‘ঘুষ ইজ অ্যা গুড ফুড’!: শান্তনু চৌধুরী
কৌতুকটি বেশ পুরনো এবং সম্ভবত অনেকের জানা। তবুও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে আবারও উল্লেখ করছি। ইংরেজ শাসনের সময় এক বাঙালি সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই সময় ইংরেজদের পক্ষ থেকে একজনকে পাঠানো হয় বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। তিনি এসে দেখেন, ঘুষ হিসেবে বিভিন্ন শাক-সবজি, ফলমূল দেওয়া হয়েছে। ইংরেজ জেন্টেলম্যান ভাবলেন, এগুলো তো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এসব খাওয়া অপরাধ হতে যাবে কেন! বিচারের রায় হলো, ‘ঘুষ ইজ অ্যা গুড ফুড’! সেই ইংরেজও নেই, তেমন ঘুষও নেই। তবে ঘুষ যে ‘গুড ফুড’, সেটা মনে হয় আক্ষরিক অর্থেই রয়ে গেছে। আবার এটাও ঠিক, ইংরেজ আমল যে ঘুষ বা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, তা বলা যাবে না। সম্প্রতি পড়ছিলাম আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত অরিন্দম দাশগুপ্তের অনুবাদে ‘আর্দালি পাঁচকড়ি খানের ঝাঁকিদর্শন’। (মূল বই তৎকালীন বেনারস শহরের ইউরেশীয় ডেপুটি কালেক্টর জর্জ ওয়েট) সেখানে পাঁচকড়ির বয়ানে ক্রমশ উন্মোচিত হয় বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতি, পুলিশ কীভাবে কোনও যথাযথ কারণ না দেখিয়েই লোকজনকে আটক করতো, আদালতে কীভাবে নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা হতো, ন্যায়পরায়ণ কর্মচারীরা দুর্নীতির এই মহলে কীভাবে নির্যাতিত, অপদস্থ হতো, কেমন করে আইনের মারপ্যাঁচের সুযোগ নিয়ে হাকিমরা নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাত ইত্যাদি। সেই অনেক বছরের আগের গল্প হলেও গল্পের ধরন হয়তো বদলেছে, কিন্তু বিষয় একই রয়ে গেছে। যেহেতু আমরা এখনও ঘুষ খাই এবং ঘুষ খাওয়ার এই সূচকে চলতি বছর আমরা বেশ এগিয়েছি। মানে ঘুষ লেনদেন আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ট্রেসের এক প্রতিবেদন বলছে, ঘুষ লেনদেনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ২০০টি দেশের ২০১৯ সালের চিত্র নিয়ে সম্প্রতি এই জরিপ করা হয়। এর মধ্যে ঘুষ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আগ্রহ, নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা এবং সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। এই সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৮৬। এর অর্থ হলো, একটি কাজের জন্য যেকোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করতে হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি এবং নিয়ন্ত্রণমূলক বাধাও অনেক বেশি। যথারীতি বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সরকারের অনেক মন্ত্রী এই প্রতিবেদনের বিপক্ষে বলেছেন। কিন্তু গেলো কয়েক মাসের ঘুষ বিষয়ক সংবাদ বাস্তবতায় এটা স্পষ্ট, যতই বেতন বাড়ুক বা যতই সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, সরকারের বিভিন্ন দফতরে দুর্নীতি বা ঘুষ লেনদেন কোনও অংশেই কমেনি।
পুলিশের বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরখাস্তকৃত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের চল্লিশ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি তো এখনও সেরা আলোচিত ঘুষ সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে। এর মধ্যে ঝালকাঠির নলছিটির এক বাসিন্দার কাছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সেরেস্তা সহকারী রেখা রানী দাশের ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সাব-রেজিস্ট্রার ও তার কার্যালয়ের কিছু কর্মচারীর ঘুষ গ্রহণের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে কয়েকজন অসাধু ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীকে দলিল গ্রহীতাদের কাছ থেকে সরাসরি ঘুষ নিতে দেখা গেছে। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুর রহমান আজাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৪ জন দফতরি কাম প্রহরী মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আরও আলোচিত ছিল ধর্ষণের মামলার খরচার কথা বলে ভিকটিমের বাবার কাছে ৫ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহের সুবর্ণাসারা ক্যাম্পের আইসি (ক্যাম্প ইনচার্জ) এসআই সৈয়দ আলীর বিরুদ্ধে। তিনি নাকি খরচা হিসেবে সেই টাকা চেয়েছেন। এগুলো সাম্প্রতিক উদাহরণ। এমন ঘটনার শেষ নেই। অনেক সময় প্রকাশও হয় না। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপ বলছে, ঘুষ ছাড়া সেবা পান না দেশের ৮৯ ভাগ মানুষ। আর দুর্নীতির শিকার ৭৫ ভাগ মানুষ কোথাও কোনও অভিযোগই করেন না। যে ২৫ ভাগ অভিযোগ করেন, তারাও মনে করেন, এর কোনও প্রতিকার নেই। তাহলে যেটা বলছিলাম—মানুষ আসলে বুঝে গেছে হয়তো প্রতিবাদ করে বা প্রতিকার চেয়ে কোনও লাভ নেই। এটা সাধারণ মানুষের কথা। যেমনটি তারা মনে করেন, ‘পুলিশ ঠিক থাকলে পুরো দেশ একদিনে সোজা হয়ে যাবে।’ কিন্তু ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই, তাও নয়। দুদক হয়তো ট্রেসের প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর সেই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছে। ঘুষের টাকাসহ বা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অনেককেই দুদক হাতেনাতে গ্রেফতারও করেছে। মাঝে মাঝে এমনও সংবাদ আসে কোনও ইউএনও বা ভূমি অফিসার নিজের দফতরে বোর্ড টাঙিয়ে লিখে দেন, ‘এখানে কোনও ঘুষ লেনদেন হয় না, কেউ ঘুষ চাইলে এই বোর্ডে লিখে জানান।’ তার মানে বিষয়টা কতটা নাজুক। আমরা হয়তো এই উদ্যোগকে বাহবা দিচ্ছি। কিন্তু ভাবছি, সাধারণ মানুষের আস্থা কতটা তলানিতে ঠেকলে এমন উদ্যোগ নিতে হয়।
২০১৭ সালে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে নুরুল ইসলাম নাহিদের একটা বক্তব্য ভাইরাল হয়। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা ঘুষ খান, কিন্তু সহনীয় মাত্রায় খান।’ পরে অবশ্য তিনি বলেছেন, এই বক্তব্য তার নয়। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) কর্মকর্তাদের কথা তিনি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে একথা তো ঠিক, ঘুষ বা দুর্নীতি কমানোর জন্যই সরকার তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাড়িয়েছে, নানারকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করার পাশাপাশি অনেক ‘রাঘববোয়াল’ ধরা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা এমন হয়েছে এখন—‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’-এর মতো। সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই কাজে বেশ অবহেলা করেন, অফিসে থাকেন না, অফিসে থাকলেও সিটে বসেন না, সিটে ব্যাগ বা কোট রেখে বাইরে ব্যক্তিগত কাজ করেন, দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রেখে মানুষকে হয়রানি করেন এবং টাকা ছাড়া সেই ফাইল ছাড়েন না। সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথাই বলতে চান না। একইসঙ্গে নিজেদের কাজের কোনও জবাবদিহিতা নেই। এমনও আছে, সরকারি অফিসের সহকারীরা কর্মকর্তাদের চেয়ে কোনও অদৃশ্যবলে বেশি ক্ষমতা রাখে এবং কর্মকর্তারা তাদের সমঝে চলেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা সংস্থা, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, পুলিশ স্টেশন, আদালত পাড়া থেকে শুরু করে সবখানেই অনেকটা রাখঢাক না রেখে প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণ চলে। ভূমিমন্ত্রী ঘুষ, দুর্নীতি রোধের চেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু এ-খাতের লোকজন