রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে টাইগারদের সিরিজ জয়
স্পোর্টস ডেস্ক
৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩২২ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করিয়েও জয় পেতে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তামিম ইকবালের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৫৮ রানের ইনিংস প্রায় মাটিই হয়ে যাচ্ছিল তিরিপানো ঝড়ে। শেষ দিকে তার ২৮ বলে ৫৫ রানের ঝড়ো ইনিংসে জিম্বাবুয়ের ইনিংস শেষ হয় ৮ উইকেটে ৩১৮ রানে। শেষ বলে ছক্কার সমীকরণ মেলাতে না পেরে হেরে গেছে তারা। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার ম্যাচে ৪ রানে জিতে সিরিজ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। এই ম্যাচে দিয়েই শততম জয়ের স্বাদ পেলেন মুশফিকুর রহিম ।
মঙ্গলবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তামিম ইকবালের অনবদ্য ১৫৮ রানের ইনিংসে ভর করে ৮ উইকেট হারিয়ে ৩২২ রান সংগ্রহ করেছে টাইগাররা। ব্যাট হাতে তামিম ইকবাল ক্যারিয়ার সেরা ১৫৮ রান করেন। ১৩৬ বল খেলে ২০ চার ও ৩ ছক্কায় এই রান করেন তিনি। ৬ চারে ৫৫ রান করেন মুশফিকুর রহিম। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৪১ ও মোহাম্মদ মিথুন অপরাজিত ৩২ রান করেন।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২২৫ রানেই সাত উইকেট হারিয়ে বসে জিম্বাবুয়ে। তখনো দরকার ছিল ৯৮ রান। হাতে ছিল মাত্র ৪৭ বল। এই অবস্থায় দুই ব্যাটসম্যান তিনোতেন্ডা মুতুমবাজি আর ডোনাল্ড টিরিপানো রীতিমতো তাণ্ডব চালান। মাত্র ৪৫ বল খেলে এই দুজন করে ৮০ রান। এর মধ্যে ৪৬ আর ৪৭তম ওভারে আসে ৩৭ রান। একপর্যায়ে শেষ দুই ওভারে জিম্বাবুয়ের দরকার পড়ে ৩৫ রানে। শফিউলের করা ৪৯তম ওভারে আসে ১৪ রান। তাতে শেষ ওভারে দরকার হয় ২১ রানের। ওই ওভারের প্রথম বলে আসে ২ রান। পরের বলে মুতুমবাজিকে ফেরান আল আমিন। পরের দুই বলে ২ ছয় মারেন ট্রিপানো। তাতে শেষ দুই বলে দরকার হয় ৬ রানের। পঞ্চম বলটি ডট হয়। আর শেষ বলে আসে ১ রান। তাতে ৪ রানের জয় পায় বাংলাদেশ।
বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতে অভিজ্ঞ রেগিস চাকাভাকে হারালো জিম্বাবুয়ে। দলীয় ১৫ রানের মাথায় শফিউল ইসলামের বলে ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটরক্ষক লিটন দাসের তালুবন্দি হন চাকাভা। আউট হওয়ার আগে করেন ৫ বলে ২ রান।
দলীয় ৬৭ রানে ফিরলেন অধিনায়ক ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান শন উইলিয়ামস। বাঁহাতি অলরাউন্ডারকে এলবিডব্লিউ করে ফেরালেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তিন চারে উইলিয়ামস ফিরেন ২৪ বলে ১৪ রান করে।
রান পাহাড়ে চাপা পড়ে যাওয়া জিম্বাবুয়েকে খেলায় ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন ওপেনার টিনাশে কামুনহুকামউইকে। ২৪তম ওভারে বোলিংয়ে এসেই টিনাশের উইকেট তুলে নেন তাইজুল ইসলাম। তার স্পিনে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরার আগে ৭০ বলে ৫টি চার ও দুই ছক্কায় ৫১ রান করে ফেরেন টিনাশে।
