গল্প-কবিতা

গল্প- ‘ঝরা ফুল’

কানিজ কাদীর

২৪ এপ্রিল, ২০১৩, বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারে রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়েছে। শত শত লোক ভবনটির নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। শত শত লোককে জীবিতও উদ্ধার করা হয়েছে। কেউ কেউ মারাত্মক জখম নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের কাউকে আনা হয়েছে এনাম মেডিকেলে, কাউকে ঢাকা মেডিকেলে, কাউকে পঙ্গু হাসপাতালে ইত্যাদি নানা হাসপাতালে। বুধবার হাসপাতালে যেয়ে এরকম একটা খবর শুনে উদগ্রীব হয়ে উঠলাম-আসলে কি ঘটেছে। দুপুরে বাসায় এসে টেলিভিশন খুলে দেখতে পেলাম ভয়াবহ চিত্র। নানা শ্রেণী, নানা পেশার উদ্ধাকর্মীরা উদ্ধার কাজে লেগে পড়েছে। ভয়াবহ চিত্রের বর্ণনা আসছিল মিডিয়ার বিভিন্ন চ্যানেলে। একেবারে আতঁকে উঠছিলাম। শিউরে উঠছিলাম এই নিষ্ঠুর কঠিন হৃদয়বিদারক চিত্র দেখে। ডাক্তার সাহেব দুপুরে বললেন,‘যাই পঙ্গু হাসপাতালে, দেখি কয়টা সাভারের রোগী ভর্তি হয়েছে। তুমি যাবা নাকি?’ এটা তো একটা জাতীয় দুর্যোগ। এ সময় আমাদের এই রোগীগুলোর কাছে যাওয়া উচিত। যদিও আমার ইউনিটে আজকে এডমিশন না।’

আমি বললাম-‘আমি যাব তোমার সাথে, দেখে আসি এদের কী অবস্থা’।
বিকেলে দুজনই পঙ্গু হাসপাতালে গেলাম। শুনলাম এ পর্যন্ত ৯টা রোগী এসেছে। সম্ভবত বেশির ভাগ রোগীই এনাম হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। আমরা একসিডেন্টের রোগীগুলো দেখতে লাগলাম। কারো হাত ভাঙা, কারো পা, কারো বা কোমড়ের হাড়ই ভেঙে গেছে। কেউবা একেবারে অজ্ঞান। রক্ত দেয়া হয়েছে। ডাক্তার সাহেব একে একে সব রোগী দেখছিলেন। আর নানা উপদেশ দিচ্ছিল। আমি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিছানার রোগীদের কাছে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ৭/৮ বছরের ছেলে একটা বিছানায় শুয়ে আছে। ওর একটা পা হাটুঁ পর্যন্ত কাটা ও অন্য পা-এর উরুতে প্লাস্টার করা। আমি ছেেেল্িটর কাছে গেলাম। বড় বড় চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। মিষ্টি মায়াবী ভাবলেশহীন চেহারা। আমি বললাম, ‘তুমি কি সাভারের রোগী?’ ও বলল, ‘না আমি ট্রেনের তলে পইরা গেছিলাম।’ আমার ওকে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। অবাকও হচ্ছিলাম। এইটুকু ছেলে একাকী কেমন করে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিভাবে এরকম হলো তোমার।’ ও বলল ‘ট্রেনের কামড়ায় দৌড়াঁ দৌঁড়ি লাফালাফি করতে যাইয়া পইড়া গেছি।’ আমি বললাম তোমার সাথে কে আছে। ও বলল , ‘কেউ নেই। আমার বাড়ির কেউ তো জানেই না। আইজ একমাস যাবৎ এইখানে আছি।’ আমি বিস্মিত হলাম। বললাম, ‘তোমার নাম কি? বাড়ি কই?’ ও বলল‘ আমার বাড়ি নরসিংদী, আমার নাম মোহাম্মদ শুভ।’ তোমার এক্সিডেন্ট কোথায় হয়েছে।’ শুভ বলল, ‘টঙ্গী।’ আমি বললাম ‘তোমার বাড়ি নরসিংদী আর এক্সিডেন্ট করলা টঙ্গী।’ ‘হ’ আমি বাড়িত থেইক্যা না কইয়াই বাইর হইছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে টঙ্গী আইছিলাম’। তোমারে কে এখানে নিয়ে আসছে। শুভ বলল,‘ আমি তো অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম। কারা জানি আইন্যা এইখানে ভর্তি করছে’।

