যে কোন ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া, ইত্যাদি দিয়ে যেকোন মানুষই যেকোন বয়সে যেমন শারিরীক ভাবে রোগাক্রান্ত হতে পারে, ব্যহত হতে পারে সেই মানুষটির দৈনন্দিন কার্যকলাপ, ঠিক তেমনিভাবে যে কোন বয়সে যে কোন মানুষেরই বিভিন্ন কারনে তার মনের বিকাশ হঠাৎ করে থেমে যেতে পারে অথবা মনোরোগ/ মানসিক রোগ তৈরী হতে পারে এই রোগের কারনে তৈরী হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা সামাজিক পর্যায়ে বৈকল্য ,ব্যহত হতে পারে সেই মানুষটির দৈনন্দিন কার্যকলাপ আমাদের সমাজে আমরা শারিরীক অসুস্থতাকে খুব সাদরে গ্রহন করতে পারি হোক তা ডায়াবেটিক, ডেঙ্গুজ্বর, যৌনরোগ অথবা ক্যান্সারের মত মরন ব্যাধি কিন্তু যদি কোন মানুষের মনোরোগ/মানিসক রোগ দেখা দেয় তখন আমাদের সমাজের, সামাজিক প্রতিবন্দকতার কারনে শারিরীক রোগের মত মনোরোগকে সাদরে গ্রহন করতে পারিনা ।
আজ যদি আমরা বর্তমান বিশ্বে একটু দৃষ্টিপাত করি এবং গভীর ভাবে অনুধাবনকরি তাহলে বুঝতে পারব যে, ”শিশুদের বিকাশ জনিত সমস্যা” আজকের পৃথিবীরএকঅনিবার্য বাস্তবতা। অটিষ্টিক অথবা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিস্অর্ডা র, শিশুরা তাদের মধ্যে অন্যতম।
আসছে ২রা এপ্রিল “অটিজম সচেতনতা দিবস”। জাতিসংঘ সহ বিশ্বের অনেক দেশই এই দিনটিকে অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশেও এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। সরকারী পর্যায়ে বাংলাদেশে কার্যকলাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। কারন আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত হোক সে অটিস্টিক অথবা বিশেষ শিশু (স্পেশিয়াল চাইল্ড) ॥
প্রকৃতির এক অপার সৃষ্টি মানুষ। বিপুল বিস্ময় রয়েছে মানুষের দেহে। প্রকৃতির সহজাত নিয়মেই মানুষ বেড়ে ওঠে মাতৃগর্ভে। অতি ক্ষুদ্র ভ্রুন হতে ধীরে ধীরে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পরিপূর্ণ ও পরিপক্ক হয়ে তৈরী হয় মানব দেহ। আপাতদৃষ্টিতে নয় মাসের গর্ভধারনের সময়টি খুব ছোট হলেও এই সময়টিতে ঘটতে থাকে বিস্ময়কর পরিবর্তন । একটি সুস্থ মানব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য গর্ভকালীন মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন মস্তিষ্কের অংশ, যার প্রারম্ভিক বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভে, অর্থাৎ শুক্রানু ও ডিম্বানু নিষেকের পর, ভ্রুণ অবস্থায় মাতৃগর্ভে আসার প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যে মস্তিস্ক তথা স্নায়ুতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়ার সাথে সাথে/ একটি সুস্থ মানব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য গর্ভকালীন মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। । জন্মের পর প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মন সক্রিয় হয়ে উঠে। শারীরিক বৃদ্ধির সাথে সাথে বিকশিত হতে শুরু করে মন-ও। একটি শিশু তার চারপাশের মানুষ সমন্ধে ধারণা লাভ করে। বস্তু সম্পর্কে শেখে, নতুন কৌশল আয়ত্তে এনে চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে ভাষার মাধ্যমে বাচনিক এবং অবাচনিক উপায়ে যোগাযোগ স্থাপিত করে অনেক তথ্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করে যা তার চিন্তা চেতনা আবেগ, অনুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার মাধ্যমে কোন কিছু সনাক্ত করতে, জানতে এবং বুঝতে পাওে এবং মস্তিষ্কের শব্দ ভান্ডারের ধারণার প্রায়োগিক কাঠামোতে জমা হতে থাকে।। তাই কেবল জন্মগতভাবে প্রাপ্ত “জিন” ই নয়, শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম আর তা নিশ্চিত করতে পারে তার চারপাশের সুস্থ ঐশ^র্য্যময় ভাষা সমৃদ্ধ পরিবেশ। । যদি কোন শিশুর শারীরিক, স্নায়ুগত ও মানসিক/মনোরোগের সমস্যা না হয়ে থাকে তবে এই ধারাবাহিকতাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া হয় এবং একটি শিশু ৫ বছরের মধ্যেই মাতৃভাষার প্রয়োজনীয় সব নিয়ম কানুন আয়ত্ত করে ফেলে। কখনও কখনও স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে।
