গল্প-কবিতা

কানিজ কাদীরের গল্প ‘শ্রমিক’

জ্যৈষ্ঠের প্রচন্ড তাপদাহ। শুক্রবার সকাল ১১টা। কড়া ঝকঝকে তীব্র উজ্জ্বল রোদ। খুব বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে বের হতে হয়েছে। বের হওয়ার পর আমার মনে হলো রৌদ্রতাপ আমাকে গিলে খাচ্ছে। আমি রোদের তাপ সহ্য করতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি রিকশা ভাড়া করার জন্য রাস্তা পার হলাম। রাস্তার ওপাড়ে বেশ কিছু রিকশা দাঁড়ানো ছিল। সামনেই একটা রিকশা পেলাম। রিকশাওয়ালা প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে সমবায় বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম ‘এই রিকশা যাবে?’ রিকশাওয়ালার বয়স ৩০-৩৫ হয়তো হবে অথবা কমও হতে পারে বা বেশিও হতে পারে। এদের বয়স বোঝাও মুশকিল । অল্প বয়সে এরা বেশি বুড়া হয়ে যায়। রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছছিল আর এক হাত দিয়ে বুকে চাপ দিয়ে বেশ কষ্ট করে বলছিল, ‘হ যামু’। কই যাইবেন। আমার গন্তব্যস্থল বলতে সে ভাড়া চাইল ষাট টাকা। ওর শরীর ছিল খালি । বেশ রোগা। কালো গায়ের চামড়া তীব্র দাহে মনে হয় আরো কালো হয়ে গিয়েছে। শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল। রিকশাওয়ালাকে আমার মনে হচিছল বেশ অসুস্থ। ভাবলাম রিকশা চালাতে চালাতে সামনে যেয়ে যদি আরো অসুস্থ হয়ে যায় সমস্যা হবে! ওই ভেবে পিছনে আসলাম। আর একটা রিকশাওয়ালা দাঁড়ানো। ও দেখলাম হাসিমুখে বলল ‘আপা আসেন । কই যাইবেন।’ ও ভাড়া চাইল পঞ্চাশ টাকা। আমি খুশিই হলাম। ওর রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম ‘ সামনের রিকশাওয়ালাটা মনে হয বেশ অসুস্থ।’ এই রিকশাওয়ালা বলল, ‘ওর রিকশায় না উইঠ্যা ভালোই করছেন। রাস্তায় বেশি অসুস্থ হইয়া পড়লে তো আপনি বিপদে পড়তেন। রিকশাওয়ালা আমাকে নিয়ে চলল। দেখলাম রিকশা বেশ আস্তে চালাচ্ছে। তার গতি বেশ কম। আমি বললাম, ‘আর একটু জোরে চালাও।’ রিকশাওয়ালা বলল,‘যে রইদ উঠছে। রিকশা টানতেই তো কষ্ট হয়।’ আমি বললাম, হ্যাঁ তোমাদের তো বেশ কষ্ট এত রোদে রিকশা চালানো। আমরা পাঁচ মিনিট রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। মাথায় একটা ক্যাপ (টুপি) কিনে নিও।’ সে একা একাই কথা বলতে থাকল, ‘আমি রিকশা একটু আস্তে আস্তে চালানোই পছন্দ করি। দশ বছর অসুস্থ ছিলাম। আমি মানসিক রোগী ছিলাম। কোনো কাজ করি নাই। এখন একটু বাইর হইছি।’ আমি বললাম, ‘দশ বছর তাহলে তুমি কিভাবে চলেছ।’ রিকশাওয়ালা জবাব দিল, ‘আমার বউ চালাইছে।’ তোমার বউ কী করে? উত্তর দিল ‘মাইনষের বাড়িতে কাম করে।’ সে আরো যোগ করল তার ক্লাস নাইনে পড়া একটি মেয়ে ও ছোট একটি ছেলে আছে।’ ওর মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে শুনে প্রশংসা করলাম। ওর মানসিক রোগ ছিল শুনে একটু ভয় হচিছল। আবার কোনো ঘটনা না ঘটায়। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে তুমি রিকশা আস্তে আস্তে চালাও।’ রিকশাওয়ালা একা একা নানা কথা বলছিল। ‘পৃথিবীতে কেউ কাউরে দেখে না। নিজের চিন্তা নিজেরই করন লাগে-ইত্যাদি নানা কথা।’ নানা কথা বলার মাঝেই সে তীব্র গরমে ঘামছিল। গলার দুপাশ দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছিল। আমি বললাম,‘এত রোদ, তোমার গামছাটা মাথায় দিয়ে নাও।’ সে কোনো কর্ণপাত করল না। মনে হচ্ছিল তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। ভাবলাম-এই যে শ্রমিক, তার শ্রমের মর্যাদা আমরা কতটুকু দিচ্ছি। রিকশাওয়ালা বলে ওদের আমরা তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করি।রিকশাওয়ালা আরেকটু এগিয়ে গেল। দেখলাম সে রিকশাটা বায়ে চাপিয়ে থামানোর চেষ্টা করল। বললাম, ‘কী হয়েছে।’ ও বলল,‘একটু পানি খাইয়া নেই।’ আমি আশেপাশে তাকাচ্ছিলাম যে ওকে একটা ক্যাপ কিনে দিতে পারি কিনা। দেখলাম ও যেখানে পানি খাচ্ছিল তার পাশের দোকানে বেশ কিছু নানা সাইজের ক্যাপ ঝুলছে। আমি রিকশাওয়ালাকে ওর সাইজের একটা ক্যাপ নিতে বললাম। দোকানদার আশি টাকা চাইল। আমি ওকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ক্যাপটা কিনে দিলাম। ও ক্যাপটা মাথায় দিয়ে রিকশা চালাতে লাগল। এরা অশিক্ষিত তাই হয়তো তার আবেগ অনুভূতি আমাদের মতো থ্যাংকইউ অথবা ধন্যবাদ দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। তবে আমি বুঝলাম সে খুব তৃপ্ত হলো আর কথা বলার ও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। আমি বললাম,‘এখন কি রোদ একটু কম লাগছে।’ ও মাথা নেড়ে বলল,‘ হ।’ আমি আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। ওর পঞ্চাশ টাকা ভাড়া শুধরে দিয়ে আমার কাজে গেলাম । ভাবছিলাম এটা মে মাস। পহেলা মে শ্রমিক দিবস। এই যে রিকশাওয়ালা, দিন মজুর, মিস্ত্রি এরা জানেও না মে দিবস কী, কী ওদের অধিকার।এদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমরা যে সুবিধা ভোগ করছি তা অপরিসীম। আমরা ওদের শ্রমেরে সঠিক মূল্য দিতে পারছি কি?

২৫ মে, ২০১২

লেখক: কানিজ কাদীর

Related Articles

Check Also
Close
Back to top button