১০২ রানে ৪ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়েকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন ওয়েসলি মাদেভেরে ও সিকান্দার রাজা। তাদের পঞ্চম উইকেট জুটিতে অস্বস্তি বাড়ছিল বাংলাদেশের। অবশেষে তাদের প্রতিরোধ ভাঙলেন তাইজুল। এই স্পিনারের দ্বিতীয় শিকার হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন মাদেভেরে।
মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নামা মাদেভেরে চমৎকার ব্যাটিংয়ে তুলে নিয়েছেন প্রথম হাফসেঞ্চুরি। আল-আমিন হোসেনের বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ফিফটি পূরণ করার খানিক পরই আউট হয়ে গেছেন তাইজুলের বলে এলবিডাব্লিউ হয়ে। আউট হওয়ার আগে ৫৭ বলে ৫ বাউন্ডারিতে করেন ৫২ রান। উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান রিচমন্ড মুতোমবামি (১৯) নিজের তৃতীয় শিকার বানিয়ে সাজঘরে ফেরান তাইজুল ইসলাম। এর পরপরই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা সিকান্দার রাজাকে মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ বানিয়ে টাইগারদের মনে স্বস্তি ফেরান অধিনায়ক মাশরাফি। ৫৭ বলে ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৬৬ রান করেছেন রাজা।
এরপর বাংলাদেশের বোলারদের ওপর চড়াও হয়েছেন ডনাল্ড টিরিপানো ও রিচমন্ড মাটুমবোদজি। ম্যাচের শেষ ওভারে টিনোটেন্ডা মাটুমবোদজিকে ফিরিয়ে ৮০ রানের জুটি ভাঙলেন আল আমিন। জয়ের জন্য শেষ ৪ বলে ১৮ রান চাই জিম্বাবুয়ের। এমন সমীকরণে পরপর দুই বলে দুই ছক্কায় জয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল সফরকারীরা। ৫ম বলে কোন রান না হওয়ায় শেষ বলে জিম্বাবুয়ের দরকার ছিল ৬ রান। কিন্তু আল আমিনের শেষ বলে বড় শট খেলতে পারেননি টিরিপানো। ১ রান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাকে। এতে ৪ রানে হার বরণ করতে হয়েছে সফরকারীদের। দুই ম্যাচ হেরে ইতোমধ্যে সিরিজ হার নিশ্চিত হয়েছে জিম্বাবুয়ের।
টাইগারদের হয়ে তিনটি উইকেট নেন তাইজুল ইসলাম আর একটি করে উইকেট নেন মাশরাফি, শফিউল, আল-আমিন এবং মিরাজ।
এর আগে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা দারুণ করেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। উদ্বোধনী জুটিতে ৩৮ রান তোলেন তারা। শুরু থেকেই ব্যাট চালিয়েছেন তামিম। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান লিটন দাস রান আউট হয়ে ফিরে যান মাত্র ৯ রান করে। সেটিও তামিমের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে। কার্ল মুম্বার করা তৃতীয় বলটি সোজা ব্যাটে খেলেন তামিম। তামিমের ব্যাট ছুঁয়ে আসা বল মুম্বার হাত ছুঁয়ে নন স্ট্রাইক প্রান্তের স্ট্যাম্প এলোমেলো করে দেয়। বল যখন স্ট্যাম্পে লাগে তখন পপিং ক্রিজের বাইরে ছিল লিটনের ব্যাট। চেষ্টা করেও তিনি লাইনের ভেতরে ব্যাট নিয়ে যেতে পারেননি।
লিটন কুমার দুর্ভাগ্যজনক আউট হওয়ার পর রান আউটে কাটা পড়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। একাদশতম ওভারে ওয়েসলি মাধভেরের করা দ্বিতীয় বলটি শান্তর প্যাডে লেগে শর্ট ফাইন লেগে চলে যায়। শান্ত রান নিতে চাননি। তামিম দৌড়ে চলে যান স্ট্রাইকিং প্রান্তে। অনিচ্ছা সত্বেও শান্তকে বেরিয়ে আসতে হয়। টেলরের হাত ঘুরে বল যায় মাধভেরের হাতে। তিনি উচ্ছ্বাস নিয়ে ট্যাম্প ভাঙেন। শান্ত মাত্র ৬ রান করে ফেরেন।
বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ফিফটি এসেছিল তামিমের। অবশেষে ৯ মাস পর আরেকটি ফিফটি পেলেন টাইগার এই ওপেনার। তার ব্যাটিংয়ের ধরণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তামিম এবার করলেন তার নিজস্ব আক্রমণাত্মক ব্যাটিং। ফিফটি ছুঁয়েছেন মাত্র ৪২ বলে, মেরেছেন ১০টি চার।
তামিমের সঙ্গে আক্রমণাত্মকভাবে ব্যাটে চালালেন মুশফিকও। ৪৭ বলেই অর্ধশতকের দেখা পেয়েছেন টাইগার ডিপেন্ডবল ব্যাটসম্যান। তবে হাফ সেঞ্চুরি তুলেই মারমুখি হয়ে যান মুশফিক। ফলাফল ৫ রান যোগ করেই সাজঘরে ফিরতে হয়েছে তাকে। ৫০ বলে ৬ চারে মুশফিকের সংগ্রহ ৫৫ রান।
দীর্ঘদিন ধরেই ওয়ানডেতে আগের সেই তামিমকে দেখা যাচ্ছে না। সেই আগ্রাসী তামিম হঠাৎ করেই কেমন জানি গুটিয়ে গেলেন। ক্রিজে এসে টুকটুক করতে করতেই নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসতেন। শেষ শতকটিও এসেছিল প্রায় ১৯ মাস আগে। এরপর ৪টি অর্ধশতকের দেখা পেলেও সেটিকে সেঞ্চুরিতে রুপ দিতে পারেননি তামিম। উল্টো মন্থর গতিতে খেলে সমালোচনায় বিধ্বস্ত হন। অবশেষে ১৯ মাস পর নিজের ক্যারিয়ারের ১২তম সেঞ্চুরি তুলে ফেললেন তামিম। ৯৫.২৮ স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি তুলতে তামিম খেলেছেন ১০৬ বল।
তামিম ইকবালের সঙ্গে ১০৬ রানের জুটি গড়ে বিদায় নিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। দলীয় ২৫৮ রানের মাথায় চার্লটন টিসুমার বলে ডিপ স্কয়ার লেগে ওয়েসলি মাধভেরের দুর্দান্ত এক ক্যাচে সাজঘরে ফেরেন তিনি। যাওয়ার আগে ৫৭ বল খেলে ৩ চারে ৪১ রান করে যান।
ওয়ানডেতে এতদিন তামিমের সর্বোচ্চ রান ছিল ১৫৪। বুলাওয়েতে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তামিম। এটিই ছিল এতদিন পর্যন্ত তার এবং বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। অবশেষে ১০ বছর পর নিজের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড নিজেই তামিম। প্রতিপক্ষ সেই জিম্বাবুয়ে।
১০৬ বলে সেঞ্চুরি, ১৩২ বলে ১৫০। অর্থাৎ সেঞ্চুরির পরের ফিফটি তুলে নিতে তামিম খরচ করেছেন মোটে ২৬টি বল। নিজের দিনে তিনি কি করতে পারেন দেখিয়ে দিলেন সবাইকে। তবে ১৩৬ বল খেলে ১৫৮ রানেই সাজঘরে ফিরতে হয়েছে তামিমকে।
শেষ দিকে মাত্র ১৯ রানেই ৪টি উইকেট হারায় বাংলাদেশ। মিরাজ (৫), মাশরাফি (১) এবং তাইজুল (০)। অবশ্য মিঠুনের ১৮ বলের ৩২ রানের ক্যামিওতে ৩২২ রানের রেকর্ড সংগ্রহ দাঁড় করাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। রোডেশিয়ানদের হয়ে তিরিপানো এবং মুম্বা ২টি করে উইকেট নেন; ১টি করে উইকেট নেন মাধেভেরে ও শুমা।
চিত্রদেশ//এস//