গল্প-কবিতা

১৬ ডিসেম্বর

কানিজ কাদীর

আজ ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনেক ছোট ছিলাম। কিছু স্মৃতি খুব মনে আছে। যেদিন দেশে বিজয় হলো নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর সে দিনটার কথা আমার বেশ ভালোই মনে আছে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, আমরা তখন ময়মনসিংহে। সকালেই আমরা শুনতে পেলাম রাস্তায় আনন্দ উল্লাস। শুনতে পেলাম পাকবাহিনী আত্নসমর্পণ করেছে। আমাদের ময়মনসিংহের বাসায় যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।আশেপাশের বাসায়ও সবাই খুব আনন্দে মেতে উঠল। সবাই যেন পরম সুখ ও স্বস্তিতে মেতে উঠল। আব্বা বাসার সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন। শুনলাম মুক্তিবাহিনীরা চিহ্নিত কিছু রাজাকারদের ধরে পেটাচ্ছে। ভাই, মা-বোন স্বজন হারানোর কষ্টের বেদনাকে হারিয়ে দিল বিজয়ের আনন্দ। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল দেশের গান, বিজয়ের গান। সে যে কী পরম তৃপ্তি তা যারা বিজয় দেখেছে তারাই উপলদ্ধি করতে পারে।সমস্ত ভয়, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে উঠতে পেরে আমরা যেন বিজয়ের গর্বে শিহরণ অনুভব করছিলাম। আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ছোট্ট দেশ। যার নাম বাংলাদেশ।
আজ বিজয় দিবসের ৪০ বছর পার হয়েছে। অনেক পাওয়া না- পাওয়ার বেদনায় আমরা সিক্ত। তবু আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস এলে আমরা আবেগে-আপ্লুত হই।নানা স্মৃতি, নানা কষ্ট ঘুরপাক খায় মনের ভিতর। সে আবেগ উছলে পড়ে নানাভাবে। যখন টেলিভশনে নানা অনুষ্ঠান দেখি তখন আরো আবেগে-আপ্লুত হয়ে পড়ি।

ভোরে উঠেই মনে হলো আজ বিজয় দিবস। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে।লেপ থেকে উঠতেই ইচ্ছা করছিল না। ভোরে উঠে ফযরের নামাজ পড়ে আবার বিছানায় শুয়েছি। বিছানায় শুয়েই টেলিভিশন ছাড়লাম।নানা রকমের অনুষ্ঠান হচ্ছে।

একটু পরে যেয়ে ছেলেকে ডাকলাম।উঠ, আজ বিজয় দিবস। দেখ টেলিভিশনে কত রকমের অনুষ্ঠান হচ্ছে। ছেলের কোনো আগ্রহ দেখলাম না। একটু পরে ছেলে উঠল। আমি ছেলেকে খুব সিরিয়াস হয়েই অনুষ্ঠানগুলো দেখতে বললাম। ছেলের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখলাম না। আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম আমরা নতুন প্রজন্মকে অনেক কিছুই জানাতে চাই, কিন্তু পরিবেশ আমাদের তা দিচ্ছে না বা ওরা এগুলো আমলে নিতে চাচ্ছে না। আমি ছেলেকে যতই বলছি, ‘দেখ কি সুন্দর সুন্দর দেশের গান হচ্ছে,মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হচ্ছে,এগুলো দেখ ভালো লাগবে।’ ও দেখলাম ঘুরে ফিরে সেই কার্টুন ও নানা বিদেশী চ্যানেল দেখাতেই আগ্রহ দেখাচ্ছে। আসলে আমরা নতুন প্রজন্মকে ভালো কিছু শেখাতে পারছি না। পরিবারে একজন ভালো কিছু সাপোর্ট করলে বা শেখাতে চাইলে অন্যজন বাধা দিচ্ছে। সমাজের চারদিক তাকালে দেখতে শুধু বড়লোক , ফ্যাশনিস্ট হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ।চারদিক বিরাজ করছে রাজনৈতিক দুষ্টচক্র। হচ্ছে ক্ষমতার হাত বদল । বদল হচ্ছে না দৃষ্টিভঙ্গি।‌চারদিকে শুধু চিৎকার, গালিগালাজ, ভন্ডামি দেখতে দেখতে স্বাধীনতার আসল স্বাদের আস্বাদন ওদের মধ্যে ঢুকাতে পারছি না।
আমরা শেখাতে চাইব মূল্যবোধ,শালীনতা, ভালো ব্যবহার। আর চারপাশের পরিবেশ ওদের কী শেখাবে!
টেলিভিশনে ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবি দুটো হচ্ছিল ।ছেলেকে ছবিগুলো সম্বন্ধে একটু একটু করে বলছিলাম। তারপরও কোনো ভ্রূক্ষেপ করল না। ছবিগুলো দেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার মধ্যে তৈরি হলো না।আমার কথায় দু-একবার চোখ বুলিয়ে সে অন্য দিকে চলে গেল। আমি ভাবলাম ওরা এসব আর ভালোবাসবে না। ওরা ভালোবাসবে ইন্টারনেট,ফেসবুক,কম্পিউটার গেমস,ইংরেজী চ্যানেল আরো কত কী! এগুলো দেখে ওরা অনেক কিছু শিখেছে। শিখেছে বিদেশী গানের আর্টিস্টদের নাম,সুন্দর করে ইংরেজীতে কথা বলা, আরো অনেক কিছু। আমরাও যেটা জানি না। যে শিল্প-সংস্কৃতি আমাদের টানে, ওদের তা একদম ভালো লাগে না।যে সুরে,কথায় আমরা আবেগ-আপ্লুত হয়ে যাই তা ওদের মন গলায় না। আমার ভিতরটা গুমড়ে-মুচড়ে যায়, কেন পারছি না ওদের সেই ইতিহাস জানাতে ,কেন পারছি না সেই সুরে আন্দোলিত করতে। একি আমার অপারগতা না দেশ ও সমাজের অপরাগতা? ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিতে দেখাচ্ছিল স্বাধীনতার পর কিছু পথভ্রষ্ট মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছিল।তাদেরকে মানুষ হওয়ার উপদেশ দিচ্ছিল এক কলেজ প্রফেসর। অবশেষে ওরা ঠিকই সঠিক পথে ফিরে আসে। আমরা কি পারব না শেখাতে আমাদের সন্তান, নতুন প্রজন্মকে সুন্দরকে ভালোবাসতে, উদ্বুদ্ধ করতে , জীবনকে জানতে ,ন্যায় ও নীতি,আদর্শ জীবনের জয়গান গাইতে।’
ছেলেকে আবারো ‘আবার তোরা মানুষ হ’ দেখতে বললাম। ও দেখলাম আমার লেপের নিচে পা ঢুকিয়ে আমার পাশে বসল। আমার কাছে জানতে চাইল ছবিটির অনেক কিছু । আমার ভালো লাগল। ছেলে ছবিটার বাকি অংশটা পুরোপুরিই দেখল। আমি ওকে দেখাতে পারলাম । ও অনেক শিল্পী সম্বন্ধে জানতে চাইল যাদের অনেকেই এখন আর নেই অথবা কেউ বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছে।
ইটিভি বাংলা টেলিভিশনে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ গানটি হচ্ছিল । শিল্পী আপেল মাহমুদ। ছেলেকে বললাম ‘তুমি কি গানটি শুনেছ? শিল্পীর নামটা কি তুমি জানো? ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ গানটি শুনেছি,কিন্তু শিল্পীর নাম ভুলে গেছি।’ আমি ওকে শিল্পীর নাম বলে দিলাম। আরো বললাম, আপেল মাহমুদের গাওয়া এই গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের কেমন উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ গানটি সবার মনেই জাগাত এক শিহরণ। সে কী আন্দোলন! গানটি যেন এক জীবন্ত দলিল।উপস্থাপিকা আপেল মাহমুদকে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কিছু বলতে বলছিল। আপেল মাহমুদ বললেন ‘আমরা যেন আমাদের প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারি।’

স্মৃতিচারণ মূলক লেখা, ১৬ ডিসেম্বর ২০১১, ‘টুকরো কথা’

লেখক: কানিজ কাদীর

Related Articles

Back to top button