সরকারি হাসপাতালগুলোর সিট বাড়ানো অতি জরুরি: কানিজ কাদীর
ডাঃ কানিজ কাদীর। পেশায় একজন সফল এনেস্থেসিওলজিস্ট। ডাক্তারি পেশায় আসার পিছনে উনার বাবার ভূমিকাই মূখ্য ছিল। তাছাড়া মায়ের সহযোগিতা ও মানসিক সাপোর্ট উনাকে ডাক্তার হতে ভীষনরকম ভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পরে উনার হাসব্যান্ড ও তার নিজস্ব উদ্যোগে তিনি এনেসথেসিয়া পেশায় আগ্রহী হন।
ডা. কানিজ কাদির ১৯৯৪ সাল থেকে এনেসথেসিয়া বিভাগে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার আগারগাঁওয়ে ‘লায়ন্স চক্ষু ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল’ এ কনসালট্যান্ট এনেস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে কর্মরত।
এ পর্যন্ত তিনি ৭ সরকারি হাসপাতালে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে,ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, গঁফরগাও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রমাটলজি এন্ড হাসপাতাল (নিটোর), ঢাকা, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, রুপগন্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নারায়নগন্জ সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা।
সম্প্রতি ‘চিত্রদেশ’ এর আয়োজনে এনেসথেসিয়া ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা হলো এনেস্থেসিওলজিস্ট ডাঃ কানিজ কাদীরের সঙ্গে। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল- সাক্ষাতকার নিয়েছেন লাবণ্য হক।
চিত্রদেশ:ডাক্তার একটি মহৎ সেবামূলক পেশা । তো এই পেশায় আসার ক্ষেত্রে আপনার জীবনে কার অনুপ্রেরণা ছিল? কি ভেবে এই পেশায় আসা? যদি বলতেন?
ডা.কানিজ কাদীর : আমি শিশুকাল থেকেই পরিবারের বড়দেরকে সবসময়ই বলতে শুনতাম আমাকে ডাক্তার বানাবেন । তবে এ পেশায় আসার পিছনে আমার বাবার ভূমিকাই মূখ্য ছিল। তাছাড়া আমার মায়ের সহযোগিতা ও মানসিক সাপোর্ট আমাকে ডাক্তার হতে ভীষনরকম ভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিলাম। বরাবরই ভাল ফলাফল ছিল। তাই মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে উত্তীর্ণ হই। এভাবেই ডাক্তারী পেশায় আসা। পরে আমার হাসব্যান্ড ও আমার নিজস্ব উদ্যোগে আমি এনেসথেসিয়া পেশায় আগ্রহী হয়ে পড়ি।
চিত্রদেশ: আপনি কত সালে এ পেশায় নিয়োগ পেয়েছেন? এ পর্যন্ত কয়টি হাসপাতালে কাজ করেছেন? আপনিতো একজন অধ্যাপক হিসেবে সরকারী কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন?
ডা. কানিজ কাদির: ১৯৯৪ সাল থেকে এনেসথেসিয়া বিভাগে কাজ শুরু করি। এ পর্যন্ত ৭টি সরকারি হাসপাতালে কাজ করেছি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, গঁফরগাও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রমাটলজি এন্ড হাসপাতাল (নিটোর), ঢাকা, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা, রুপগন্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নারায়নগন্জ সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা।
চিত্রদেশ : আপনিতো কর্মজীবনে আগে অনেকগুলো সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাজ করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। সে বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
ডাঃ কানিজ কাদীর: বাংলাদেশ দরিদ্র জনসংখ্যা অনেক। তাদেরকে চিকিৎসা সেবার জন্য সরকারি হাসপাতালেই বেশি যেতে হয়। জনবহুল এই দেশে প্রতিদিন এত অধিক রোগীর চিকিৎসা দিতে হয় যে, তখন চিকিৎসা সেবার মান কিছুটা ঘাটতি হবেই । আর আমাদের দেশের জনগনও কিছুটা অসহিষ্ণুও বটে। তাছাড়া এত রোগীর সংকুলান করা যায় না বলেও রোগীদের চিকিৎসা সেবা পেতে অনেক সময়ই দেরি হয়। এতে চিকিৎসকদের ও হাত থাকে না। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগে হাসপাতালগুলোর সিট সংখ্যা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় জনবল ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও আবশ্যকীয় জিনিসপত্রের সমাধান অতি জরুরি।
চিত্রদেশ: আপনি তো একজন স্বনামধন্য এনেস্থেসিওলজিস্ট। এনেসথেসিয়া দেয়ার ক্ষেত্রে একজন রোগীর কোন কোন বিষয়গুলো মাথায় রেখে তাকে এনেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন?
ডাঃকানিজ কাদীর: এনেসথেসিয়া দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই একজন রোগীর কি ধরনের অপারেশন হবে ও অপারেশনের সময় কতক্ষন লাগবে তা জানা দরকার। তারপর রোগীর বয়স, ওজন জানাও আবশ্যক। এরপর রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখতে হবে। রোগীর প্রতিটা সিস্টেম স্বাভাবিক কিনা তা পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে। বিশেষ করে রোগীর হৃদপিন্ড, শ্বাসতন্ত্র, কিডনী, যকৃতের কোন অসুস্থতা থাকলে তার চিকিৎসা করে নিতে হবে । তাছাড়া রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিন ঠিক আছে কিনা, সংক্রমণ বা আরও কোন সমস্যা আছে কিনা তা দেখতে হবে। শিশুদের অপারেশনে এনেসথেসিয়া দেয়ার পূর্বে কোন জন্মগত ক্রটি আছে কিনা তা দেখা অত্যন্ত জরুরি।
চিত্রদেশ: এ ক্ষেত্রে রোগীর কোন কোন রোগগুলো এনেসথেসিয়া দেয়ার বিষয়ে জটিলতা তৈরি করে?
