মুক্তমত

বাংলাদেশের নতুন বিশ্ব রেকর্ড: রুমিন ফারহানা

কাউকে ভূতে পায়, কাউকে ভাবে পায়, কাউকে পায় বাহাত্তরে। বাংলাদেশকে পেয়েছে ‘রেকর্ডে’। কথায় কথায় বাংলাদেশ আজকাল রেকর্ড করে। উন্নয়নের রেকর্ড, দুর্নীতির রেকর্ড, গুম-খুন-ধর্ষণের রেকর্ড–এসব রেকর্ডের ডামাডোলে কিছুদিন আগেই খবর এসেছে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঘুষের ঝুঁকিতে থাকার রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ (আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ‘ট্রেস’ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে)। এরকম রেকর্ডের রেশে ভাসতে ভাসতেই জানতে পারলাম পেঁয়াজের মূল্যে বিশ্ব রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ১১ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে বেড়েছে ৫৪৬ শতাংশ। দারুণ না?

পেঁয়াজ এখন জাতে উঠেছে। যে পেঁয়াজ ছিল রান্নার চুলায়, বড়জোর সালাদের টেবিলে, সেই পেঁয়াজ এখন উঠলো কার্গো বিমানে। পেঁয়াজ নিয়ে সংসদে কথা হয়েছে, পত্রিকায় লেখা হচ্ছে, এমনকি বুদ্ধিজীবীদের কলামে পর্যন্ত পেঁয়াজ। ফেসবুকের কথা তো বাদই দিলাম। সেখানে কত কিছুই তো ঘোরে। ব্যঙ্গ হোক, বিদ্রূপ হোক কিংবা কেবলই মজা, পেঁয়াজ এখন বিয়েবাড়িতে উপহার হিসেবেও জায়গা করে নিচ্ছে। সেই খবর আবার ছবিসহ ফলাও করে ছাপছে জাতীয় দৈনিকগুলো; পেঁয়াজেরই দিন বটে।

৩০ টাকার পেঁয়াজ প্রায় ৩০০ টাকা হলো কী করে? যারা কেজির নিচে পেঁয়াজ কিনতো না, তারা এখন হালিতে নেমেছে। আর যারা আধাকেজিতে হিসাব কষতো তারা নেমে এসেছে একটি বা দু’টিতে। এক কেজি পেঁয়াজের দামে ১২ কেজি চাল, মজা মন্দ নয়। পেঁয়াজের তেজ আমরা আগে তেমন না বুঝলেও ভারতে দফায় দফায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পতন ঘটিয়েছে পেঁয়াজ। অথচ পৃথিবীতে যত পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়, তার ২৫ শতাংশ হয় ভারতে। সেই ভারতেই যদি পেঁয়াজের তেজে সরকারের পতন ঘটে তাহলে বাংলাদেশে অন্তত দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন হবে না, তা কী করে হয়?

মজার বিষয় হলো পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল অনেকের মধ্যে এক ধরনের মজা করার প্রবণতা লক্ষণীয়। নির্লিপ্ত, নির্বিকার ও আমোদপ্রিয় জনগণ থাকলে দায়িত্বশীলদের দায়িত্বভার অনেকটাই কমে যায়।

প্রথাগতভাবে বাংলাদেশ ভারত থেকেই পেঁয়াজ আমদানি করে। সেই ভারতে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপন্ন হয় মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে। সারা বিশ্ব জানে এই জুন থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজের ভীষণ ক্ষতি হয়েছিল। এই কারণে ওই রাজ্যে পেঁয়াজের ফলন ৩০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে দেশে রাজনীতি ও পেঁয়াজ একে অন্যে বিলীন, যে দেশের রাজনীতি পাড়ায় আদর করে পেঁয়াজের ডাক নাম হয় ‘অনিয়ন বম্ব’, সেই দেশে এই ধরনের বিপর্যয়ের পরে পেঁয়াজ রফতানি যে বন্ধ থাকবে, সেটা একটি শিশুরও বোঝার কথা।

এটুকু হলেও কথা ছিল। এই বিপর্যয়ের মধ্যেই মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিধান সভা নির্বাচনকে সামনে রেখে পেঁয়াজের মূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিতে পারে, এমন পূর্বাভাস ভারতীয় পত্রিকায় ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার পেঁয়াজের রফতানি নিরুৎসাহিত করতে এর রফতানি মূল্য টনপ্রতি ৮৫০ ডলার বেঁধে দেয়। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ দুম করে হঠাৎ একদিন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হয়নি। দরদ বাদই দেই, সরকারের যদি জনগণের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধও থাকতো তাহলেও অনেক আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।

সরকারের বিরোধী দল দমনের কার্যকলাপ দেখে তো মনে হয় না, দেশে গোয়েন্দা সংস্থার কোনও অভাব আছে। তাদের কারও কাছে কী তথ্য ছিল? কী ঘটতে যাচ্ছে? অথচ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন এ ধরনের তথ্য একজন সাধারণ নাগরিকও চাইলে যেকোনও সময়ে পেতে পারে। এই লেখার প্রয়োজনে কিছুক্ষণ গুগল করে আমি নিজেও দেখলাম অনেক আগেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য খুব সহজেই পাওয়া যায়।

এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ বিকল্প কোনও দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে, আগে আমদানি করে রাখা পেঁয়াজ আকাশচুম্বী দামে বিক্রি করা হয়েছে। এই সংকটের মধ্যেই মিয়ানমার থেকে ৪২ টাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকায়। কয়েকদিন আগেই শ্যামবাজারের আড়ত থেকে ১৩৭ টাকায় কেনা পেঁয়াজ ২২০ টাকায় বিক্রি করার তথ্য পত্রিকায় এসেছে। এই নয়-ছয়ের খেলাতে গত ৩ নভেম্বর কনশাস কনজুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) হিসাব করে দেখিয়েছে, পেঁয়াজের দামে কারসাজি করে জনগণের পকেট থেকে লোপাট করা হয়েছে ৩ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। এই হিসাবটা করা হয়েছিল যখন পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকার নিচে ছিল। আর এখন যখন পেঁয়াজ ‘ট্রিপল সেঞ্চুরি’র দিকে যাত্রা করেছে, তখন এই লুটপাটের অংকটা কত, সেই হিসাব আপনারাই করুন।

কিছু মুখ আছে যেগুলো খুললেই বিপদ। এগুলো বন্ধ থাকলে জনগণ স্বস্তিতে থাকে, যেমন যে মুহূর্তে বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সহসা ১০০ টাকার নিচে পেঁয়াজ যাবে না, ঠিক সেই মুহূর্তে ১৫০-এর কাছাকাছি দামে থাকা পেঁয়াজ লাফিয়ে উঠলো ১৮০-তে। ১৮০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনতে মানুষ যখন চোখ আর নাকের জলে জেরবার, ঠিক তখনই শিল্পমন্ত্রী সংসদে জানালেন পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আছে। আর যায় কোথায়? পেঁয়াজ হাঁকলো ডাবল সেঞ্চুরি।

এই সরকার ক্ষমতাসীন থাকার ১১ বছরে মেগা প্রকল্পের নামে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে, শেয়ারবাজার থেকে জনগণের পকেট খালি করা হয়েছে, ব্যাংকের টাকা লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়ে সাধারণ মানুষকে পথে বসানোর আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। এর সঙ্গে লুটের খুব গুরুত্বপূর্ণ খাত হয়েছে কারসাজির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে জনগণের পকেট খালি করা। সব তথ্য সরকারের হাতে থাকার পরও কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে পেঁয়াজের এই সংকট তৈরি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সংকটটি ছিল পরিকল্পিত। সাধারণ মানুষের হাজার কোটি টাকা গুটিকতকে ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা থেকেই এই সংকট তৈরি করা হয়েছে। স্বজনতোষী পুঁজিবাদে এটাই ঘটে। আমি বিশ্বাস করি, জনগণের এই কষ্টের টাকার হিস্যা গেছে সরকারের অনেক ওপর মহল পর্যন্ত।

মনে আছে ‘খুশিতে, ঠেলায়, ঘোরতে’ কী ভীষণ ভাইরাল হয়েছিল? যে ঘটনা একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টে দেয়, সংবিধান-স্বীকৃত রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণ থেকে গুটিকতেক মানুষের হাতে তুলে দেয়, সেই ঘটনায় কি এই ফান হওয়ার কথা? কথায় বলে, ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’, আর অধিকতর শোকে সম্ভবত মানুষ আশ্রয় নেয় ডার্ক হিউমারের। বাংলাদেশের মানুষের হয়েছে সেই দশা। সরকারের নানামুখী চাপ আর অত্যাচারে নাস্তানাবুদ মানুষ প্রতিকারের আর কোনও ভাষা না পেয়ে নিজেদের ভেতরকার ক্ষোভ, দুঃখ, রাগ, হতাশা প্রকাশের পথ খুঁজে নিয়েছে ফেসবুকের ট্রল আর ফান করার মাধ্যমে।

গত এক দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চেহারা পালটানোর সঙ্গে সঙ্গে খুব গভীরভাবে পাল্টানো হয়েছে এই দেশের মানুষের চরিত্র। ভাবতে অবাক লাগে, এই দেশেই নিজের অধিকারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিলো ৫২, ৬৯, ৭১ সাল, এমনকি আশির দশকেও। সেই একই দেশের মানুষ এখন নিজের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম দূরে থাকুক, ন্যূনতম প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। তাই আমরা কেউ যদি মনে করি এবারের পেঁয়াজের ঘটনাই হতে যাচ্ছে এই ধারার শেষ ঘটনা, আমরা ভীষণ ভ্রান্তির মধ্যে আছি। আমরা যেন প্রস্তুত থাকি এরচেয়ে আরও ভয়ঙ্কর কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার। যে জনগণ নিজ রাষ্ট্রের মালিকানা হারায়, সেটা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম তো দূরেই থাকুক, সেটা নিয়ে ট্রল করে, তাদের জীবনে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটতেই থাকার কথা।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 

Related Articles

Back to top button