আন্তর্জাতিকপ্রধান সংবাদ

করোনায় ৬ মাস চেতনাহীন, অতঃপর অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
করোনায় ফুসফুস গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় ছয় মাস চেতনাহীন অবস্থায় হাসপাতালে কৃত্রিম ফুসফুসের সহায়তায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত ভারতীয় এক নাগরিক। আমিরাতের একটি হাসপাতাল থেকে প্রায় ছয় মাস পর ছাড়া পেয়েছেন ৩৮ বছর বয়সী ওই ভারতীয়।

আমিরাতের একটি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে টেকনিশিয়ান হিসাবে কর্মরত ছিলেন অরুণ কুমার এম নাইর নামের ওই প্রবাসী। মহামারিতে একেবারে সম্মুখসারিতে থেকে রোগীদের সেবা দিয়েছেন তিনি। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তার ফুসফুসের বেশিরভাগ অংশ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে হাসপাতালে কৃত্রিম ফুসফুসের (ইসিএমও মেশিনের) সহায়তায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়েছেন প্রায় অর্ধ-বছর।

এই সময়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সহ্য করেছেন তিনি। এছাড়াও ট্র্যাকিওস্টমি এবং ব্রঙ্কোস্কোপি করানোসহ বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি।

করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তার লড়াকু মনোবল আর আমিরাতি জনগণের সেবার প্রতি সম্মান জানিয়ে দেশটির বহুমুখী স্বাস্থ্যসেবা গোষ্ঠী ভিপিএইচ হেলথকেয়ার তাকে ৫০ লাখ রুপি আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

অরুণ কুমারের এই অলৌকিক বেঁচে ফেরা উদযাপনে বৃহস্পতিবার আবু ধাবির বুরজিল হাসপাতালে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে আমিরাতি সহকর্মীরা ওই আর্থিক সহায়তা তার হাতে তুলে দিয়েছেন বলে হাসপাতালের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ভিপিএইচ হেলথকেয়ার গোষ্ঠী অরুণ কুমারের স্ত্রীকে হাসপাতালে চাকরি এবং তার সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছে।

ভারতের মালাবার উপকূলীয় প্রদেশ কেরালার বাসিন্দা অরুণ কুমারকে এক মাস আগে হাসপাতালের সাধারণ কক্ষে স্থানান্তর করা হয়। তার আগে পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা অরুণ কুমার।

তিনি বলেন, ‌‘আমার কিছুই মনে নেই। তবে আমি জানি যে, সবেমাত্র মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছি। আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং আরও শত শত মানুষের প্রার্থনার শক্তিতে আজ আমি বেঁচে আছি।’

আমিরাতের কোভিড-১৯ টাস্ক ফোর্সের অংশ হিসাবে গত বছরের জুলাইয়ের মাঝের দিকে আবু ধাবির এলএলএইচ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সময় করোনায় আক্রান্ত হন অরুণ। তিনি ২০১৩ সাল থেকে ওই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে টেকনিশিয়ান হিসাবে কর্মরত।

করোনা শনাক্ত হওয়ার পর তাকে সরকারি কোয়ারেন্টাইন স্থাপনায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু কয়েক দিন পর তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। নিশ্বাস নেওয়াই তার জন্য ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়।

কোয়ারেন্টাইন স্থাপনা থেকে অরুণকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, তার ফুসফুস গুরুতরভাবে সংক্রমিত হয়েছে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পরবর্তীতে চিকিৎসকরা তাকে ইসিএমও (কৃত্রিম ফুসফুস) সাপোর্ট দেন। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ১১৮ দিন পর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সেই মেশিন খুলে ফেলা হয় তার।

শুরুতে শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ দেখা যায় এবং চিকিৎসায় ভালোভাবে সাড়া দেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে আবারও তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এক পর্যায়ে তা গুরুতর আকার ধারণ করে।

অসুস্থ থাকাকালীন ভারতে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছে নিজের অসুস্থতার কথা জানাননি তিনি। মহামারিতে হাসপাতাল থেকে বিশেষ দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা আসায় তিনি টেলিফোন করতে পারবেন না বলে পরিবারকে জানিয়েছিলেন।

অরুণের স্ত্রী জেনি জর্জও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী। তিনি বলেন, অরুণ কোভিড-১৯ টাস্ক ফোর্সের অংশ হিসাবে কাজ করায় আমরা কোনও ভুল সন্দেহ করিনি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফোন পাওয়ার পর আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি।

পরে ভিসার ব্যবস্থা করে আবু ধাবিতে স্বামীর কাছে যান জেনি। তিনি বলেন, এই খবরটি অরুণের বাবা-মা এবং আমার কাছে বড় ধাক্কা হিসাবে এসেছিল। আমরা একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম এবং তার সুস্বাস্থ্য ও দ্রুত আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। গত আগস্টে আমিরাত থেকে কেরালায় নিজ বাড়িতে আসার কথা ছিল অরুণের।

শুরু থেকে অরুণের চিকিৎসা করেছেন বুরজিল হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. তারিক আলী মোহাম্মদ আল হাসান। তিনি বলেন, অরুণের অবস্থা একেবারে প্রথম দিন থেকে আশঙ্কাজনক ছিল।

ডা. তারিক বলেন, তার ফুসফুস বিকল হয়ে গিয়েছিল এবং কোনোভাবেই তা উন্নতি হচ্ছিল না। কেবলমাত্র ইসিএমও মেশিনের সাহায্যে তিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন। এবং এটি প্রায় ১১৮ দিন ধরে চলতে থাকে। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীর সুস্থ হয়ে ফেরা প্রায় অসম্ভব। এই কারণেই অরুণের বেঁচে ফেরাটা আমাদের সবার কাছে ‘এক অলৌকিক ঘটনা।’

বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য শিগগিরই স্ত্রীসহ ভারতে ফিরবেন অরুণ কুমার। আমিরাতে এখনও তার ফিজিওথেরাপি চলছে। আগামী মাসে আবারও কাজে ফিরতে পারবেন বলে নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন অরুণ।

সূত্র: পিটিআই।

চিত্রদেশ//এফটি//

Related Articles

Back to top button