দিল্লি সহিংসতায় নিহত ৩৪, ভয়াবহ আতঙ্কে মুসলিমরা
দিল্লিতে গত তিনদিনের সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪য়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক মানুষ। আর হতাহতদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বলে জানা গেছে। ভারতের বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই এই সহিংসতাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ এই দিল্লির এই ঘটনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত গুজরাট দাঙ্গার মিল খুঁজে পেয়েছেন। অন্যদিকে দিল্লির বর্তমান পরিস্থিতিতে ভয়াবহ আতঙ্কে রয়েছেন সংখ্যালঘু মুসলিমরা।
দিল্লি সংহিসতার সূচনা গত রোববার থেকে, মোদি সরকারের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে আয়োজিত বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের প্রথমদিন সোমবার থেকেই ভয়াবহ রূপ নেয় এই বিক্ষোভ। মোদির সমর্থকেরা জাফরাবাদ-মৌজপুর এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি সহিংস রূপ নেয়। সোমবার ওই সংঘাতের প্রথমদিনে এক পুলিশসহ পাঁচজন নিহত হয়। মঙ্গলবার তা বেড়ে দাঁড়ায় সাতে। এরপরই দিল্লির সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চলে পরিকল্পিত হামলা। সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবারের ওই হামলায় সর্বশেষ খবরে ৩৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানা গেছে। আহত হয়েছে আরও দুই শতাধিক মানুষ। তবে হতাহতের পৃকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা বুধবার রাতেও আহতদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর মিলেছে।
আহতদের মধ্যে কমপক্ষে ৪৬ জনের শরীরে বুলেট পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তারা আহত হয়েছে বন্দুকের গুলিতে। ফলে এটিকে হিন্দু-মুসলিমদের কোনও গতানুগতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসাবে দেখা যাচ্ছে না। এতে প্রশাসন আরও ভালো করে বলতে গেলে পুলিশের মদদ লক্ষ্য করা গেছে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, হাসপাতালগুলোতে এমন অনেক আহতের খোঁজ পাওয়া গেছে যাদের চোখে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার জানায়, অ্যাসিড হামলায় দৃষ্টি হারিয়েছেন কমপক্ষে চারজন। খুরশিদ নামে এক জনের দু’চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওই ব্যক্তি তেগ বাহাদুর হাসপাতাল থেকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত পাননি। রিকশায় এসেছেন। দুই চোখ-সহ পুরো মুখ ঝলসে গিয়েছে ওয়কিলের। ফলে এটা স্পষ্ট, পরিকল্পিত এই দাঙ্গায় আগুন লাগানো, পাথরবাজি, গুলির সঙ্গে চালানো হয়েছে অ্যাসিড হামলাও। এমনকি পুলিশকেও নাকি অ্যাসিড হামলার মুখে পড়তে হয়েছিল।
গত কয়েকদিনের ভয়াবহ সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিমরা। তাদের বহু ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হিংসার আগুনে। বাদ যায়নি তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদগুলোও। এক মসজিদে আগুন লাগিয়ে তার মিনারে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করেছে চরমপন্থি হিন্দুরা। সেই ছবি আর ভিডিও ফুটেজ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে এখনও। ভয়ে বহু মুসলিম ঘর-বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেছে। ফলে দিল্লি জাফরাবাদ ও মৌজপুরে এলাকার মুসলিম বসতিগুলোতে এখন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ফাঁকা রাস্তা জুড়ে পাথর, ইট, ভাঙা কাচ, ভাঙা লোহার রড। ভিতরের গলি থেকে আজও পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। মৌজপুরের গলির একটি দোকানে আগুন নেভেনি। বলাবাহুল্য এই দোকানের মালিকও একজন মুসলিম।
এ নিয়ে আনন্দবাজারের বক্তব্য, ‘দোকানের মালিক কোন ধর্মের, তা দেখেই আগুন লাগানো হয়েছে। এ পাড়ায় ধর্মের জোরে যাদের দোকান বেঁচে গিয়েছে, অন্য গলিতে সেই ধর্মের জেরেই দোকান পুড়েছে।’
জাফরাবাদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দার বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, ‘ভিতরের মহল্লায় অশান্তি চলছে। কোথায় কতজনের মরদেহ পড়ে রয়েছে, কেউ জানে না। পুলিশ এখনও ঢুকতে পারেনি ভিতরে।’ অর্থাৎ পুলিশ এখনও সে চেষ্টা করেনি বা তাদের সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
আনন্দবাজার জানায়, খাজুরি খাসের গামরি এক্সটেনশনে মুহম্মদ সাইদ সালমানি মঙ্গলবার দুধ কিনতে বেরিয়েছিলেন। এসময় তার বাড়িটি ঘিরে ফেলে দাঙ্গাকারী হিন্দুরা। খবর পেয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যান সালমানি। কিন্তু পাড়ার লোকেরা নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে বাড়ির দিকে যেতে দেননি। ফলে আগুনে পুড়ে মারা যান ৮৫ বছরের মা আকবরি। একই সঙ্গে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন দর্জির দোকানটি ।
তেগবাহাদুর ও লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, হতাহতদের বেশির ভাগই গরিব বা মধ্যবিত্ত। ২৮ বছরের মুবারক হুসেন দ্বারভাঙা থেকে বাবরপুরে এসে শ্রমিকের কাজ করতেন। বিজয় পার্কে তার বুকে গুলি লাগে। মুদাস্সির খান, শাহিদ খান আলভি অটো চালাতেন। ভজনপুরার মারুফ আলিকে কপালে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা হয়েছে।
সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার তিন দিন পর এদিকে বুধবার দিল্লি দাঙ্গ কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শনে যান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। এসময় এক মুসলিম ছাত্রী তাকে বলেন, পুলিশ হামলা বন্ধের কোন্রও চেষ্টা করেনি। বরং দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বিষয়টি উপভোগ করেছে। ওই ছাত্রীর কথার কোনও উত্তর ছিল না দোভালের কাছে। তবে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
অমিত শাহ কি তবে ব্যর্থ?
