রিও ভাইরাস কতটা আতঙ্কের?
স্বাস্থ্য ডেস্ক
পাঁচ বছর পরও করোনা মহামারীর প্রভাব রয়েছে জনমনে। সংক্রমণের ভয়, লকডাউন ও স্বজন হারানোর বেদনা এখনও তাড়া করে বিশ্ববাসীকে। ফলে নতুন করে কোনো নতুন ভাইরাসের খবর এলে মানুষের মনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রিও ভাইরাস নামে একটি জুনোটিক রোগ শনাক্ত হয়েছে, যা নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পাঁচজনের শরীরে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ানো এই ভাইরাসটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে কিনা তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি মৃদু উপসর্গ তৈরি করে, তবে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা একে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। এ অবস্থায় রিও ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই জানালেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জুনোটিক রোগগুলো মানবস্বাস্থ্যের জন্য দিন দিন বড় হুমকি হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের নজরে এসেছে তুলনামূলক কম পরিচিত কিন্তু বিস্তৃত রিও ভাইরাস।
রিও ভাইরাসের ইতিহাস ও বিস্তার
রিও ভাইরাস একটি দ্বিসূত্রক আরিএনএ ভাইরাস, যা রিও-ভাইরিডি (Reoviridae) পরিবারভুক্ত। ১৯৫০-এর দশকে শ্বাসতন্ত্র এবং অন্ত্রের নমুনা থেকে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে এটি কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত না হলেও গবেষণায় এর সংক্রমণের সম্ভাব্য উৎস এবং উপসর্গ নিয়ে ধীরে ধীরে তথ্য উঠে আসতে থাকে। রিও ভাইরাস মূলত জুনোটিক উৎস থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। সংক্রমিত প্রাণী যেমন গবাদিপশু, পাখি এবং কীটপতঙ্গ এই ভাইরাসের বাহক হতে পারে। সংক্রমণ সাধারণত মল-মুখ (ফ্যাসিয়াল ওরাল) পদ্ধতিতে এটি ঘটে। দূষিত পানি, খাদ্য এবং সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে। পরিবেশে সহজে টিকে থাকার ক্ষমতার কারণে এটি দ্রুত ছড়াতে পারে।
রিও ভাইরাস ইতোমধ্যেই বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়েছে। এটি উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় সব মহাদেশেই শনাক্ত হয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মৃদু উপসর্গ সৃষ্টি করে, কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে এটি ডায়রিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার কারণ হতে পারে। বাংলাদেশেও রিও ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে পাঁচজনের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে আক্রান্তদের মধ্যে তেমন কোনো জটিলতা দেখা যায়নি।
রিও ভাইরাস বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটির পরিচিত বহু পুরনো। ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ, ঝুঁকি ও সম্ভবনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী একাধিক গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে একটি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় রিও ভাইরাসের পরিবেশগত বিস্তার এবং সংক্রমণের উৎস নিয়ে গবেষণা। গবেষণাটি ড. তাকাশি ইয়ামামোটোর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল পরিচালনা করে। যেখানে ভাইরাসটির পরিবেশগত উপস্থিতি, সংক্রমণের উৎস এবং বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে এর বিস্তৃতি নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, রিও ভাইরাস শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিভিন্ন প্রাণী যেমন পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং এমনকি গাছের মধ্যেও পাওয়া গেছে। গবেষকরা নিশ্চিত করেন যে, এই ভাইরাস প্রকৃতিতে অত্যন্ত অভিযোজনশীল এবং এটি ভেক্টর হিসেবে পশু-পাখি বা পতঙ্গকে ব্যবহার করে বিভিন্ন পরিবেশে ছড়াতে সক্ষম। এমনকি ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রক্রিয়ায় জলবায়ুগত পরিবর্তন এবং পরিবেশগত উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেও পর্যবেক্ষণ করেন তারা।
এই গবেষণার মাধ্যমে বিশেষত রিও ভাইরাসের ‘হোস্ট জাম্পিং’ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে ভাইরাসটি এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ ধরনের সংক্রমণ প্রক্রিয়া মানুষের মধ্যে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ভাইরাসটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জলবায়ুগত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে বলেও জানানো হয়।
অন্যদিকে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা রিও ভাইরাসের অনকোলিটিক (ক্যানসার কোষ ধ্বংসকারী) বৈশিষ্ট্য নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা পরিচালনা করেছেন। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল রিও ভাইরাসের মাধ্যমে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং ক্যানসার চিকিৎসায় এটি কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তা নির্ণয় করা।
গবেষণায় দেখা গেছে, রিও ভাইরাস নির্দিষ্ট ক্যানসার কোষে সংক্রমণ ঘটিয়ে সেগুলোর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম। বিশেষ করে, এই ভাইরাসটি রাসায়নিক থেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপির মতো প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে ক্যানসার চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়ানো যেতে পারে।
গবেষকরা আরও পর্যবেক্ষণ করেছেন, রিও ভাইরাস ক্যানসার কোষে সংক্রমণ ঘটিয়ে সেগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে সহায়তা করে। এ ধরনের গবেষণা ভবিষ্যতে ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে এবং রোগীদের জন্য আরও কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনে সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ
বাংলাদেশে রিও ভাইরাস শনাক্ত হলেও তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, রিও ভাইরাস সাম্প্রতিক সময়ে শনাক্ত হলেও এটি নতুন কোনো রোগ নয়। বহু বছর ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এর উপসর্গ খুবই মৃদু। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা বুঝতেও পারেন না।
সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এটি ফেটাল না, অর্থাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি নেই বললেই চলে। সাধারণ প্যারসিটামলেই রোগ সেরে যায়। তবে শিশু, বয়স্ক ও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিল হতে পারে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এক্ষেত্রে করোনাকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা অনুসরণ করে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরাসজনিত রোগগুলো স্নায়ুবিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তবে রিও ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস)-এর সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, রিও ভাইরাস এতটা ভয়াবহ না। অনেকেই অজ্ঞাতসারে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাদের শরীরে এ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি থাকে। তাই আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।