শহীদুল্লাহ হল থেকে বেরিয়ে তাপস উদ্দেশ্যহীনভাবে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হেয়ার রোডে চলে এসেছে। এখন বোধ হয় পাত-ঝরার কাল। কী মাস এটা? আজকের সবকিছুই এত সুন্দও আর এত বিষণ্ন! পুরো ঢাকা শহরে এই রাস্তাটা সবচেয়ে সুন্দর। এখান দিয়ে হাঁটতে গেলে কখনও কখনও ভুল হতে পারে বিদেশের কোনো রাস্তা মনে করে। একথা মনে হতেই একাকী রাস্তায় শব্দ করে হেসে উঠল তাপস। পথটা নির্জন, শুধু একটা পাতাকুড়ানি মেয়ে তার পাতার বস্তা হাতে নিয়ে একটু যেন চমকে উঠে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইল। হাসি থামিয়ে তাপস ভাবল- নাহ্ , এটা পৃথিবীর ধরে যশে ভরা কোনো শহর বলে ভুল করার কোনো কারণ নেই। ওসব শহরে আর যা-ই থাক পাতাকুড়ানি নেই নিশ্চয়ই।
বিদেশ কথাটা ভাবতেই আবারও তাপসের হাসি পেল। এদেশের সব মানুষের ধারণা বিদেশের সব ভালো। এমনকি কুকুরগুলোও। এই রাস্তাটার নাম হেয়ার রোড কেন? এ-প্রশ্নের সহজ উত্তর ছিল কনকের কাছে। কনক হেসে হেসে বলত, এখানে কোনো হেয়ার সাহেবের বাস ছিল বোধ হয়। বেশ লাগছে হেঁটে যেতে। চারদিকে রোদে মাখামাখি। একবারে ঝকঝক করছে। যেমন করত কনকের চোখ। অবশ্য সুমন বলে, ও সবই তোর বিভ্রম। কনকের চোখ কোনো-কালেই ঝকঝকে নয়। বরং ভীষণ ডাল। শেরাটনের সামনে দাঁড়িয়ে তাপসের মনে হলো হাঁটার জন্য রাস্তা ভালো। একটা রিকশা নিলে হয়। এ-রাস্তায় আবার রিকশা চলে না। ভিআইপি রোড। আবারও উলটো দিকে হাঁটলে কেমন হয়? অথবা বাসে চেপে এক্কেবারে মিরপুর চিড়িয়াখানা? সাত-পাচঁ ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হয়ে পিজি হাসপাতালের নিচে এসে দাঁড়াল তাপস।
মনের সব কষ্ট দলা হয়ে আটকে আছে গলার কাছে। শরীর মন একসাথে ছুটে যেতে চাইছে কনকের কাছে। আস্তে আস্তে হেঁটে ওষুধের দোকানের সামনে এস দাঁড়াল তাপস। দোকানদার তাপসকে দেখে একটু অভ্যর্থনার হাসি দিল। একটু কি বিষণ্ন হাসি, তাপস ভাবল। পরক্ষণেই মনে হলো দোকানি কেন বিষণ্ন হবে? ধুর, মনের ভুল।
একটা ফোন করতে পারি?
দোকানি হেসে মাথা ঝাঁকাল, হ্যাঁ। অনেকদিনের চেনা। মাঝের কয়েক মাস বাদ দিয়ে গত তিন-চার বছর মাঝেমধ্যেই ঘুমের ওষুধ কিনেছে এখান থেকে।
মাঝখানের কয়েক মাস বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো চুল শ্যামল একটা চেহারা যেন ঘুমের পরশ বুলিয়ে দিত দুচোখে। সকালে জেগে তাপস কিছুতেই মনে করতে পারত না মেঘের মতো চুলে-ঢাকা আলো-আলো চেহারাটা কার-এক যুগ আগে হারিয়ে-যাওয়া মায়ের, নাকি জীবনের হাতছানি কনকের।
ডায়াল ঘোরানো শেষ হতেই- হ্যালো! ওপার থেকে ফোন তুলেছে কাঁকন- কনকের বড় বোন। ভারি নরম আর শান্ত মেয়ে। হ্যালো হ্যালো করছে কাঁকন। অস্থিরভাবে। ফোনে ভেসে আসছে অনেকজনের কথা বলার আওয়াজ। সাথে সাথে হৃদয়ের গভীরে আঘাত করল সানাইয়ের করুণ আনন্দঘণ সুর। কাঁকন ফোনটা আরেকজনের হাতে দিয়ে দিল। ফোন হাতে নিয়ে একরাশ কাচভাঙ্গার শব্দে হেসে উঠল তরুণী। কী জনাব কিছু তো বলুন! ইাহয় এক লাইন গান অথবা এক পঙক্তি কবিতা । কথা বলতে না চাইলে ফোন করে বিরক্ত করবেন না। যত্তোসব।
ফোন ছেড়ে দিল ওপাশ থেকে। ফোনটা নামিয়ে রাখতেই চোখ পড়ল দোকানির চোখে। তাপস অস্ফুট স্বরে জানাল, পাওয়া গেল না।
শিশুপার্কের ফুটপাতে হাঁটতে হাটঁতে তাপস ভাবতে থাকল, কবে থেকে চিনতাম ওকে! এই জীবনে নাকি তারও আগ থেকে? কত কথা বলার ছিল । কত কথা শোনার ছিল। কত কথা জানাতে চেয়েছিলাম। কত কথা জানাতে চেয়েছিলাম। শ্রাবণের বৃষ্টির মতো মস্তিষ্কের আঘাত করে যাচেছ সেসব কথা যা আর কোনোদিনই বলা হবে না। আর কোনো কনক নেই এ-পৃথিবীর কোথাও যাকে তাপস শোনাতে চায় অনেক কথা।
হলে ফিরে এবারে কয়েন বক্স থেকে আবারও ফোন করল। ফোন তুলেছে কনক। সমস্ত রক্তে তোলপাড় তুলে ভেসে এল সেই একটু কঠিন মিষ্টি গলা। সারা মস্তিষ্কে, সত্তায়, হৃদয়ে রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ল হ্যালো শব্দটি। তাপস মনে-মনে উচ্চারণ করল-ভালো থেকো ভালো থেকো।
ফোন নামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল তাপস। আজকের দিনটা অসাধারণ সুন্দর। বাতাসে মাধবীলতার গন্ধ। আকাশের নীলে আশ্চর্য মাদকতা। চারদিকে যেন আনন্দধ্বনি।
আজ কনকের বিয়ে।
লেখক: