যেভাবে করোনা ঠেকাল চীন কোরিয়া সিঙ্গাপুর
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর সঙ্গে পুরো বিশ্ব এখন লড়াই করছে। ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতোমধ্যে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সংক্রমণ অনেকটাই দমিয়ে দিয়েছে দেশগুলো।
চীন সরকার একে ‘গণযুদ্ধ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ‘ফাইট অন উহান, ফাইট অন চায়না’ কর্মসূচি চালু করে। এ ছাড়া প্রেরণামূলক ছবি, বিজ্ঞাপন তৈরি করে যুদ্ধকালীন প্রচারের মতো প্রচার চালাতে শুরু করে। অন্য দেশগুলোও চীনের নীতি অনুসরণ করে সফল হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নাগরিকদের সচেতনতা ও বিশ্বজুড়ে পরস্পরের সহযোগিতার মাধ্যমে আক্রান্ত দেশগুলো ভাইরাসটির মোকাবেলা করতে পারে। খবর নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স ও বিবিসির।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশগুলো অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাস আক্রমণের পর মহামারীতে জ্বর মাপা তারা নিয়মে পরিণত করেছিল। চীনের উহানের বিভিন্ন স্থানে নানা পন্থা নেয়া হয়েছিল। জ্বর হলে তাপমাত্রা মাপা বাধ্যতামূলক ছিল। তাপমাত্রা মাপার জন্য পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক জায়গায় বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। অনেক সময় বলপ্রয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে চীন করোনা সংক্রমণ দমিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই কেউ ঘর থেকে বের হতে পারেনি।
কিছু বিল্ডিং পুরো লকডাউন ছিল। কিছু কমিউনিটি লকডাউন ছিল। কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে যেত। খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ, সব দুয়ারে দুয়ারে পাঠানো হয়েছে। চীন সরকার শুরুতে একটু দেরি করলেও পরে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে করোনাকে প্রায় হারিয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সব সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা প্রত্যেক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা জরুরি। মহামারী সময় উহানে ১৮ হাজার ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা হয়েছিল। সংক্রমিত ব্যক্তিদের ঘরে বসে পৃথককরণের বিকল্প অবশ্যই খুঁজতে হবে। কারণ, এটি পরিবারকে বিপন্ন করে তোলে। চীনে ৭৫-৮০ ভাগ সংক্রমণের ঘটনা পরিবারের মধ্য থেকে ঘটেছে। অনেক সময় সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খোঁজার জন্য কর্মীর ঘাটতি থাকে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নেয়া যায়। যারা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসবেন, তাদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে এবং দিনে দু’বার তাপমাত্রা মাপতে হবে। সংক্রমিত ব্যক্তিদের ঘরে থাকার নিয়মের বদলে শহরগুলোয় এমন সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে মৃদু ও হালকা অসুস্থ ব্যক্তিরা নার্স ও চিকিৎসকদের সাহায্যে দ্রুত সেরে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। কারণ, তাদের হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছিল। সরকার একে ‘গণযুদ্ধ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ‘ফাইট অন উহান, ফাইট অন চায়না’ কর্মসূচি চালু করে।
এ ছাড়া প্রেরণামূলক ছবি, বিজ্ঞাপন তৈরি করে যুদ্ধকালীন প্রচারের মতো প্রচার চালাতে শুরু করে। অনেক মানুষ জ্বর মাপা, সংক্রমিত ব্যক্তির খোঁজ করা, হাসপাতালের নির্মাণকাজ, খাবার সরবরাহের মতো নানা কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই সাধারণ সেবার মতো কাজগুলো চালাতে পারেন। বিশেষজ্ঞ জিমের বলেন, আমার অভিজ্ঞতায়, জনসাধারণকে কতটা অবহিত করা হয়েছে এবং তাদের অংশগ্রহণের ওপর সাফল্য নির্ভরশীল।
মাস্কের ব্যবহার নিয়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিভক্ত মতামত পাওয়া যায়। তবে এশিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী ব্যক্তিরা মাস্ক ব্যবহারের মূল্য বোঝেন। সার্জিক্যাল মাস্কে করোনাভাইরাসে প্রতিরোধ নিয়ে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তবে এশিয়ার দেশগুলোয় মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হয়। চীনের কয়েকটি শহরে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি মাস্ক ব্যবহার করার জন্য পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, অসুস্থদের অবশ্যই রোগ ছড়ানো ঠেকাতে মাস্ক পরতে হবে।
জরুরি পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি ড. ডেভিড এল হিম্যান বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সহকর্মীদের মাধ্যমে গুচ্ছাকারে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়।
