পারোনি? নাকি পুরান ঢাকার খাস বাংলায় তোমাকে কিছু শুনাতে হবে।
নাজমার বাবার এই কথায় ঘটক ব্যাটা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। চুলকানি বাবার কারিশমা যে এত তাড়াতাড়ি শুরু হবে আমি বুঝতে পারিনি আনিস ভাই। এক কাজ করতে পারবে আনিস ভাই?
কী কাজ?
সেটা হচ্ছে, আমি আবার চুলকানি বাবার কাছে যেতে চাই। উনাকে আমি কিছু স্পেশাল গিফট করতে চাই। সেদিন উনাকে যে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি, তা উনার কাজের তুলনায় কম দেয়া হয়েছে। তাই উনাকে আরো কিছু দেয়া উচিত। তুমি কী বলো আনিস ভাই।
আনিস ফুয়াদের কথার উত্তর না দিয়ে উল্টা ফুয়াদকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা ফুয়াদ, আজ বাসায় কোনো অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান আছে নাকি রে? আম্মা আর আনিসা রংপুর থেকে ঢাকায় এলো অথচ আমি জানলাম না! আমাকে বলতে মামি নিষেধ করেছিল। মামা আবার কী যেন আলোচনা করবে। আমার কাছে যেন কেমন কেমন লাগছে ব্যাপারটা। তুই কি কিছু জানিস নাকি?
ফুয়াদ স্ট্রেইট উত্তর দিল, তোমার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা চলছে।
কী বললি তুই! আমার বিয়ের আলোচনা মানে? আমার কাছে কে মেয়ে বিয়ে দিবে? একটা বেকার ছেলের কাছে কেউ তার মেয়েকে দেয় নাকি? কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলছিস! ফাজলামো না করে সত্যি করে বল, আজ বাসায় কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?
আরে বাবা, বললাম তো তোমার বিয়ের আলোচনা হচ্ছে। আর তুমি বেকার কে বলল? তোমার একটি জবরদস্ত চাকরির ব্যাবস্থা করা হয়েছে।
আমার চাকরির ব্যবস্থা আবার কে করল?
যিনি তার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দিবেন তিনিই ব্যবস্থা করেছেন। হাজার হলেও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বলে কথা।
বসার ঘর থেকে বজু সাহেবের কণ্ঠ শুনা গেল। তিনি আনিসকে ডাকছেন।
ফুয়াদ তার বাবার আওয়াজ শুনতে পেয়ে বলল, আনিস ভাই, তোমাকে তোমার শ্বশুরমশাই ডাকছে, তুমি যাও।
কী বললি তুই?
না মানে বললাম, তোমাকে বাবা ডাকছে, তুমি যাও, আমি একটু নাজমার সাথে ফোনে কথা বলে বুলবুল সাহেবের একটু খবর নেই।
নাজমাকে ফোন দিয়ে বুলবুল সাহেবের খবর নিবি মানে?
আনিস অবাক হয়ে ফুয়াদকে প্রশ্ন করল।
বুলবুল সাহেব হচ্ছে আমার হবু শ্বশুরমশাই আর নাজমার বাবা। বুঝতে পেরেছ এখন?

আনিসের মা আলেয়ার কাছে বিস্তারিত শুনে আনিস মাথা নিচু করে বসে রইল। এখন আনিস বুঝতে পারল, তাহিতির লজ্জায় কেন তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। কেন তাহিতি রীতিমতো দৌড়ে বসার ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। কেন তার মা আর বোনকে ঢাকায় আনা হয়েছে। আর কেন বা তার মা-বোন যে ঢাকায় আসবে, তা জানাতে নিষেধ করা হয়েছে।
আনিস মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের
হচ্ছে না। আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটাই পেয়েছে।
এমন সারপ্রাইজ সে জীবনে পায়নি। সে কেন, হয়তো খুব মানুষই এমন সারপ্রাইজ পায়।
আনিস চুপ করে বসে আছে। সবাই তার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার পজিটিভ উত্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। এখন আনিস কী বলবে? কী বলার আছে আনিসের? একটা সরকারি চাকরির অনেক দিনের আশা তার এবং তার মায়ের ছিল। বহু চেষ্টা আনিস করেছে একটি সরকারি চাকরির জন্য। কিন্তু টাকার কাছে বারবার হার মেনেছে আনিস। সেই আশা তার মামা আজ পূরণ করেছে। শুধু তার নয়, তার মায়ের দীর্ঘদিনের আশা আজ পূরণ হয়েছে। তার মা তাকে এই বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য বলছে। তার মাও এই বিয়েতে রাজি। রাজি তার ছোট বোন আনিসাও। আনিস ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। আনিস মাথা তুলে সবার দিকে তাকাল। কিন্তু অবাক বিষয় হচ্ছে, আনিসের চোখ দিয়ে আনিস কাউকেই দেখতে পারছে না। সবাইকেই আনিসের কাছে জাকিয়া মনে হতে লাগল। আনিস নিজের হাত দিয়ে চোখ ভালো করে মুছে বাস্তবে ফিরে এলো। আনিস মনে মনে ভাবল, জাকিয়াকে সে ভালোবাসে এটা সত্য। কিন্তু জাকিয়াকে সে আজও যেমন বলতে পারেনি, হয়তো এ জীবনে আর বলাও হবে। হয়তো আজ থেকে আর কোনোদিন জাকিয়ার সাথে দেখাও হবে না। কেয়ার সাথেও হয়তো আর দেখা হবে না। কারণ আজকের পর আর কেয়াকে পড়াতে সে যাবে না।
আনিস একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে বলল, আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসা অপ্রকাশিতই থাক। কিন্তু জাকিয়ার জন্য তার কষ্ট অনুভব
হতে লাগল। (চলবে)

 

Related Articles

Back to top button