পৃথিবীর সবকিছু সবসময় আপন নিয়মে চলে না। আজ যদি আমরা বর্তমান বিশ্বে একটু দৃষ্টিপাত করি এবং গভীর ভাবে অনুধাবনকরি তাহলে বুঝতে পারব যে, ”শিশুদের মনের বিকাশ জনিত সমস্যা” আজকের পৃথিবীরএকঅনিবার্য বাস্তবতা। অটিষ্টিক অথবা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিস্অর্ডারশিশুরা তাদের মধ্যে অন্যতম।
অটিজম হচ্ছে মস্তিষ্ক / মনের বিকাশের একটি অসম্পূর্ণ অবস্থা এ সমস্যায় একটি শিশু পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উদ্দিপনা ,ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক আবেগ ভাষার মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করতে অর্থাৎ মৌলিক আবেগ আকাঙ্খা অথবা মনোগত অবস্থাকে যেমন- চিন্তা, অভিপ্রায়, কামনা, অভিলাষ, স্বপ্ন, কল্পনা এবং ছলনা ইত্যাদি অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে না,এবং অন্যের মনেও যে এগুলির অস্তিত্ব আছে তা বুঝতে পারে না । যার দরুন অটিষ্টিক শিশুদের যোগাযোগ এবং সামাজিকতা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অর্থবোধক হয় না /
ভাষা বিকাশের এবং প্রকাশের অসম্পূর্ণতা কারনে, অটিষ্টিক শিশুরা :-
১)সরাসরি বক্তার দিকে মুখ তুলে চোখে চোখে তাকায় না ।
২) ভাষা অনুধাবনের ক্ষেত্রে এবং মানসিক ত্ত আবেগগত বহিঃপ্রকাশে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় কারন ভাষার প্রত্যেকটি শব্দই কোন না কোন বক্তব্যকে ধারন করে যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে নানা অর্থগত ব্যঞ্জনা। মূলত শব্দ উচ্চরনের দ্বারাই যে কোন শিশু তার কাঙ্খিত মনের বক্তব্যকে অন্যের কাছে তুলে ধরে এবং অন্যের কাছ থেকে ব্যক্ত কোন শব্দ হতে অর্থ খুজে বের করে। সামাজিকতার জন্য যোগাযোগ কর্মটি সাধিত করে। অটিষ্টিক অথবা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিস্অর্ডার শিশুর মধ্যে ভাষিক বক্তব্য বলতে এবং বুঝতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় ॥
৩) সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ ভাষার যৌথ মনোযোগের মাধ্যমে যোগাযোগ করে অন্যের মনোগত অবস্থাকে যেমন বুঝতে পারে না তেমনিভাবে নিজের মনোগত অবস্থাকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে না অথবা বিলম্ব ঘটে।
৪)শিশুর আয়ত্তকৃত শব্দের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশেষ করে, ‘যাই’, ‘করি’, ‘খাই’ ইত্যাদি পরিচিত ক্রিয়াপদ ব্যতীত বৈচিত্র্যময় ক্রিয়াপদের সংখ্যা নেই বললেই চলে এবং কিছু স্বরের পুনঃপুন অনুকরন করে ॥
৫)সমবয়সীদের সাথে অন্তরঙ্গ হতে সমস্যা।প্রতীকি খেলা এবং অর্থবহ খেলা খেলতে অসামর্থ্য।
৬)শিশুরা বয়স বারার সাথে সাথে শব্দাবলী ও বিভিন্ন ভাষিক উপাদান আয়ত্ত করে তখন এসব ভাষাগত উপাদানের সাহায্যে সে পরিবার সমবয়সী শিক্ষক ও সমাজের অন্যান্য সবার সঙ্গে যোগাযোগের যোগ্যতা অর্জন করে । যোগাযোগের এই যোগ্যতার সারকথা হচ্ছে বিভিন্ন সমাজিক প্রতিবেশে ভাষা বিচিত্র ভাষিক উপাদানের সঠিক ও কৌশলগত ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করা। মানুষ সামাজিক প্রয়োজনে ভাষা ব্যবহার করতে শিখলেও কিছু কিছু সামাজিক ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের জন্য যোগাযোগের যোগ্যতার আবশ্যকতা রয়েছে। বিশেষ করে প্রশ্ন করতে শেখা, কাউকে অনুরোধ বা আদেশ করা কিছু প্রত্যাখান করা, অসম্মতি প্রকাশ, ক্ষমা চাওয়া, প্রশংসা করা, নমনীয়তার গুন অর্জন করা ইত্যাদি আরো অনেক সামাজিক দক্ষতা যা যোগাযোগে তাৎপর্য পূর্ন ভ’মিকা পালন করে। নির্দিষ্ট পরিবেশ বা প্রতিবেশ অনুযায়ী ভাষা ব্যবহারের এই দক্ষতাকে প্রায়োগিক দক্ষতা নামেও অভিহিত করা হয়। অটিষ্টিক অথবা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিস্অর্ডার শিশুদের মধ্যে প্রায়োগিক দক্ষতার তাৎপর্যপূর্ণভাবে সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় ॥
৭) অটিষ্টিক অথবা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিস্অর্ডার শিশুর ভাষার যৌথ মনোযোগের মাধ্যমে যোগাযোগ করে অনের মনোগত অবস্থাকে যেমন বুঝতে পারে না তেমনিভাবে নিজের মনোগত অবস্থাকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে না অথবা বিলম্ব ঘটে। এর ফলে অটিষ্টিক শিশুদের মধ্যে কিছু অকার্যকর বা অনুপোযোগী আচরণ যেমন- বার বার একই আচরণের পুনরাবৃত্তি, আত্মঘাতমূলক, আগ্রাসনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক আচরণ পরিলক্ষিত হয়।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ভাষাবিকাশ ও প্রকাশে লক্ষনীয় সীমাবদ্ধতার কারনে আচরণগত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। যা তার দৈনন্দিন জীবন প্রবাহে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এই ধরনের সমস্যা একটি শিশুর নির্বাহী নিয়ন্ত্রনের সক্ষমতা থেকে শুরু করে তার সামাজিক দক্ষতা ও বুদ্ধিদীপ্ততার সার্বিক বিচ্যুতি বা বিকার পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর তার মাত্রাভেদ হয়ে থাকে ভিন্ন ভিন্ন। যা নির্ভর করে একটি শিশুর ভাষা আয়ত্ত্বকরনের উপাত্তগুলো, অর্থাৎ-ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ও অর্থ তার উপর। কারন এই উপাত্তগুলো নিয়ে একটি শিশুর জন্মগ্রহন করলেই হবে না উপাত্তগুলোকে বিশ্বব্যাকরনের ধারনা কার্যে উপযোগী করতে হবে আর তা করতে হলে একটি শিশুকে পারিপার্শ্বিক উপাত্ত হতে “ইনপুট” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপাত্তগুলোকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক ভাবসত্তা ও বস্তুসত্তা চিনে তা তার নিজের প্রজ্ঞান কাঠামোতে ধারন করতে হবে আর এই সহজাত কার্যটি একটি অটিস্টিক শিশুর মধ্যে অবর্তমান থাকে।কোন শিশুর চিকিৎসা শুরুর পূর্বে প্রয়োজন রোগ নির্নয়। অর্থাৎ শিশুটি অটিস্টিক কিনা তা নির্নয় করতে হবে এবং স্পীচ ল্যাংগুয়েজ থেরাপী নেওয়ার উপযোগী কিনা অর্থাৎ হাইপার একটিভিটি আছে কিনা সেটাও নির্নয় করতে হবে। আর তা নির্নয় করবেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজনে ঔষধ ও প্রদান করবেন।একজন চিকিৎসা ভাষাবিদ্, একটি শিশুর মধ্যে ভাষার উপাত্তগুলোর মধ্যে কোনটি কতটুকু আক্রান্ত হয়েছে তা খুজে বের করেন এবং সেই অনুযায়ী তার চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন, যাকে বলা হয় “স্পীচ ল্যাংগুয়েজ থেরাপী”। যত তাড়াতাড়ি একটি শিশুর এই উপাত্তগুলোকে খুজে বের করে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে তত তাড়াতাড়ি একটি শিশুর আচরনগত অবস্থার উন্নতি হবে। কারন বয়স বাড়ার সাথে এই উপাত্তগুলোর কার্যক্ষমতা প্রজ্ঞাকাঠামোতে ধারনের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
আমাদের উদ্দেশ্য একটি অটিস্টিক শিশুকে “অর্থবহ জীবন” প্রদান করা। যাতে সে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা না হয়ে যায়।
লেখক পরিচিতি:
(চিকিৎসা ভাষাবিদ এবং মনরোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ)
জেড,এইচ, সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।