১৩ সংখ্যাটা বড়মামার জন্য খুব লাকি। জন্মের তারিখ নাকি অনেকের জন্য লাকি হয়। আমার প্রায়ই মনে হত ২০১৩ সাল বা বড়মামার কেমন হবে। সেই ২০১৩ সাল এল অথচ বড়মামা নেই! এই নভেম্বর মাসে মা, বড়মামা, শাহীন মামার জন্মদিন কাজেই এটি আমার অনেক প্রিয় একটি মাস। ছোটবেলায়ে আমরা কয়েকটা বছর পিরোজপুর ছিলাম। তখনও আমার ছোট বোনটি হয় নি। মা-র কলেজ ছুটি হলেই আমাদের দুই বোনকে নিয়ে ঢাকা চলে আসত। এসে আমরা বড়মামার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় উঠতাম। একতো বড়মামা হচ্ছে মা-র বড়ভাই তার উপর সমবয়সী কাজিনরা আছে। আরেকটা কারণ ছিল বড়মামী আমাদের খুব আদর করত। ফলে আমরা ওই বাসায় উঠতাম। সেই সময়টা ছিল স্বপ্নের মত। সারাদিন খেলা, খেলা আর খেলা। কখনও শীলা আপুর ভাল্লুকের সাথে বিয়ে হচ্ছে, কখনও আমরা হচ্ছি বর যাত্রী কখনও বা আকাশ থেকে বরফ পরছে আমরা শীতে থর থর করে কাঁপছি। কখনও বা নাচের অনুষ্ঠান। ওই দিন আমরা লিপস্টিক দেয়ার অনুমতি পেতাম। নিজেকে এত সুন্দর লাগত! বার বার আয়নার সামনে যাওয়া লাগত। বিপাশা আর আমি পিঠাপিঠি দেখে ওর সাথে বেশি থাকতাম। ওর মতের অমিল হলেই আমাকে বাসা থেকে বের করে দিত আমি মন খারাপ করে আরেকজনের কাছে চলে যেতাম। একটু পর আবার খাতির। কোন ফাঁকে সময় চলে যেত, মা-রও কলেজ খুলে যেত আমরা মনের দুঃখে চলে যেতাম। আমি খেয়াল করে দেখলাম আমার জীবনের প্রায় সব কিছুর প্রথম বড়মামার দেয়া! শুধু যে আমার তানা আমাদের পরিবারের অনেকেরই। মধ্যবিত্ত পরিবার তাই সমুদ্র দেখার প্ল্যান হত কিন্তু বাস্তবায়িত হত না। হঠাৎ একদিন বড়মামা ঘোষণা দিল দল বেঁধে কক্সবাজার যাওয়া হবে! আরে কী আনন্দ!! আমি সমুদ্র এত বড় হবে ভাবি নি, ভেবেছিলাম পুকুরের থেকে একটু বড় হবে বড়জোর। আমার একটা ছবি আছে ঢেউয়ের ফেনা আমার পায়ে লাগছে গোলাপি ফ্রক পরা আমি ভয়ে দৌড় দিচ্ছি। প্রথম পাহাড় দেখা সেই বড়মামা। সবাই মিলে সীতাকুন্ডে উঠছি, আমার পাহাড় বাইতে গিয়ে জান শেষ। প্রথম গল্পের বই সেই বড়মামার ‘নীল হাতি’ বইটি পড়ে আমার খুব হাতি পালতে ইচ্ছে হল। ছোটবেলা থেকে আমি একটু গাধা কিসিমের তাই মাকে মনের ইচ্ছার কথা বললাম। মা বলল, ‘আচ্ছা কিনে দিব।’ খুশিতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘কই পালব মা?’ মাও বলল, ‘বারান্দায়।‘ একটু পর মনে একটি প্রশ্ন আসল তাই মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বড় হলে কই পালব?’ মা বলল, ‘বাগানে থাকবে।’ আমি হৃষ্ট চিত্তে ঘুমাতে গেলাম। জীবনের প্রথম গাড়িতে চড়া বড়মামাদের সাদা গাড়ি, প্রথম প্লেনে চড়া বড়মামা, প্রথম চিড়িয়াখানা দেখা বড়মামা, প্রথম শাড়ী পরে সবাই ঘুরতে যাওয়া বড়মামা, প্রথম চাইনিজ খাওয়া বড়মামা, প্রথম বিদেশ দেখা বড়মামা…লিস্ট মনে হয় বাড়তেই থাকবে শেষ আর হবে না। যেকোন বিপদে পরলে আমরা বড়মামাকে পেতাম। আমার মনে আছে, বিয়ের পর একদিন চাকরির বাজার প্রসঙ্গে সমিক বলল, ‘অপলা, আমরা দুইজনই প্রাইভেট জব করি। হুট করে জব চলে গেলে কী হবে আমাদের?’ আমি কোন কিছু না ভেবে বললাম, ‘বড়মামা আছে, চিন্তা নাই।’ বলেই আমি অন্য কাজে চলে গেলাম। যে জিনিসে চিন্তা নেই তা নিয়ে আমি কেন দুশ্চিন্তা করব? এত কিছু বড়মামা তবু কেন জানি আমরা বড়মামাকে খুব ভয় পেতাম। ঈদে কে আগে সালাম করবে এই নিয়ে গুঁতোগুঁতি লেগে যেত। যেন প্রথম সালাম করাটাই বেশি ভয়ের। কিন্তু বয়সের ডাবল সালামি পেতে আমাদের আপত্তি ছিল না।
বড়মামার ওই ঘটনাটার পর একটা অলিখিত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। বড়মামার বাসায়ে যেতে অস্বস্তি লাগে, ভাল লাগে না বেশিক্ষণ বসতে। বিশেষ বিশেষ দিন যেমন, জন্মদিন, গল্পের বই বের হওয়া, ঈদ এগুলোতে যেতাম। শেষের দিকে যেতামও না মা-কে বলতাম ‘তুমি যাও।’ এভাবেই চলছিল দিনগুলো। যখন বড়মামার ক্যান্সারের খবর পেলাম আমাদের কারোরই মনে হয় নি বড়মামা আর আসবে না। ক্যান্সার ছড়িয়ে গিয়েছে যাক, শরীর খারাপ হচ্ছে হোক কিন্তু আমরা জানি বড়মামা সব উতরে চলে আসবে। এমনই তো হয়। তাই তাঁর চলে যাওয়াটা ছিল অসম্ভব কষ্টের! বড়মামার সাথে দূরত্ব তৈরি হলেও ভালবাসাতো একই ছিল। সেই চিরন্তন একটি বানী আছে না, ‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন’ তাই মানি। কিন্তু যখন মা বলে, ‘অমি, দাদাভাইয়ের কথা মনে করলে বুকটা ভেঙ্গে যায়।’ তখন বড্ড কষ্ট হয়। যখন ইকবাল মামাকে ফোন দিয়ে নিজের মন খারাপের কথা বলার পর অপর প্রান্ত থেকে ইকবাল মামা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘অমি, আটটা বছর দাদাভাইয়ের সাথে ভাল ভাবে কথা হয় নি, আমার কষ্টটা বুঝ?’ তখন ওই বানীটি খুব ঠুকনো মনে হয়। যখন দেখি নুহাশের লিখার মাঝে তার বাবার জন্য হাহাকার তখন নিজেকেই অসহায় লাগে। যখন মা বলে, ‘তোমার নানু সারাদিন কান্না কাটি করে, দিন দিন যেন ছোট্ট হয়ে বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছে।’ তখন ওই বানীটি মিথ্যা মনে হয়।
লেখক পরিচিতি: হুমায়ূন আহমেদের বোনের মেয়ে।
লেখক, অপলা হায়দার।