লেদার পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে: তোফাজ্জল হোসেন তপু
এনেক্স লেদারের শুরুটা হয়েছে ২০১৫ সালে। মূল উদ্যোক্তা ছিল দুইজন। এরা হলেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তােফাজ্জল হােসেন তপু (এনেক্স লেদারের চেয়ারম্যান) ও মোস্তফা দীপু (এনেক্স লেদারের ব্যবস্থ্যাপনা পরিচালক)। আর তাদের সেই উদ্যোগের সহযোগী হিসেবে ছিলেন আরো দুইজন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র সাখাওয়াত হোসেন ও আরিফ মৃধা ।
এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মূল লক্ষ্যটা ছিল নিজে কিছু করা এবং কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করে দেয়া। সর্বপরি সমাজও রাষ্ট্রের জন্য কিছু করা। এবং নিজস্ব একটা স্বত্তা তৈরি করা।
বাংলাদেশে চামড়াজাত পণ্যের সমস্যা ও সম্ভবনা নিয়ে চিত্রদেশ ডটকমকে একান্ত সাক্ষাতকার দিয়েছেন ‘এনেক্স লেদার’-এর চেয়ারম্যান, তরুণ উদ্যোক্তা তোফাজ্জল হোসেন তপু – সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন- লাবণ্য হক
চিত্রদেশ: আপনার দৃষ্টিতে বর্তমানে লেদার প্রোডাক্টের চাহিদা বাড়ছে না কমছে বলে মনেহয়?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: বাড়ছে তো অবশ্যই। যেমন শোরুম ভিত্তিক তেমনই বাড়ছে অনলাইন ভিত্তিক কেনাকাটা। এখন যারা ফ্যাশন সচেতন ফ্যাশন প্রিয় মানুষ তারা গ্রামে বসেও অনলাইনে লেদার পণ্যের অর্ডার করে। যা একদিনের মধ্যে ডেলিভারির মাধ্যমে তাদের কাছে পণ্য পৌছেঁ যাচ্ছে। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমি মনে করি লেদার পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
চিত্রদেশ: চামড়জাত পণ্যে খাতে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কোন সমস্যায় পড়তে হয় কী? এ খাতকে আরো এগিয়ে নিতে এবং উদ্যোক্তাদের চামড়াজাত পণ্যে শিল্পে এগিয়ে আসতে করণীয় কী?
তোফাজ্জল হোসেন তপু
তোফাজ্জল হোসেন তপু: আসলে সমস্যা তো অবশ্যই কিছু আছে । তবে আমার মনেহয় একজন উদ্যোক্তা সমস্যাকে কখনোই সমস্যা মনে করে না। সমস্যাকে সমাধান করাই হলো একজন উদ্যোক্তার কাজ। আর আমরাও এভাবেই এগুচ্ছি। তারপরও ফ্যাশন প্রিয় মানুষের কাছে লেদার প্রোডাক্ট খুব প্রিয় হলেও বর্তমানে এই লেদার প্রোডাক্ট তৈরিতে কাচাঁমালের দাম কম থাকলেও কেমিক্যাল এবং বাইরে থেকে লেদার তৈরির কেমিক্যাল আমদানি করে আনতে হয়। যে কারণে কস্টিং অনেক বেড়ে যায়। এজন্য দেশীয় চামড়ায় দাম কম থাকলেও কেমিক্যালের কারণে কস্টিংটা আমাদের আগের মতোই থাকছে। আর এ কারণেই আমরা যখন বিক্রি করতে যাই তখন ক্রেতারা আমাদেরকে প্রশ্ন করে , চামড়ার দাম এতো কম অথচ চামড়ার তৈরি পণ্যের কেন এত বেশি দাম? তবে সবাইকে তো আর একেক করে বুঝানো সম্ভব হয় না। দেখা যাচ্ছে কেমিক্যাল, একসেসরিজ, ওয়ার্কার, প্রশাসনিক কস্ট থাকে যা সবকিছু মিলিয়ে প্রোডাক্টের দামটা একটু বেড়ে যায় এটা একটা বড় সমস্যা।
চিত্রদেশ: এ অবস্থায় চামড়াজাত পণ্যের কাচাঁমাল আমদানিতে রেট কমানোর জন্য সরকারের কী করণীয়?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: সরকারের তো অবশ্যই এখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা উচিত। কারণ হচ্ছে আমরা (বন্ড বা এক্সপোর্ট লাইসেন্সধারী উদ্যোক্তা।যাদের বন্ড লাইসেন্স আছে তারা ট্যাক্স ছাড়া কাচাঁমাল আমদানি করতে পারে ) যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তারা তো বন্ডের আন্ডারে না। যেসব উদ্যোক্তারা বন্ডের আন্ডারে আছে এবং এক্সপোর্ট করে তারা হয়তো ট্যাক্স ছাড়া ইমপোর্ট করতে পারে। আমরা যারা লোকালি কিনি তাদের হয়তো বন্ড লাইসেন্স ইউজ করা হয় না। আমরা যারা ছোট ছোট ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আছি আমাদের কে যদি তারা অর্থাৎ যারা লেদার নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে যদি বন্ডের সুযোগগুলো দিয়ে অর্থাৎ লাইসেন্স করার ক্যাপাসিটি তো ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাদের নেই বা আমরা পারি না। সেক্ষেত্রে এটাকে যদি নমনীয় করে তাহলে আমরা যারা দেশের জন্য কাজ করছি এই শিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে পারি। একই সঙ্গে আমার আরেকটা দাবিও রয়েছে । যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যারা কেবল ব্যবসা শুরু করেছে বা এখনো লাভের মুখ দেখেনি। সেক্ষেত্রে সরকারের যে ভ্যাট, ট্যাক্স আছে বা এগুলো দেয়ার জন্য যে নিয়ম আছে আমরা কিন্তু ভ্যাট, ট্যাক্স দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। এবং সেটা দিব। কিন্তু এখানে যারা ছোট উদ্যোক্তা আছে । তাদের জন্য এমন একটা প্রসিডিউর রাখা উচিত যাতে করে উদ্যোক্তারা লাভের মুখ দেখার আগ পর্যন্ত বা একটা স্বল্প মেয়াদি ৩/৫ বছর পর্যন্ত যদি তাদের ভ্যাট , ট্যাক্স মওকুফ করা যায়। কেননা বর্তমানে বেসরকারী ব্যাংকগুলো যে ইন্টারেস্টে লােন দেয়। সেই ইন্টারেস্টর লোন নিয়ে প্রতিমাসে কিস্তি পরিশোধ করে ব্যবসা চালিয়ে নেয় খুব কঠিন।
চিত্রদেশ: এই শিল্পের আরাে প্রসার ঘটাতে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত বা কী ধরনের সহযোগিতা করা উচিত?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: আসলে এই ক্ষেত্রেও সরকারেরই উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া উচিত। যেন যেসব উদ্যেক্তারা আসলে প্রকৃতভাবে চামড়াজাত পণ্য নিয়ে কাজ করছে বা অলরেডি এই মার্কেটে টিকে গেছে তাদের কে আরো কীভাবে নার্সিং করলে তারা এক্সপোর্ট করতে পারবে।
চিত্রদেশ: চামড়াজাত পণ্যে রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা কী? আপনাদের পণ্যগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: আসলে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে যে রকম একটা সেটআপ প্রয়োজন সেটা আসলে আমাদের এখনো নেই। রপ্তানি করার উপযোগি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারিভাবে ৪/৫ বছর মেয়াদি রিটার্নবল ফাইন্যান্স খুব জরুরি। তাহলে আমরা বিনিয়োগ করে রপ্তানি করতে পারি।
চিত্রদেশ: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: নতুন উদ্যোক্তাদের তো সবসময় বলে থাকি বা পরামর্শ দিতে চাই। একটা বিজনেসে আসার আগে স্টাডি করা উচিত। যে সে কী বিজনেস করবেন। এবং কী ধরনের বিজনেস করবেন একটু ক্লিয়ার কনসেপ্ট থাকতে হবে। আগামী ১০ বছরের পজেটিভ ও নেগেটিভ বিষয়গুলো ভেবে রাখতে হবে। একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রবল ইচ্ছা শক্তি থাকতে হবে। এবং অজস্র বাধাঁ বিপত্তি কাটিয়ে উঠার মানসিকতা থাকতে হবে। কারণ ব্যবসা করতে গেলে অনেক বাধাঁ বিপত্তি সমুক্ষীন হতে হবে। ব্যবসা করতে এলে হোচট খাবেই তারপরও এই হোচট খেয়েই আবার উঠে দাড়ানোর মানসিকতা থাকতে হবে। ফাইন্যান্সিয়ালি একটা ব্যাকআপ থাকতে হবে। আমি মনে করি কেউ যদি ১০ লাখ টাকা নিয়ে বিজনেস শুরু করে তাহলে তাকে ৫/৭ লাখ টাকা রাখতে হবে ব্যাকআপের জন্য বিজনেসে বিনিয়োগের ৫০%।
চিত্রদেশ: এনেক্স লেদার মূলত কী কী ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করে থাকেন? কোথায় কোথায় কীভাবে বাজারজাত করে থাকেন?