অর্থ-বাণিজ্যপ্রধান সংবাদ

সোনালী ব্যাংক-বিডিবিএলের একীভূতকরণে চুক্তি স্বাক্ষর

নিজস্ব প্রতিবেদক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে রাষ্ট্র পরিচালিত আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি (বিডিবিএল)। রবিবার (১২ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকে দুই ব্যাংকের মধ্যে এমওইউ সই হয়।
চুক্তিতে সই করেন সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম ও বিডিবিএলের এমডি হাবিবুর রহমান গাজী। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী, বিডিবিএলের চেয়ারম্যান শামীমা নার্গিসসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বিডিবিএল চেয়ারম্যান বলেন, বিডিবিএল এর চারটি ইনডিকেটরের মধ্যে তিনটিই ভালো আছে শুধু একটিতে একটু দুর্বল অবস্থায় আছে, খেলাপি ঋণ। আগে যেটা ৪১ শতাংশ ছিল, আমরা সেটা কমিয়ে ৩৪ শতাংশে নিয়ে এসেছি। মার্জারের যে নীতিমালা আছে চারটি ইন্ডিকেটরের মধ্যে খেলাপি ঋণের বিষয়টা আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরো বলেন, এক বছরে আমি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪১ থেকে ৩৪ শতাংশে এসেছি। ছয় মাসে ৩৪ থেকে ৫-১০ বা ১৫তে আসা সম্ভব না। খেলাপি ঋণ শুধুই আমার একটিভনেস না, যার যে খেলাপি তাকেও এগিয়ে আসতে হবে। সে যদি এগিয়ে না আসে তার জামানত বিক্রি করতে হলেও আমাকে অনেকগুলো ধাপ অর্থঋণ আদালত, অর্থ ও জারি মামলাসহ বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে আসতে হবে। যেটা কোনোভাবেই ছয় মাসে সম্ভব না।
বিডিবিএল সময় নিতে পারত তারপরও কেন মার্জারে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাইভেট ব্যাংকগুলো যেমন গ্যারান্টি দিচ্ছে, আগামী এক বছরে এত হাজার কোটি টাকা আনব আমি সেই গ্যারান্টি দিতে পারছি না। কারণ আমাদের ব্রাঞ্চের সংখ্যা কম। মাত্র ৫০ টি। কাজেই আমি যে সময় নিব বাংলাদেশ ব্যাংক তো আর আমাকে ৫-১০ বছর সময় দিবে না।
বিডিবিএলর কর্মীরা মার্জারে না যেতে খোলা চিঠির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিডিবিএল চেয়ারম্যান বলেন, এখানে দুই ব্যাংকের পর্ষদ মিলে একীভূতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাজেই তারা অনেক কিছু প্লাস মাইনাস করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেটা বেটার হয় সেটা করা হয়েছে।

এসময় সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, আমরা অনেক চিন্তা ভাবনা করেই মার্জারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা কোনো চাপের মুখে নয়, নিজেরাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের দুই ব্যাংকের দুই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। সেগুলা কাজে লাগিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। আজকে বিডিবিএলের চেয়ারম্যানও ছিলেন এখানে। তার কিছু প্রশ্ন ছিল। গভর্নর সেগুলোর সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, সোনালী ব্যাংকের আমানত এই মুহুর্তে এক লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে বিডিবিএলের তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। যা প্রায় ৫০ ভাগের এক ভাগ। একই অবস্থা লোনের ক্ষেত্রেও। কাজেই এটা সোনালী ব্যাংকে খুব বেশি ইফেক্ট পড়বে না। আর বিডিবিএল এর কর্মকর্তাদের শঙ্কা বা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। আমাদের প্রায় ৮ হাজার কর্মী আছে তারপরও অনেক লোকবল প্রয়োজন, আর বিডিবিএল-এর ৬০০র মতো কর্মী আছে। সুতরাং তাদের শঙ্কার কিছু নাই।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে ব্যাংক একীভূত সংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করছে। তবে সেই নীতিমালা প্রকাশের আগেই তিনটি ব্যাংক ও পরে দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী এই পর্যায়ে ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা স্বেচ্ছায়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, একীভতকরণ প্রক্রিয়া স্বেচ্ছায় হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংক একীভূত হবে, তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে এই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে স্বেচ্ছায় বা ঐচ্ছিক ভিত্তিতে, অর্থাৎ ব্যাংকগুলো নিজেরাই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৪ এপ্রিল ব্যাংক একীভূত হওয়া সংক্রান্ত নীতিমালা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, কোনও ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নেবে। একীভূত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তিন বছর পর্যন্ত পৃথক আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন করতে পারবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে তিন বছর পর অবশ্যই একীভূত হওয়া দুই ব্যাংকের সমন্বিত আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন শুরু করতে হবে। পাশাপাশি ‘বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ সম্পর্কিত নীতিমালায়’ বলা হয়েছে দুর্বল ব্যাংককে ২০২৫ সাল থেকে বাধ্যতামূলক একীভূত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল হিসেবে বিবেচিত ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ জন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করারও পরামর্শ দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয় ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও। ওই বৈঠকে গভর্নর জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে।
১৪ মার্চ ইসলামি ধারার এক্সিম ব্যাংক ও কনভেনশনাল পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আলাদা বৈঠক করে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরে গভর্নরের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
এরপর গত ৩ এপ্রিল সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) একীভূতকরণের। এরপর ৮ এপ্রিল বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি খাতের সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ শতাংশ। এছাড় অর্থ ঋণ আদালতে ২ লাখ কোটি টাকার অর্থ মামলায় আটকে রয়েছে। যা খেলাপি হিসেবে গণ্য করলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার মত খেলাপি ঋণ রয়েছে।

Related Articles

Back to top button