ভাইরাসটি এভাবে কেন ঘুরে বেড়ায়, তা কেউ নিশ্চিত নন। তবে বিশেষজ্ঞরা হাল ছেড়ে দিচ্ছেন না। ড. হিম্যান বলেন, আপনাকে পৃথক প্রাদুর্ভাবগুলো শনাক্ত করতে এবং থামাতে হবে। এরপর কঠোরভাবে কে কার সংস্পর্শে এসেছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে এগুলো করতে গেলে স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তাদের বুদ্ধিমান, দ্রুত প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং জনগণের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা লাগবে।
করোনা মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে একাধিক মার্কিন বিশেষজ্ঞ তাদের মতামত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, জনগণকে অবশ্যই বাড়িতে থাকতে হবে। এর পাশাপাশি এমন সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে, যাতে সংক্রমণের শিকার হওয়া ব্যক্তিকে আলাদা রাখা যায় এবং বাড়ির বাইরে থেকে যত্ন নেয়া যায়। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হবে। মাস্ক ও ভেন্টিলেটর উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার সব বাধা দ্রুত দূর করতে হবে। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনে এগোতে পারলে করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের সরে দাঁড়াতে হবে এবং বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কথা অবশ্যই শুনতে হবে। যুদ্ধের সময় যেমন জেনারেলরা প্রতিদিন ব্রিফিং করেন, তেমনি এখন এ মহামারীবিষয়ক জটিল ধারণা ব্যাখ্যা, ওষুধ বা সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার পরামর্শে বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ টিম জিমের বলেন, এ জরুরি মুহূর্তে আমাদের কী করা উচিত ছিল বা কার দোষে, সেগুলো নিয়ে কথা বলা অনর্থক। আমাদের এখন শত্রুর ওপর মনোযোগ দিতে হবে। এ শত্রু এখন করোনাভাইরাস। তারা বলছেন, তাদের কথা শোনার পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে চরম সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করার বিষয়টিতে। যদি কোনো জাদুদণ্ডের সাহায্যে ১৪ দিন পর্যন্ত মানুষকে এক জায়গায় আটকে রাখা যায় এবং ছয় ফুট দূরত্ব তৈরি করা সম্ভব হয়, তবে এ মহামারী অনেকাংশে আটকে দেয়া যাবে।
এতে ভাইরাস সংক্রমণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই সপ্তাহের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ দেখা যায়। যদি যথেষ্ট পরীক্ষা করা যায়, তবে সংক্রমিত সবাইকে আলাদা করে ফেলা যাবে। এতে সমস্যা কেটে যাবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওই জাদুদণ্ড নেই বলে রাতারাতি ব্যাপক পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করার বিকল্প নেই। এ পদক্ষেপের জন্য ভ্রমণ ও মানুষের মধ্যে সংস্পর্শে আশার বিষয়টি অবশ্যই কমাতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শহরের মধ্যে বিপজ্জনক কিছু জায়গা থাকে যেমন রেস্তোরাঁ, জিম, হাসপাতাল বা গণপরিবহন।
এসব স্থানে কারও কাশি থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। মানুষের মধ্যে সংস্পর্শ কমাতে দেরি হয়ে গেলে এ ধরনের হটস্পট বা বিপজ্জনক জায়গা আরও বাড়তে থাকে। এক সপ্তাহের আগ পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা যায় না। যখন কেবল মানুষ অসুস্থ হতে শুরু করে তখন টের পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত ও নিরাপদ উপায়ে পরীক্ষা করতে হবে। গুরুতর অসুস্থদের অবশ্যই প্রথমে যেতে হবে এবং পরীক্ষকদের অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে। চীনে যারা পরীক্ষার জন্য গিয়েছিলেন, তারা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আগে তাদের উপসর্গের বিবরণ দেন।
যদি চিকিৎসক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত দেন, তবে অন্য রোগীদের থেকে দূরে কোনো ক্লিনিকে তার পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসকরা জ্বর মাপার পর প্রশ্ন করেন। এরপর তাদের ফ্লু পরীক্ষা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা পরীক্ষা করা হয়। তাদের ফুসফুস সিটি স্ক্যানে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এরপর কেবল করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য বলা হয়। এর আগে পরীক্ষার জন্য চার ঘণ্টা সময় লাগত।
চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানের চিকিৎসকরা হাসপাতালের ফার্মাসিতে যা কিছু ছিল তা নিয়েই লড়াইয়ে নেমেছেন। তারা অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া ড্রাগ ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং অ্যান্টি-ভাইরাল রেমডিসিভার ব্যবহার করেছিল। তবে এগুলো ব্যবহারের কোনো অনুমতি নেই। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এগুলো কার্যকর কি না, এর কোনো প্রমাণও নেই। চীনে ২০০ ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা হয়েছে।
চিত্রদেশ//এস//