খােজঁ-খবরসারাদেশ

হাওরের ধান দ্রুত ঘরে তুলতে হারভেস্টারের বিকল্প নেই

স্টাফ রিপোর্টার:

‘কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে, অর্থ-শ্রম-সময় বাঁচবে’ এটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি স্লোগান। কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও ব্যয় সাশ্রয় করতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নত যন্ত্রপাতির কোনো বিকল্প নেই। বোরো মৌসুমে ধানকাটার ক্ষেত্রে চরম শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস ও সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করা। হাওর অঞ্চলে ইতোমধ্যে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটে আশার আলো হতে পারে কম্বাইন হারভেস্টার। হারভেস্টারের মাধ্যমে সাড়ে তিন হেক্টর জমির ধান একই সাথে কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দি করতে দেড়শ শ্রমিক ও প্রায় ৫০ হাজার টাকা সাশ্রয় করতে পারে।

বাংলাদেশে অনেকগুলো কোম্পানি কৃষি যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রপাতি বিপণন ও সরবরাহ করছে। এর মধ্যে এসিআই, দি মেটাল (প্রা.) লিমিটেড, আরএফএল, আলীম ইন্ডাট্রিজ লিমিটেড, নবতি ইন্ডাট্রিজ (প্রা.) লিমিটেড, হক করপোরেশন, নিউ বর্ষা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ডিএমআরআই, চিটাগাং বিল্ডার্স, জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি কোম্পানি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাজারে যেসব কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি করছে তার মধ্যে রয়েছে- পাওয়ার টিলার, পাওয়ার রাইচ রিপার, কম্বাইন হারভেস্টার, মাড়াইকল, আলু উত্তোলন যন্ত্র, ভুট্টা মাড়াইকল, ওয়াটার পাম্প, ট্রাক্টর, ট্রান্সপ্লানার, বিভিন্ন সাইজের ট্রলি, পাওয়ার জুট রিবনার, সৌরশক্তিচালিত আলোক ফাঁদ, সিডার, বেড প্লান্টার, প্যাডেল থ্রেসার, পাওয়ার স্পেয়ার, গাছে স্প্রে করার জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন স্প্রে মেশিন, আর্দ্রতা মাপক যন্ত্র, ধান শুকানোর যন্ত্র ছাড়াও আরও অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি।

সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু হারভেস্টার ও যন্ত্রপাতি হাওর অঞ্চলে প্রদান করেছে। কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান জানান, হাওর অঞ্চলে (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টর ও ১৩৭টি রিপার সরবরাহের বরাদ্দ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বর্তমানে হাওরাঞ্চলে ৩৬২টি কম্বাইন হারভেস্টর ও এক হাজার ৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এছাড়াও পুরোনো ২২০টি কম্বাইন হারভেস্টর ও ৪৮৭টি রিপার দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, হাওরের বোরো ধান কাটার জন্য আমরা জরুরি ভিত্তিতে এসব যন্ত্রপাতি বরাদ্দ করেছি। এর ফলে এ অঞ্চলের ধান কাটায় আর কোনো সমস্যা হবে না।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, ইয়ানমার কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে এক হেক্টর জমির ধান কাটতে ১৮ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। কিন্তু এই পরিমাণ ধান কাটতে প্রথাগতভাবে ৬১ জন শ্রমিক লাগবে। একদিনে ইয়ানমার হারভেস্টার প্রায় সাড়ে তিন হেক্টর জমির ধান সর্বোচ্চ ৬৩ জন শ্রমিক দিয়েই কাটানো সম্ভব। কিন্তু সেই পরিমাণ জমির ধান কাটতে প্রথাগতভাবে ন্যূনতম ২১৩ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। পরিস্থিতি অনুসারে আরও বেশি প্রয়োজন হতে পারে। ফলে কম্বাইন হারভেস্টারে ১৫০ জন শ্রমিকের সাশ্রয় করবে। আবার হারভেস্টারের মাধ্যমে এখন কাদামাটি ও পড়ে ধাকা ধানও কাটা সম্ভব।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষিযন্ত্র বিপণনকারী এসিআই মটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, হাওর এলাকা ছাড়াও কৃষকদের মাঝে জাপানি প্রযুক্তির ইয়ানমার কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহ করছি। যন্ত্রটি শ্রমিক ও খরচের সর্বোচ্চ সাশ্রয় করছে বলে কৃষকরা জানিয়েছে। বর্তমান শ্রমিক সংকটে হারভেস্টার হতে পারে অন্যতম ভরসার জায়গা। ইয়ানমার কম্বাইন হারভেস্টারে একজন কৃষক এক ঘণ্টায় এক একর জমির ধান একই সাথে কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দি অনায়াসেই করতে পারে। একদিনে হারভেস্টার দিয়ে ১০ একর পর্যন্ত কাটতে খরচ হবে মাত্র ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রথাগতভাবে সেটি করতে খরচ হবে প্রায় ৭৫ থেকে ৯০ হাজার টাকা। ফলে কম্বাইন হারভেস্টারে ১০ একর জমির ধান কাটার মাধ্যমে সাশ্রয় হবে দেড়শোর বেশি শ্রমিক বা প্রায় প্রায় ৫৫ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি। অন্যান্য জেলা বা উপজেলা থেকে আসতে পারছে না শ্রমিক। অল্প সংখ্যক শ্রমিক মাঠে কাজ করছে। ধান কাটার সময় তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য যেসব যন্ত্র বরাদ্দ দিয়েছে তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে। ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলা করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

কম্বাইন হারভেস্টার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিবিদ শেখ মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও ব্যয় সাশ্রয় করতে হলে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। দিন যতই যাচ্ছে শ্রমিক সংকট তত বাড়ছে। এছাড়া শ্রমিকের যে মজুরি তাতে যান্ত্রিকীকরণ না হলে ওই কৃষক কৃষিকাজ করে লাভবান হতে পারবে না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৃষকদের মাঝে ধানকাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার রিপারসহ কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি বাবদ ইতঃপূর্বে একশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আজ (১৯ এপিল) আরও একশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলো। কৃষিকে সমৃদ্ধ করার জন্যই সরকার এ খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে নাজিম উদ্দিন বলেন, বর্তমানে দেশে জাপান ও চীনসহ বিভিন্ন দেশের ধানকাটার মেশিন বা কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রি হচ্ছে। সেবাদানকারীরা এসব মেশিন কিনে ন্যূনতম অর্থে কৃষকের ধান কেটে দিয়ে লাভবান হচ্ছে। বর্তমানের শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় ২০ হাজার কম্বাইন হারভেস্টার দরকার। প্রতি ব্লকে একটি করে প্রায় ১৫ হাজার কম্বাইন হাভেস্টার বর্তমানের চাহিদা মেটাতে পারে।

 

চিত্রদেশ//জিএ//

Related Articles

Back to top button