ডাঃ কানিজ কাদীর: শিশুদের জন্মগত শারীরিক ক্রটি (যেমন: হৃদপিন্ড ছিদ্র বা অন্যান্য অঙ্গে সমস্যা), শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, হাঁপানি , যে কোন কারনে শ্বাসকষ্ট থাকলে এনেসথেসিয়া জটিল হতে পারে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে জন্মগত জটিলতা, সংক্রমণ, লিভার সংক্রমণ, কিডনী রোগ থাকলে এনেসথেসিয়া জটিল হতে পারে।
চিত্রদেশ: সম্প্রতি শিশু আয়ানের একটি বিষয় দেশে খুব তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ডাঃ কানিজ কাদীর: শিশু আয়ানের মৃত্যুর বিষয়টি আমি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি। আসলে এ ব্যাপারে বাস্তবে কি হয়েছিল জানি না। ব্যাপারটা খুবই কষ্টকর ও বেদনাদায়ক। সত্যিকার অর্থে এটা একটা দূর্ঘটনা। এনেসথেসিয়া প্রদানের ক্ষেত্রে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা যে কারও বেলায় যে ঘটবে না তা বলা যায় না। কোন চিকিৎসকই চায় না তার হাতে কোন রোগী মারা যাক। তবে একজন এনেসথেটিস্টকে অবশ্যই সব বিষয়ে চোখ কান খোলা রেখে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাজ করা আবশ্যক। কারন এনেসথেসিয়া অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার।
চিত্রদেশ: আপনি তো এ পেশায় বহুদিন ধরে রয়েছেন। তো , আপনার জীবনে কি এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে যেটা আপনার মনে দাগ কেটে গেছে। যদি সেটা পাঠকদের সাথে শেয়ার করতেন?
ডাঃ কানিজ কাদীরঃ আমি মনে করি প্রত্যেকটা এনেসথেটিস্ট এর জীবনে কোন না কোন ঘটনা আছে যা তার জন্য স্মরণীয়। সে যত পারদর্শীই হোক না কেন। দীর্ঘ এনেসথেসিয়া পেশায় সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে যেয়ে অনেক অনেক এনেসথেসিয়া বিষয়ক জটিলতা ম্যানেজ করতে হয়েছে। তবে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী জাগানোর সময় একটা বাচ্চা ছেলে অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে গিয়েছিল দীর্ঘসময় (মেশিনে অক্সিজেন ও নাইট্রাস অক্সাইড সিস্টেম উল্টা ছিল) । বাচ্চাটিকে নিয়ে আমি খুব উদ্বেগে পড়ে গিয়েছিলাম। এ ঘটনাটি এখনও মনে দাগ কেটে আছে।
চিত্রদেশ: এনেসথেসিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনসেটিভ পেশা । এই মহৎ পেশায় কেউ আসতে চাইলে অথবা এই প্রজন্মের নতুন এনেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে যারা কাজ করছে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ডাঃকানিজ কাদীরঃ এনেসথেসিয়া অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনসেটিভ পেশা। একটা ভাল সার্জারী পেতে হলে অবশ্যই ভাল এনেসথেসিয়া প্রয়োজন। নতুন এনেসথেসিওলজিস্টদের আমি বলবো প্রতিটা অপারেশনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে ।সে যত ছোট অপারেশনই হোক। এনেসথেসিয়া দেয়ার আগে সকল ইমার্জেন্সি যন্ত্রপাতি ও ওষুধ হাতের কাছে রাখতে হবে। ওষুধপত্র নিজেকে চেক করে নিতে হবে। রোগী মনিটর করতে হবে খুব মনোযোগ দিয়ে। সব ব্যাপারে চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অপারেশনের পরও রোগীর সার্বিক অবস্থা সন্তুষ্টজনক আছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। সবসময় এনেসথেসিয়া বিষয়ক জ্ঞান বাড়াতে পড়াশোনা করতে হবে।
চিত্রদেশ: আমরা জানি আপনি একজন অধ্যাপক হিসেবে সরকারী হাসপাতাল থেকে রিটায়ার্ড করে এখন বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করছেন? তো এই সরকারি হাসপাতাল বনাম বেসরকারি হাসপাতাল দুইয়ের মধ্যে কেমন পার্থক্য দেখছেন? সেটা কেমন? কোন অসংগতি কি চোখে পড়েছে? সেটা কিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় বলে আপনার মনে হয়?
ডাঃকানিজ কাদীর: পার্থক্য তো আছেই। বেসরকারি হাসপাতালে অর্থের সংকুলান যারা করতে পারে অর্থাৎ ধনী শ্রেনীই বেশি চিকিৎসা সেবা নিতে যায়। সাধারন জনগনই সরকারি হাসপাতালে যায় চিকিৎসার জন্য। বেসরকারি হাসপাতালের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাও একটু বেশি, ঝামেলাও কম। জবাবদিহিতাও বেশি। বেসরকারি হাসপাতালে জনবল কম থাকাতে অনেক দায়িত্বই চিকিৎসক কে একা সামলাতে হয়। সরকারি হাসপাতালে জবাবদিহিতা কম থাকার কারনে স্বেচ্ছাচারিতাও বেশি। তবে বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মানও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। নিয়মকানুন ও শৃংখলা অনেক উন্নত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের তদারকি ও অত্যাবশ্যকীয় আনুসঙ্গিক বিষয়াদির যোগান, হাসপাতালের জনবল ও বিশেষ করে চিকিৎসকের সেবার মান আরও উন্নত হবে বলে আমি মনে করি।