ওকে দেখলাম কেমন যেন ভাবলেশহীনভাবে মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘তোমার তো এক পা কাটা। এখন তুমি কি করবা।’ শুভ বলল, ‘কি আর করমু, ভিক্ষা কইরা খাওয়ান লাগব।’ আমি বললাম, ‘ তুমি লেখাপড়া করো, ভিক্ষা করবা কেন। আর তোমার তো দুইটা হাতও আছে। তুমি পায়ে কৃত্রিম পা লাগায়ে নিবা, তখন তুমি হাটঁতেও পারবা। ’ শুভ দেখলাম বেশ খুশি হয়ে গেল। সে আমাকে প্রশ্ন করল-কৃত্রিম পা লাগাইলে আমি আবার হাটতে পারমু? দেঁŷড়াইতে পারমু? ’ আমি বললাম, হ্যাঁ তুমি দেঁŷড়াতে না পারলেও ভালোই হাটতে পারবা। তাছাড়া লম্বা প্যান্ট পড়লে তোমার কৃত্রিম পা বোঝাও যাবে না।’ খুশি হয়ে বলল,‘হ, আমার তো দুইটা হাত আছে, শান্তর তো দুইটা হাতও নাই। ওর দুইটা হাত তো ওর সৎ বাপে রাগ কইরা কাইট্যা ফালাইছে।’ ও তো এই হাসপাতালেই ভর্তি।’ তারপর শান্ত চিপস খাবার বায়না করে ওর সৎ বাবাকে গালি দিলে রেগে গিয়ে জঙ্গলে নিয়ে কিভাবে ওর দুটি হাত কেটে দিয়েছে সে গল্পটি সে বলল আমার কাছে। বেশ গুছিয়ে বলল। আমাকেও ধৈর্য ধরে শুনতে হলো। ঘটনাটি সত্যি। টিভিতে দেখিয়েছে।

আমি বললাম, ‘তুই ভালো হলে তোর বাড়িতে যাবি তো। বাড়ির ঠিকানা মনে আছে ? তোর বাপের কোনো ফোন নম্বর নাই? শুভ বলল,‘ বাড়িতে যাইতে পারমু। আমার বাপের ফোন নম্বরও মুখস্ত আছিল। মাথায় বাড়ি খাইয়া ভুইল্যা গেছি। আমি বললাম ‘তোর বাড়ির তো কেউ জানে না তোর এই অবস্থা । তারা তোরে পাইলে যে কী করবে।’
শুভ বলল,‘বাড়িতে গেলে আমারে দেইখ্যা সবাই খুব কষ্ট পাইব আমার একটা বইন আছে। হে তো বেশি মন খারাপ করব। মা মনে হয় খুব কানতাছে।’

আমি শুভকে সান্তনা দিয়ে ওর কাছ থেকে চলে এসে ডাক্তার সাহেবের সাথে পোস্ট অপারেটিভ রুমে গেলাম। ওখানে একটা সাভারের কোমরের হাড় ভাঙা নিয়ে খুব খারাপ রোগী ছিল। রোগীটাকে দেখছিলাম, এমন সময় দেখলাম দুটো তরুণ-তরুণী হাতে পাউরুটি, ফল, পানি নিয়ে সাভারের রোগীদের খুজঁছে। পোস্ট অপারেটিভ থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরে আসব ভাবলাম। চলে আসার আগে ভাবলাম শুভ ছেলেটার সাথে একটু কথা বলে যাই। ওর বিছানার কাছে আবার গেলাম। দেখি শুভ খুব মজা করে আপেল কামড়ে খাচ্ছে। পাশে পড়ে আছে পানির বোতল , পাউরুটি। শরীরে কোনো কাপড় নেই। আমি বললাম ‘ তুই, এই খাবার কই পাইলি।’ বলল,‘ একটা ছেলে আর মেয়ে দিয়া গেছে। আমারে জিগাইছে তুমি কি সাভারের রোগী। আমি কইছি, ‘হ।’ কি মজা! আপেল পাইলাম, পাউরুটি পাইলাম, পানি পাইলাম।’ তোরে তো এখান থেকেই খাবার দেয়।’ শুভ বলল,‘ হাসপাতালের ভাত-তরকারী মজা লাগে না।’ ওকে খালি গায় দেখে জিজ্ঞেস করলাম-‘ তুই খালি গায় কেন? সে উত্তর দিল, ‘জামা একটা আছে, ছিঁড়া গেছে। এখন শইলে একটু বাতাস খাওয়াইতাসি।’ আমি ওকে বললাম, ‘যা তোকে আমার ছেলের একটা গেঞ্জি দিব।’ আমি ওর কাছ থেকে চলে আসছিলাম। শুভ আমাকে পিছন থেকে ডেকে বলল-‘জামার লগে দু’গা ভাতও নিয়া আইসেন।’