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: এনেক্স লেদার বিভিন্ন ধরনের লেদার প্রোডাক্ট তৈরি করে থাকে যেমন অফিস ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, সাইড ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক এছাড়া নারী -পুরুষ সবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের জুতা রয়েছে। যেমন- সাইকেল সু রয়েছে। ওয়ালেট , চাবি রিং, বেল্ট। আমরা কর্পোরেট গিফট আইটেমের কাজগুলো করে থাকি। আমরা রানার কোম্পানি, এরিস্টটো ফার্মা, নিপা ফার্মাসহ প্রভৃতি কোম্পানির কাজগুলো করেছি। আমরা বায়িং হাউসের মাধ্যমে ফ্রান্সে কিছু প্রােডাক্ট রপ্তানি করেছি। আমাদের নেক্সট টার্গেট হলো ইকমার্স সাইট অ্যামাজনে প্রােডাক্ট সেল করা। সেই মােতাবেক আমাদের প্রোডাক্ট তৈরি করছি। এছাড়াও ঢাকার ধানমন্ডি ও চিটাগাংয়ের চকবাজারে এনেক্স লেদারের শোরুম রয়েছে। যেখান থেকে ক্রেতারা তাদের পছন্দের প্রোডাক্টগুলো কিনতে পারেন। এছাড়া আমরা ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে এবং ওয়েব সাইটের মাধ্যমে প্রােডাক্ট সেল করি। এছাড়াও লোকাল প্রায় ১৫টি আমরা ই-কমার্স সাইট রয়েছে যাদের মাধ্যমে আমরা পণ্য সেল করি যেমন- দারাজ, আজকের ডিল, দিনরাত্রি, সপআপ, ডেইলি গ্রাম প্রভৃতি। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের শোরুমের জন্য আমাদের প্রােডাক্ট হোল সেল নিয়ে যায় বিক্রির জন্য যেমন টাঙ্গাইল , রাজশাহী, খুলনা আমাদের একটা এক্সক্লুসিভ প্রােডাক্ট রয়েছে। লেদারের জায়নামাজ , লেদারের টুপি পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান গিফট আইটেম হিসেবে আমাদের এই প্রোডাক্টগুলো নিয়েছি।
চিত্রদেশ: এনেক্স লেদার এই পর্যন্ত কয়টা মেলার অংশ গ্রহণ করেছে?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: আমরা এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ করি। এসএমইয়ের আন্ডারে এসএমই মেলা সারাদেশব্যাপী ডিস্ট্রিক লেবেলেও অংশগ্রহণ করে থাকে। শিল্প মেলায় অংশগ্রহণ করে এনেক্স লেদার তৃতীয় পুরষ্কার পেয়েছে।
চিত্রদেশ: চিত্রদেশ: এনেক্স লেদারের শুরুটা হয়েছে কবে? কীভাবে? এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মূল লক্ষ্যটা কী ছিল?
তোফাজ্জল হোসেন তপু:: এনেক্স লেদারের শুরুটা হয়েছে ২০১৫ সালে। মূলত আমরা দুইজন উদ্যেক্তা। আমি তােফাজ্জল হােসেন তপু (এনথ্রোপলজি, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) আরেকজন মোস্তফা দীপু (দর্শন, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) আমরাই হচ্ছি মূল উদ্যোক্তা। আর আমাদের উদ্যোগের সহযোগী হিসেবে আমাদের ইউনিভার্সিটির (চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ) আরো দুইজন বন্ধু ও নিয়েই আমরা শুরু করি। একজন হলেন সাখাওয়াত হোসেন (পলিটিক্যাল সাইন্স, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) আরেকজন আরিফ মৃধা ৩৬ তম ব্যাচ (চারুকলা , চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) যিনি এনেক্স লেদারের লগো, থিম,ব্র্যান্ডিং নিয়ে মূলত কাজ করেন।
এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্যটা ছিল নিজে কিছু করা এবং কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করে দেয়া। সর্বপরি সমাজও রাষ্ট্রের জন্য কিছু করা। এছাড়া আরেকটা বিষয় ছিল আমারনিজস্ব একটা সত্তা তৈরি করা। আমি থাকি বা না থাকি প্রতিষ্ঠানটা থাকবে। যে কারণে আমরা পার্টনারশীপে প্রতিষ্ঠান করেছি। যেন আমি না থাকলেও যেন প্রতিষ্ঠান থাকে।
চিত্রদেশ: এনেক্স লেদারের ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?
তোফাজ্জল হোসেন তপু: আমাদের এখন মূল টার্গেট হচ্ছে আমরা একটা এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরি করবো যেটা শুধুমাত্র এক্সপাের্ট হবে। আমরা এক্সপোর্ট করার জন্য একটা সেটাআপ দিব।এক্ষেত্রে যদি আমরা ভালো কোন ফাইন্যান্স পাই সেটা সরকারি বা বেসরকারি বা কোন পার্টনাশীপ, জয়েন্ট ভেন্চার যেভাবেই হোক সেটাতে আমার কাজ করে আমার এক্সপোর্টের দিকে যাবো। তখন আমি চাই আমাদের এখানে আরো এক হাজার লোক কাজ করুক। কর্মসংস্থান হোক। সেটাই স্বপ্নই দেখি।