বিনোদন

করোনায় বাবাকে হারিয়ে ছেলের অক্সিজেন জেনারেটর আবিষ্কার

পাবনা প্রতিনিধি:
চারদিকে অক্সিজেন এর অভাব নেই, শুধু বুক ভরে টেনে নিলেই হয়। কিন্তু বাতাসে থাকা সেই অক্সিজেনটুকু করোনা আক্রান্ত বাবা বুক ভরে নিতে পারছিলেন না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বাবাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি। সেই কষ্ট থেকে নিজেই বাতাস থেকে অক্সিজেন তৈরির জেনারেটর উদ্ভাবন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহের মাহমুদ তারিফ। তার আবিষ্কৃত এই অক্সিজেন জেনারেটর প্ল্যান্ট আশা জাগিয়েছে পাবনাসহ পুরো দেশবাসীকে।

তারিফের মা, তসলিমা খাতুন তারিফের এই উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে ছলছল চোখে বলেন, তারিফের সাফল্যে আমার বুকটা ভরে গেছে। যেটা বলে বোঝাতে পারব না। তার বাবার স্বপ্নপূরণে কাজ করে যাচ্ছে আমার ছেলে। অক্সিজেনের অভাবে তার বাবাকে মারা যেতে দেখেছে সে।

ঈশ্বরদী শহরের কলেজ রোডে মশুড়িয়া পাড়া বকুলের মোড় এলাকার নিজ বাড়িতে বর্তমানে মা-ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করা তারিফ জানায়, গত বছরের ২ আগস্ট তার বাবা হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অক্সিজেনের অভাবে মানুষের শ্বাস নেওয়ার চেষ্টার যে যন্ত্রণা, তা সে সামনে থেকে দেখেছে। সেখান থেকেই অক্সিজেন জেনারেটর ও কনসেন্ট্রেটর উদ্ভাবন করার জন্য উঠে পড়ে লাগে সে।

ঈশ্বরদী সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহের মাহমুদ তারিফ তার উদ্ভাবন সম্পর্কে বলেন, উদ্ভাবিত প্ল্যান্টে প্রথমে বাতাসকে একটি সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়। পরে বাতাস থেকে অন্যান্য উপাদান পৃথক করে বেছে নেওয়া হয় শুধু অক্সিজেনকে। ডায়নামো দিয়ে প্রথমে একটি সিলিন্ডারে বাতাস প্রবেশ করানো হয়। আর এ বাতাসে অক্সিজেন ছাড়াও অন্যান্য উপাদান থাকায় সেগুলো বের করার জন্য জিওলাইট ব্যবহার করা হয়। জিওলাইটের মাধ্যম বাতাস থেকে অক্সিজেন এক দিক দিয়ে এবং অন্যান্য উপাদানগুলো আরেক দিক দিয়ে বের করা হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়।

কিশোর এ উদ্ভাবক জানায়, সাধারণত প্রতি মিনিটে ১০ থেকে ১৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করে এমন অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের দাম ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি প্রতি মিনিটে ২৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। এটি স্থানীয় উপকরণে তৈরি করলে খরচ পড়বে প্রায় ৬৫ হাজার টাকার মতো। সম্পূর্ণ স্থানীয় প্রযুক্তিতে এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে ২৪ দিনের মতো। তবে সঠিক কারিগরি সহায়তা পেলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায়ও এটি তৈরি করা সম্ভব।

ইতোমধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ইনোভেশন টিমের বিশেষজ্ঞ টিম তারিফের উদ্ভাবন মেশিনটি দেখেছে। তারা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সেগুলো নিয়ে কাজও চলছে। এদিকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিজের প্ল্যান্ট থেকে পরীক্ষামূলক অক্সিজেন তৈরি করে ইতোমধ্যেই দেখিয়েছে তারিফ। তার এ প্ল্যান্টে প্রতি মিনিটে ২৫ লিটার অক্সিজেন উৎপাদন করা যাবে বলে দাবি করে তারিফ। ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হলে কোভিড আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন সরবরাহের সংকট অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ ঈশ্বরদীবাসী আশায় বুক বেঁধেছে এ আবিষ্কার ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে করোনা রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখবে।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. সালেহ মুহাম্মদ আলী বলেন, যেহেতু একজন শিক্ষার্থী এটা তৈরি করেছে, তাই এর কিছু টেকনিক্যাল ত্রুটি রয়েছে। তবে এটা পরিচর্যা করলে উদ্যোগটি চমকপ্রদ হতে পারে। উদ্ভাবনটা চমৎকার, খুবই প্রশংসনীয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে অনেকেই এ জাতীয় উদ্ভাবনী যন্ত্র জমা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু তারিফের প্রকল্পই অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

তার উদ্ভাবিত অক্সিজেন জেনারেটর ও কনসেন্ট্রেটর বাতাসের ২১ শতাংশ অক্সিজেনকে প্রক্রিয়াজাত করে ৯৮ শতাংশে রূপান্তর করে। এ যন্ত্র একটানা ৭ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। ১০ মিনিটের বিরতিতে আবার টানা ৭ ঘণ্টা চলবে।

তারিফ তার নিজের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে এর নামকরণ করেছে ‘টিএলআর-সিভি ১৯’। অক্সিজেন লেভেল ৯০ থেকে ৯১-তে নেমে আসা কয়েকজনকে তার প্ল্যান্টের অক্সিজেন দিয়ে লেভেল ৯৮ থেকে ৯৯-তে ওঠানো সম্ভব হয়েছে। তার এ উদ্ভাবন ল্যাব টেস্টেও সফলতা আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারিফ।

ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, একদিন তারিফ তার শিক্ষকসহ এসে বিষয়টি জানালে আমি একটি প্ল্যান বাজেট দিতে বলি। প্রায় ৭০ ভাগ কাজ সম্পাদন করার পর আর্থিকভাবে সহযোগিতা করি। বর্তমানে এটির সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তারিফের মা তসলিমা খাতুন বলেন, একদিন তারিফ আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা চায়। আমি বলি টাকা দিয়ে কী করবা? সে বলে, আমি একটা যন্ত্র আবিষ্কার করব। যেটা দিয়ে বাতাসের সাহায্যে অক্সিজেন উৎপাদন করা যায়। অনেক প্রচেষ্টার পর সে এটি তৈরি করেছে। আমার ছেলে দেশের সুনাম বয়ে আনবে। পরিবার ও পাবনাবাসীর মুখ উজ্জ্বল করবে বলে আমি আশা রাখি।

সাঁড়া মারোয়ারী মডেল সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আয়নুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকেই তারিফের মধ্যে প্রতিভা লক্ষ্য করতাম। আজ তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম। তারিফের সাফল্যে শুধু স্কুল বা উপজেলা প্রশাসনই নয়, গোটা পাবনাবাসী আজ গর্বিত। বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে তাকে সার্বিক সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছি।

চিত্রদেশ//এফটি//

Related Articles

Back to top button