কথাটি শুনে আমার খুব কষ্ট লাগল। গাড়িতে বাসায় আসতে আসতে ডাক্তার সাহেবকে শুভর কথা বললাম। ওর জন্য এরই মধ্যে একদিন ভাত-তরকারি নিয়ে যাব ভাবলাম। দুদিন পর ছুটির দিন (শুক্রবার) বিকেলে ভাত, মুরগির মাংস ও ভাজি , ডাল টিফিন বক্সে নিলাম। সাথে পানির বোতল ও পলিথিন নিলাম। ছেলের একটা পুরনো গেঞ্জি নিলাম। ছেলে বাসায় ছিল না তাই একটা গেঞ্জিই খুজেঁ পেলাম নেবার মতো সেটাই নিলাম। হাসপাতালে গেলাম বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে। শুভর বিছানার দিকে যাচ্ছিলিাম! দেখলাম ওর বয়সী আরেকটা ছেলে ওর বিছানার পাশে দাড়িঁয়ে ওর সাথে গল্প করছে। আমি শুভর কাছে যাবার সাথে সাথেই ও ছেলেটিকে উচ্ছসিত ভাবে বলে উঠল, ‘দেখছস, আমি কইছিনা আমার জন্য ভাত লইয়া আইব।’ আমি বললাম, ‘এই ছেলে কে রে।’ ও বলল-‘ এইখানে ফুটফরমাইস করে।’ আমি টিফিন বক্সগুলো ওকে দিলাম আর বললাম, ‘নে ভিতরে পলিথিন আছে, খাবারগুলো পলিথিনে ঢেলে আমাকে টিফিন বক্সগুলো দিয়ে দে।’ ও হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার তো একটা থালি আছে।’ আরো বলল,‘ তুমি আমার জামা আনছো।’ ও আমাকে তুমি করে সম্বোধন করল যেন আমি ওর কত আপন। আমি গেঞ্জিটা তো একটু বড় হইল। না হয়, বড়ই ভালো।’ আমি বললাম, ‘যা তোকে পরে একটা শার্ট কিনে দেব।’ ওকে বললাম ‘তুই তো এখন ভালো হয়ে যাবি। ছুটি দিলে কই যাবি।’ শুভ বলল ‘এক্কেবারে পরথমে আমি আমার বাড়িতে যামু।’ ওর কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে ওকে একশত টাকা দিলাম। ওখুশিতে ওর কাছে থাকা আরো কিছু টাকা বের করে আমাকে দেখাল- আর বলল ‘এই দ্যাখো আমার কত টাকা হইছে। আমারে অনেকেই টাকা দিছে। আমারে সবাই আদর করে।’

বাসায় এলাম। শুভর গল্প সবার কাছে করলাম। ভাবলাম আর একদিন ওকে একটা শার্ট কিনে দিয়ে আসব। ২-৩ দিন পর ডাক্তার সাহেবকে বললাম, ‘ ওই ছেলেটা কি এখনো ভর্তি আছে? উনি বললেন,‘না, ওরে আর দেখতাছি না, মনে হয় ছুটি হয়ে গেছে। ’ আমার শুনে বেশ খারাপ লাগল। একটা আফসোসও থেকে গেল ‘ওকে একটা নতুন শার্ট কিনে দিতে পারলাম না।’

লেখক:

Related Articles

Back to top button