স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বাজেটে
স্টাফ রিপোর্টার:
দেশব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করেছে নভেল করোনা ভাইরাস। এই মহামারি যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করছে সরকার। সস্পদের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও প্রতিবছরই বড় বাজেটের রেকর্ড ভেঙেছে ক্ষমতাসীন সরকার। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে চাঙ্গা করতে আসন্ন (২০২০-২১) অর্থবছরের জন্য সাম্ভব্য জাতীয় বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে চলতি বাজেট থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বা ১২ শতাংশ বেশি। তবে আসন্ন বাজেটের সাম্ভব্য ঘাটতি এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের ঘাটতি থেকে ৪৫ হাজার (জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ) কোটি টাকা বেশি। এটি আগের যে কোনো বছরের তুলনায় সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১১ জুন) জাতীয় সংসদে বিশাল অঙ্কের এই বাজেট উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৯তম বাজেট এবং বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় ও বর্তমান অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাজেট।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনা-দুর্যোগে স্বাস্থ্য, খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ নানা খাতে সরকারি ব্যয় বেড়েছে। বিনামূল্যে চাল বিতরণ, দশ টাকা মূল্যে গরিব মানুষকে চাল সরবরাহ করা, করোনাকালীন কর্মহীন মানুষকে নগদ টাকা দেওয়া, অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাসহ নানা আর্থিক সুবিধা দেওয়ায় ভর্তুকির চাপ বেড়ে গেছে। এজন্য করোনাকালীন সংকট মোকাবিলায় এই বিশাল অঙ্কের বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার।
আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনা ভাইরাস পরবর্তী অর্থনীতি মোকাবিলায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সামাজিক ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপরেও জোর দেওয়া হবে। তবে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই দুই খাতে থাকছে বিশেষ প্রণোদনা। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকিসহ এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সহায়তায় কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
বাজেটে জরুরি খাত ছাড়া কোনও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে না। করোনা পরবর্তী সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও রাখা হবে। শিল্পের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও করোনা পরবর্তী বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। একই সঙ্গে আসন্ন বাজেটে আগামী বছরের জন্য ব্যক্তি আয়কর সীমা বাড়ানো হচ্ছে। তবে করপোরেট করহার কিছুটা কমানো হতে পারে। নতুন করারোপ হবে না। ঘোষণা না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্তি করা হবে। এজন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এছাড়া দাতা সংস্থার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৭০ হাজার কোটি টাকার তহবিল আশা করছে সরকার।
এদিকে করোনা সঙ্কটের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। এজন্য প্রণোদনার অর্থ দ্রুত ছাড়করণ, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা নিশ্চিত করা, উৎপাদিত পণ্যের দেশি-বিদেশি বাজার সৃষ্টি, রেমিটেন্স আহরণে প্রণোদনা অব্যাহত রাখার মতো কর্মসূচি রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সস্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, কোনও সংকটেই জীবন যেমন থেমে থাকে না, তেমনই সরকারের সামনে এগোনোর পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও থেমে থাকবে না। সবকিছু মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হয়। আমরা সামনে আগানোর চেষ্টা করছি। সেভাবেই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করছি।
মন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করছি, আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হবে। যে যাই বলুক, জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের কাঙ্ক্ষিত হারেই অর্জিত হবে। মূল্যস্ফীতিও ধরে রাখতে পারবো স্বাচ্ছন্দ্যময় হারের মধ্যেই। সবকিছু বাজেট বক্তৃতায় পরিষ্কার হবে। এখনও অনেক কিছু চূড়ান্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত সরকার মানুষের জন্য কল্যাণকর একটি বাজেট উপস্থাপন করবে বলে জানান তিনি।
নতুন বাজেট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী জানান, আসন্ন নতুন বাজেটে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসব প্রকল্প দ্রুত শেষ করতে বাজেটে বরাদ্দ বেশি রাখা হবে। করের হার নতুন করে বাড়ানো হবে না।
বাজেট ঘাটতি: রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় বাড়বে বাজেট ঘাটতিও। আসন্ন বাজেটের ঘাটতি হতে পারে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে ঘাটতির (অনুদানসহ) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, এটি মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ।
জিডিপি আকার: ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য রেকর্ড জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থবিভাগ। প্রবৃদ্ধির এই হার এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মোকাবিলা, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে সরকার। সরকার চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ৫.৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা: ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে সংগৃহীত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এডিপি আকার: আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ। এডিপির জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা এবং বহিঃসম্পদ থেকে ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকার জোগান দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন এডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ৫৮৪টি। মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাড়ছে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ: মোট ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দও বাড়াচ্ছে সরকার। এ খাতে এবারই প্রথমবার ৫২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের থেকে পাঁচ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা বেশি। একইসঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ছয় অর্থবছর ধরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এবার পরিমাণ অন্যবারের তুলনা অনেক বেশি বাড়ছে। মূলত খাদ্য ও কৃষিতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্যই বরাদ্দটা একটু বেশি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৭ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এটা চলতি বাজেটের সংশোধনীতে বাড়িয়ে ৪৮ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা করা হয়।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ছে: করোনার করণে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আর্থিক সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ বাড়িয়ে ৯৭ লাখে উন্নীত করতে চায় সরকার। এ জন্য চলতি বাজেটের তুলনায় আগামী বাজেটে বরাদ্দও এক হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৮১ লাখ মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সুবিধা পাচ্ছে।
বাড়ছে করমুক্ত আয়ের সীমা: টানা ৫ বছর পর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হবে। করোনাকালীন ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কষ্ট লাঘবে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
চিত্রদেশ//এস//