এতটাই সংঘবদ্ধ যে, পেরে উঠছেন বলে মনে হচ্ছে না। টিআইবি রিপোর্ট বলছে, ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে সেবা পেতে ৫০০ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘুষ বিষয়ক বক্তব্যটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘যে ঘুষ নেবে তার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিতে হবেই, আর যে দেবে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ দু’জনই অপরাধী। এই বিষয়টা মাথায় রেখে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’ প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবস্থাটি নেওয়া যে সহজ নয়, সেটা সবাই জানেন। কারণ বিপদে পড়েই বা কোনও একটি কাজের প্রয়োজনেই মানুষ সরকারি বা সহযোগিতাকারী দফতরগুলোতে যান। সে সময় তারা যে কতটা অসহায় থাকেন, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রায় বলা হয়, সরকারি কমকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। আরও নানা সুযোগ-সুবিধা তো রয়েছেই। তাহলে প্রশ্ন আসে এরপরও কেন দুর্নীতি, ঘুষ লেনদেন। কেন সরকারি অফিসে অফিসে সিন্ডিকেট, কেন টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। একথা সত্য, আগে যেমন মানুষের সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ ছিল না, এখন হয়েছে উল্টো। তার কারণ বেতনভাতা। যেটা একসময় ছিল অনেকটাই অকল্পনীয়। প্রতিটি গ্রেডে পে-কমিশনের সুপারিশ প্রায় পুরোটাই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতনভাতা পাচ্ছে, তা দিয়ে তাদের সংসার খরচ চালাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এরপরও দুর্নীতি বাড়ার, ঘুষ লেনদেন বাড়ার কারণ হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা (সবার কথা বলছি না) শুধুমাত্র বেতনভাতা বাড়িয়েই তাদের লোভ সীমাবদ্ধ রাখেনি। তাদের ‘আরও চাই আরও চাই’ স্বভাবের কারণে বাড়ছে ঘুষ দুর্নীতি। কারণ দুর্নীতির শেকড় আরও গভীরে। সেই শেকড় সহজেই উপড়ানো সম্ভব নয়। তাই মুখের কথা নয়, ঘুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযান চালাতে হবে, বিচারের রায় জনগণের সামনে এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে অন্যরা শিক্ষা পায়। একইসঙ্গে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা যাতে না হয়। মুখের মধু কথায় দুর্নীতি বন্ধ হবে না, এটা জানা কথা। কারণ যেটা স্বভাবজাত দুর্নীতি, সেটা স্বভাব না বদলালে বদল করা সম্ভব নয়। সহজ পথে বড়লোক হওয়ার চিন্তায় যে কেউ হয়ে ওঠে বড় দুর্নীতিবাজ। এছাড়া পরশ্রীকাতরতা বা অন্যেরটা দেখে নিজেরও লোভ জাগে। দুর্নীতি কমাতে হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে সুশাসনটা জরুরি। কারণ অনেকেই বলে থাকেন টাকার ভাগ নাকি ‘ওপরমহল’ পর্যন্ত যায়। এই ওপরমহল ঠিক না হলে যতই সুযোগ-সুবিধা দিক, সেটা কাজে আসবে না। দুর্নীতি করে কেউ যাতে পার না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তবে ‘চোরে ধর্মের কাহিনী না শুনলে’ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবেগঘন বক্তব্যটি ঘুষগ্রহণকারীদের জানা দরকার। ‘চাওয়া-পাওয়ার সীমা আছে। সম্পদের সীমা আছে। মানুষ আসলে অন্ধ হয়ে যায় অর্থের জন্য। কিন্তু এটা ভুলে যায়, মরে গেলে কিছুই সঙ্গে নেওয়া যাবে না, কবরে একাই যেতে হবে। যা রেখে যাবে, সেটা আর কোনোদিন তার কাজে লাগবে না। আর যদি বেশি রেখে যায়, তবে ছেলেমেয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। ওই নিয়ে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যাবে। সম্পদের পেছনে অন্ধের মতো ছুটে বেড়ানো আর নিজের সবকিছু নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।’
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক