সারাদেশ

চীনে ‘স্মার্ট সিটি’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ত্রিশ বছর আগে শেনজেন ছিলো জেলেদের গ্রাম, ধানক্ষেত দিয়ে চারপাশ ঘেরা। তারপর যখন চীনের প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে একে গড়ে তোলা হয়, একে একে গ্রামীণ মেঠোপথ থেকে ব্যস্ত ব্যবসায়িক শহরে রূপান্তরিত হয় শেনজেন। এক কোটি কুড়ি লাখ মানুষের এই শহরটি এখন পার্ল নদী অববাহিকায় ডুবতে বসা বিরাট এক নগর মাত্র।

বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে চীনের স্মার্ট শহর হবার পরিকল্পনা বিশ্বের বড় পরিকল্পনাগুলোর অন্যতম। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, নজরদারী সংক্রান্ত যে প্রযুক্তি দেশটির হাতে রয়েছে, তা এর নাগরিকদের জীবনমান বাড়াতে পারবে কিনা, নাকি সেসব কেবল তাদের ওপর নজর রাখার কাজেই ব্যবহার হবে।

পরিচ্ছন্ন নগর

২০৫০ সালের মধ্যে চীনের শহরগুলোতে আরো ২৯ কোটি কুড়ি লাখ বাসিন্দা বাড়বে। ইতিমধ্যে দেশটির ৫৮ শতাংশের বেশি নাগরিক শহুরে এলাকায় বাস করেন, যেখানে ১৯৮০ সালে মাত্র ১৮ শতাংশ মানুষ শহরে থাকতো।

কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশটিতে ৬৬২ টি শহর আছে, এর মধ্যে ১৬০টির বেশি শহরেই অন্তত দশ লাখ বা তার বেশি মানুষ বাস করে।

সম্প্রতি বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিত স্মার্ট সিটিজ মেলায় শেনজেন অংশ নিয়ে বড় ধরণের প্রদর্শনী করেছে।

জিয়াং ওয়েই ডং, শেনজেনের প্রতিনিধি দলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিবিসিকে ব্যাখ্যা করছিলেন শহরটি কী ধরণের প্রযুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। শহরটির মূল মনোযোগ এখন জনসংখ্যার ওপর।

‘অন্য শহরের তুলনায় শেনজেন পরিষ্কার’, বলেন জিয়াং ওয়েই ডং।

তিনি বলেন, চীনের শহরগুলোর মধ্যে শেনজেনেই প্রথম বিদ্যুৎ চালিত বাস এবং ট্যাক্সি চালু হয়। স্মার্ট যানবাহনের পাশাপাশি, শহরটিতে নতুন করে স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা চালু হয়েছে, যার মাধ্যমে দূরদূরান্তের প্রদেশ থেকে আসা মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ক রেকর্ড তাৎক্ষণিকভাবে সরবারহ করা যায়। কিন্তু যখন নিরাপত্তার ব্যপারে জানতে চাওয়া হয়, ঐ কর্মকর্তার জবাব তখন ততটা উচ্চকিত ছিলো না। আমরা কেবল ট্রাফিকের সমস্যার নিয়ে কাজ করি, শেনজেনের নাগরিকদের মনিটর করা হয় না।

কিন্তু কিছুদিন আগে শেনজেন শহরে নজরদারি সংক্রান্ত আরেকটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আগত দর্শনার্থীদের সবাইকে মতামত দিতে হয়েছে।

মেলায় প্রত্যেক দর্শনার্থীদের ফেসিয়াল রিকগনিশন এবং কর্তৃপক্ষের দেয়া নানা ধরণের চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে হয়, যার বেশিরভাগের মাধ্যমেই ঐ নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।

রাস্তায় আবর্জনা ফেলা, ট্রেনে উচ্চস্বরে গান বাজানো, সড়কে লাল বাতি জ্বলে থাকার সময় মাঝখান দিয়ে দৌড় দেয়া – আপাত দৃষ্টিতে ছোট সমস্যা হলেও সেগুলো আসলে অত ছোট সমস্যা নয়। ২০১৪ সালে সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম প্রকাশ করে সরকার। এর মাধ্যমে কিছুটা অরওয়েলিয় (ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের প্রবর্তিত ধারণা) ধারণার মত ভালো আচরণের জন্য নাগরিকেরা পুরষ্কার পাবেন, আর খারাপ আচরণের জন্য সাজা পাবেন।

এ বছরের মার্চে, ট্রেনে সিগারেট খাওয়া এবং মেয়াদ-উত্তীর্ণ টিকেট নিয়ে ভ্রমণ করার মত নিয়ম না মানায় শাস্তি হিসেবে দশ লাখের বেশি চীনা নাগরিককে ট্রেন ও প্লেনের টিকেট কিনতে দেয়া হয়নি।

স্মার্ট সিটি প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, চীনের এই সামাজিক স্কোরের ধারণা নিয়ে পরীক্ষা চালানো প্রশংসনীয়, কিন্তু এভাবে শাস্তির ভয়ে বেঁচে থাকা কঠিন।

আর যেহেতু সব শহরে একইভাবে এই নিয়ম চালু হয়নি, অনেক সময়ই বেড়াতে আসা বিদেশীরা বিপদে পড়েন। চীনের নাগরিকদের কাছে বিষয়টি অতটা আজব হয়তো লাগে না, কারণ বছরের পর বছর ধরে তাদের আচরণের ওপর সরকার নজর রেখে আসছে। তবে এর অপব্যবহারের আশংকাও রয়েছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে এই সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেমের কারণে দেশটির মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর হওয়া নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

চীনে আলিবাবা এবং টেনসেন্ট নামে দুইটি বড় অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকের বিপুল তথ্য জমা আছে। আলিবাবা গ্রাহকের মোবাইলের ক্যামেরা এবং জিপিএস লোকেশনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্যের মাধ্যমে তারা এক হাজার ট্রাফিক লাইট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এভাবে তারা সত্তর লক্ষ মানুষের শহর হোয়াংজুকে চীনের সবচেয়ে জনবহুল শহরের তালিকায় নিচের দিকে নামিয়ে এনেছে।

আবার পশ্চিমা দেশগুলো আগের চেয়ে বেশি হারে চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করছে, যার ফলেও চীনের বিভিন্ন শহরে চাপ বাড়বে বলে ধারণা করা হয়।

যদিও কর্তৃপক্ষ বারবার আশ্বস্ত করার জন্য বলে যাচ্ছে যে নজরদারি করা হবে না এবং ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা রয়েছে, কিন্তু কার্যত সে আশ্বাসে ভরসা কতটা রাখা যাবে সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

 

চিত্রদেশ//এস//

Related Articles

Back to top button