দিল্লির ঘটনায় কড়া নিন্দার মুখে পড়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মোদির প্রধান সহযোগী বলে পরিচিত অমিত শাহ। অমিত শাহের ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। তিনি তার পদত্যাগেরও দাবি জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধেও তোপ দাগেন কংগ্রেস সভানেত্রী। রোববার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পরেও কোনও পদক্ষেপ না নেয়ায় তিনি অমিত ও কেজরিওয়ালের নিন্দা করেন।
এদিকে দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অজিত দোভালকে দায়িত্ব দেয়ার ঘটনা নিয়ে অনেকে ভ্রু কুঁচকেছেন। কেননা দিল্লি পুলিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীন। আর দিল্লিতে শান্তি ফেরানোর চেষ্টায় নেমেছেন অজিত।
বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধি বঢ়রাও, দলীয় নেতাদের বিদ্বেষমূলক মন্তব্যে নীরব থাকার অভিযোগ তুলে তাকে ‘লজ্জাজনক’আখ্যা দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র। ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতার’কারণেই সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণী সুপাস্টার রজনীকান্ত।
এতদিন কোথায় ছিলেন মোদি?
দিল্লিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে গত রোববার থেকে। কিন্তু বুধবার প্রথমবারের মতো সেখানে ‘শান্তির বার্তা’ ছড়ালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটারে তিনি বলেন, ‘শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই বিষয়। আমি আমার দিল্লির ভাই ও বোনদের, সবসময় শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। যত দ্রুত সম্ভব শান্তি ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানো জরুরি।’
এ নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এই তিন দিন কোথায় ছিলেন মোদি? তিনি কি তবে ট্রাম্পের ভারত সফর নিয়ে এখনও এতটাই রোমাঞ্চিত যে দেশের রাজধানীর পরিস্থিতি নিয়েও ভাবার সময় পাননি!
দিল্লিতে সহিংস হামলা নিয়ে শান্তির বাণী ছড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। বিধানসভায় ভাষণে, তিনি বলেন, ‘এখন দিল্লিতে দুটি বিকল্প রয়েছে, মানুষকে এক হয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, নাহলে তারা একে অন্যকে আক্রমণ এবং মারবে। মৃতদের স্তুপের ওপরে আধুনিক দিল্লি তৈরি সম্ভব নয়। ঘৃণা, সংঘর্ষ, ঘরবাড়ি জ্বালানোর রাজনীতি বরদাস্ত করা যাবে না।’
এরই মধ্যে অজিত দোভালের মতো কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দিল্লির অবস্থা সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ ও পরিস্থিতি আমাদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে বলেও দাবি করেছেন।
আসলেই দিল্লির মুসলিম মহল্লাগুলোতে এখন কবরের শান্তি বিরাজ করছে। কেননা গত কয়েকদিনের হামলায় তারাই তো বেশি হতাহত হয়েছে। এখনও অনেকের দগ্ধ লাশ পুড়ে যাওয়া বাড়ির মধ্যেই পরে আছে। কেউ আছেন হাসপাতালে। আর জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন বাকি। সংখ্যালঘুদের বাড়ি ছাড়ার প্রবণতা এখনও থামেনি। এর একটি হৃদয়গ্রাহী চিত্র তুলে ধরেছে আনন্দবাজার।
‘কিন্তু ‘শান্ত’ মানে শান্তি নয়। নিরপত্তাও নয়। বুধবার দুপুরে দেখা গেল, মুস্তাফাবাদে একমাত্র মেয়ের হাত ধরে প্রাণভয়ে মহল্লা ছাড়ছেন এক মহিলা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই তার মুখে। পিছনে ফেজ টুপি, কুর্তা-পাজামায় স্বামী। মাথায়-পিঠে ব্যাগ, লেপ-কম্বল। বাড়ি-দোকান পুড়েছে। পথে নেমেছেন নিরাপদ কোনও আশ্রয়ের খোঁজে।’
সূত্র: আনন্দবাজার, এনডিটিভি, বিবিসি বাংলা
চিত্রদেশ //এফ//