অর্থ-বাণিজ্যপ্রধান সংবাদ

সামাজিক অস্থিরতা ঠেকাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে: আইএমএফ

বিশ্বব্যাপী চলমান করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা ঠেকাতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুপারিশ করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)।

এজন্য সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে ব্যাপকভাবে। প্রয়োজন হলে অভ্যন্তরীণ ঋণের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণও নিতে হবে। সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো করতে পারলে করোনা মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হবে।

করোনা মহামারীর মধ্যেও কিছু এলাকাকে করোনামুক্ত করে সীমিত আকারে উৎপাদন কর্মকাণ্ড চালানোর সুপারিশ করেছে আইএমএফ। তা না হলে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, তেমনি ভেঙে পড়বে সরবরাহ ব্যবস্থাও।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থাপনার হালনাগাদ তথ্য নিয়ে আইএমএফের প্রকাশিত ‘আর্থিক সতর্কতা : করোনা মহামারী চলার সময়ে জনগণের জন্য নীতি সহায়তা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। করোনার প্রভাবে মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আইএমএফ এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নীতি সহায়তা দিতে আইএমএফ বিশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য আইএমএফ কিছু সুপারিশও করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে প্রচলিত বরাদ্দের অতিরিক্ত আরও ২৫০ কোটি টাকা জরুরি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য উপকরণ আমদানিতে আরোপিত শুল্ক সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে রয়েছে- চিকিৎসাসামগ্রী, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী ও করোনা ভাইরাস শনাক্ত করার কিট। একই সঙ্গে সরকার সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক, কর্মচারী ও কৃষকদের জন্য প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়েছে।

দৈনিক আয় করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের জন্যও নেয়া হয়েছে বিশেষ কর্মসূচি। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকার রফতানিমুখী শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে।

এখন পর্যন্ত সরকার করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর বাইরে নীতি সহায়তা দেয়ারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনার থাবা দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে হচ্ছে। এতে চিকিৎসা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। সবার আগে মানুষের জীবন রক্ষায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। করোনা মহামারীর মধ্যেও কিছু এলাকাকে করোনামুক্ত করে সীমিত আকারে উৎপাদন কর্মকাণ্ড চালানোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে।

তা না হলে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, তেমনি ভেঙে পড়বে সরবরাহ ব্যবস্থাও। এতে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে একদিকে স্বল্প আয়ের মানুষ অর্থ সংকটে পড়বে, অন্যদিকে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে। তখন পণ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। ফলে চাহিদার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রা থেমে আছে। এতে অর্থের চলাচলও হঠাৎ করে থমকে গেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থের চাহিদা কমে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার কমে তলানিতে পৌঁছেছে।

এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে এখন করোনার থাবা সবচেয়ে বেশি। আগে ইউরোপীয় মুদ্রা বাজারে ইউরো লাইবর রেট (ইউরোপের এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের এক দিনের জন্য ধার) দেড় শতাংশের কাছাকাছি উঠানাম করত। এখন তা নেমে এসেছে নেগেটিভ পর্যায়ে। অর্থাৎ শূন্য শতাংশের নিচে। অর্থের চলাচল না থাকায় এর বিপরীতে কোনো আয় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোকে সামনে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে।

এদিকে বাংলাদেশসহ স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে বিরাজ করছে ভিন্ন চিত্র। লকডাউনের কারণে অর্থের চলাচল না থাকায় গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু টাকা জমা হচ্ছে খুবই কম। এতে ব্যাংকগুলো সামনে বড় ধরনের তারল্য সংকটের মুখে পড়তে পারে।

এ অবস্থা মোকাবেলা করতে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোগান বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছে আইএমএফ। তারা বলছে, তারল্যের জোগান বাড়ানো না হলে ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে ইতোমধ্যে বেশ কিছু নীতি সহায়তা দেয়া হয়েছে। ফলে বাজারে ৩৩ হাজার কোটি টাকার নগদ জোগান এসেছে।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে ব্যাংকগুলোর জন্য। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট হবে না বলে মনে করছেন তারা। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটের ভয়াবহতা আগেই আঁচ করতে পেরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আইএমএফ বলেছে, এ মুহূর্তে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর জন্য জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ অর্থে বাড়াতে হবে কর্মসংস্থান। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে আর্থিক ও নীতি সহায়তা দিতে হবে। সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হবে না।

আইএমএফ সতর্ক বলেছে, এখন যেসব অর্থ ব্যয় হবে তার বিপরীতে রিটার্ন (উৎপাদন ও আয়) আসবে কম। ফলে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা থাকে। এ সময়ে রাজস্ব আয় কম হবে বলে সরকারকে ঋণ করে ব্যয় করতে হবে।

এর মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে অভ্যন্তরীণ ঋণের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণও নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (টাকা ছাপিয়ে) থেকে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জরুরি প্রয়োজনে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। কিন্তু ঋণের অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঋণের অর্থ উৎপাদনমুখী খাতে ব্যয় হলে মূল্যস্ফীতির চাপ কম হবে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে এখন বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন ব্যয় কম। এ কারণে রেমিটেন্স, বৈশ্বিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্য স্থবির। অর্থনীতিতে এ স্থবিরতা কাটাতে বেশ লাগবে। লকডাউনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে এশিয়ার দেশগুলো।

এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সেবা খাতের। দেশে দেশে লকডাউনের কারণে এখন চলাচল বন্ধ। এতে বিমান, পণ্য পরিবহন, জাহাজ, পর্যটন, কারখানা, দোকান, রেস্তোরাঁ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।

চিত্রদেশ//এস//

Related Articles

Back to top button